প্রতিবেশিনী
Stories
আমার প্রতিবেশিনী বালবিধবা। যেন শরতের শিশিরাশ্রুপ্লুত শেফালির মতো বৃন্তচ্যুত; কোনো বাসরগৃহের ফুলশয্যার জন্য সে নহে, সে কেবল দেবপূজার জন্যই উৎসর্গ-করা।
তাহাকে আমি মনে মনে পূজা করিতাম। তাহার প্রতি আমার মনের ভাবটা যে কী ছিল পূজা ছাড়া তাহা অন্য কোনো সহজ ভাষায় প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি না -- পরের কাছে তো নয়ই, নিজের কাছেও না।
আরো দেখুন
সুয়োরানীর সাধ
Stories
সুয়োরানীর বুঝি মরণকাল এল।
তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে, তার কিছুই ভালো লাগছে না। বদ্দি বড়ি নিয়ে এল। মধু দিয়ে মেড়ে বললে, 'খাও।' সে ঠেলে ফেলে দিলে।
আরো দেখুন
অপরিচিতা
Stories
আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যের হিসাবে বড়ো, না গুণের হিসাবে। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা সেই ফুলের মতো যাহার বুকের উপরে ভ্রমর আসিয়া বসিয়াছিল, এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে।
সেই ইতিহাসটুকু আকারে ছোটো, তাহাকে ছোটো করিয়াই লিখিব। ছোটোকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন।
আরো দেখুন
মুক্তি
Stories
বিরহিণী তার ফুলবাগানের এক ধারে বেদী সাজিয়ে তার উপর মূর্তি গড়তে বসল। তার মনের মধ্যে যে মানুষটি ছিল বাইরে তারই প্রতিরূপ প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে, আর চেয়ে চেয়ে দেখে, আর ভাবে, আর চোখ দিয়ে জল পড়ে।
কিন্তু, যে রূপটি একদিন তার চিত্তপটে স্পষ্ট ছিল তার উপরে ক্রমে যেন ছায়া পড়ে আসছে। রাতের বেলাকার পদ্মের মতো স্মৃতির পাপড়িগুলি অল্প অল্প করে যেন মুদে এল।
আরো দেখুন
চার অধ্যায়
Novels
এলার মনে পড়ে তার জীবনের প্রথম সূচনা বিদ্রোহের মধ্যে। তার মা মায়াময়ীর ছিল বাতিকের ধাত, তাঁর ব্যবহারটা বিচার-বিবেচনার প্রশস্ত পথ ধরে চলতে পারত না। বেহিসাবি মেজাজের অসংযত ঝাপটায় সংসারকে তিনি যখন-তখন ক্ষুব্ধ করে তুলতেন, শাসন করতেন অন্যায় করে, সন্দেহ করতেন অকারণে। মেয়ে যখন অপরাধ অস্বীকার করত, ফস করে বলতেন, মিথ্যে কথা বলছিস। অথচ অবিমিশ্র সত্যকথা বলা মেয়ের একটা ব্যসন বললেই হয়। এজন্যেই সে শাস্তি পেয়েছে সব-চেয়ে বেশি। সকল রকম অবিচারের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা তার স্বভাবে প্রবল হয়ে উঠেছে। তার মার কাছে মনে হয়েছে, এইটেই স্ত্রীধর্মনীতির বিরুদ্ধ।
একটা কথা সে বাল্যকাল থেকে বুঝেছে যে, দুর্বলতা অত্যাচারের প্রধান বাহন। ওদের পরিবারে যে-সকল আশ্রিত অন্নজীবী ছিল, যারা পরের অনুগ্রহ-নিগ্রহের সংকীর্ণ বেড়া-দেওয়া ক্ষেত্রের মধ্যে নিঃসহায়ভাবে আবদ্ধ তারাই কলুষিত করেছে ওদের পরিবারের আবহাওয়াকে, তারাই ওর মায়ের অন্ধ প্রভুত্বচর্চাকে বাধাবিহীন করে তুলেছে। এই অস্বাস্থ্যকর অবস্থার প্রতিক্রিয়ারূপেই ওর মনে অল্পবয়স থেকেই স্বাধীনতার আকাঙক্ষা এত দুর্দাম হয়ে উঠেছিল।
প্রহরশেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ।"
Upwards
Towards the peaks,
Towards the stars,
Towards the vast silence."
আরো দেখুন
কীটের সংসার
Verses
এক দিকে কামিনীর ডালে
মাকড়সা শিশিরের ঝালর দুলিয়েছে,
    আর-এক দিকে বাগানে রাস্তার ধারে
        লাল-মাটির-কণা-ছড়ানো
                   পিঁপড়ের বাসা।
যাই আসি তারি মাঝখান দিয়ে
               সকালে বিকালে।
আনমনে দেখি শিউলিগাছে কুঁড়ি ধরেছে,
        টগর গেছে ফুলে ছেয়ে।
বিশ্বের মাঝে মানুষের সংসারটুকু
        দেখতে ছোটো, তবু ছোটো তো নয়।
               তেমনি ওই কীটের সংসার।
        ভালো করে চোখে পড়ে না,
               তবু সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে আছে ওরা।
কত যুগ থেকে অনেক ভাবনা ওদের,
    অনেক সমস্যা, অনেক প্রয়োজন--
           অনেক দীর্ঘ ইতিহাস।
        দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
চলেছে প্রাণশক্তির দুর্বার আগ্রহ।
               মাঝখান দিয়ে যাই আসি,
শব্দ শুনি নে ওদের চিরপ্রবাহিত
               চৈতন্যধারার--
    ওদের ক্ষুধাপিপাসা-জন্মমৃত্যুর।
গুন গুন সুরে আধখানা গানের
           জোড় মেলাতে খুঁজে বেড়াই
                       বাকি আধখানা পদ,
এই অকারণ অদ্ভুত খোঁজের কোনো অর্থ নেই
    ওই মাকড়সার বিশ্বচরাচরে,
           ওই পিঁপড়ে-সমাজে।
    ওদের নীরব নিখিলে এখনি উঠছে কি
        স্পর্শে স্পর্শে সুর, ঘ্রাণে ঘ্রাণে সংগীত,
           মুখে মুখে অশ্রুত আলাপ,
               চলায় চলায় অব্যক্ত বেদনা।
আমি মানুষ--
    মনে জানি সমস্ত জগতে আমার প্রবেশ,
           গ্রহনক্ষত্রে ধূমকেতুতে
    আমার বাধা যায় খুলে খুলে।
কিন্তু ওই মাকড়সার জগৎ বদ্ধ রইল চিরকাল
           আমার কাছে,
    ওই পিঁপড়ের অন্তরের যবনিকা
        পড়ে রইল চিরদিন আমার সামনে
           আমার সুখে দুঃখে ক্ষুব্ধ
               সংসারের ধারেই।
ওদের ক্ষুদ্র অসীমের বাইরের পথে
           আসি যাই সকালে বিকালে--
    দেখি, শিউলিগাছে কুঁড়ি ধরছে,
               টগর গেছে ফুলে ছেয়ে।
আরো দেখুন
মানী
Verses
আরঙজেব ভারত যবে
           করিতেছিল খান-খান
মারবপতি কহিলা আসি,
          "করহ প্রভু অবধান,
গোপন রাতে অচলগড়ে
নহর যাঁরে এনেছ ধরে
          সিরোহিপতি সুরতান।
কী অভিলাষ তাঁহার 'পরে
          আদেশ মোরে করো দান।'
শুনিয়া কহে আরঙজেব,
          "কি কথা শুনি অদ্ভুত!
এতদিনে কি পড়িল ধরা
          অশনিভরা বিদ্যুৎ?
পাহাড়ি লয়ে কয়েক শত
পাহাড়ে বনে ফিরিতে রত
মরুভূমির মরীচি-মতো
          স্বাধীন ছিল রাজপুত!
দেখিতে চাহি, আনিতে তারে
         পাঠাও কোনো রাজদূত।'
মাড়োয়ারাজ যশোবন্ত
          কহিলা তবে জোড়কর,
"ক্ষত্রকুলসিংহশিশু
          লয়েছে আজি মোর ঘর--
বাদশা তাঁরে দেখিতে চান,
বচন আগে করুন দান
কিছুতে কোনো অসম্মান
          হবে না কভু তাঁর 'পর
সভায় তবে আপনি তাঁরে
          আনিব করি সমাদর।'
আরঙজেব কহিলা হাসি,
          "কেমন কথা কহ আজ!
প্রবীণ তুমি প্রবল বীর
          মাড়োয়াপতি মহারাজ।
তোমার মুখে এমন বাণী
শুনিয়া মনে শরম মানি,
মানীর মান করিব হানি
          মানীরে শোভে হেন কাজ?
কহিনু আমি, চিন্তা নাহি,
          আনহ তাঁরে সভামাঝ।'
সিরোহিপতি সভায় আসে
          মাড়োয়ারাজে লয়ে সাথ,
উচ্চশির উচ্চ রাখি
          সমুখে করে আঁখিপাত
কহিল সবে বজ্রনাদে
"সেলাম করো বাদশাজাদে'--
হেলিয়া যশোবন্ত-কাঁধে
          কহিলা ধীরে নরনাথ,
"গুরুজনের চরণ ছাড়া
          করি নে কারে প্রণিপাত।'
কহিলা রোষে রক্ত-আঁখি
          বাদশাহের অনুচর,
"শিখাতে পারি কেমনে মাথা
          লুটিয়া পড়ে ভূমি-'পর।'
হাসিয়া কহে সিরহিপতি,
"এমন যেন না হয় মতি
ভয়েতে কারে করিব নতি,
          জানি নে কভু ভয়-ডর।'
এতেক বলি দাঁড়ালো রাজা
          কৃপাণ-'পরে করি ভর।
বাদশা ধরি সুরতানেরে
          বসায়ে নিল নিজপাশ--
কহিলা, "বীর, ভারত-মাঝে
          কী দেশ-'পরে তব আশ?'
কহিলা রাজা, "অচলগড়
দেশের সেরা জগৎ-'পর।'
সভার মাঝে পরস্পর
          নীরবে উঠে পরিহাস।
বাদশা কহে, "অচল হয়ে
          অচলগড়ে করো বাস।'
আরো দেখুন
শেষ বেলা
Verses
     এল বেলা পাতা ঝরাবারে;
শীর্ণ বলিত কায়া, আজ শুধু ভাঙা ছায়া
          মেলে দিতে পারে।
    একদিন ডাল ছিল ফুলে ফুলে ভরা
              নানা-রঙ-করা।
          কুঁড়ি ধরা ফলে
     কার যেন কী কৌতূহলে
          উঁকি মেরে আসা
     খুঁজে নিতে আপনার বাসা।
          ঋতুতে ঋতুতে
      আকাশের উৎসবদূতে
     এনে দিত পল্লবপল্লীতে তার
কখনো পা টিপে চলা হালকা হাওয়ার,
     কখনো-বা ফাল্গুনের অস্থির এলোমেলো চাল
     জোগাইত নাচনের তাল।
                   জীবনের রস আজ মজ্জায় বহে,
                    বাহিরে প্রকাশ তার নহে।
             অন্তরবিধাতার সৃষ্টিনির্দেশে
          যে অতীত পরিচিত সে নূতন বেশে
               সাজবদলের কাজে ভিতরে লুকালো--
     বাহিরে নিবিল দীপ, অন্তরে দেখা যায় আলো।
          গোধূলির ধূসরতা ক্রমে সন্ধ্যার
                   প্রাঙ্গণে ঘনায় আঁধার।
               মাঝে-মাঝে জেগে ওঠে তারা,
          আজ চিনে নিতে হবে তাদের ইশারা।
       সমুখে অজানা পথ ইঙ্গিত মেলে দেয় দূরে,
          সেথা যাত্রার কালে যাত্রীর পাত্রটি পুরে
     সদয় অতীত কিছু সঞ্চয় দান করে তারে
          পিপাসার গ্লানি মিটাবারে।
                   যত বেড়ে ওঠে রাতি।
     সত্য যা সেদিনের উজ্জ্বল হয় তার ভাতি।
                   এই কথা  ধ্রুব জেনে, নিভৃতে লুকায়ে
     সারা জীবনের ঋণ একে একে দিতেছি চুকায়ে।
আরো দেখুন