আজ এই বাদলার দিন, এ মেঘদূতের দিন নয়। এ দিন অচলতায় বাঁধা। মেঘ চলছে না, চলছে না হাওয়া, টিপিটিপি বৃষ্টি ঘোমটার মতো পড়ে আছে দিনের মুখের উপর। সময়ে যেন স্রোত নেই, চার দিকে অবারিত আকাশ, অচঞ্চল অবসর। যেদিন মেঘদূত লিখেছেন কবি সেদিন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে নীল পাহাড়ের গায়ে। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটেছে মেঘ, পুবে হাওয়া বয়েছে শ্যামজম্বুবনান্তকে দুলিয়ে দিয়ে। যক্ষনারী বলে উঠেছে, মা গো, পাহাড়সুদ্ধ নিল বুঝি উড়িয়ে। মেঘদূতে উড়ে চলে যাওয়ার বিরহ, দুঃখের ভার পড়ল না তার 'পরে-- সেই বিরহে ব্যথার উপর মুক্তি হয়েছে জয়ী। সেদিনকার পৃথিবী জেগে উঠেছিল উচ্ছল ঝরনায়, উদ্বেল নদীস্রোতে, মুখরিত বনহিল্লোলে, তার সঙ্গে দুলে দুলে উঠেছে মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিরহীর বাণী। একদা যখন মিলনে ছিল না বাধা তখন ব্যবধান ছিল সমস্ত বিশ্বে, বিচিত্র পৃথিবীর বেষ্টনী পড়ে থাকত নিভৃত বাসরকক্ষের বাইরে। যেদিন এল বিচ্ছেদ সেদিন বাঁধন-ছাড়া দুঃখ বেরোল নদী গিরি অরণ্যের উপর দিয়ে। কোণের কান্না মিলিয়ে গেল পথের উল্লাসে। অবশেষে ব্যথার রূপ দেখা গেল যে কৈলাসে যাত্রা হল শেষ! সেখানে অচল ঐশ্বর্যের মাঝখানে প্রতীক্ষার নিশ্চল বেদনা। অপূর্ণ যখন চলেছে পূর্ণের দিকে তার বিচ্ছেদের যাত্রাপথে আনন্দের নব নব পর্যায়। পরিপূর্ণ অপেক্ষা করছে স্থির হয়ে; নিত্যপুষ্প, নিত্যচন্দ্রালোক, নিত্যই সে একা-- সেই তো একান্ত বিরহী। যে অভিসারিকা তারই জয়, আনন্দে সে চলেছে কাঁটা মাড়িয়ে। ভুল বলা হল বুঝি। সেও তো নেই স্থির হয়ে যে পরিপূর্ণ, সে যে বাজায় বাঁশি, প্রতীক্ষার বাঁশি-- সুর তার এগিয়ে চলে অন্ধকার পথে। বাঞ্ছিতের আহ্বান আর অভিসারিকার চলা পদে পদে মিলেছে একই তালে। তাই নদী চলেছে যাত্রার ছন্দে, সমুদ্র দুলেছে আহ্বানের সুরে।