এই গ্রন্থাবলীতে আমার কাব্যরচনার প্রথম পরিচয় নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্ধ্যাসংগীত। তার পূর্বেও অনেক লেখা লিখেছি, সেগুলিকে লুপ্ত করবার চেষ্টা করেছি অনাদরে। হাতের অক্ষর পাকাবার যে খাতা ছিল বাল্যকালে সেগুলিকে যেমন অনাদরে রাখি নি, এও তেমনি। সেগুলিও ছিল যাকে বলে কপিবুক, বাইরে থেকে মডেল-লেখা নকল করবার সাধনায়। কাঁচা বয়সে পরের লেখা মক্শ করে আমরা অক্ষর ফেঁদে থাকি বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার মধ্যেও নিজের স্বাভাবিক ছাঁদ একটা প্রকাশ হতে থাকে। অবশেষে পরিণতিক্রমে সেইটেই বাইরের নকল খোলসটাকে বিদীর্ণ করে স্বরূপকে প্রকাশ করে দেয়। প্রথম বয়সের কবিতাগুলি সেই রকম কপিবুকের কবিতা। সেই কপিবুক-যুগের চৌকাঠ পেরিয়েই প্রথম দেখা দিল সন্ধ্যাসংগীত। তাকে আমের বোলের সঙ্গে তুলনা করব না, করব কচি আমের গুটির সঙ্গে, অর্থাৎ তাতে তার আপন চেহারাটা সবে দেখা দিয়েছে শ্যামল রঙে। রস ধরে নি, তাই তার দাম কম। কিন্তু সেই কবিতাই প্রথম স্বকীয় রূপ দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। অতএব সন্ধ্যাসংগীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে। সে সময়কার অন্য সমস্ত কবিতা থেকে আপন ছন্দের বিশেষ সাজ পরে এসেছিল। সে সাজ বাজারে চলিত ছিল না।
ধূমকেতু মাঝে মাঝে হাসির ঝাঁটায় দ্যুলোক ঝাঁটিয়ে নিয়ে কৌতুক পাঠায় বিস্মিত সূর্যের সভা ত্বরিতে পারায়ে-- পরিহাসচ্ছটা ফেলে সুদূরে হারায়ে, সৌর বিদূষক পায় ছুটি। আমার জীবনকক্ষে জানি না কী হেতু, মাঝে মাঝে এসে পড়ে খ্যাপা ধূমকেতু-- তুচ্ছ প্রলাপের পুচ্ছ শূন্যে দেয় মেলি, ক্ষণতরে কৌতুকের ছেলেখেলা খেলি নেড়ে দেয় গম্ভীরের ঝুঁটি। এ জগৎ মাঝে মাঝে কোন্ অবকাশে কখনো বা মৃদুস্মিত কভু উচ্চহাসে হেসে ওঠে, দেখা যায় আলোকে ঝলকে-- তারা কেহ ধ্রুব নয়, পলকে পলকে চিহ্ন তার নিয়ে যায় মুছে। তিমির-আসনে যবে ধ্যানমগ্ন রাতি উল্কাবরিষনকর্তা করে মাতামাতি-- দুই হাতে মুঠা মুঠা কৌতুকের কণা ছড়ায় হরির লুঠ, নাহি যায় গনা, প্রহর-কয়েক যায় ঘুচে। অনেক অদ্ভুত আছে এ বিশ্বসৃষ্টিতে, বিধাতার স্নেহ তাহে সহাস্য দৃষ্টিতে। তেমনি হালকা হাসি দেবতার দানে রয়েছে খচিত হয়ে আমার সম্মানে-- মূল্য তার মনে মনে জানি। এত বুড়ো কোনোকালে হব নাকো আমি হাসি-তামাশারে যবে কব ছ্যাব্লামি। এ নিয়ে প্রবীণ যদি করে রাগারাগি বিধাতার সাথে তারে করি ভাগাভাগি হাসিতে হাসিতে লব মানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর