উপভোগ (upabhog)

মনুষ্যের যতদুর উপভোগ করিবার , অধিকার করিবার ক্ষমতা আছে, স্পর্শেই তাহার চূড়ান্ত । যাহাকে সে স্পর্শ করিতে পারে তাহাকেই সে সর্বাপেক্ষা আয়ত্ত মনে করে। এই নিমিত্ত ঋষিরা আয়ত্ত পদার্থকে "করতলন্যস্ত আমলকবৎ" বলিতেন। এই জন্য মানুষেরা ভোগ্য পদার্থকে প্রাণপণে স্পর্শ করিতে চায় । স্পর্শ করিতে পারাই তাহাদের অভিলাষের উপসংহার। আমাদের হৃদয়ে স্পর্শের ক্ষুধা চির জাগ্রত, এই জন্য যাহা আমরা স্পর্শ করিতে পারি তাহার ক্ষুধা আমাদের শীঘ্র মিটিয়া যায়, যাহা স্পর্শ করিতে পারি না তাহার ক্ষুধা আর শীঘ্র মেটে না । কমলাকান্ত চক্রবর্তী তাঁহার দ্বাদশসংখ্যক দপ্তরে একটি গীতের ব্যাখ্যা  করিয়াছেন,সেই গীতের একস্থলে আছে --

 

"মণি নও মাণিক নও যে হার করে গলে পরি,

ফুল নও যে কেশের করি বেশ ।"

 

 

ইহা মনুষ্যহৃদয়ের কাতর ক্রন্দন । তোমার ঐ রূপ যাহা দেখিতে পাইতেছি,তোমার ঐ হৃদয় যাহা অনুভব করিতে পারিতেছি, উহা যদি মণির মত মাণিকের মত হইত, উহা যদি হার করিয়া গলায় পরিতে পারিতাম, বুকের কাছে উহার  স্পর্শ অনুভব করিতে পারিতাম, আহা, তাহা হইলে কি হইত! উহার অর্থ এমন নহে যে "বিধাতা জগৎ জড়ময় করিয়াছেন কেন? রূপ জড় পদার্থ কেন? আমরা যখন বঁধুকে স্পর্শ করি, তখন তাহার দেহ স্পর্শ করি মাত্র। তাহার দেহের কোমলতা , শীতোষ্ণতা অনুভব করিতে পারি মাত্র। কিন্তু তাহার রূপ স্পর্শ করিতে পারি না ত, তাহার রূপ অনুভব করিতে পারি না ত। রূপ দৃশ্য হইল কেন, রূপ মণি মাণিকের মত স্পৃশ্য হইল না কেন ? তাহা হইলে আমি রূপের হার করিতাম,রূপ দিয়া কেশের বেশ করিতাম । যখন কবিরা অশরীরী পদার্থকে শরীরবদ্ধ করেন, তখন আমরা এত আনন্দ লাভ করি কেন ? কবির কল্পনা-বলে মুহুর্ত্তে  আমাদের মনে হয় যেন তাহার শরীর আছে, যেন তাহাকে আমরা স্পর্শ করিতেছি । আমাদের বহুদিনের আকুল তৃষা যেন আজ মিটিল । যখন রাধিকা শ্যামের  মুখ বর্ণণা করিয়া কহিল "হাসিখানি তাহে ভায়" তখন হাসিকে "হাসিখানি" কহিল কেন? যেন হাসি একটি স্বতন্ত্র পদার্থ, যেন হাসিকে ছুঁইতে পারি, যেন হাসিখানিকে লইয়া গলার হার করিয়া রাখিতে পারি! তাহার প্রাণের বাসনা তাহাই! যদি হাসি "হাসিখানি" হইত, শ্যাম যখন চলিয়া যাইত, তখন হাসিখানিকে লইয়া বসিয়া থাকিতাম! আমাদের অপেক্ষা কবিদের একটি সুখ অধিক আছে। আমরা যাহাকে স্পর্শ করিতে পারি না, কল্পনায় তাঁহারা তাহাকে স্পর্শ করিতে পারেন।  উষাকে তাঁহারা বালিকা মনে করেন, সঙ্গীতকে তাঁহারা নির্ঝর মনে করেন,নবমালিকা ফুলকে তাঁহারা যেরূপ স্পর্শ করিতে পারেন জ্যোৎস্নাকে তাঁহারা সেইরূপ স্পর্শ করিতে পারেন, এই নিমিত্ত তাঁহারা সাহস করিয়া নবমালিকা লতার "বনজ্যোৎস্না" নামকরণ করিয়াছেন। পৃথিবীতে আমরা যাহাকে স্পর্শ করিতে পাইয়াছি তাহাকে আর স্পর্শ করিতে চাই না, যাহাকে স্পর্শ করিতে পাই না তাহাকে স্পর্শ করিতে চাই । এ কি বিড়ম্বনা !

 

"ফল ফুল" প্রসঙ্গের পূর্ব্বে নিম্নলিখিত প্রসঙ্গটি ছিল --

 

অদূরদর্শীরা আক্ষেপ করেন আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ দরিদ্র। দূরদর্শীরা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলেন আমাদের দেশ, আমাদের সমাজ দরিদ্র হইতে শিখিল না। সে দিন আমার বন্ধু ক দুঃখ করিতেছিলেন যে, আমাদের দেশে যথাসংখ্যক উপযুক্ত মাসিক পত্রিকার নিতান্ত অভাব। পন্ডিত খ কহিলেন, "আহা, আমাদের দেশে এমন দিন কবে আসিবে যে দিন উপযুক্ত মাসিক পত্রিকার যথার্থ অভাব উপস্থিত হইবে !" আসল কথা এই  যে, দরিদ্র না হইলে বড়মানুষ হওয়া যায় না । নীচে না থাকিলে উপরে উঠা যায় না । বড়মানুষ নই বলিয়া দুঃখ করিবার আগে ,দরিদ্র নই বলিয়া দুঃখ কর । যাহার অভাব নাই তাহার অভাব মোচন হইল না বলিয়া বিলাপ করা বৃথা । এখন আমাদের সমাজকে এমন একটা ঔষধ দিতে হইবে যাহা প্রথমে ঔষধরূপে ক্ষুধা  জন্মাইয়া পরে  পথ্যরূপে সেই ক্ষুধা মোচন করিবে । একেবারেই খাদ্য দেওয়ার ফল নাই । আমাদের দেশে যাহারা খাবারের  দোকান খোলে তাহারা  ফেল হয় কেন ? আমাদের সমাজে যখনি একখানি মাসিক পত্রের জন্ম হয় তখনি সমাজ রাজপুত পিতার ন্যায় ভূমিষ্ঠশয্যাতেই তাহাকে বিনাশ করে কেন ? যাহার আবশ্যক কেহ বোধ করে না সে টেকিয়া থাকিতে পারে না। অতএব আবশ্যকবোধ জন্মে নাই বলিয়াই দুঃখ, দ্রব্যটি নাই বলিয়া নহে ।

 

"দ্রুত বুদ্ধি" প্রসঙ্গের নিম্নোদ্ধৃত শেষাংশ পরিত্যক্ত হইয়াছে ---

 

কবিরা এইরূপ অসাধারণ বুদ্ধিমান । তাঁহারা বুঝেন, কিন্তু এত বিদ্যুৎ-বেগে যুক্তির রাস্তা অতিক্রম করিয়া আসেন যে, রাস্তা মনে থাকে না, কেবল বুঝেন মাত্র । কাজেই অনেক সমালোচককে রাস্তা বাহির করিবার জন্য জাহাজ পাঠাইতে হয় । বিষম হাঙ্গামা করিতে হয় । কবি উপস্থিত আছেন, অথচ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি উত্তর দিতে পারেন না । তিনি বসিয়া বসিয়া শুনিতেছেন --- কেহ বলিতেছে উত্তরে পথ, কেহ বলিতেছে দক্ষিণে পথ । দ্রুতগামী কবি সহসা এমন একটা দূর   ভবিষ্যতের রাজ্যে গিয়া  উপস্থিত হন যে, বর্ত্তমান কাল তাঁহার ভাবভঙ্গী বুঝিতে পারে না । কি করিয়া বুঝিবে ? বর্ত্তমান কালকে এক এক পা করিয়া রাস্তা খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেইখানে যাইতে হইবে; কাজেই সে হঠাৎ মনে করে কবিটা বুঝি পথ হারাইয়া কোন অজায়গায় গিয়া উপস্থিত হইল ; কবিরা মহা দার্শনিক । কেবল দার্শনিকদের ন্যায় তাঁহারা ইচ্ছা করিলে নির্ব্বোধ হইতে পারেন না । কিয়ৎ-পরিমানে নির্ব্বোধ না হইলে এ সংসারে বুদ্ধিমান বলিয়া খ্যাতি হয় না ।

 

                  

 

  •  

Rendition

Please Login first to submit a rendition. Click here for help.