সংস্কার
Stories
চিত্রগুপ্ত এমন অনেক পাপের হিসাব বড়ো অক্ষরে তাঁর খাতায় জমা করেন যা থাকে পাপীর নিজের অগোচরে। তেমনি এমন পাপও ঘটে যাকে আমিই চিনি পাপ বলে, আর-কেউ না। যেটার কথা লিখতে বসেছি সেটা সেই জাতের। চিত্রগুপ্তের কাছে জবাবদিহি করবার পূর্বে আগে-ভাগে কবুল করলে অপরাধের মাত্রাটা হাল্‌কা হবে।
ব্যাপারটা ঘটেছিল কাল শনিবার দিনে। সেদিন আমাদের পাড়ায় জৈনদের মহলে কী একটা পরব ছিল। আমার স্ত্রী কলিকাকে নিয়ে মোটরে করে বেরিয়েছিলুম-- চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল বন্ধু নয়নমোহনের বাড়িতে।
আরো দেখুন
এমন দিনে তারে
Songs
     এমন দিনে তারে বলা যায়
     এমন ঘনঘোর বরিষায়।
     এমন দিনে মন খোলা যায়--
এমন মেঘস্বরে       বাদল-ঝরোঝরে
     তপনহীন ঘন তমসায়॥
     সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
     নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি         গভীর দুখে দুখি,
     আকাশে জল ঝরে অনিবার--
     জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
     সমাজ সংসার মিছে সব,
     মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে   আঁখির সুধা পিয়ে
     হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব--
     আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥
     তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
     নামাতে পারি যদি মনোভার।
শ্রাবণবরিষনে         একদা গৃহকোণে
     দু কথা বলি যদি কাছে তার
     তাহাতে আসে যাবে কিবা কার॥
     ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
     বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে   রহিয়া গেল মনে
     সে কথা আজি যেন বলা যায়--
     এমন ঘনঘোর বরিষায়॥
আরো দেখুন
জীবিত ও মৃত
Stories
রানীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে। পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই, পতিও নাই পুত্রও নাই। একটি ভাশুরপো, শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি, সেই তাহার চক্ষের মণি। সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল, সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাহাকে মানুষ করিয়াছে। পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্রাণের টান আরো যেন বেশি হয়, কারণ তাহার উপরে অধিকার থাকে না; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই, কেবল স্নেহের দাবি-- কিন্তু কেবলমাত্র স্নেহ সমাজের সমক্ষে আপনার দাবি কোনো দলিল অনুসারে সপ্রমাণ করিতে পারে না এবং চাহেও না, কেবল অনিশ্চিত প্রাণের ধনটিকে দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সহিত ভালোবাসে।
বিধবার সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি এই ছেলেটির প্রতি সিঞ্চন করিয়া একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল। হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল-- সময় জগতের আর-সর্বত্রই চলিতে লাগিল, কেবল সেই স্নেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইয়া গেল।
আরো দেখুন
পত্রের প্রত্যাশা
Verses
     চিঠি কই! দিন গেল         বইগুলো ছুঁড়ে ফেলো,
          আর তো লাগে না ভালো ছাইপাঁশ পড়া।
     মিটায়ে মনের খেদ             গেঁথে গেছে অবিচ্ছেদ
          পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদ মিছে মন-গড়া।
     কাননপ্রান্তের কাছে           ছায়া পড়ে গাছে গাছে,
          ম্লান আলো শুয়ে আছে বালুকার তীরে।
     বায়ু উঠে ঢেউ তুলি,               টলমল পড়ে দুলি
          কূলে বাঁধা নৌকাগুলি জাহ্নবীর নীরে।
     চিঠি কই! হেথা এসে             একা বসে দূর দেশে
          কী পড়িব দিন শেষে সন্ধ্যার আলোকে!
     গোধূলির ছায়াতলে           কে বলো গো মায়াবলে
          সেই মুখ অশ্রুজলে এঁকে দেবে চোখে।
     গভীর গুঞ্জনস্বনে               ঝিল্লিরব উঠে বনে,
          কে মিশাবে তারি সনে স্মৃতিকণ্ঠস্বর।
     তীরতরু-ছায়ে-ছায়ে            কোমল সন্ধ্যার বায়ে
          কে আনিয়া দিবে গায়ে সুকোমল কর।
     পাখি তরুশিরে আসে,        দূর হতে নীড়ে আসে,
          তরীগুলি তীরে আসে, ফিরে আসে সবে--
     তার সেই স্নেহস্বর                 ভেদি দূর-দূরান্তর
          কেন এ কোলের 'পরে আসে না নীরবে!
     দিনান্তে স্নেহের স্মৃতি         একবার আসে নিতি
          কলরব-ভরা প্রীতি লয়ে তার মুখে--
     দিবসের ভার যত                  তবে হয় অপগত,
          নিশি নিমেষের মতো কাটে স্বপ্নসুখে।
     সকলি তো মনে আছে            যতদিন ছিল কাছে
          কত কথা বলিয়াছে কত ভালোবেশে--
     কত কথা শুনি নাই               হৃদয়ে পায় নি ঠাঁই,
          মুহূর্ত শুনিয়া তাই ভুলেছি নিমেষে।
     পাতা পোরাবার ছলে           আজ সে যা-কিছু বলে
          তাই-শুনে মন গলে, চোখে আসে জল--
     তারি লাগি কত ব্যথা,            কত মনোব্যাকুলতা,
          দু-চারিটি তুচ্ছ কথা জীবনসম্বল।
     দিবা যেন আলোহীনা            এই দুটি কথা বিনা
          "তুমি ভালো আছ কি না' "আমি ভালো আছি'।
     স্নেহ যেন নাম ডেকে          কাছে এসে যায় দেখে,
          দুটি কথা দূর থেকে করে কাছাকাছি।
     দরশ পরশ যত                     সকল বন্ধন গত,
          মাঝে ব্যবধান কত নদীগিরিপারে--
     স্মৃতি শুধু স্নেহ বয়ে             দুঁহু করস্পর্শ লয়ে
          অক্ষরের মালা হয়ে বাঁধে দুজনারে।
     কই চিঠি! এল নিশা,           তিমিরে ডুবিল দিশা,
          সারা দিবসের তৃষা রয়ে গেল মনে--
     অন্ধকার নদীতীরে           বেড়াতেছি ফিরে ফিরে,
          প্রকৃতির শান্তি ধীরে পশিছে জীবনে।
     ক্রমে আঁখি ছলছল্‌,               দুটি ফোঁটা অশ্রুজল
          ভিজায় কপোলতল, শুকায় বাতাসে--
     ক্রমে অশ্রু নাহি বয়,                ললাট শীতল হয়
          রজনীর শান্তিময় শীতল নিশ্বাসে।
আকাশে অসংখ্য তারা               চিন্তাহারা ক্লান্তিহারা
              হৃদয় বিস্ময়ে সারা হেরি একদিঠি--
     আর যে আসে না আসে               মুক্ত এই মহাকাশে
              প্রতি সন্ধ্যা পরকাশে অসীমের চিঠি।
     অনন্ত বারতা বহে,               অন্ধকার হতে কহে,
            "যে রহে যে নাহি রহে কেহ নহে একা--
     সীমাপরপারে থাকি                সেথা হতে সবে ডাকি
            প্রতি রাত্রে লিখে রাখি জ্যোতিপত্রলেখা।"
আরো দেখুন
মেঘছায়ে সজল বায়ে
Songs
     মেঘছায়ে সজল বায়ে মন আমার
উতলা করে সারাবেলা কার লুপ্ত হাসি, সুপ্ত বেদনা হয় রে॥
কোন্‌ বসন্তের নিশীথে যে বকুলমালাখানি পরালে
তার    দলগুলি গেছে ঝরে, শুধু গন্ধ ভাসে প্রাণে॥
জানি    ফিরিবে না আর ফিরিবে না,     জানি তব পথ গেছে সুদূরে
পারিলে না তবু পারিলে না চিরশূন্য করিতে ভুবন    মম--
তুমি    নিয়ে গেছ মোর বাঁশিখানি, দিয়ে গেছ তোমার গান॥
আরো দেখুন
শুন নলিনী, খোলো গো
Songs
       শুন     নলিনী, খোলো গো আঁখি--
       ঘুম      এখনো ভাঙিল না কি!
       দেখো, তোমারি দুয়ার-'পরে
       সখী,    এসেছে তোমারি রবি॥
       শুনি    প্রভাতের গাথা মোর
       দেখো ভেঙেছে ঘুমের ঘোর,
    জগত উঠেছে নয়ন মেলিয়া নূতন জীবন লভি।
তবে    তুমি কি সজনী জাগিবে নাকো,
           আমি যে তোমারি কবি॥
       প্রতিদিন আসি, প্রতিদিন হাসি,
           প্রতিদিন গান গাহি--
       প্রতিদিন প্রাতে শুনিয়া সে গান
           ধীরে ধীরে উঠ চাহি।
       আজিও এসেছি, চেয়ে দেখো দেখি
           আর তো রজনী নাহি।
       আজিও এসেছি, উঠ উঠ সখী,
           আর তো রজনী নাহি।
       সখী,    শিশিরে মুখানি মাজি
       সখী,    লোহিত বসনে সাজি
দেখো   বিমল সরসীর-আরশির 'পরে অপরূপ রূপরাশি।
       থেকে থেকে ধীরে হেলিয়া পড়িয়া
       নিজ মুখছায়া আধেক হেরিয়া
ললিত অধরে উঠিবে ফুটিয়া শরমের মৃদু হাসি॥
আরো দেখুন
ললাটের লিখন
Stories
ছেলেবেলায় পৃথ্বীশের ডান দিকের কপালে চোট লেগেছিল ভুরুর মাঝখান থেকে উপর পর্যন্ত। সেই আঘাতে ডান চোখটাও সংকুচিত। পৃথ্বীশকে ভালো দেখতে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরটা কাটা দাগের অবিচারে সম্পূর্ণ হতে পারল না। অদৃষ্টের এই লাঞ্ছনাকে এত দিন থেকে প্রকাশ্যে পৃথ্বীশ বহন করে আসছে তবুও দাগও যেমন মেলায় নি তেমনি ঘোচে নি তার সংকোচ। নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হবার উপলক্ষে প্রত্যেকবার ধিক্‌কারটা জেগে ওঠে মনে। কিন্তু বিধাতাকে গাল দেবার অধিকার তার নেই। তার রচনার ঐশ্বর্যকে বন্ধুরা স্বীকার করছে প্রচুর প্রশংসায়, শত্রুরা নিন্দাবাক্যের নিরন্তর কটুক্তিতে। লেখার চারি দিকে ভিড় জমছে। দু টাকা আড়াই টাকা দামের বইগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। সম্পাদকরা তার কলমের প্রসাদ ছুটোছাঁটা যা-ই পায় কিছুই ছাড়ে না। পাঠিকারা বলে, পৃথ্বীশবাবু মেয়েদের মন ও চরিত্র যেমন আশ্চর্য বোঝেন ও বর্ণনা করেন এমন সাধ্য নেই আর কোনো লেখকের। পুরুষ-বন্ধুরা বলে, ওর লেখায় মেয়েদের এত-যে স্তুতিবাদ সে কেবল হতভাগার ভাঙা কপালের দোষে। মুখশ্রী যদি অক্ষুণ্ন হত তা হলে মেয়েদের সম্বন্ধে সত্য কথা বাধত না মুখে। মুখের চেহারা বিপক্ষতা করায় মুখের অত্যুক্তিকে সহায় করেছে মনোহরণের অধ্যবসায়।
শ্রীমতী বাঁশরি সরকার ব্যারিস্টারি চক্রের মেয়ে-- বাপ ব্যারিস্টার, ভাইরা ব্যারিস্টার। দু বার গেছে য়ুরোপে ছুটি উপলক্ষে। সাজে সজ্জায় ভাষায় ভঙ্গিতে আছে আধুনিক যুগের সুনিপুণ উদ্দামতা। রূপসী বলতে যা বোঝায় তা নয়, কিন্তু আকৃতিটা যেন ফ্রেঞ্চ পালিশ দিয়ে ঝকঝকে করা।
আরো দেখুন
চণ্ডী
Stories
দিদি, তুমি বোধ হয় ও পাড়ার চণ্ডীবাবুকে জান?
জানি নে! তিনি যে ডাকসাইটে নিন্দুক।
আরো দেখুন