যে পলায়নের অসীম তরণী বাহিছে সূর্যতারা সেই পলায়নে দিবসরজনী ছুটেছ গঙ্গাধারা। চিরধাবমান নিখিলবিশ্ব এ পলায়নের বিপুল দৃশ্য, এই পলায়নে ভূত ভবিষ্য দীক্ষিছে ধরণীরে। জলের ছায়া সে দ্রুততালে বয়, কঠিন ছায়া সে ওই লোকালয়, একই প্রলয়ের বিভিন্ন লয় স্থিরে আর অস্থিরে। সৃষ্টি যখন আছিল নবীন নবীনতা নিয়ে এলে, ছেলেমানুষির স্রোতে নিশিদিন চল অকারণ খেলে। লীলাছলে তুমি চিরপথহারা, বন্ধনহীন নৃত্যের ধারা, তোমার কুলেতে সীমা দিয়ে কারা বাঁধন গড়িছে মিছে। আবাঁধা ছন্দে হেসে যাও সরি পাথরের মুঠি শিথিলিত করি, বাঁধাছন্দের নগরনগরী ধুলায় মিলায় পিছে। অচঞ্চলের অমৃত বরিষে চঞ্চলতার নাচে, বিশ্বলীলা তো দেখি কেবলি সে নেই নেই ক'রে আছে। ভিত ফেঁদে যারা তুলিছে দেয়াল তারা বিধাতার মানে না খেয়াল, তারা বুঝিল না-- অনন্তকাল অচির কালেরই মেলা। বিজয়তোরণ গাঁথে তারা যত আপনার ভারে ভেঙে পড়ে তত, খেলা করে কাল বালকের মতো লয়ে তার ভাঙা ঢেলা। ওরে মন, তুই চিন্তার টানে বাঁধিস নে আপনারে, এই বিশ্বের সুদূর ভাসানে অনায়াসে ভেসে যা রে। কী গেছে তোমার কী রয়েছে আর নাই ঠাঁই তার হিসাব রাখার, কী ঘটিতে পারে জবাব তাহার নাই বা মিলিল কোনো। ফেলিতে ফেলিতে যাহা ঠেকে হাতে তাই পরশিয়া চলো দিনে রাতে, যে সুর বাজিল মিলাতে মিলাতে তাই কান দিয়ে শোনো। এর বেশি যদি আরো কিছু চাও দুঃখই তাহে মেলে। যেটুকু পেয়েছে তাই যদি পাও তাই নাও, দাও ফেলে। যুগ যুগ ধরি জেনো মহাকাল চলার নেশায় হয়েছে মাতাল, ডুবিছে ভাসিছে আকাশ পাতাল আলোক আঁধার বহি। দাঁড়াবে না কিছু তব আহ্বানে, ফিরিয়া কিছু না চাবে তোমা-পানে, ভেসে যদি যাও যাবে একখানে সকলের সাথে রহি।
যারা আমার সাঁঝসকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো আপন হিয়ার পরশ দিয়ে; এই জীবনের সকল সাদা কালো যাদের আলোক-ছায়ার লীলা; মনের মানুষ বাইরে বেড়ায় যারা তাদের প্রাণের ঝরনা-স্রোতে আমার পরান হয়ে হাজার ধারা চলছে বয়ে চতুর্দিকে। নয় তো কেবল কালের যোগে আয়ু, নয় সে কেবল দিনরজনীর সাতনলি হার, নয় সে নিশাস-বায়ু। নানান প্রাণের প্রীতির মিলন নিবিড় হয়ে স্বজনবন্ধুজনে পরমায়ুর পাত্রখানি জীবনসুধায় ভরছে ক্ষণে ক্ষণে। একের বাঁচন সবার বাঁচার বন্যাবেগে আপন সীমা হারায় বহুদূরে; নিমেষগুলির ফলের গুচ্ছ ভরে রসের ধারায়। অতীত হয়ে তবুও তারা বর্তমানের বৃন্তদোলায় দোলে,-- গর্ভ-বাঁধন কাটিয়ে শিশু তবু যেমন মায়ের বক্ষে কোলে বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের গ্রন্থি দিয়ে। তাই তো যখন শেষে একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শুষ্ক জীবন মম শীর্ণ রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণীসম শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্ত সলিল স্রস্ত অবহেলায়। তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের সূর্য-ডোবার বেলায় তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো-- ব'লে নে ভাই, এই যে দেখা এই যে ছোঁওয়া, এই ভালো এই ভালো। এই ভালো আজ এ সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গাযমুনায় ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়। এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান গাওয়া এই ভাষায়; তারার সাথে নিশীথ রাতে ঘুমিয়ে-পড়া নূতন প্রাণের আশায়।
মাটির ছেলে হয়ে জন্ম, শহর নিল মোরে পোষ্যপুত্র ক'রে। ইঁটপাথরের আলিঙ্গনের রাখল আড়ালটিকে আমার চতুর্দিকে। বই প'ড়ে তাই পেতে হত ভ্রমণকারীর দেখা ছাদের উপর একা। কষ্ট তাদের, বিপদ তাদের, তাদের শঙ্কা যত লাগত নেশার মত। পথিক যে জন পথে পথেই পায় সে পৃথিবীকে, মুক্ত সে চৌদিকে। চলার ক্ষুধায় চলতে সে চায় দিনের পরে দিনে অচেনাকেই চিনে। লড়াই ক'রে দেশ করে জয়, বহায় রক্তধারা, ভূপতি নয় তারা। পলে পলে পার যারা হয় মাটির পরে মাটি প্রত্যেক পদ হাঁটি-- নাইকো সেপাই, নাইকো কামান, জয়পতাকা নাহি-- আপন বোঝা বাহি অপথেও পথ পেয়েছে, অজানাতে জানা, মানে নাইকো মানা-- মরু তাদের, মেরু তাদের, গিরি অভ্রভেদী তাদের বিজয়বেদী। সবার চেয়ে মানুষ ভীষণ; সেই মানুষের ভয় ব্যাঘাত তাদের নয়। তারাই ভূমির বরপুত্র, তাদের ডেকে কই, তোমরা পৃথ্বীজয়ী।