করুণা
Stories
গ্রামের মধ্যে অনুপকুমারের ন্যায় ধনবান আর কেহই ছিল না। অতিথিশালানির্মাণ, দেবালয়প্রতিষ্ঠা, পুষ্করিণীখনন প্রভৃতি নানা সৎকর্মে তিনি ধনব্যয় করিতেন। তাঁহার সিন্ধুক-পূর্ণ টাকা ছিল, দেশবিখ্যাত যশ ছিল ও রূপবতী কন্যা ছিল। সমস্ত যৌবনকাল ধন উপার্জন করিয়া অনুপ বৃদ্ধ বয়সে বিশ্রাম করিতেছিলেন। এখন কেবল তাঁহার একমাত্র ভাবনা ছিল যে, কন্যার বিবাহ দিবেন কোথায়। সৎপাত্র পান নাই ও বৃদ্ধ বয়সে একমাত্র আশ্রয়স্থল কন্যাকে পরগৃহে পাঠাইতে ইচ্ছা নাই--তজ্জন্যও আজ কাল করিয়া আর তাঁহার দুহিতার বিবাহ হইতেছে না।
সঙ্গিনী-অভাবে করুণার কিছুমাত্র কষ্ট হইত না। সে এমন কাল্পনিক ছিল, কল্পনার স্বপ্নে সে সমস্ত দিন-রাত্রি এমন সুখে কাটাইয়া দিত যে, মুহূর্তমাত্রও তাহাকে কষ্ট অনুভব করিতে হয় নাই। তাহার একটি পাখি ছিল, সেই পাখিটি হাতে করিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর পাড়ে কল্পনার রাজ্য নির্মাণ করিত। কাঠবিড়ালির পশ্চাতে পশ্চাতে ছুটাছুটি করিয়া, জলে ফুল ভাসাইয়া, মাটির শিব গড়িয়া, সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটাইয়া দিত। এক-একটি গাছকে আপনার সঙ্গিনী ভগ্নী কন্যা বা পুত্র কল্পনা করিয়া তাহাদের সত্য-সত্যই সেইরূপ যত্ন করিত, তাহাদিগকে খাবার আনিয়া দিত, মালা পরাইয়া দিত, নানাপ্রকার আদর করিত এবং তাদের পাতা শুকাইলে, ফুল ঝরিয়া পড়িলে, অতিশয় ব্যথিত হইত। সন্ধ্যাবেলা পিতার নিকট যা-কিছু গল্প শুনিত, বাগানে পাখিটিকে তাহাই শুনানো হইত। এইরূপে করুণা তাহার জীবনের প্রত্যুষকাল অতিশয় সুখে আরম্ভ করিয়াছিল। তাহার পিতা ও প্রতিবাসীরা মনে করিতেন যে, চিরকালই বুঝি ইহার এইরূপে কাটিয়া যাইবে।
আরো দেখুন
বালক
Verses
হিরণমাসির প্রধান প্রয়োজন রান্নাঘরে।
      দুটি ঘড়া জল আনতে হয় দিঘি থেকে--
         তার দিঘিটা ওই দুই ঘড়ারই মাপে
                 রান্নাঘরের পিছনে বাঁধা দরকারের বাঁধনে।
এ দিকে তার মা-মরা বোনপো,
    গায়ে যে রাখে না কাপড়,
        মনে যে রাখে না সদুপদেশ,
           প্রয়োজন যার নেই কোনো কিছুতেই,
সমস্ত দিঘির মালেক সেই লক্ষ্মীছাড়াটা।
        যখন খুশি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জলে,
    মুখে জল নিয়ে আকাশে ছিটোতে ছিটোতে সাঁতার কাটে,
ছিনিমিনি খেলে ঘাটে দাঁড়িয়ে,
      কঞ্চি নিয়ে করে মাছ-ধরা খেলা,
         ডাঙায় গাছে উঠে পাড়ে জামরুল--
             খায় যত ছড়ায় তার বেশি।
      দশ-আনির টাক-পড়া মোটা জমিদার,
         লোকে বলে দিঘির স্বত্ব তারই--
বেলা দশটায় সে চাপড়ে চাপড়ে তেল মাখে বুকে পিঠে,
             ঝপ্‌ করে দুটো ডুব দিয়ে নেয়,
বাঁশবনের তলা দিয়ে দুর্গা নাম করতে করতে চলে ঘরে--
             সময় নেই, জরুরি মকর্দমা।
         দিঘিটা আছে তার দলিলে, নেই তার জগতে।
আর ছেলেটার দরকার নেই কিছুতেই,
             তাই সমস্ত বন-বাদাড় খাল-বিল তারই--
      নদীর ধার, পোড়ো জমি, ডুবো নৌকা, ভাঙা মন্দির,
             তেঁতুল গাছের সবার উঁচু ডালটা।
জামবাগানের তলায় চরে ধোবাদের গাধা,
         ছেলেটা তার পিঠে চড়ে--
             ছড়ি হাতে জমায় ঘোড়দৌড়।
      ধোবাদের গাধাটা আছে কাজের গরজে--
             ছেলেটার নেই কোনো দরকার,
      তাই জন্তুটা তার চার পা নিয়ে সমস্তটা তারই,
             যাই বলুন-না জজসাহেব।
      বাপ মা চায় পড়ে শুনে হবে সে সদর-আলা;
সর্দার পোড়ো ওকে টেনে নামায় গাধার থেকে,
         হেঁচড়ে আনে বাঁশবন দিয়ে,
             হাজির করে পাঠশালায়।
মাঠে ঘাটে হাটে বাটে জলে স্থলে তার স্বরাজ--
         হঠাৎ দেহটাকে ঘিরলে চার দেয়ালে,
             মনটাকে আঠা দিয়ে এঁটে দিলে
                 পুঁথির পাতার গায়ে।
আমিও ছিলেম একদিন ছেলেমানুষ।
         আমার জন্যেও বিধাতা রেখেছিলেন গড়ে
             অকর্মণ্যের অপ্রয়োজনের জল স্থল আকাশ।
তবু ছেলেদের সেই মস্ত বড়ো জগতে
         মিলল না আমার জায়গা।
আমার বাসা অনেক কালের পুরোনো বাড়ির
             কোণের ঘরে--
                 বাইরে যাওয়া মানা।
  সেখানে চাকর পান সাজে, দেয়ালে মোছে হাত,
             গুন গুন ক'রে গায় মধুকানের গান;
    শান-বাঁধানো মেজে, খড়্‌খড়ে-দেওয়া জানলা।
নীচে ঘাট-বাঁধানো পুকুর, পাঁচিল ঘেঁষে নারকেল গাছ।
    জটাধারী বুড়ো বট মোটা মোটা শিকড়ে
               আঁকড়ে ধরেছে পুব ধারটা।
        সকাল থেকে নাইতে আসে পাড়ার লোকে,
           বিকেলের পড়ন্ত রোদে ঝিকিমিকি জলে
               ভেসে বেড়ায় পাতিহাঁসগুলো,
                   পাখা সাফ করে ঠোঁট দিয়ে মেজে।
প্রহরের পর কাটে প্রহর।
        আকাশে ওড়ে চিল,
    থালা বাজিয়ে যায় পুরোনো কাপড়ওয়ালা,
        বাঁধানো নালা দিয়ে গঙ্গার জল এসে পড়ে পুকুরে।
    পৃথিবীতে ছেলেরা যে খোলা জগতের যুবরাজ
               আমি সেখানে জন্মেছি গরিব হয়ে।
                       শুধু কেবল
    আমার খেলা ছিল মনের ক্ষুধায়, চোখের দেখায়,
           পুকুরের জলে, বটের শিকড়-জড়ানো ছায়ায়,
নারকেলের দোদুল ডালে, দূর বাড়ির রোদ-পোহানো ছাদে।
               অশোকবনে এসেছিল হনুমান,
    সেদিন সীতা পেয়েছিলেন নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের খবর।
আমার হনুমান আসত বছরে বছরে আষাঢ় মাসে
           আকাশ কালো করে
                   সজল নবনীল মেঘে।
        আনত তার মেদুর কণ্ঠে দূরের বার্তা,
               যে দূরের অধিকার থেকে আমি নির্বাসিত।
        ইমারত-ঘেরা ক্লিষ্ট যে আকাশটুকু
               তাকিয়ে থাকত একদৃষ্টে আমার মুখে,
        বাদলের দিনে গুরুগুরু ক'রে তার বুক উঠত দুলে।
বট গাছের মাথা পেরিয়ে কেশর ফুলিয়ে দলে দলে
               মেঘ জুটত ডানাওয়ালা কালো সিংহের মতো।
    নারকেল-ডালের সবুজ হত নিবিড়,
               পুকুরের জল উঠত শিউরে শিউরে।
        যে চাঞ্চল্য শিশুর জীবনে রুদ্ধ ছিল
               সেই চাঞ্চল্য বাতাসে বাতাসে, বনে বনে।
পুব দিকের ও পার থেকে বিরাট এক ছেলেমানুষ ছাড়া পেয়েছে আকাশে,
               আমার সঙ্গে সে সাথি পাতালে।
        বৃষ্টি পড়ে ঝমাঝম। একে একে
পুকুরের পৈঁঠা যায় জলে ডুবে।
        আরো বৃষ্টি, আরো বৃষ্টি, আরো বৃষ্টি।
রাত্তির হয়ে আসে, শুতে যাই বিছানায়,
        খোলা জানলা দিয়ে গন্ধ পাই ভিজে জঙ্গলের।
               উঠোনে একহাঁটু জল,
ছাদের নালার মুখ থেকে জলে পড়ছে জল মোটা ধারায়।
           ভোরবেলায় ছুটেছি দক্ষিণের জানলায়,
                   পুকুর গেছে ভেসে;
        জল বেরিয়ে চলেছে কল্‌কল্‌ করে বাগানের উপর দিয়ে,
    জলের উপর বেলগাছগুলোর ঝাঁকড়া মাথা জেগে থাকে।
পাড়ার লোকে হৈ হৈ করে এসেছে
        গামছা দিয়ে ধুতির কোঁচা দিয়ে মাছ ধরতে।
           কাল পর্যন্ত পুকুরটা ছিল আমারি মতো বাঁধা,
    এ বেলা ও বেলা তার উপরে পড়ত গাছের ছায়া,
           উড়ো মেঘ জলে বুলিয়ে যেত ক্ষণিকের ছায়াতুলি,
    বটের ডালের ভিতর দিয়ে যেন সোনার পিচকারিতে
           ছিটকে পড়ত তার উপরে আলো--
    পুকুরটা চেয়ে থাকত আকাশে ছল্‌ছলে দৃষ্টিতে।
           আজ তার ছুটি, কোথায় সে চলল খ্যাপা
                   গেরুয়া-পরা বাউল যেন।
পুকুরের কোণে নৌকোটি
    দাদারা চড়ে বসল ভাসিয়ে দিয়ে,
        গেল পুকুর থেকে গলির মধ্যে,
           গলির থেকে সদর রাস্তায়--
তার পরে কোথায় জানি নে। বসে বসে ভাবি।
           বেলা বাড়ে।
    দিনান্তের ছায়া মেশে মেঘের ছায়ায়,
           তার সঙ্গে মেশে পুকুরের জলে বটের ছায়ার কালিমা।
                   সন্ধে হয়ে এল।
    বাতি জ্বলল ঝাপসা আলোয় রাস্তার ধারে ধারে,
           ঘরে জ্বলেছে কাঁচের সেজে মিট্‌মিটে শিখা,
ঘোর অন্ধকারে একটু একটু দেখা যায়
           দুলছে নারকেলের ডাল,
                   ভূতের ইশারা যেন।
গলির পারে বড়ো বাড়িতে সব দরজা বন্ধ,
        আলো মিট্‌ মিট্‌ করে দুই-একটা জানলা দিয়ে
           চেয়ে-থাকা ঘুমন্ত চোখের মতো।
        তার পরে কখন আসে ঘুম।
    রাত দুটোর সময় স্বরূপ সর্দার নিষুত রাতে
           বারান্দায় বারান্দায় হাঁক দিয়ে যায় চলে।
বাদলের দিনগুলো বছরে বছরে তোলপাড় করেছে আমার মন;
        আজ তারা বছরে বছরে নাড়া দেয় আমার গানের সুরকে।
    শালের পাতায় পাতায় কোলাহল,
        তালের ডালে ডালে করতালি,
               বাঁশের দোলাদুলি বনে বনে--
    ছাতিম গাছের থেকে মালতীলতা
               ঝরিয়ে দেয় ফুল।
আর সেদিনকার আমারি মতো অনেক ছেলে আছে ঘরে ঘরে,
        লাঠাইয়ের সুতোয় মাখাচ্ছে আঠা,
               তাদের মনের কথা তারাই জানে।
আরো দেখুন
রাজর্ষি
Novels
রাজর্ষি সম্বন্ধে কিছু বলবার জন্যে অনুরোধ পেয়েছি। বলবার বিশেষ কিছু নেই। এর প্রধান বক্তব্য এই যে, এ আমার স্বপ্নলব্ধ উপন্যাস।
বালক পত্রের সম্পাদিকা আমাকে ঐ মাসিকের পাতে নিয়মিত পরিবেশনের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তার ফল হল এই যে, প্রায় একমাত্র আমিই হলুম তার ভোজের জোগানদার। একটু সময় পেলেই মনটা "কী লিখি' "কী লিখি' করতে থাকে।
হরি তোমায় ডাকি-- বালক একাকী,
আঁধার অরণ্যে ধাই হে।
গহন তিমিরে নয়নের নীরে
পথ খুঁজে নাহি পাই হে।
সদা মনে হয় কী করি কী করি,
কখন আসিবে কাল-বিভাবরী,
তাই ভয়ে মরি ডাকি "হরি হরি'--
হরি বিনা কেহ নাই হে।
নয়নের জল হবে না বিফল,
তোমায় সবে বলে ভকতবৎসল,
সেই আশা মনে করেছি সম্বল--
বেঁচে আছি আমি তাই হে।
আঁধারেতে জাগে তোমার আঁখিতারা,
তোমার ভক্ত কভু হয় না পথহারা,
ধ্রুব তোমায় চাহে তুমি ধ্রুবতারা--
আর কার পানে চাই হে।
"মা আমার পাষাণের মেয়ে
সন্তানে দেখলি নে চেয়ে।"
কলহ কটকটাং কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং
কটন কিটন কীটং কুট্‌নলং খট্টমট্টং।
আমায় ছ-জনায় মিলে পথ দেখায় ব'লে
পদে পদে পথ ভুলি হে।
নানা কথার ছলে নানান মুনি বলে,
সংশয়ে তাই দুলি হে।
তোমার কাছে যাব এই ছিল সাধ,
তোমার বাণী শুনে ঘুচাব প্রমাদ,
কানের কাছে সবাই করিছে বিবাদ
শত লোকের শত বুলি হে।
কাতর প্রাণে আমি তোমায় যখন যাচি
আড়াল করে সবাই দাঁড়ায় কাছাকাছি,
ধরণীর ধুলো তাই নিয়ে আছি--
পাই নে চরণধূলি হে।
শত ভাগ মোর শত দিকে ধায়,
আপনা-আপনি বিবাদ বাধায়,
কারে সামালিব এ কী হল দায়
একা যে অনেকগুলি হে।
আমায় এক করো তোমার প্রেমে বেঁধে,
এক পথ আমায় দেখাও অবিচ্ছেদে,
ধাঁধার মাঝে পড়ে কত মরি কেঁদে--
চরণেতে লহ তুলি হে।
আরো দেখুন
পুরোনো বাড়ি
Stories
অনেক কালের ধনী গরিব হয়ে গেছে, তাদেরই ঐ বাড়ি।
দিনে দিনে ওর উপরে দুঃসময়ের আঁচড় পড়ছে।
আরো দেখুন
বদনাম
Stories
ক্রিং ক্রিং ক্রিং সাইকেলের আওয়াজ; সদর দরজার কাছে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন ইন্‌স্‌পেক্টার বিজয়বাবু। গায়ে ছাঁটা কোর্তা, কোমরে কোমরবন্ধ, হাফ-প্যাণ্টপরা, চলনে কেজো লোকের দাপট। দরজার কড়া নাড়া দিতেই গিন্নি এসে খুলে দিলেন।
ইন্‌স্‌পেক্টার ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ঝংকার দিয়ে উঠলেন--'এমন করে তো আর পারি নে, রাত্তিরের পর রাত্তির খাবার আগলে রাখি! তুমি কত চোর ডাকাত ধরলে, সাধু সজ্জনও বাদ গেল না, আর ঐ একটা লোক অনিল মিত্তিরের পিছন পিছন তাড়া করে বেড়াচ্ছ, সে থেকে থেকে তোমার সামনে এসে নাকের উপর বুড়ো আঙুল নাড়া দিয়ে কোথায় দৌড় মারে তার ঠিকানা নেই। দেশসুদ্ধ লোক তোমার এই দশা দেখে হেসে খুন, এ যেন সার্কাসের খেলা হচ্ছে।'
আরো দেখুন
সুরদাসের প্রার্থনা
Verses
ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন,
          আমি কবি সুরদাস।
     দেবী, আসিয়াছি ভিক্ষা মাগিতে,
          পুরাতে হইবে আশ।
     অতি অসহন বহ্নিদহন
     মর্মমাঝারে করি যে বহন,
     কলঙ্করাহু প্রতি পলে পলে
          জীবন করিছে  গ্রাস।
     পবিত্র তুমি, নির্মল তুমি,
          তুমি দেবী, তুমি সতী--
     কুৎসিত দীন অধম পামর
          পঙ্কিল আমি অতি।
তুমিই লক্ষ্মী, তুমিই শক্তি
     হৃদয়ে আমার পাঠাও ভক্তি--
     পাপের তিমির পুড়ে যায় জ্বলে
          কোথা সে পুণ্যজ্যোতি।
     দেবের করুণা মানবী-আকারে,
     আনন্দধারা বিশ্বমাঝারে,
     পতিতপাবনী গঙ্গা যেমন
          এলেন পাপীর কাজে--
     তোমার চরিত রবে নির্মল,
     তোমার ধর্ম রবে উজ্জ্বল,
     আমার এ পাপ করি দাও লীন
          তোমার পুণ্যমাঝে।
     তোমারে কহিব লজ্জাকাহিনী
          লজ্জা নাহিকো তায়।
     তোমার আভায় মলিন লজ্জা
          পলকে মিলায়ে যায়।
     যেমন রয়েছে তেমনি দাঁড়াও,
     আঁখি নত করি আমা-পানে চাও,
     খুলে দাও মুখ আনন্দময়ী--
          আবরণে নাহি কাজ।
     নিরখি তোমারে ভীষণ মধুর,
     আছ কাছে তবু আছ অতি দূর--
     উজ্জ্বল যেন দেবরোষানল,
          উদ্যত যেন বাজ।
     জান কি আমি  পাপ-আঁখি মেলি
          তোমারে দেখেছি চেয়ে,
     গিয়েছিল মোর বিভোর বাসনা
          ওই মুখপানে ধেয়ে!
তুমি কি তখন পেরেছ জানিতে?
     বিমল হৃদয়-আরশিখানিতে
     চিহ্ন কিছু কি পড়েছিল এসে
          নিশ্বাসরেখাছায়া?
     ধরার কুয়াশা ম্লান করে যথা
          আকাশ উষার কায়া!
     লজ্জা সহসা আসি অকারণে
     বসনের মতো রাঙা আবরণে
     চাহিয়াছিল কি ঢাকিতে তোমায়
          লুব্ধ নয়ন হতে?
     মোহচঞ্চল সে লালসা মম
     কৃষ্ণবরন ভ্রমরের সম
     ফিরিতেছিল কি গুণ-গুণ কেঁদে
          তোমার দৃষ্টিপথে?
     আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত
          প্রভাতরশ্মিসম--
     লও, বিঁধে দাও বাসনাসঘন
          এ কালো নয়ন মম।
     এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই,
          ফুটেছে মর্মতলে--
     নির্বাণহীন অঙ্গারসম
          নিশিদিন শুধু জ্বলে।
     সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও
          জ্বালাময় দুটো চোখ,
     তোমার লাগিয়া তিয়াষ যাহার
          সে আঁখি তোমারি হোক।
     অপার ভুবন, উদার গগন,
          শ্যামল কাননতল,
বসন্ত অতি মুগ্ধমুরতি,
           স্বচ্ছ নদীর জল,
     বিবিধবরন সন্ধ্যানীরদ,
           গ্রহতারাময়ী নিশি,
     বিচিত্রশোভা শস্যক্ষেত্র
           প্রসারিত দূরদিশি,
     সুনীল গগনে ঘনতর নীল
           অতি দূর গিরিমালা,
     তারি পরপারে রবির উদয়
           কনককিরণ-জ্বালা,
     চকিততড়িৎ সঘন বরষা,
           পূর্ণ ইন্দ্রধনু,
     শরৎ-আকাশে অসীমবিকাশ
           জ্যোৎস্না শুভ্রতনু--
     লও, সব লও, তুমি কেড়ে লও,
           মাগিতেছি অকপটে,
     তিমিরতূলিকা দাও বুলাইয়া
           আকাশ-চিত্রপটে।
     ইহারা আমারে ভুলায়ে সতত,
           কোথা নিয়ে যায় টেনে!
     মাধুরীমদিরা পান করে শেষে
           প্রাণ পথ নাহি চেনে।
     সবে মিলে যেন বাজাইতে চায়
           আমার বাঁশরি কাড়ি,
     পাগলের মতো রচি নব গান,
           নব নব তান ছাড়ি।
     আপন ললিত রাগিণী শুনিয়া
           আপনি অবশ মন--
ডুবাইতে থাকে কুসুমগন্ধ
           বসন্তসমীরণ।
     আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে,
           ফুল মোরে ঘিরে বসে,
     কেমনে না জানি জ্যোৎস্নাপ্রবাহ
           সর্বশরীরে পশে।
     ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে
           ভুবনমোহিনী মায়া,
     যৌবন-ভরা বাহুপাশে তার
           বেষ্টন করে কায়া।
     চারি দিকে ঘিরি করে আনাগোনা
           কল্পমুরতি কত,
     কুসুমকাননে বেড়াই ফিরিয়া
           যেন বিভোরের মতো।
     শ্লথ হয়ে আসে হৃদয়তন্ত্রী,
           বীণা খসে যায় পড়ি,
     নাহি বাজে আর হরিনামগান
           বরষ বরষ ধরি।
     হরিহীন সেই অনাথ বাসনা
           পিয়াসে জগতে ফিরে--
     বাড়ে তৃষা, কোথা পিপাসার জল
           অকূল লবণনীরে।
     গিয়েছিল, দেবী, সেই ঘোর তৃষা
           তোমার রূপের ধারে--
     আঁখির সহিতে আঁখির পিপাসা
           লোপ করো একেবারে।
     ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমার মূর্তি
           পশেছে জীবনমূলে,
এই ছুরি দিয়ে সে মুরতিখানি
           কেটে কেটে লও তুলে।
     তারি সাথে হায় আঁধারে মিশাবে
           নিখিলের শোভা যত--
     লক্ষ্মী যাবেন, তাঁরি সাথে যাবে
           জগৎ ছায়ার মতো।
     যাক, তাই যাক, পারি নে ভাসিতে
           কেবলি মুরতিস্রোতে।
     লহ মোরে তুলি আলোকমগন
           মুরতিভুবন হতে।
     আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে--
           একাকী অসীম ভরা,
     আমারি আঁধারে মিলাবে গগন
           মিলাবে সকল ধরা।
     আলোহীন সেই বিশাল হৃদয়ে
           আমার বিজন বাস,
     প্রলয়-আসন জুড়িয়া বসিয়া
           রব আমি বারো মাস।
     থামো একটুকু, বুঝিতে পারি নে,
           ভালো করে ভেবে দেখি--
     বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার
           চিরকাল রবে সে কি?
     ক্রমে ধীরে ধীরে নিবিড় তিমিরে
           ফুটিয়া উঠিবে না কি
     পবিত্র মুখ, মধুর মূর্তি,
           স্নিগ্ধ আনত আঁখি?
এখন যেমন রয়েছ দাঁড়ায়ে
           দেবীর প্রতিমা-সম,
     স্থিরগম্ভীর করুণ নয়নে
           চাহিছ হৃদয়ে মম,
     বাতায়ন হতে সন্ধ্যাকিরণ
           পড়েছে ললাটে এসে,
     মেঘের আলোক লভিছে বিরাম
           নিবিড়তিমির কেশে,
     শান্তিরূপিণী এ মুরতি তব
           অতি অপূর্ব সাজে
     অনলরেখায় ফুটিয়া উঠিবে
           অনন্তনিশি-মাঝে।
     চৌদিকে তব নূতন জগৎ
           আপনি সৃজিত হবে,
     এ সন্ধ্যাশোভা তোমারে ঘিরিয়া
           চিরকাল জেগে রবে।
     এই বাতায়ন, ওই চাঁপা গাছ,
           দূর সরযূর রেখা
     নিশিদিনহীন অন্ধ হৃদয়ে
           চিরদিন যাবে দেখা।
     সে নব জগতে কালস্রোত নাই,
           পরিবর্তন নাহি--
     আজি এই দিন অনন্ত হয়ে
           চিরদিন রবে চাহি।
     তবে তাই হোক, হেয়ো না বিমুখ,
           দেবী, তাহে কিবা ক্ষতি--
     হৃদয়-আকাশে থাক্‌-না জাগিয়া
           দেহহীন তব জ্যোতি
বাসনামলিন আঁখিকলঙ্ক
          ছায়া ফেলিবে না তায়,
     আঁধার হৃদয়-নীল-উৎপল
          চিরদিন রবে পায়।
     তোমাতে হেরিব আমার দেবতা,
          হেরিব আমার হরি--
     তোমার আলোকে জাগিয়া রহিব
          অনন্ত বিভাবরী।
আরো দেখুন
চোখের বালি
Novels
বিনোদিনীর মাতা হরিমতি মহেন্দ্রের মাতা রাজলক্ষ্মীর কাছে আসিয়া ধন্না দিয়া পড়িল। দুইজনেই এক গ্রামের মেয়ে, বাল্যকালে একত্রে খেলা করিয়াছেন।
রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ধরিয়া পড়িলেন, "বাবা মহিন, গরিবের মেয়েটিকে উদ্ধার করিতে হইবে। শুনিয়াছি মেয়েটি বড়ো সুন্দরী, আবার মেমের কাছে পড়াশুনাও করিয়াছে-- তোদের আজকালকার পছন্দর সঙ্গে মিলিবে।"
"চরণতরণী দে মা, তারিণী তারা।'
আরো দেখুন
এসো আজি সখা
Verses
এসো আজি সখা বিজন পুলিনে
              বলিব মনের কথা;
মরমের তলে যা-কিছু রয়েছে
              লুকানো মরম-ব্যথা।
সুচারু রজনী, মেঘের আঁচল
              চাপিয়া অধরে হাসিছে শশি,
বিমল জোছনা সলিলে মজিয়া
              আঁধার মুছিয়া ফেলেছে নিশি,
কুসুম কাননে বিনত আননে
       মুচকিয়া হাসে গোলাপবালা,
বিষাদে মলিনা, শরমে নিলীনা,
       সলিলে দুলিছে কমলিনী বধূ
ম্লানরূপে করি সরসী আলা!
       আজি, খুলিয়া ফেলিব প্রাণ
       আজি, গাইব কত গান,
আজি, নীরব নিশীথে,চাঁদের হাসিতে
       মিশাব অফুট তান!
দুই হৃদয়ের যত আছে গান
       এক সাথে আজি গাইব,
দুই হৃদয়ের যত আছে কথা
       দুইজনে আজি কহিব;
কতদিন সখা, এমন নিশীথে
       এমন পুলিনে বসি,
মানসের গীত গাহিয়া গাহিয়া
       কাটাতে পাই নি নিশি!
স্বপনের মতো সেই ছেলেবেলা
       সেইদিন সথা মনে কি হয়?
হৃদয় ছিল গো কবিতা মাখানো
      প্রকৃতি আছিল কবিতাময়,
কী সুখে কাটিত পূরণিমা রাত
      এই নদীতীরে আসি,
[কু]সুমের মালা গাঁথিয়া গাঁথিয়া
      গনিয়া তারকারাশি।
যমুনা সুমুখে যাইত বহিয়া
      সে যে কী সুখের গাইত গান,
ঘুম ঘুম আঁখি আসিত মুদিয়া
      বিভল হইয়া যাইত প্রাণ!
[কত] যে সুখের কল্পনা আহা
      আঁকিতাম মনে মনে
[সা] রাটি জীবন কাটাইব যেন
              ...    
তখন কি সখা জানিতাম মনে
      পৃথিবী কবির নহে
কল্পনা আর যতই প্রবল
      ততই সে দুখ সহে!
এমন পৃথিবী, শোভার আকর
      পাখি হেথা করে গান
কাননে কাননে কুসুম ফুটিয়া
      পরিমল করে দান!
আকাশে হেথায় উঠে গো তারকা
      উঠে সুধাকর, রবি,
বরন বরন জলদ দেখিছে
      নদীজলে মুখছবি,
এমন পৃথিবী এও কারাগার
      কবির মনের কাছে!
যে দিকে নয়ন ফিরাইতে যায়
      সীমায় আটক আছে!
তাই [যে] গো সখা মনে মনে আমি
      গড়েছি একটি বন,
সারাদিন সেথা ফুটে আছে ফুল,
      গাইছে বিহগগণ!
আপনার ভাবে হইয়া পাগল
      রাতদিন সুখে আছি গো সেথা
বিজন কাননে পাখির মতন
      বিজনে গাইয়া মনের ব্যথা!
কতদিন পরে পেয়েছি তোমারে,
      ভুলেছি মরমজ্বালা;
দুজনে মিলিয়া সুখের কাননে
      গাঁথিব কুসুমমালা!
দুজনে মিলিয়া পূরণিমা রাতে
      গাইব সুখের গান
যমুনা পুলিনে করিব দুজনে
      সুখ নিশা অবসান,
আমার এ মন সঁপিয়া তোমারে
      লইব তোমার মন
হৃদয়ের খেলা খেলিয়া খেলিয়া
      কাটাইব সারাক্ষণ!
এইরূপে সখা কবিতার কোলে
      পোহায়ে যাইবে প্রাণ
সুখের স্বপন দেখিয়া দেখিয়া
      গাহিয়া সুখের গান।
আরো দেখুন