ভাই নিশি, তখন উনিশ আমি, তুমি হবে বুঝি পঁচিশের কাছাকাছি। তোমার দুখানা বই ছাপা হয়ে গেছে-- "ক্ষান্তপিসি,' তার পরে "পঞ্চুর মৌতাত'। তা ছাড়া মাসিকপত্র কালচক্রে ক্রমে বের হল "রক্তের আঁচড়'। হুলুস্থূল পড়ে গেল দেশে। কলেজের সাহিত্যসভায়। সেদিন বলেছিলেম বঙ্কিমের চেয়ে তুমি বড়ো, তাই নিয়ে মাথা-ফাটাফাটি। আমাকে খ্যাপাত দাদা নিশি-পাওয়া ব'লে। কলেজের পালা-শেষে করেছি ডেপুটিগিরি, ইস্তফা দিয়েছি কাজে স্বদেশীর দিনে। তার পর থেকে, যা আমার সৌভাগ্য অভাবনীয় তাই ঘটে গেল-- বন্ধুরূপে পেলেম তোমাকে। কাছে পেয়ে কোনোদিন তোমাকে করি নি খাটো-- ছোটো বড়ো নানা ত্রুটি সেও আমি হেসে ভালোবেসে তোমার মহত্ত্বে সবই মিলিয়ে নিয়েছি। এ ধৈর্য, এ পূর্ণদৃষ্টি, এও যে তোমারি কাছে শেখা। দোষে ভরা অসামান্য প্রাণ, সে চরিত্র-রচনায় সব চেয়ে ওস্তাদি তোমার সে তো আমি জানি। তার পরে কতবার অনুরোধ করেছ কেবলই-- বলেছিলে, "লেখো, লেখো, গল্প লেখো। লেখকের মঞ্চে ছিল পিঠ-উঁচু তোমারি চৌকিটা। আত্ম-অবিশ্বাসে শুধু আটকে পড়েছ পড়ুয়ার নীচের বেঞ্চিতে।' শেষকালে বহু ইতস্তত ক'রে লেখা করলেম শুরু। বিষয়টা ঘটেছিল আমারি আমলে পান্তিঘাটায়। আসামি পোলিটিকাল, সাতমাস পলাতকা। মাকে দেখে যাবে বলে একদিন রাত্রে এসেছিল প্রাণ হাতে ক'রে। খুড়ো গেল পুলিসে খবর দিতে। কিছুদিন নিল সে আশ্রয় জেলেনীর ঘরে। যখন পড়ল ধরা সত্য সাক্ষ্য দিল খুড়ো, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছে জেলেনী। জেলেনীকে দিতে হল জেলে, খুড়ো হল সাব্রেজিস্ট্রার। গল্পখানা পড়ে বিস্তর বাহবা দিয়েছিলে। খাতাখানা নিজে নিয়ে শম্ভু সাণ্ডেলের ঘরে বলে এলে-- কালচক্রে অবিলম্বে বের হওয়া চাই। বের হল মাসে মাসে-- শুক্নো কাশে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল খ্যাতি নিমেষে নিমেষে। বাঁশরি'তে লিখে দিল-- কোথা লাগে আশুবাবু এ নবীন লেখকের কাছে। শুনে হেসেছিলে তুমি। পাঞ্চজন্যে লিখেছিল রতিকান্ত ঘোষ-- এত দিনে বাঙলা ভাষায় সত্য লেখা পাওয়া গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার হাস নি তুমি। তার পর থেকে তোমার আমার মাঝখানে খ্যাতির কাঁটার বেড়া ক্রমে ঘন হল। এখন আমার কথা শোনো। আমার এ খ্যাতি আধুনিক মত্ততার ইঞ্চিদুই পলিমাটি-'পরে হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা। স্টুপিড জানে না-- মূল এর বেশি দূর নয়; ফল এর কোনোখানে নেই, কেবলই পাতার ঘটা। তোমার যে পঞ্চু সে তো বাঙলার ডন্কুইক্সোট, তার যা মৌতাত সে যে জন্মখ্যাপাদের মগজে মগজে দেশে দেশে দেখা দেয় চিরকাল। আমার এ কুঞ্জলাল তুবড়ির মতো জ্বলে আর নেবে-- বোকাদের চোখে লাগে ধাঁধা। আমি জানি তুমি কতখানি বড়ো। এ ফাঁকা খ্যাতির চোরা মেকি পয়সায় বিকাব কি বন্ধুত্ব তোমার। কাগজের মোড়কটা খুলে দেখো, আমার লেখার দগ্ধশেষ। আজ বাদে কাল হ'ত ধুলো, আজ হোক ছাই।
যৌবন হচ্ছে জীবনে সেই ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে ও রূপে অকস্মাৎ বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কড়ি ও কোমল আমার সেই নবযৌবনের রচনা। আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ তখন যেন প্রথম উপলব্ধি করেছিলুম। মনে পড়ে তখনকার দিনে নিজের মনের একটা উদ্বেল অবস্থা। তখন আমার বেশভূষায় আবরণ ছিল বিরল। গায়ে থাকত ধুতির সঙ্গে কেবল একটা পাতলা চাদর, তার খুঁটোয় বাঁধা ভোরবেলায় তোলা একমুঠো বেলফুল, পায়ে একজোড়া চটি। মনে আছে থ্যাকারের দোকানে বই কিনতে গেছি কিন্তু এর বেশি পরিচ্ছন্নতা নেই, এতে ইংরেজ দোকানদারের স্বীকৃত আদবকায়দার প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ হত। এই আত্মবিস্মৃত বেআইনী প্রমত্ততা কড়ি ও কোমলের কবিতায় অবাধে প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে এই রীতির কবিতা তখনো প্রচলিত ছিল না। সেইজন্যেই কাব্যবিশারদ প্রভৃতি সাহিত্যবিচারকদের কাছ থেকে কটুভাষায় ভর্ৎসনা সহ্য করেছিলুম। সে-সব যে উপেক্ষা করেছি অনায়াসে সে কেবল যৌবনের তেজে। আপনার মধ্যে থেকে যা প্রকাশ পাচ্ছিল, সে আমার কাছেও ছিল নূতন এবং আন্তরিক। তখন হেম বাঁড়ুজ্জে এবং নবীন সেন ছাড়া এমন কোনো দেশপ্রসিদ্ধ কবি ছিলেন না যাঁরা নূতন কবিদের কোনো-একটা কাব্যরীতির বাঁধা পথে চালনা করতে পারতেন। কিন্তু আমি তাঁদের সম্পূর্ণই ভুলে ছিলুম। আমাদের পরিবারের বন্ধু কবি বিহারীলালকে ছেলেবেলা থেকে জানতুম এবং তাঁর কবিতার প্রতি অনুরাগ আমার ছিল অভ্যস্ত। তাঁর প্রবর্তিত কবিতার রীতি ইতিপূর্বেই আমার রচনা থেকে সম্পূর্ণ স্খলিত হয়ে গিয়েছিল। বড়োদাদার স্বপ্নপ্রয়াণের আমি ছিলুম অত্যন্ত ভক্ত, কিন্তু তাঁর বিশেষ কবিপ্রকৃতির সঙ্গে আমার বোধ হয় মিল ছিল না, সেইজন্য ভালোলাগা সত্ত্বেও তাঁর প্রভাব আমার কবিতা গ্রহণ করতে পারে নি। তাই কড়ি ও কোমলের কবিতা মনের অন্তঃস্তরের উৎসের থেকে উছলে উঠেছিল। তার সঙ্গে বাহিরের কোনো মিশ্রণ যদি ঘটে থাকে তো সে গৌণভাবে। এই আমার কবিতা প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র৻ এবং বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে-- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,-- বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।