মনে হয় কী একটি শেষ কথা আছে, সে কথা হইলে বলা সব বলা হয়। কল্পনা কাঁদিয়া ফিরে তারি পাছে পাছে, তারি তরে চেয়ে আছে সমস্ত হৃদয়। শত গান উঠিতেছে তারি অন্বেষণে, পাখির মতন ধায় চরাচরময়। শত গান ম'রে গিয়ে, নূতন জীবনে একটি কথায় চাহে হইতে বিলয়। সে কথা হইলে বলা নীরব বাঁশরি, আর বাজাব না বীণা চিরদিন-তরে। সে কথা শুনিতে সবে আছে আশা করি, মানব এখনো তাই ফিরিছে না ঘরে। সে কথায় আপনারে পাইব জানিতে, আপনি কৃতার্থ হব আপন বাণীতে।
পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে। আজ ধুলার আসন ধন্য করে বসবে কি মোর সাথে। রচবে তোমার মুখের ছায়া চোখের জলে মধুর মায়া, নীরব হয়ে তোমার পানে চাইব গো জোড় হাতে। এরা সবাই কী বলে যে লাগে না মন আর, আমার হৃদয় ভেঙে দিল কী মাধুরীর ভার। বাহুর ঘেরে তুমি মোরে রাখবে না কি আড়াল করে, তোমার আঁখি চাইবে না কি আমার বেদনাতে।
মা, যদি তুই আকাশ হতিস, আমি চাঁপার গাছ, তোর সাথে মোর বিনি-কথায় হত কথার নাচ। তোর হাওয়া মোর ডালে ডালে কেবল থেকে থেকে কত রকম নাচন দিয়ে আমায় যেত ডেকে। মা ব'লে তার সাড়া দেব কথা কোথায় পাই, পাতায় পাতায় সাড়া আমার নেচে উঠত তাই। তোর আলো মোর শিশির-ফোঁটায় আমার কানে কানে টলমলিয়ে কী বলত যে ঝলমলানির গানে। আমি তখন ফুটিয়ে দিতেম আমার যত কুঁড়ি, কথা কইতে গিয়ে তারা নাচন দিত জুড়ি। উড়ো মেঘের ছায়াটি তোর কোথায় থেকে এসে আমার ছায়ায় ঘনিয়ে উঠে' কোথায় যেত ভেসে। সেই হত তোর বাদল-বেলার রূপকথাটির মতো; রাজপুত্তুর ঘর ছেড়ে যায় পেরিয়ে রাজ্য কত; সেই আমারে বলে যেত কোথায় আলেখ-লতা, সাগরপারের দৈত্যপুরের রাজকন্যার কথা; দেখতে পেতেম দুয়োরানীর চক্ষু ভর-ভর, শিউরে উঠে পাতা আমার কাঁপত থরথর। হঠাৎ কখন বৃষ্টি তোমার হাওয়ার পাছে পাছে নামত আমার পাতায় পাতায় টাপুর-টুপুর নাচে; সেই হত তোর কাঁদন-সুরে রামায়ণের পড়া, সেই হত তোর গুনগুনিয়ে শ্রাবণ-দিনের ছড়া। মা, তুই হতিস নীলবরনী, আমি সবুজ কাঁচা; তোর হত, মা, আলোর হাসি, আমার পাতার নাচা। তোর হত, মা, উপর থেকে নয়ন মেলে চাওয়া, আমার হত আঁকুবাঁকু হাত তুলে গান গাওয়া। তোর হত, মা চিরকালের তারার মণিমালা, আমার হত দিনে দিনে ফুল-ফোটাবার পালা।