বঞ্চিত (bonchito)
ফুলিদের বাড়ি থেকে এসেই দেখি
পোস্টকার্ডখানা আয়নার সামনেই,
কখন এসেছে জানি নে তো।
মনে হল, সময় নেই একটুও;
গাড়ি ধরতে পারব না বুঝি।
বাক্স থেকে টাকা বের করতে গিয়ে
ছড়িয়ে পড়ল সিকি দুয়ানি,
কিছু কুড়োলেম, কিছু রইল বা,
গ'নে ওঠা হল না।
কাপড় ছাড়ি কখন।
নীল রঙের রেশমি রুমালখানা
দিলেম মাথার উপর তুলে কাঁটায় বিঁধে।
চুলটাকে জড়িয়ে নিলুম কোনোমতে
টবের গাছ থেকে তুলে নিলুম
চন্দ্রমল্লিকা বাসন্তীরঙের।
স্টেশনে এসে দেখি গাড়ি আসেই না,
জানি নে কতক্ষণ গেল--
পাঁচ মিনিট, হয়তো বা পঁচিশ মিনিট।
গাড়িতে উঠে দেখি চেলি-পরা বিয়ের কনে দলে-বলে;
আমার চোখে কিছুই পড়ে না যেন,
খানিকটা লাল রঙের কুয়াশা, একখানা ফিকে ছবি।
গাড়ি চলেছে ঘটর ঘটর, বেজে উঠছে বাঁশি,
উড়ে আসছে কয়লার গুঁড়ো,
কেবলই মুখ মুছছি রুমালে।
কোন্-এক স্টেশনে
বাঁকে করে ছানা এনেছে গয়লার দল।
গাড়িটাকে দেরি করাচ্ছে মিছিমিছি।
হুইস্ল্ দিলে শেষকালে;
সাড়া পড়ল চাকাগুলোয়, চলল গাড়ি।
গাছপালা, ঘরবাড়ি, পানাপুকুর
ছুটেছে জানলার দু ধারে পিছনের দিকে --
পৃথিবী যেন কোথায় কী ফেলে এসেছে ভুলে,
ফিরে আর পায় কি-না পায়।
গাড়ি চলেছে ঘটর ঘটর।
মাঝখানে অকারণে গাড়িটা থামল অনেক ক্ষণ,
খেতে খেতে খাবার গলায় বেধে যাবার মতো।
আবার বাঁশি বাজল,
আবার চলল গাড়ি ঘটর ঘটর।
শেষে দেখা দিল হাবড়া স্টেশন।
চাইলেম না জানালার বাইরে,
মনে স্থির করে আছি --
খুঁজতে খুঁজতে আমাকে আবিষ্কার করবে একজন এসে,
তার পরে দুজনের হাসি।
বিয়ের কনে, টোপর-হাতে আত্মীয়স্বজন,
সবাই গেল চলে।
কুলি এসে চাইলে মুখের দিকে,
দেখলে গাড়ির ভিতরটাতে মুখ বাড়িয়ে,
কিছুই নেই।
যারা কনেকে নিতে এসেছিল গেল চলে।
যে জনস্রোত এ মুখে আসছিল
ফিরল গেটের দিকে।
গট গট করে চলতে চলতে
গার্ড্ আমার জানালার দিকে একটু তাকালে,
ভাবলে মেয়েটা নামে না কেন।
মেয়েটাকে নামতেই হল।
এই আগন্তুকের ভিড়ের মধ্যে
আমি একটিমাত্র খাপছাড়া।
মনে হল প্লাটফর্ম্টার
এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত প্রশ্ন করছে আমাকে;
জবাব দিচ্ছি নীরবে,
"না এলেই হত।"
আর-একবার পড়লুম পোস্টকার্ড্খানা --
ভুল করি নি তো?
এখন ফিরতি গাড়ি নেই একটাও।
যদি বা থাকত, তবু কি ...
বুকের মধ্যে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে
কত রকমের "হয়তো'--
সবগুলিই সাংঘাতিক।
বেরিয়ে এসে তাকিয়ে রইলুম ব্রিজটার দিকে।
রাস্তার লোক কী ভাবলে জানি নে।
সামনে ছিল বাস্, উঠে পড়লুম।
ফেলে দিলুম চন্দ্রমল্লিকাটা।