অনেক হাজার বছরের মরু-যবনিকার আচ্ছাদন যখন উৎক্ষিপ্ত হল, দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের বিরাট কঙ্কাল;-- ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে ছিল তার জীবনক্ষেত্র। তার মুখরিত শতাব্দী আপনার সমস্ত কবিগান বাণীহীন অতলে দিয়েছে বিসর্জন। আর, যে-সব গান তখনো ছিল অঙ্কুরে, ছিল মুকুলে, যে বিপুল সম্ভাব্য সেদিন অনালোকে ছিল প্রচ্ছন্ন অপ্রকাশ থেকে অপ্রকাশেই গেল মগ্ন হয়ে-- যা ছিল অপ্রজ্বল ধোঁওয়ার গোপন আচ্ছাদনে তাও নিবল। যা বিকাল, আর যা বিকাল না,-- দুই-ই সংসারের হাট থেকে গেল চলে একই মূল্যের ছাপ নিয়ে। কোথাও রইল না তার ক্ষত, কোথাও বাজল না তার ক্ষতি। ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের হয়েছে আবর্তন। নূতন নূতন বিশ্ব অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছে আলোকে, ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে; অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ, যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ। মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি। তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে। প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য, তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে। হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা। জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম স্তিমিত নিভৃতে দাও আমাকে আশ্রয়।
দুঃখের দিনে লেখনীকে বলি-- লজ্জা দিয়ো না। সকলের নয় যে আঘাত ধোরো না সবার চোখে। ঢেকো না মুখ অন্ধকারে, রেখো না দ্বারে আগল দিয়ে। জ্বালো সকল রঙের উজ্জ্বল বাতি, কৃপণ হোয়ো না। অতি বৃহৎ বিশ্ব, অম্লান তার মহিমা, অক্ষুব্ধ তার প্রকৃতি। মাথা তুলেছে দুর্দর্শ সূর্যলোকে, অবিচলিত অকরুণ দৃষ্টি তার অনিমেষ, অকম্পিত বক্ষ প্রসারিত গিরি নদী প্রান্তরে। আমার সে নয়, সে অসংখ্যের। বাজে তার ভেরী সকল দিকে, জ্বলে অনিভৃত আলো, দোলে পতাকা মহাকাশে। তার সমুখে লজ্জা দিয়ো না-- আমার ক্ষতি আমার ব্যথা তার সমুখে কণার কণা। এই ব্যথাকে আমার বলে ভুলব যখনি তখনি সে প্রকাশ পাবে বিশ্বরূপে। দেখতে পাব বেদনার বন্যা নামে কালের বুকে শাখাপ্রশাখায়; ধায় হৃদয়ের মহানদী সব মানুষের জীবনস্রোতে ঘরে ঘরে। অশ্রুধারার ব্রহ্মপুত্র উঠছে ফুলে ফুলে তরঙ্গে তরঙ্গে; সংসারের কূলে কূলে চলে তার বিপুল ভাঙাগড়া দেশে দেশান্তরে। চিরকালের সেই বিরহতাপ, চিরকালের সেই মানুষের শোক, নামল হঠাৎ আমার বুকে; এক প্লাবনে থর্থরিয়ে কাঁপিয়ে দিল পাঁজরগুলো-- সব ধরণীর কান্নার গর্জনে মিলে গিয়ে চলে গেল অনন্তে, কী উদ্দেশে কে তা জানে। আজকে আমি ডেকে বলি লেখনীকে, লজ্জা দিয়ো না। কূল ছাপিয়ে উঠুক তোমার দান। দাক্ষিণ্যে তোমার ঢাকা পড়ুক অন্তরালে আমার আপন ব্যথা। ক্রন্দন তার হাজার তানে মিলিয়ে দিয়ো বিশাল বিশ্বসুরে।