মালিনী (malini)

     

    সূচনা

    মালিনী নাটিকার উৎপত্তির একটা বিশেষ ইতিহাস আছে, সে স্বপ্নঘটিত। কবিকঙ্কণকে দেবী স্বপ্নে আদেশ করেছিলেন তাঁর গুণকীর্তন করতে। আমার স্বপ্নে দেবীর আবির্ভাব ছিল না, ছিল হঠাৎ মনের একটা গভীর আত্মপ্রকাশ ঘুমন্ত বুদ্ধির সুযোগ নিয়ে।
    তখন ছিলুম লণ্ডনে। নিমন্ত্রণ ছিল প্রিমরোজ হিলে তারক পালিতের বাসায়। প্রবাসী বাঙালিদের প্রায়ই সেখানে হত জটলা, আর তার সঙ্গে চলত ভোজ। গোলেমালে রাত হয়ে গেল। যাঁদের বাড়িতে ছিলুম, অত রাত্রে দরজার ঘন্টা বাজিয়ে দিয়ে হঠাৎ চমক লাগিয়ে দিলে গৃহস্থ সেটাকে দুঃসহ বলেই গণ্য করতেন ; তাই পালিত সাহেবের অনুরোধে তাঁর ওখানেই রাত্রিযাপন স্বীকার করে নিলুম। বিছানায় যখন শুলুম তখনো চলছে কলরবের অন্তিম পর্ব, আমার ঘুম ছিল আবিল হয়ে।
    এমন সময় স্বপ্ন দেখলুম, যেন আমার সামনে একটা নাটকের অভিনয় হচ্ছে। বিষয়টা একটা বিদ্রোহের চক্রান্ত। দুই বন্ধুর মধ্যে এক বন্ধু কর্তব্যবোধে সেটা ফাঁস করে দিয়েছেন রাজার কাছে। বিদ্রোহী বন্দী হয়ে এলেন রাজার সামনে। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্যে তাঁর বন্ধুকে যেই তাঁর কাছে এনে দেওয়া হল দুই হাতের শিকল তাঁর মাথায় মেরে বন্ধুকে দিলেন ভূমিসাৎ করে।
    জেগে উঠে যেটা আমাকে আশ্চর্য ঠেকল সেটা হচ্ছে এই যে, আমার মনের একভাগ নিশ্চেষ্ট শ্রোতামাত্র, অন্যভাগ বুনে চলেছে একখানা নাটক। স্পষ্ট হোক অস্পষ্ট হোক একটা কথাবার্তার ধারা গল্পকে বহন করে চলেছিল। জেগে উঠে সে আমি মনে আনতে পারলুম না। পালিত সাহেবকে মনের ক্রিয়ার এই বিস্ময়করতা জানিয়েছিলুম। তিনি এটাতে বিশেষ কোনো ঔৎসুক্য বোধ করলেন না।
    কিন্তু অনেক কাল এই স্বপ্ন আমার জাগ্রত মনের মধ্যে সঞ্চরণ করেছে। অবশেষে অনেক দিন পরে এই স্বপ্নের স্মৃতি নাটিকার আকার নিয়ে শান্ত হল।
    বোধ করি এই নাটিকায় আমার রচনার একটা কিছু বিশেষত্ব ছিল, সেটা অনুভব করেছিলুম যখন দ্বিতীয় বার ইংলণ্ডে বাসকালে এর ইংরেজি অনুবাদ কোনো ইংরেজ বন্ধুর চোখে পড়ল। প্রথম দেখা গেল এটা আর্টিস্ট রোটেনস্টাইনের মনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। কখনো কখনো এটাকে তাঁর ঘরে অভিনয় করবার ইচ্ছেও তাঁর হয়েছিল। আমার মনে হল, এই নাটকের প্রধান চরিত্রগুলি তাঁর শিল্পী-মনে মূর্তিরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার পরে এক দিন ট্রেভেলিয়ানের মুখে এর সম্বন্ধে মন্তব্য শুনলুম। তিনি কবি এবং গ্রীক সাহিত্যের রসজ্ঞ। তিনি আমাকে বললেন, এই নাটকে তিনি গ্রীক নাট্যকলার প্রতিরূপ দেখেছেন। তার অর্থ কী তা আমি সম্পূর্ণ বুঝতে পারি নি, কারণ যদিও কিছু কিছু তর্জমা পড়েছি, তবু গ্রীক নাট্য আমার অভিজ্ঞতার বাইরে। শেক্‌সপীয়রের নাটক আমাদের কাছে বরাবর নাটকের আদর্শ। তার বহুশাখায়িত বৈচিত্র৻ ব্যাপ্তি ও ঘাতপ্রতিঘাত প্রথম থেকেই আমাদের মনকে অধিকার করেছে। মালিনীর নাট্যরূপ সংযত সংহত এবং দেশকালের ধারায় অবিচ্ছিন্ন। এর বাহিরের রূপায়ণ সম্বন্ধে যে মত শুনেছিলুম এ হচ্ছে তাই। কবিতার মর্মকথাটি প্রথম থেকেই যদি রচনার মধ্যে জেনেশুনে বপন করা না হয়ে থাকে তবে কবির কাছেও সেটা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে দেরি লাগে। আজ আমি জানি মালিনীর মধ্যে কী কথাটি লিখতে লিখতে উদ্ভাবিত হয়ে ছিল গৌণরূপে ঈষৎগোচর। আসল কথা, মনের একটা সত্যকার বিস্ময়ের আলোড়ন ওর মধ্যে দেখা দিয়েছে।
    আমার মনের মধ্যে ধর্মের প্রেরণা তখন গৌরীশংকরের উত্তুঙ্গ শিখরে শুভ্র নির্মল তুষারপুঞ্জের মতো নির্মল নির্বিকল্প হয়ে স্তব্ধ ছিল না, সে বিগলিত হয়ে মানবলোকে বিচিত্র মঙ্গলরূপে মৈত্রীরূপে আপনাকে প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছে। নির্বিকার তত্ত্ব নয় সে, মূর্তিশালার মাটিতে পাথরে নানা অদ্ভুত আকার নিয়ে মানুষকে সে হতবুদ্ধি করতে আসে নি। কোনো দৈববাণীকে সে আশ্রয় করে নি। সত্য যার স্বভাবে, যে মানুষের অন্তরে অপরিমেয় করুণা, তার অন্তঃকরণ থেকে এই পরিপূর্ণ মানব-দেবতার আবির্ভাব অন্য মানুষের চিত্তে প্রতিফলিত হতে থাকে। সকল আনুষ্ঠানিক সকল পৌরাণিক ধর্মজটিলতা ভেদ করে তবেই এর যথার্থ স্বরূপ প্রকাশ হতে পারে।
    আমার এ মতের সত্যাসত্য আলোচ্য নয়। বক্তব্য এই যে, এই ভাবের উপরে মালিনী স্বতই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে; এরই যা দুঃখ, এরই যা মহিমা, সেইটেতেই এর কাব্যরস। এই ভাবের অঙ্কুর আপনা-আপনি দেখা দিয়েছিল "প্রকৃতির প্রতিশোধ'এ, সে-কথা ভেবে দেখবার যোগ্য। "নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ'এ হয়তো তারও আগে এর আভাস পাওয়া যায়।

    প্রথম দৃশ্য

    রাজান্তঃপুর
    মালিনী ও কাশ্যপ
    কাশ্যপ।
    ত্যাগ করো, বৎসে, ত্যাগ করো সুখ-আশা
    দুঃখভয় ;  দূর করো  বিষয়পিপাসা ;
    ছিন্ন করো সংসারবন্ধন ; পরিহর
    প্রমোদপ্রলাপ চঞ্চলতা ;  চিত্তে ধরো
    ধ্রুবশান্ত সুনির্মল প্রজ্ঞার আলোক
    রাত্রিদিন-- মোহশোক পরাভূত হোক।
    মালিনী।
    ভগবন্, রুদ্ধ আমি, নাহি হেরি চোখে ;
    সন্ধ্যায় মুদ্রিতদল পদ্মের কোরকে
    আবদ্ধ ভ্রমরী- স্বর্ণরেণুরাশিমাঝে
    মৃত জড়প্রায়। তবু কানে এসে বাজে
    মুক্তির সংগীত, তুমি কৃপা কর যবে।
    কাশ্যপ।
    আশীর্বাদ করিলাম, অবসান হবে
    বিভাবরী, জ্ঞানসূর্য-উদয়-উৎসবে
    জাগ্রত এ জগতের জয়জয়রবে
    শুভলগ্নে সুপ্রভাতে হবে উদ্‌ঘাটন
    পুষ্পকারাগার তব। সেই মহাক্ষণ
    এসেছে নিকটে। আমি তবে চলিলাম
    তীর্থপর্যটনে।
    মালিনী।
                   লহো দাসীর প্রণাম।
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    মহাক্ষণ আসিয়াছে। অন্তর চঞ্চল
    যেন বারিবিন্দুসম করে টলমল
    পদ্মদলে। নেত্র মুদি শুনিতেছি কানে
    আকাশের কোলাহল; কাহারা কে জানে
    কী করিছে আয়োজন আমারে ঘিরিয়া,
    আসিতেছে যাইতেছে ফিরিয়া ফিরিয়া
    অদৃশ্যমুরতি। কভু বিদ্যুতের মতো
    চমকিছে আলো ; বায়ুর তরঙ্গ যত
    শব্দ করি করিছে আঘাত। ব্যথাসম
    কী যেন বাজিছে আজি অন্তরেতে মম
    বারম্বার-- কিছু আমি নারি বুঝিবারে
    জগতে কাহারা আজি ডাকিছে আমারে।
    রাজমহিষীর প্রবেশ
    মহিষী।
    মা গো মা, কী করি তোরে লয়ে। ওরে বাছা,
    এ-সব কি সাজে তোরে কভু, এই কাঁচা
    নবীন বয়সে?  কোথা গেল বেশভূষা
    কোথা আভরণ? আমার সোনার উষা
    স্বর্ণপ্রভাহীনা, এও কি চোখের 'পরে
    সহ্য হয় মার?
    মালিনী।
               কখনো রাজার ঘরে
    জন্মে না কি ভিখারিনী? দরিদ্রের কূলে
    তুই যে, মা জন্মেছিস সে কি গেলি ভুলে
    রাজেশ্বরী? তোর সে বাপের দরিদ্রতা
    জগৎবিখ্যাত, বল্‌ মা, সে যাবে কোথা?
    তাই আমি ধরিয়াছি অলংকারসম
    তোমার বাপের দৈন্য সর্ব অঙ্গে মম,
    মা আমার।
    মহিষী।
                     ওগো, আপন বাপের গর্বে
    আমার বাপেরে দাও খোঁটা? তাই গর্ভে
    ধরেছিনু তোরে, ওরে অহংকারী মেয়ে?
    জানিস, আমার পিতা তোর পিতা চেয়ে
    শতগুণে ধনী, তাই, ধনরত্নমানে
    এত তাঁর হেলা।
    মালিনী।
                        সে তো সকলেই জানে।  
    যেদিন পিতৃব্য তব, পিতৃধনলোভে
    বঞ্চিলেন পিতারে তোমার, মনঃক্ষোভে
    ছাড়িলেন গৃহ তিনি। সর্ব ধনজন
    সম্পদ সহায় করিলেন বিসর্জন
    অকাতর মনে ; শুধু সযত্নে আনিলা
    পৈতৃক দেবতামূর্তি শালগ্রামশিলা
    দরিদ্রকুটিরে। সেই তাঁর ধর্মখানি
    মোর জন্মকালে মোরে দিয়েছ, মা, আনি--
    আর কিছু নহে। থাক্‌-না মা, সর্বক্ষণ
    তব পিতৃভবনের দরিদ্রের ধন
    তোমারি কন্যার হৃদে। আমার পিতার
    যা-কিছু ঐশ্বর্য আছে ধনরত্নভার
    থাক্‌ রাজপুত্রতরে।
    মহিষী।
                             কে তোমারে বোঝে
    মা আমার ! কথা শুনে জানি না কেন যে
    চক্ষে আসে জল। যেদিন আসিলি কোলে
    বাক্যহীন মূঢ় শিশু, ক্রন্দনকল্লোলে
    মায়েরে ব্যাকুল করি, কে জানিত তবে
    সেই ক্ষুদ্র মুগ্ধ মুখ এত কথা কবে
    দুই দিন পরে। থাকি তোর মুখ চেয়ে,
    ভয়ে কাঁপে বুক। ও মোর সোনার মেয়ে,
    এ ধর্ম কোথায় পেলি, কী শাস্ত্রবচন?
    আমার পিতার ধর্ম সে তো পুরাতন
    অনাদি কালের। কিন্তু মা গো, এ যে তব
    সৃষ্টিছাড়া বেদছাড়া ধর্ম অভিনব
    আজিকার গড়া। কোথা হতে ঘরে আসে
    বিধর্মী সন্ন্যাসী? দেখে আমি মরি ত্রাসে !
    কী মন্ত্র শিখায় তারা, সরল হৃদয়
    জড়ায় মিথ্যার জালে? লোকে না কি কয়
    বৌদ্ধেরা পিশাচপন্থী, জাদুবিদ্যা জানে,
    প্রেতসিদ্ধ তারা। মোর কথা লহ কানে,
    বাছা রে আমার ! ধর্ম কি খুঁজিতে হয় ?
    সুর্যের মতন ধর্ম চিরজ্যোতির্ময়
    চিরকাল আছে। ধরো তুমি সেই ধর্ম,
    সরল সে পথ। লহ ব্রতক্রিয়াকর্ম
    ভক্তিভরে। শিবপূজা করো দিনযামী,
    বর মাগি লহ, বাছা, তাঁরি মতো স্বামী।
    সেই পতি হবে তোর সমস্ত দেবতা,
    শাস্ত্র হবে তাঁরি বাক্য, সরল এ কথা।
    শাস্ত্রজ্ঞানী পণ্ডিতেরা মরুক ভাবিয়া
    সত্যাসত্য ধর্মাধর্ম কর্তাকর্মক্রিয়া
    অনুস্বার-চন্দ্রবিন্দু লয়ে। পুরুষের
    দেশভেদে কালভেদে প্রতিদিবসের
    স্বতন্ত্র নূতন ধর্ম ; সদা হাহা ক'রে
    ফিরে তারা শান্তি লাগি সন্দেহসাগরে,
    শাস্ত্র লয়ে করে কাটাকাটি। রমণীর
    ধর্ম থাকে বক্ষে কোলে চিরদিন স্থির
    পতিপুত্ররূপে।
    রাজার প্রবেশ
    রাজা।
                          কন্যা, ক্ষান্ত হও এবে,
    কিছুদিন-তরে।  উপরে আসিছে নেবে
    ঝটিকার মেঘ।  
    মহিষী।
                       কোথা হতে মিথ্যা ভয়
    আনিয়াছ মহারাজ?
    রাজা।
                             বড়ো মিথ্যা নয়।
    হায় রে অবোধ মেয়ে, নব ধর্ম যদি
    ঘরেতে আনিতে চাস, সে কি বর্ষানদী
    একেবারে তট ভেঙে হইবে প্রকাশ
    দেশবিদেশের দৃষ্টিপথে? লজ্জাত্রাস
    নাহি তার? আপনার ধর্ম আপনারি,
    থাকে যেন সংগোপনে, সর্বনরনারী
    দেখে যেন নাহি করে দ্বেষ, পরিহাস
    না করে কঠোর। ধর্মেরে রাখিতে চাস
    রাখ্‌ মনে মনে।
    মহিষী।
                         ভর্ৎসনা করিছ কেন
    বাছারে আমার মহারাজ? কত যেন
    অপরাধী। কী শিক্ষা শিখাতে এলে আজ,
    পাপ রাষ্ট্রনীতি? লুকায়ে করিবে কাজ,
    ধর্ম দিবে চাপা! সে মেয়ে আমার নয়।
    সাধুসন্ন্যাসীর কাছে উপদেশ লয়,
    শুনে পুণ্যকথা, করে সজ্জনের সেবা--
    আমি তো বুঝি না তাহে দোষ দিবে কেবা,
    ভয় বা কাহারে।
    রাজা।
                          মহারানী, প্রজাগণ
    ক্ষুব্ধ অতিশয়। চাহে তারা নির্বাসন
    মালিনীর।
    মহিষী।
                   কী বলিলে! নির্বাসন কারে!
    মালিনীরে ? মহারাজ, তোমার কন্যারে?
    রাজা।
     ধর্মনাশ-আশঙ্কায় ব্রাহ্মণের দল
    এক হয়ে-
    মহিষী।
                   ধর্ম জানে ব্রাহ্মণে কেবল?
    আর ধর্ম নাই ? তাদেরি পুঁথিতে লেখা
    সর্বসত্য, অন্য কোথা নাহি তার রেখা
    এ বিশ্বসংসারে ? ব্রাহ্মণেরা কোথা আছে
    ডেকে নিয়ে এস। আমার মেয়ের কাছে
    শিখে নিক ধর্ম কারে বলে। ফেলে দিক
    কীটে-কাটা ধর্ম তার, ধিক্‌ ধিক্‌ ধিক্‌।--
    ওরে বাছা, আমি লব নবমন্ত্র তোর,
    আমি ছিন্ন করে দেব জীর্ণ শাস্ত্রডোর
    ব্রাহ্মণের। তোমারে পাঠাবে নির্বাসনে?--  
    নিশ্চিন্ত রয়েছ মহারাজ? ভাব মনে
    এ কন্যা তোমার কন্যা, সামান্য বালিকা!
    ওগো, তাহা নহে। এ যে দীপ্ত অগ্নিশিখা।
    আমি কহিলাম আজি শুনি লহো কথা--
    এ কন্যা মানবী নহে, এ কোন্‌ দেবতা,
    এসেছে তোমার ঘরে। করিয়ো না হেলা,
    কোন্‌ দিন অকস্মাৎ ভেঙে দিয়ে খেলা
    চলে যাবে-- তখন করিবে হাহাকার,
    রাজ্যধন সব দিয়ে পাইবে না আর।
    মালিনী।
        প্রজাদের পুরাও প্রার্থনা। মহাক্ষণ
    এসেছে নিকটে। দাও মোরে নির্বাসন
    পিতা।
    রাজা।
                  কেন বৎসে, পিতার ভবনে তোর
    কী অভাব?  বাহিরের সংসার কঠোর
    দয়াহীন, সে কি বাছা পিতৃমাতৃক্রোড়?
    মালিনী।
        শোনো পিতা-- যারা চাহে নির্বাসন মোর
    তারা চাহে মোরে। ওগো মা, শোন্‌ মা কথা--
    বোঝাতে পারি নে মোর চিত্তব্যাকুলতা।
    আমারে ছাড়িয়া দে মা, বিনা দুঃখশোকে,
    শাখা হতে চ্যুত পত্রসম। সর্বলোকে
    যাব আমি-- রাজদ্বারে মোরে যাচিয়াছে
    বাহির-সংসার। জানি না কী কাজ আছে,
    আসিয়াছে মহাক্ষণ।
    রাজা।
                            ওরে শিশুমতি,
    কী কথা বলিস।
    মালিনী।
                       পিতা, তুমি নরপতি,
    রাজার কর্তব্য করো। জননী আমার,
    আছে তোর পুত্রকন্যা এ ঘরসংসার,
    আমারে ছাড়িয়া দে মা। বাঁধিস নে আর
    স্নেহপাশে।
    মহিষী।
                    শোনো কথা শোনো একবার।
    বাক্য নাহি সরে মুখে, চেয়ে তোর পানে
    রয়েছি বিস্মিত। হাঁ গো, জন্মিলি যেখানে
    সেখানে কি স্থান নাই তোর? মা আমার,
    তুই কি জগৎলক্ষ্ণী, জগতের ভার
    পড়েছে কি তোরি 'পরে? নিখিলসংসার
    তুই বিনা মাতৃহীনা, যাবি তারি কাছে
    নূতন আদরে-- আমাদের মা কে আছে
    তুই চলে গেলে?
    মালিনী।
                          আমি স্বপ্ন দেখি জেগে,
    শুনি নিদ্রাঘোরে, যেন বায়ু বহে বেগে,
    নদীতে উঠিছে ঢেউ, রাত্রি অন্ধকার,
    নৌকাখানি তীরে বাঁধা-- কে করিবে পার,
    কর্ণধার নাই-- গৃহহীন যাত্রী সবে
    বসে আছে নিরাশ্বাস-- মনে হয় তবে
    আমি যেন যেতে পারি, আমি যেন জানি
    তীরের সন্ধান-- মোর স্পর্শে নৌকাখানি
    পাবে যেন প্রাণ, যাবে যেন আপনার
    পূর্ণ বলে-- কোথা হতে বিশ্বাস আমার
    এল মনে? রাজকন্যা আমি, দেখি নাই
    বাহির-সংসার-- বসে আছি এক ঠাঁই
    জন্মাবধি, চতুর্দিকে সুখের প্রাচীর,
    আমারে কে করে দেয় ঘরের বাহির
    কে জানে গো। বন্ধ কেটে দাও মহারাজ,
    ওগো, ছেড়ে দে মা, কন্যা আমি নহি আজ,
    নহি রাজসুতা-- যে মোর অন্তরযামী
    অগ্নিময়ী মহাবাণী, সেই শুধু আমি।
    মহিষী।
         শুনিলে তো মহারাজ? এ কথা কাহার?
    শুনিয়া বুঝিতে নারি। এ কি বালিকার?
    এই কি তোমার কন্যা? আমি কি আপনি
    ইহারে ধরেছি গর্ভে?  
    রাজা।
                               যেমন রজনী
    উষারে জনম দেয়। কন্যা জ্যোতির্ময়ী
    রজনীর কেহ নহে, সে যে বিশ্বজয়ী
    বিশ্বে দেয় প্রাণ।
    মহিষী।
                         মহারাজ তাই বলি,
    খুঁজে দেখো কোথা আছে মায়ার শিকলি
    যাহে বাঁধা পড়ে যায় আলোকপ্রতিমা।
    কন্যার প্রতি
    মুখে খুলে পড়ে কেশ, এ কী বেশ! ছি মা !
    আপনারে এত অনাদর! আয় দেখি,
    ভালো করে বেঁধে দিই। লোকে বলিবে কী
    দেখে তোরে? নির্বাসন! এই যদি হয়
    ধর্ম ব্রাহ্মণের, তবে হোক, মা, উদয়
    নবধর্ম-- শিখে নিক তোরি কাছ হতে
    বিপ্রগণ। দেখি মুখ, আয় মা, আলোতে।
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    সেনাপতির প্রবেশ
    সেনাপতি।
     মহারাজ, বিদ্রোহী হয়েছে প্রজাগণ
    ব্রাহ্মণবচনে। তারা চায় নির্বাসন
    রাজকুমারীর।
    রাজা।
                       যাও তবে সেনাপতি,
    সামন্তনৃপতি সবে আনো দ্রুতগতি।
    [ উভয়ের প্রস্থান ]

    দ্বিতীয় দৃশ্য

    মন্দিরপ্রাঙ্গণে  ব্রাহ্মণগণ
    ব্রাহ্মণগণ।
     নির্বাসন, নির্বাসন, রাজদুহিতার
    নির্বাসন!  
    ক্ষেমংকর।
               বিপ্রগণ, এই কথা সার।
    এ সংকল্প দৃঢ় রেখো মনে। জেনো ভাই,
    অন্য অরি নাহি ডরি, নারীরে ডরাই।
    তার কাছে অস্ত্র যায় টুটে, পরাহত
    তর্কযুক্তি, বাহুবল করে শির নত--
    নিরাপদে হৃদয়ের মাঝে করে বাস
    রাজ্ঞীসম মনোহর মহাসর্বনাশ।
    চারুদত্ত।
       চলো সবে রাজদ্বারে, বলো, "রক্ষ রক্ষ
    মহারাজ, আর্যধর্মে করিতেছে লক্ষ্য
    তব নীড় হতে সর্প'।
    সুপ্রিয়।
                             ধর্ম? মহাশয়,
    মূঢ়ে উপদেশ দেহ ধর্ম কারে কয়।
    ধর্ম নির্দোষীর নির্বাসন?
    চারুদত্ত।
                             তুমি দেখি
    কুলশত্রু বিভীষণ। সকল কাজে কি
    বাধা দিতে আছ?
    সোমাচার্য।
                      মোরা ব্রাহ্মণসমাজে
    একত্রে মিলেছি সবে ধর্মরক্ষাকাজে,
    তুমি কোথা হতে এসে মাঝে দিলে দেখা
    অতিশয় সুনিপুণ বিচ্ছেদের রেখা--
    সূক্ষ্ণ সর্বনাশ।
    সুপ্রিয়।
                       ধর্মাধর্ম সত্যাসত্য
    কে করে বিচার? আপন বিশ্বাসে মত্ত
    করিয়াছ স্থির, শুধু দল বেঁধে সবে
    সত্যের মীমাংসা হবে, শুধু উচ্চরবে?
    যুক্তি কিছু নহে?
    চারুদত্ত।
                         দম্ভ তব অতিশয়
    হে সুপ্রিয়।
    সুপ্রিয়।
                   প্রিয়ম্বদ, মোর দম্ভ নয়,
    আমি অজ্ঞ অতি-- দম্ভ তারি যে আজিকে
    শতার্থক শাস্ত্র হতে দুটো কথা শিখে
    নিষ্পাপ নিরপরাধ রাজকুমারীরে
    টানিয়া আনিতে চাহে ঘরের বাহিরে
    ভিক্ষুকের পথে-- তাঁর শাস্ত্রে মোর শাস্ত্রে
    দু-অক্ষর প্রভেদ বলিয়া।
    ক্ষেমংকর।
                            বচনাস্ত্রে
    কে পারে তোমারে বন্ধুবর।
    সোমাচার্য।
                               দূর করে
    দাও সুপ্রিয়েরে। বিপ্রগণ, করো ওরে
    সভার বাহির।
    চারুদত্ত।
                    মোরা নির্বাসন চাহি
    রাজকুমারীর। যার অভিমত নাহি
    যাক সে বাহিরে।
    ক্ষেমংকর।
                     ক্ষান্ত হও বন্ধুগণ।
    সুপ্রিয়।
         ভ্রমক্রমে আমারে করেছ নির্বাচন
    ব্রাহ্মণমণ্ডলী। আমি নহি এক জন
    তোমাদের ছায়া। প্রতিধ্বনি নহি আমি
    শাস্ত্রবচনের। যে শাস্ত্রের অনুগামী
    এ ব্রাহ্মণ, সে শাস্ত্রে কোথাও লেখে নাই
    শক্তি যার ধর্ম তার।

    ক্ষেমংকরের প্রতি

                 চলিলাম ভাই,
    আমারে বিদায় দাও।
    ক্ষেমংকর।
                         দিব না বিদায়।
    তর্কে শুধু দ্বিধা তব, কাজের বেলায়
    দৃঢ় তুমি পর্বতের মতো। বন্ধু মোর,
    জান না কি আসিয়াছে দুঃসময় ঘোর--
    আজ মৌন থাকো।
    সুপ্রিয়।
                           বন্ধু, জন্মেছে ধিক্কার।
    মূঢ়তার দুর্বিনয় নাহি সহে আর।
    যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকর্ম ব্রত-উপবাস
    এই শুধু ধর্ম ব'লে করিবে বিশ্বাস
    নিঃসংশয়ে? বালিকারে দিয়া নির্বাসনে
    সেই ধর্ম রক্ষা হবে? ভেবে দেখো মনে
    মিথ্যারে সে সত্য বলি করে নি প্রচার ;  
    সেও বলে সত্য ধর্ম, দয়া ধর্ম তার,
    সর্বজীবে প্রেম-- সর্বধর্মে সেই সার,
    তার বেশি যাহা আছে, প্রমাণ কী তার?
    ক্ষেমংকর।
     স্থির হও ভাই। মূল ধর্ম এক বটে,
    বিভিন্ন আধার। জল এক, ভিন্ন তটে
    ভিন্ন জলাশয়। আমরা যে সরোবরে
    মিটাই পিপাসা পিতৃপিতামহ ধ'রে
    সেথা যদি অকস্মাৎ নবজলোচ্ছ্বাস
    বন্যার মতন আসে, ভেঙে করে নাশ
    তটভূমি তার, সে উচ্ছ্বাস হলে গত
    বাঁধ-ভাঙা সরোবরে জলরাশি যত
    বাহির হইয়া যাবে। তোমার অন্তরে
    উৎস আছে, প্রয়োজন নাহি সরোবরে--
    তাই বলে ভাগ্যহীন সর্বজনতরে
    সাধারণ জলাশয় রাখিবে না তুমি--
    পৈতৃক কালের বাঁধা দৃঢ় তটভূমি,
    বহুদিবসের প্রেমে সতত লালিত
    সৌন্দর্যের শ্যামলতা, সযত্নপালিত
    পুরাতন ছায়াতরুগুলি, পিতৃধর্ম,
    প্রাণপ্রিয় প্রথা, চির-আচরিত কর্ম,
    চিরপরিচিত নীতি? হারায়ে চেতন
    সত্যজননীর কোলে নিদ্রায় মগন
    কত মূঢ় শিশু, নাহি জানে জননীরে--
    তাদের চেতনা দিতে মাতার শরীরে
    কোরো না আঘাত। ধৈর্য সদা রাখো সখে,
    ক্ষমা করো ক্ষমাযোগ্য জনে, জ্ঞানালোকে
    আপন কর্তব্য করো।
    সুপ্রিয়।
                             তব পথগামী
    চিরদিন এ অধীন। রেখে দিব আমি
    তব বাক্য শিরে করি। যুক্তিসূচি-'পরে
    সংসার-কর্তব্যভার কভু নাই ধরে!
    উগ্রসেনের প্রবেশ
    উগ্রসেন।
        কার্য সিদ্ধ ক্ষেমংকর! হয়েছে চঞ্চল
    ব্রাহ্মণের বাক্য শুনে রাজসৈন্যদল,
    আজি বাঁধ ভাঙে-ভাঙে।
    সোমাচার্য।
                            সৈন্যদল!
    চারুদত্ত।
                                      সে কী!
    এ কী কাণ্ড, ক্রমে এ যে বিপরীত দেখি
    বিদ্রোহের মতো।
    সোমাচার্য।
                     এতদূর ভালো নয়,
    ক্ষেমংকর
    চারুদত্ত।
                  ধর্মবলে ব্রাহ্মণের জয়,
    বাহুবলে নহে। যজ্ঞযাগে সিদ্ধি হবে ;
    দ্বিগুণ উৎসাহভরে এস, বন্ধু, সবে
    করি মন্ত্রপাঠ। শুদ্ধাচারে যোগাসনে
    ব্রহ্মতেজ করি উপার্জন। একমনে
    পূজি ইষ্টদেবে।
    সোমাচার্য।
                     তুমি কোথা আছ দেবী,
    সিদ্ধিদাত্রী জগদ্ধাত্রী! তব পদ সেবি
    ব্যর্থকাম কভু নাহি হবে ভক্তজন।
    তুমি কর নাস্তিকের দর্পসংহরণ
    সশরীরে-- প্রত্যক্ষ দেখায়ে দাও আজি
    বিশ্বাসের বল। সংহারের বেশে সাজি
    এখনি দাঁড়াও সর্বসম্মুখেতে আসি
    মুক্তকেশে খড়গহস্তে, অট্টহাস হাসি
    পাষণ্ডদলনী। এস সবে একপ্রাণ
    ভক্তিভরে সমস্বরে করহ আহ্বান
    প্রলয়শক্তিরে।
    সমস্বরে
    ব্রাহ্মণগণ।
                    সবে করজোড়ে যাচি-
    আয় মা প্রলয়ংকরী।
    মালিনীর প্রবেশ
    মালিনী।
                             আমি আসিয়াছি।
    ক্ষেমংকর ও সুপ্রিয় ব্যতীত
    সমস্ত ব্রাহ্মণের ভুমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম
    সোমাচার্য।
     এ কী দেবী, এ কী বেশ!  দয়াময়ী এ যে
    এসেছেন ম্লানবস্ত্রে নরকন্যা সেজে।
    এ কী অপরূপ রূপ! এ কী স্নেহজ্যোতি
    নেত্রযুগে! এ তো নহে সংহারমুরতি।
    কোথা হতে এলে মাতঃ? কী ভাবিয়া মনে,
    কী করিতে কাজ?
    মালিনী।
                          আসিয়াছি নির্বাসনে,
    তোমরা ডেকেছ বলে ওগো বিপ্রগণ।
    সোমাচার্য।
     নির্বাসন। স্বর্গ হতে দেবনির্বাসন
    ভক্তের আহ্বানে!  
    চারুদত্ত।
                         হায়, কী করিব মাতঃ,
    তোমার সহায় বিনা আর রহে না তো
    এ ভ্রষ্ট সংসার।
    মালিনী।
                     আমি ফিরিব না আর।
    জানিতাম, জানিতাম তোমাদের দ্বার
    মুক্ত আছে মোর তরে। আমারি লাগিয়া
    আছ বসে। তাই আমি উঠেছি জাগিয়া
    সুখসম্পদের মাঝে, তোমরা যখন
    সবে মিলি যাচিলে আমার নির্বাসন
    রাজদ্বারে।
    ক্ষেমংকর।
               রাজকন্যা?
    সকলে।
                             রাজার দুহিতা!
    সুপ্রিয়।
          ধন্য ধন্য!
    মালিনী।
                   আমারে করেছ নির্বাসিতা?
    তাই আজি মোর গৃহ তোমাদের ঘরে।
    তবু এক বার মোরে বলো সত্য করে
    সত্যই কি আছে কোনো প্রয়োজন মোরে,
    চাহ কি আমায়? সত্যই কি নাম ধরে
    বাহির-সংসার হতে ডেকেছিলে সবে
    আপন নির্জন ঘরে বসে ছিনু যবে
    সমস্ত জগৎ হতে অতিশয় দূরে
    শতভিত্তি-অন্তরালে রাজ-অন্তঃপুরে
    একাকী বালিকা। তবে সে তো স্বপ্ন নয়!
    তাই তো কাঁদিয়াছিল আমার হৃদয়
    না বুঝিয়া কিছু!
    চারুদত্ত।
                       এস,এস মা জননী,
    শতচিত্তশতদলে দাঁড়াও অমনি
    করুণামাখানো মুখে।
    মালিনী।
                             আসিয়াছি আজ--
    প্রথমে শিখাও মোরে কী করিব কাজ
    তোমাদের। জন্ম লভিয়াছি রাজকুলে,
    রাজকন্যা আমি-- কখনো গবাক্ষ খুলে
    চাহি নি বাহিরে, দেখি নাই এ সংসার
    বৃহৎ বিপুল-- কোথায় কী ব্যথা তার
    জানি না তো কিছু। শুনিয়াছি দুঃখময়
    বসুন্ধরা, সে দুঃখের লব পরিচয়
    তোমাদের সাথে।
    দেবদত্ত।
                        ভাসি নয়নের জলে,
    মা, তোমার কথা শুনে।
    সকলে।
                               আমরা সকলে
    পাষণ্ড পামর।
    মালিনী।
                    আজি মোর মনে হয়
    অমৃতের পাত্র যেন আমার হৃদয়--
    যেন সে মিটাতে পারে এ বিশ্বের ক্ষুধা,
    যেন সে ঢালিতে পারে সান্ত্বনার সুধা
    যত দুঃখ যেথা আছে সকলের 'পরে
    অনন্ত প্রবাহে। দেখো দেখো নীলাম্বরে
    মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ পেয়েছে প্রকাশ।
    কী বৃহৎ লোকালয়, কী শান্ত আকাশ--
    এক জ্যোৎস্না বিস্তারিয়া সমস্ত জগৎ
    কে নিল কুড়ায়ে বক্ষে-- ওই রাজপথ,
    ওই গৃহশ্রেণী, ওই উদার মন্দির--
    স্তব্ধচ্ছায়া তরুরাজি--দূরে নদীতীর,
    বাজিছে পূজার ঘন্টা-- আশ্চর্য পুলকে
    পুরিছে আমার অঙ্গ, জল আসে চোখে।
    কোথা হতে এনু আমি, আজি জ্যোৎস্নালোকে
    তোমাদের এ বিস্তীর্ণ সর্বজনলোকে।
    চারুদত্ত।
       তুমি বিশ্বদেবী।
    সোমাচার্য।
                     ধিক্‌ পাপ-রসনায়!  
    শত ভাগে ফাটিয়া গেল না বেদনায়--
    চাহিল তোমার নির্বাসন!  
    দেবদত্ত।
                               চলো সবে
    বিপ্রগণ, জননীরে জয়জয়রবে
    রেখে আসি রাজগৃহে।
    সমবেত কণ্ঠে।                           জয় জননীর!
    জয় মা লক্ষ্ণীর! জয় করুণাময়ীর!
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    ক্ষেমংকর।
     দূর হোক, মোহ দূর হোক! কোথা যাও
    হে সুপ্রিয়?
    সুপ্রিয়।
                   ছেড়ে দাও, মোরে ছেড়ে দাও।
    ক্ষেমংকর।
     স্থির হও। তুমিও কি, বন্ধু, অন্ধভাবে
    জনস্রোতে সর্বসাথে ভেসে চলে যাবে?
    সুপ্রিয়।
         এ কি স্বপ্ন ক্ষেমংকর?
    ক্ষেমংকর।
                             স্বপ্নে মগ্ন ছিলে
    এতক্ষণ-- এখন সবলে চক্ষু মেলে
    জেগে চেয়ে দেখো।
    সুপ্রিয়।
                            মিথ্যা তব স্বর্গধাম,
    মিথ্যা দেবদেবী, ক্ষেমংকর-- ভ্রমিলাম
    বৃথা এ সংসারে এতকাল। পাই নাই
    কোনো তৃপ্তি কোনো শাস্ত্রে, অন্তর সদাই
    কেঁদেছে সংশয়ে। আজ আমি লভিয়াছি
    ধর্ম মোর, হৃদয়ের বড়ো কাছাকাছি।
    সবার দেবতা তব, শাস্ত্রের দেবতা--
    আমার দেবতা নহে। প্রাণ তার কোথা,
    আমার অন্তরমাঝে কই কহে কথা,
    কী প্রশ্নের দেয় সে উত্তর-- কী ব্যথার
    দেয় সে সান্ত্বনা! আজি তুমি কে আমার
    জীবনতরণী-'পরে রাখিলে চরণ
    সমস্ত জড়তা তার করিয়া হরণ
    একি গতি দিলে তারে!  এতদিন পরে
    এ মর্তধরণীমাঝে মানবের ঘরে
    পেয়েছি দেবতা মোর।
    ক্ষেমংকর।
                           হায় হায় সখে,
    আপন হৃদয় যবে ভুলায় কুহকে
    আপনারে, বড়ো ভয়ংকর সে সময়--
    শাস্ত্র হয় ইচ্ছা আপনার, ধর্ম হয়
    আপন কল্পনা। এই জ্যোৎস্নাময়ী নিশি
    যে সৌন্দর্যে দিকে দিকে রহিয়াছে মিশি
    ইহাই কি চিরস্থায়ী? কাল প্রাতঃকালে
    শতলক্ষ ক্ষুধাগুলা শতকর্মজালে
    ঘিরিবে না ভবসিন্ধু-- মহাকোলাহলে
    হবে না কঠিন রণ বিশ্বরণস্থলে?
    তখন এ জ্যোৎস্নাসুপ্তি স্বপ্নমায়া বলে
    মনে হবে, অতি ক্ষীণ, অতি ছায়াময়।
    যে সৌন্দর্যমোহ তব ঘিরেছে হৃদয়
    সেও সেই জোৎস্নাসম-- ধর্ম বল তারে?
    এক বার চক্ষু মেলি চাও চারি ধারে
    কত দুঃখ, কত দৈন্য, বিকট নিরাশা!
    ওই ধর্মে মিটাইবে মধ্যাহ্নপিপাসা
    তৃষ্ঞাতুর জগতের? সংসারের মাঝে
    ওই তব ক্ষীণ মোহ লাগিবে কী কাজে?
    খররৌদ্রে দাঁড়াইয়া রণরঙ্গভূমে
    তখনো কি মগ্ন হয়ে রবে এই ঘুমে,
    ভুলে রবে স্বপ্নধর্মে-- আর কিছু নাহি?
    নহে সখে!
    সুপ্রিয়।
                    নহে নহে।
    ক্ষেমংকর।
                          তবে দেখো চাহি
    সম্মুখে তোমার। বন্ধু, আর রক্ষা নাই।
    এবার লাগিল অগ্নি। পুড়ে হবে ছাই
    পুরাতন অট্টালিকা, উন্নত উদার,
    সমস্ত ভারতখণ্ড কক্ষে কক্ষে যার
    হয়েছে মানুষ।-- এখনো যে দু নয়নে
    স্বপ্ন লেগে আছে তব!
    খাণ্ডবদহনে
    সমস্ত বিহঙ্গকুল গগনে গগনে
    উড়িয়া ফিরিয়াছিল করুণ ক্রন্দনে
    স্বর্গ সমাচ্ছন্ন করি, বক্ষে রক্ষণীয়
    অক্ষম শাবকগণে স্মরি। হে সুপ্রিয়,
    সেইমতো উদ্‌বেগ-অধীর পিতৃকুল
    নানা স্বর্গ হতে আসি আশঙ্কাব্যাকুল
    ফিরিছেন ্‌শূন্যে শূন্যে আর্ত কলস্বরে
    আসন্নসংকটাতুর ভারতের 'পরে।--
    তবু স্বপ্নে মগ্ন সখে!
    দেখো মনে স্মরি,
    আর্যধর্মমহাদুর্গ এ তীর্থনগরী
    পুণ্য কাশী। দ্বারে হেথা কে আছে প্রহরী?
    সে কি আজ স্বপ্নে রবে কর্তব্য পাসরি
    শত্রু যবে সমাগত, রাত্রি অন্ধকার,
    মিত্র যবে গৃহদ্রোহী, পৌর পরিবার
    নিশ্চেতন। হে সুপ্রিয়, তুলে চাও আঁখি।
    কথা কও। বলো তুমি, আমারে একাকী
    ফেলিয়া কি চলে যাবে মায়ার পশ্চাতে
    বিশ্বব্যাপী এ দুর্যোগে, প্রলয়ের রাতে?
    সুপ্রিয়।
         কভু নহে, কভু নহে। নিদ্রাহীন চোখে
    দাঁড়াইব পার্শ্বে তব।
    ক্ষেমংকর।
                         শুন তবে, সখে,
    আমি চলিলাম।
    সুপ্রিয়।
                       কোথা যাবে?
    ক্ষেমংকর।
                                 দেশান্তরে।
    হেথা কোনো আশা নাই আর। ঘরে পরে
    ব্যাপ্ত হয়ে গেছে বহ্নি। বাহির হইতে
    রক্তস্রোত মুক্ত করি হবে নিবাইতে।
    যাই, সৈন্য আনি।
    সুপ্রিয়।
                           হেথাকার সৈন্যগণ
    রয়েছে প্রস্তুত।
    ক্ষেমংকর।
                    মিথ্যা আশা। এতক্ষণ
    মুগ্ধ পঙ্গপালসম তারাও সকলে
    দগ্ধপক্ষ পড়িয়াছে সর্ব দলেবলে
    হুতাশনে। জয়ধ্বনি ওই শুনা যায়।
    উন্মত্তা নগরী আজি ধর্মের চিতায়
    জ্বালায় উৎসবদীপ।
    সুপ্রিয়।
                           যদি যাবে ভাই,
    প্রবাসে কঠিন পণে, আমি সঙ্গে যাই।
    ক্ষেমংকর।
     তুমি কোথা যাবে বন্ধু? তুমি হেথা থেকো
    সদা সাবধানে; সকল সংবাদ রেখো
    রাজভবনের। লিখো পত্র। দেখো সখে,
    তুমিও ভুলো না শেষে নূতন কুহকে,
    ছেড়ো না আমায়। মনে রেখো সর্বক্ষণ
    প্রবাসী বন্ধুরে।
    সুপ্রিয়।
                       সখে, কুহক নূতন,
    আমি তো নূতন নহি। তুমি পুরাতন
    আর আমি পুরাতন।
    ক্ষেমংকর।
                          দাও আলিঙ্গন।
    সুপ্রিয়।
         প্রথম বিচ্ছেদ আজি। ছিনু চিরদিন
    এক সাথে। বক্ষে বক্ষে বিরহবিহীন
    চলেছিনু দোঁহে--আজ তুমি কোথা যাবে,
    আমি কোথা রব।
    ক্ষেমংকর।
                      আবার ফিরিয়া পাবে
    বন্ধুরে তোমার। শুধু মনে ভয় হয়
    আজি বিপ্লবের দিন বড়ো দুঃসময়--
    ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ধ্রুব বন্ধচয়,
    ভ্রাতারে আঘাত করে ভ্রাতা, বন্ধু হয়
    বন্ধুর বিরোধী। বাহিরিনু অন্ধকারে,
    অন্ধকারে ফিরিয়া আসিব গৃহদ্বারে--
    দেখিব কি দীপ জ্বালি বসি আছ ঘরে
    বন্ধু মোর? সেই আশা রহিল অন্তরে।

    তৃতীয় দৃশ্য

    অন্তঃপুরে মহিষী
    মহিষী।
         এখানেও নাই! মা গো, কী হবে আমার!
    কেবলি এমন করে কতদিন আর
    চোখে চোখে রাখি তারে, ভয়ে ভয়ে থাকি,
    রজনীতে ঘুম ভেঙে নাম ধ'রে ডাকি,
    জেগে জেগে উঠি। চোখের আড়াল হলে
    মনে শঙ্কা হয়, কোথা গেল বুঝি চলে
    আমার সে স্বপ্নস্বরূপিণী। যাই, খুঁজি,
    কোথা সে লুকায়ে আছে।  
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    যুবরাজের সহিত রাজার প্রবেশ
    রাজা।
                                   অবশেষে বুঝি
    দিতে হল নির্বাসন।  
    যুবরাজ।                               না দেখি উপায়।
    ত্বরা যদি নাহি কর রাজ্য তবে যায়
    মহারাজ। সৈন্যগণ নগরপ্রহরী
    হয়েছে বিদ্রোহী। স্নেহমোহ পরিহরি
    কর্তব্য সাধন করো-- দাও মালিনীরে
    অবিলম্বে নির্বাসন।
    রাজা।
                             ধীরে, বৎস, ধীরে।
    দিব তারে নির্বাসন,পুরাব প্রার্থনা,
    সাধিব কর্তব্য মোর। মনে করিয়ো না
    বৃদ্ধ আমি মোহমুগ্ধ, অন্তর দুর্বল,
    রাজধর্ম তুচ্ছ করি ফেলি অশ্রুজল।
    মহিষীর পুনঃপ্রবেশ
    মহিষী।
          মহারাজ, মহারাজ, বলো সত্য করে
    কোথা লুকায়েছ তারে কাঁদাইতে মোরে?
    কোথায় সে?
    রাজা।
                      কে মহিষী?
    মহিষী।
                                মালিনী আমার।
    রাজা।
          কোথায় সে? চলে গেছে? নাই ঘরে তার?  
    মহিষী।
        ওগো, নাই। যাও তুমি সৈন্যদল ল'য়ে
    খোঁজো তারে পথে পথে আলয়ে আলয়ে,
    করো ত্বরা। ওগো,তারে করিয়াছে চুরি
    তোমার প্রজারা মিলে। নিষ্ঠুর চাতুরী
    তাহাদের। দূর করে দাও সর্বজনে।
    শূন্য করে দাও এ নগরী, যতক্ষণে
    ফিরে নাহি দেয় মালিনীরে।
    রাজা।
                                    গেছে চলে?
    প্রতিজ্ঞা করিনু আমি ফিরাইব কোলে
    কোলের কন্যারে মোর। রাজ্যে ধিক্‌ থাক্‌।
    ধিক্‌ ধর্মহীন রাজনীতি। ডাক্‌, ডাক্‌
    সৈন্যদলে।
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    মালিনীকে লইয়া সৈন্যগণ ও প্রজাগণের মশাল ও সমারোহ সহকারে প্রবেশ
    ব্রাহ্মণগণ।
                  জয় জয় শুভ্র পুণ্যরাশি,
    বিগ্রহিণী দয়া।
    ছুটিয়া গিয়া
    মহিষী।
                       ওমা, ওমা, সর্বনাশী,
    ও রাক্ষসী মেয়ে, আমার হৃদয়বাসী
    নির্দয় পাষাণী, এক পল করি না গো
    বুকের বাহির-- তবু ফাঁকি দিয়ে, মা গো,
    কোথা গিয়েছিলি?
    প্রজাগণ।                             কোরো না গো তিরস্কার
    মহারানী! আমাদের ঘরে একবার
    গিয়েছিল আমাদের মাতা।
    চারুদত্ত।
                                কেহ নই
    আমরা কি ওগো রানী? দেবী দয়াময়ী
    শুধু তোমাদেরি?
    দেবদত্ত।
                         ফিরে তো এনেছি পুন
    পুণ্যবতী প্রাসাদলক্ষ্ণীরে।
    সোমাচার্য।
                             মা গো, শুন,
    আমাদের ভুলিয়ো না আর। মাঝে মাঝে
    শুনি যেন শ্রীমুখের বাণী, শুভকাজে
    পাই আশীর্বাদ, তা হলে পরান-তরী
    পথ পাবে পারাবারে-- ধ্রুবতারা ধরি
    যাবে মুক্তিপারে।
    মালিনী।
                         তোমরা যেয়ো না দূরে
    এসেছ যাহারা।  প্রতিদিন রাজপুরে
    দেখা দিয়ে যেয়ো। সকলেরে এনো ডাকি,
    সবারে দেখিতে চাহি আমি। হেথা থাকি
    রব আমি তোমাদেরি ঘরে পুরবাসী।
    সকলে।
         মোরা আজি ধন্য সবে, ধন্য আজি কাশী।
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    মালিনী।
        ওগো পিতা, আজ আমি হয়েছি সবার।
    কী আনন্দ উচ্ছ্বসিল, জয়জয়কার
    উঠিল ধ্বনিয়া যবে সহস্র হৃদয়
    মুহূর্তে বিদীর্ণ করি।
    রাজা।
                              কী সৌন্দর্যময়
    আজিকার ছবি। সমুদ্রমন্থনে যবে
    লক্ষ্ণী উঠিলেন, তাঁরে ঘেরি কলরবে
    মাতিল উন্মাদনৃত্যে ঊর্মিগুলি সবে,
    সেইমতো উচ্ছ্বসিত জনপারাবার,
    মাঝে তুমি লোকলক্ষ্ণী মাতা।
    মালিনী।
                                     মা আমার,
    এ প্রাচীরে মোরে আর নারিবে লুকাতে।
    তব অন্তঃপুরে আমি আনিয়াছি সাথে
    সর্বলোক-- দেহ নাই মোর,বাধা নাই,
    আমি যেন এ বিশ্বের প্রাণ!
    মহিষী।
                                   থাক্‌ তাই,
    বিশ্বপ্রাণ হয়ে আপন করিয়া সবে
    থাক্‌ মার কাছে। বাহিরে যেতে না হবে,
    হেথা নিয়ে আয় তোর বৃহৎ সংসার--
    মাতা কন্যা দোঁহে মিলি সেবা করি তার।
    অনেক হয়েছে রাত, বোস্‌ মা এখানে,
    শান্ত করো আপনারে-- জ্বলিছে নয়ানে
    উদ্দীপ্ত প্রাণের জ্যোতি নিদ্রার আরাম
    দগ্ধ করি।  একটুকু করো, মা, বিশ্রাম।
    মাতাকে আলিঙ্গন করিয়া
    মালিনী।
        মা গো, শ্রান্ত এবে আমি। কাঁপিতেছে দেহ।
    কোথা গিয়েছিনু চলে ছাড়ি মার স্নেহ
    প্রকাণ্ড পৃথিবী-মাঝে! মা গো, নিদ্রা আন্‌
    চক্ষে মোর। ধীরে ধীরে কর্‌ তুই গান
    শিশুকালে শুনিতাম যাহা। আজি মোর
    চক্ষে আসিতেছে জল, বিষাদের ঘোর
    ঘনাইছে প্রাণে।
    মহিষী।
                        বসুগণ, রুদ্রগণ,
    বিশ্বদেবগণ, সবে করহ রক্ষণ
    কন্যারে আমার। মর্তলোক, স্বর্গলোক
    হও অনুকূল-- শুভ হোক, শুভ হোক
    কন্যার আমার। হে আদিত্য, হে পবন,
    করি প্রণিপাত, সর্ব দিক্‌পালগণ
    করো দূর মালিনীর সর্ব অকল্যাণ।--  
    দেখিতে দেখিতে আহা শ্রান্ত দু-নয়ান
    মুদিয়া এসেছে ঘুমে। আহা, মরে যাই!
    দূর হোক, দূর হোক সকল বালাই। --
    ভয়ে অঙ্গ কাঁপে মোর। কন্যার তোমার
    এ কী খেলা মহারাজ? সমস্ত সংসার
    খেলার সামগ্রী তার--তারে রেখে দিবে
    আপনার গৃহকোণে, ঘুম পাড়াইবে
    পদ্মহস্ত পরশিয়া ললাটে তাহার!
    অবাক হয়েছি দেখে কাণ্ড বালিকার।
    যেমন খেলেনাখানি, তেমনি এ খেলা।
    মহারাজ, সাবধান হও এই বেলা।
    নবধর্ম, নবধর্ম কারে বল তুমি!
    কে আনিল নবধর্ম, কোথা তার ভূমি
    আকাশকুসুম? কোন্‌ মত্ততার স্রোতে
    ভেসে এল--কন্যারে মায়ের কোল হতে
    টানিয়া লইয়া যায়--ধর্ম বলে তায়?
    তুমিও দিয়ো না যোগ কন্যার খেলায়
    মহারাজ। বলে দাও, গ্রহবিপ্রগণ
    করুক সকলে মিলে শান্তিস্বস্ত্যয়ন
    দেবার্চনা। স্বয়ম্বরসভা আনো ডেকে
    মালিনীর তরে। মনোমত বর দেখে
    খেলা ভেঙে যোগ্য কণ্ঠে দিক বরমালা--
    দূর হবে নবধর্ম, জুড়াইবে জ্বালা।

    চতুর্থ দৃশ্য

    রাজ-উপবন
    মালিনী পরিচারিকাবর্গ ও সুপ্রিয়
    মালিনী।
        হায়, কী বলিব! তুমিও কি মোর দ্বারে
    আসিয়াছ দ্বিজোত্তম? কী দিব তোমারে?
    কী তর্ক করিব? কী শাস্ত্র দেখাব আনি?
    তুমি যাহা নাহি জান আমি কি তা জানি?
    সুপ্রিয়।
         শাস্ত্রসাথে তর্ক করি, নহে তোমা-সনে।
    সভায় পণ্ডিত আমি, তোমার চরণে
    বালকের মতো। দেবী, লহো মোর ভার।
    যে পথে লইয়া যাবে জীবন আমার
    সাথে যাবে, সর্ব তর্ক করি পরিহার,
    নীরব ছায়ার মতো দীপবর্তিকার।
    মালিনী।
        হে ব্রাহ্মণ, চলে যায় সকল ক্ষমতা
    তুমি যবে প্রশ্ন কর, নাহি পাই কথা।
    বড়ই বিস্ময় লাগে মনে। হে সুপ্রিয়,
    মোর কাছে কী জানিতে এসেছ তুমিও?
    সুপ্রিয়।
          জানিবার কিছু নাই, নাহি চাহি জ্ঞান।
    সব শাস্ত্র পড়িয়াছি, করিয়াছি ধ্যান
    শত তর্ক শত মত। ভুলাও, ভুলাও,
    যত জানি সব জানা দূর করে দাও।
    পথ আছে শতলক্ষ, শুধু আলো নাই
    ওগো দেবী জ্যোতির্ময়ী-- তাই আমি চাই
    একটি আলোর রেখা উজ্জ্বল সুন্দর
    তোমার অন্তর হতে।
    মালিনী।
                            হায় বিপ্রবর,
    যত তুমি চাহিতেছ আমি যেন তত
    আপনারে হেরিতেছি দরিদ্রের মতো।
    যে দেবতা মর্মে মোর বজ্রালোক হানি
    বলেছিল একদিন বিদ্যুন্ময়ী বাণী
    সে আজি কোথায় গেল। সেদিন, ব্রাহ্মণ,
    কেন তুমি আসিলে না? কেন এতক্ষণ
    সন্দেহে রহিলে দূরে? বিশ্বে বাহিরিয়া
    আজি মোর জাগে ভয়, কেঁপে ওঠে হিয়া,
    কী করিব কী বলিব বুঝিতে না পারি--
    মহাধর্মতরণীর বালিকা কাণ্ডারী
    নাহি জানি কোথা যেতে হবে। মনে হয়
    বড়ো একাকিনী আমি-- সহস্র সংশয়,
    বৃহৎ সংসার, অসংখ্য জটিল পথ,
    নানা প্রাণী--দিব্যজ্ঞান ক্ষণপ্রভাবৎ
    ক্ষণিকের তরে আসে। তুমি মহাজ্ঞানী
    হবে কি সহায় মোর?
    সুপ্রিয়।
                             বহু ভাগ্য মানি
    যদি চাহ মোরে।
    মালিনী।
                         মাঝে মাঝে নিরুৎসাহ
    রুদ্ধ করে দেয় যেন প্রাণের প্রবাহ--
    পীড়ন করিতে থাকে নিরুদ্ধ নিশ্বাসে,
    থেকে থেকে অকারণ অশ্রুজলে ভাসে
    দু-নয়ন কোন্‌ বেদনায়। অকস্মাৎ
    আপনার 'পরে যেন পড়ে দৃষ্টিপাত
    সহস্র লোকের মাঝে, সেই দুঃসময়ে
    তুমি মোর বন্ধু হবে? মন্ত্রগুরু হয়ে
    দিবে নবপ্রাণ?
    সুপ্রিয়।
                       প্রস্তুত রাখিব নিত্য
    এ ক্ষুদ্র জীবন। আমার সকল চিত্ত
    সবল নির্মল করি, বুদ্ধি করি শান্ত,
    সমর্পণ করি দিব নিয়ত একান্ত
    তব কাজে।
    প্রতিহারীর প্রবেশ
    প্রতিহারী।
                     প্রজাগণ দরশন যাচে।
    মালিনী।
        আজ নহে, আজ নহে। সকলের কাছে
    মিনতি আমার; আজি  মোর কিছু নাহি।
    রিক্ত চিত্ত মাঝে মাঝে ভরিবারে চাহি--
    বিশ্রাম প্রার্থনা করি ঘুচাতে জড়তা।    
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    সুপ্রিয়ের প্রতি
    যে কথা শুনাতেছিলে কহ সেই কথা,
    আপন কাহিনী। শুনিয়া বিস্ময় লাগে,
    নূতন বারতা পাই, নবদৃশ্য জাগে
    চক্ষে মোর। তোমাদের সুখদুঃখ যত,
    গৃহের বারতা সব, আত্মীয়ের মতো
    সকলি প্রত্যক্ষ যেন জানিবারে পাই।
    ক্ষেমংকর বান্ধব তোমার?
    সুপ্রিয়।
                                  বন্ধু, ভাই,
    প্রভু। সূর্য সে আমার, আমি তার রাহু,
    আমি তার মহামোহ। বলিষ্ঠ সে বাহু,
    আমি তাহে লৌহপাশ। বাল্যকাল হতে
    দৃঢ় সে অটলচিত্ত, সংশয়ের স্রোতে
    আমি ভাসমান। তবু সে নিয়ত মোরে
    বন্ধুমোহে বক্ষোমাঝে রাখিয়াছে ধরে
    প্রবল অটল প্রেমপাশে, নিঃসন্দেহে
    বিনা পরিতাপে, চন্দ্রমা যেমন স্নেহে
    সহাস্যে বহন করে কলঙ্ক অক্ষয়
    অনন্ত ভ্রমণপথে। ব্যর্থ নাহি হয়
    বিধির নিয়ম কভু-- লৌহময় তরী
    হোক না যতই দৃঢ়, যদি রাখে ধরি
    বক্ষতলে ক্ষুদ্র ছিদ্রটিরে, এক দিন
    সংকটসমুদ্রমাঝে উপায়বিহীন
    ডুবিতে হইবে তারে। বন্ধু চিরন্তন,
    তোমারে ডুবাব আমি, ছিল এ লিখন।
    মালিনী।
        ডুবায়েছ তারে?
    সুপ্রিয়।
                        দেবী, ডুবায়েছি তারে।
    জীবনের সব কথা বলেছি তোমারে,
    শুধু, সেই কথা আছে বাকি।
        যেই দিন
    বিদ্বেষ উঠিল গর্জি দয়াধর্মহীন
    তোমারে ঘেরিয়া চারি দিকে, একাকিনী
    দাঁড়াইয়া পূর্ণ মহিমায়, কী রাগিণী
    বাজাইলে! বংশীরবে যেন মন্ত্রাহত
    বিদ্রোহ করিল আসি ফণা অবনত
    তব পদতলে। শুধু বিপ্র ক্ষেমংকর
    রহিল পাষাণচিত্ত, অটল-অন্তর।
    একদা ধরিয়া কর কহিল সে মোরে
    "বন্ধু, আমি চলিলাম দূর দেশান্তরে।
    আনিয়া বিদেশী সৈন্য বরুণার কূলে
    নবধর্ম উৎপাটন করিব সমূলে
    পুণ্য কাশী হতে।' চলি গেল রিক্ত হাতে
    অজ্ঞাত ভুবনে। শুধু লয়ে গেল সাথে
    আমার হৃদয়, আর, প্রতিজ্ঞা কঠোর।
    তার পরে জান তুমি কী ঘটিল মোর।
    লভিলাম যেন আমি নবজন্মভূমি
    যেদিন এ শুষ্ক চিত্তে বরষিলে তুমি
    সুধাবৃষ্টি। "সর্ব জীবে দয়া' জানে সবে,
    অতি পুরাতন কথা-- তবু এই ভবে
    এই কথা বসি আছে লক্ষবর্ষ ধরি
    সংসারের পরতীরে। তারে পার করি
    তুমি আজি আনিয়াছ সোনার তরীতে
    সবার ঘরের দ্বারে। হৃদয়-অমৃতে
    স্তন্যদান করিয়াছ সে দেবশিশুরে,
    লয়েছে সে নবজন্ম মানবের পুরে
    তোমারে মা ব'লে। স্বর্গ আছে কোন্‌ দূরে,
    কোথায় দেবতা-- কে বা সে সংবাদ জানে
    শুধু জানি বলি দিয়া আত্ম-অভিমানে
    বাসিতে হইবে ভালো, বিশ্বের বেদনা
    আপন করিতে হবে-- যে কিছু বাসনা
    শুধু আপনার তরে তাই দুঃখময়।
    যজ্ঞে যাগে তপস্যায় কভু মুক্তি নয়,
    মুক্তি শুধু  বিশ্বকাজে। ফিরে গিয়ে ঘরে
    সে নিশীথে কাঁদিয়া কহিনু উচ্চস্বরে,
    "বন্ধু, বন্ধু, কোথা গেছ বহু বহু দূরে--
    অসীম ধরণীতলে মরিতেছ ঘুরে!'
    ছিনু তার পত্র-আশে-- পত্র নাহি পাই,
    না জানি সংবাদ। আমি শুধু আসি যাই
    রাজগৃহমাঝে, চারি দিকে দৃষ্টি রাখি,
    শুধাই বিদেশীজনে, ভয়ে ভয়ে থাকি--
    নাবিক যেমন দেখে চকিত নয়নে
    সমুদ্রের মাঝে, গগনের কোন্‌ কোণে
    ঘনাইছে ঝড়। এল ঝড় অবশেষে
    একখানি ছোটো পত্ররূপে! লিখেছে সে--
    রত্নবতী নগরীর রাজগৃহ হতে
    সৈন্য লয়ে আসিছে সে শোণিতের স্রোতে
    ভাসাইতে নবধর্ম, ভিড়াইতে তীরে
    পিতৃধর্ম  মগ্নপ্রায়, রাজকুমারীরে
    প্রাণদণ্ড দিতে। প্রচণ্ড আঘাতে সেই
    ছিঁড়িল প্রাচীন পাশ এক নিমেষেই।
    রাজারে দেখানু পত্র। মৃগয়ার ছলে
    গোপনে গেছেন রাজা সৈন্যদলবলে
    আক্রমিতে তারে। আমি হেথা লুটাতেছি
    পৃথ#aলে-- আপনার মর্মে ফুটাতেছি
    দন্ত আপনার।
    মালিনী।
                     হায়, কেন তুমি তারে
    আসিতে দিলে না হেথা মোর গৃহদ্বারে
    সৈন্যসাথে? এ ঘরে সে প্রবেশিত আসি
    পূজ্য অতিথির মতো, সুচিরপ্রবাসী
    ফিরিত স্বদেশে তার।
    রাজার প্রবেশ
    রাজা।
                               এসো আলিঙ্গনে
    হে সুপ্রিয়!  গিয়েছিনু অনুকূল ক্ষণে
    বার্তা পেয়ে। বন্দী করিয়াছি ক্ষেমংকরে
    বিনাক্লেশে। তিলেক বিলম্ব হলে পরে
    সুপ্তরাজগৃহশিরে বজ্র ভয়ংকর
    পড়িত ঝঞ্ঝনি, জাগিবার অবসর
    পেতেম না কভু। এসো আলিঙ্গনে মম
    বান্ধব, আত্মীয় তুমি।
    সুপ্রিয়।
                             ক্ষম মোরে ক্ষম
    মহারাজ!
    রাজা।
                    শুধু নহে শূন্য আত্মীয়তা
    প্রিয়বন্ধু! মনে আনিয়ো না হেন কথা
    শুধু রাজ-আলিঙ্গনে পুরস্কার তব।
    কী ঐশ্বর্য চাহ? কী সম্মান অভিনব
    করিব সৃজন তোমাতরে? কহো মোরে!
    সুপ্রিয়।
         কিছু নহে, কিছু নহে, খাব ভিক্ষা করে
    দ্বারে দ্বারে।
    রাজা।
                     সত্য কহো, রাজ্যখণ্ড লবে?
    সুপ্রিয়।
         রাজ্যে ধিক্‌ থাক্‌।
    রাজা।
                            অহো, বুঝিলাম তবে
    কোন্‌ পণ চাহ জিনিবারে, কোন্‌ চাঁদ
    পেতে চাও হাতে। ভালো, পুরাইব সাধ,
    দিলাম অভয়। কোন্‌ অসম্ভব আশা
    আছে মনে, খুলে বলো। কোথা গেল ভাষা!
    বেশি দিন নহে, বিপ্র, সে কি মনে পড়ে
    এই কন্যা মালিনীর নির্বাসনতরে
    অগ্রবর্তী ছিলে তুমি। আজি আরবার
    করিবে কি সে প্রার্থনা? রাজদুহিতার
    নির্বাসন পিতৃগৃহ হতে? সাধনার
    অসাধ্য কিছুই নাই--বাঞ্ছা সিদ্ধ হবে,
    ভরসা বাঁধহ বক্ষোমাঝে। শুন তবে--
    জীবনপ্রতিমে, বৎসে, যে তোমার প্রাণ
    রক্ষা করিয়াছে, সেহ বিপ্র গুণবান্‌
    সুপ্রিয় সবার প্রিয়, প্রিয়দরশন,
    তারে--
    সুপ্রিয়।
                 ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও হে রাজন্‌!
    অয়ি দেবী,আজন্মের ভক্তি-উপহারে
    পেয়েছে আপন ঘরে ইষ্টদেবতারে
    কত অকিঞ্চন-- তেমনি পেতেম যদি
    আমার দেবীরে, রহিতাম নিরবধি
    ধন্য হয়ে। রাজহস্ত হতে পুরস্কার!
    কী করেছি? আশৈশব বন্ধুত্ব আমার
    করেছি বিক্রয়, আজি তারি বিনিময়ে
    লয়ে যাব শিরে করি আপন আলয়ে
    পরিপূর্ণ সার্থকতা? তপস্যা করিয়া
    মাগিব পরমসিদ্ধি জন্মান্ত ধরিয়া--
    জন্মান্তরে পাই যদি তবে তাই হোক--
    বন্ধুর বিশ্বাস ভাঙি সপ্ত স্বর্গলোক
    চাহি না লভিতে।  পূর্ণকাম তুমি দেবী,
    আপনার অন্তরের মহত্ত্বেরে সেবি
    পেয়েছ অনন্ত শান্তি-- আমি দীনহীন
    পথে পথে ফিরে মরি অদৃষ্ট-অধীন
    শ্রান্ত নিজভারে। আর কিছু চাহিব না--
    দিতেছ নিখিলময় যে শুভকামনা
    মনে করে অভাগারে তারি এক কণা
    দিয়ো মনে মনে।
    মালিনী।
                        ওরে রমণীর মন,
    কোথা বক্ষোমাঝে বসে করিস ক্রন্দন
    মধ্যাহ্নে নির্জন নীড়ে প্রিয়বিরহিতা
    কপোতীর প্রায়?-- কী করেছ বলো পিতা
    বন্দীর বিচার?
    রাজা।
                         প্রাণদণ্ড হবে তার।
    মালিনী।
        ক্ষমা করো--একান্ত এ প্রার্থনা আমার
    তব পদে।
    রাজা।
                    রাজদ্রোহী, ক্ষমিব তাহারে
    বৎসে?
    সুপ্রিয়।
                 কে কার বিচার করে এ সংসারে!
    সে কি চেয়েছিল তব সসাগরা মহী
    মহারাজ? সে জানিত তুমি ধর্মদ্রোহী,
    তাই সে আসিতেছিল তোমার বিচার
    করিতে আপন বলে। বেশি বল যার
    সেই বিচারক। সে যদি জিনিত আজি
    দৈবক্রমে, সে বসিত বিচারক সাজি,
    তুমি হতে অপরাধী!
    মালিনী।
                            রাখো প্রাণ তার
    মহারাজ!  তার পরে স্মরি উপকার
    হিতৈষী বন্ধুরে তব যাহা ইচ্ছা দিয়ো,
    লবে সে আদর করি।
    রাজা।
                              কী বল সুপ্রিয়?
    বন্ধুরে করিব বন্ধুদান?
    সুপ্রিয়।
                             চিরদিন
    স্মরণে রহিবে তব অনুগ্রহ-ঋণ
    নরপতি।
    রাজা।
                    কিন্তু তার পূর্বে এক বার
    দেখিব পরীক্ষা করি বীরত্ব তাহার।
    দেখিব মরণভয়ে টলে কি না টলে
    কর্তব্যের বল। মহত্ত্বের শিখা জ্বলে
    নক্ষত্রের মতো-- দীপ নিবে যায় ঝড়ে,
    তারা নাহি নিবে। সে কথা হইবে পরে।
    তোমার বন্ধুরে তুমি পাবে, মাঝখানে
    উপলক্ষ আমি।  সে দানে তৃপ্তি না মানে
    মন। আরো দিব। পুরস্কার ব'লে নয়--
    রাজার হৃদয় তুমি করিয়াছ জয়,
    সেথা হতে লহ তুলি রত্ন সর্বোত্তম
    হৃদয়ের।-- কন্যা, কোথা ছিল এ শরম
    এতদিন! বালিকার লজ্জাভয়শোক
    দূর করি দীপ্তি পেত অম্লান আলোক
    দুঃসহ উজ্জ্বল। কোথা হতে এল আজ
    অশ্রুবাষ্পে ছলছল কম্পমান লাজ--
    যেন দীপ্ত হোমহুতাশনশিখা ছাড়ি
    সদ্য বাহিরিয়া এল স্নিগ্ধসুকুমারী
    দ্রুপদদুহিতা।  
    সুপ্রিয়ের প্রতি
    উঠ, ছাড়ো পদতল।
    বৎস, বক্ষে এস। সুখ করিছে বিহ্বল
    দুর্ভর দুঃখেরই মতো। দাও অবসর,
    হেরি প্রাণপ্রতিমার মুখশশধর
    বিরলে আনন্দভরে শুধু ক্ষণকাল।
    [ উভয়ের প্রস্থান ]
    স্বগত
    বহুদিন পরে মোর মালিনীর ভাল
    লজ্জার আভায় রাঙা। কপোল উষার
    যখনি রাঙিয়া উঠে, বুঝা যায়, তার
    তপন উদয় হতে দেরি নাই আর।
    এ রাঙা আভাস দেখে আনন্দে আমার
    হৃদয় উঠিছে ভরি ; বুঝিলাম মনে
    আমাদের কন্যাটুকু বুঝি এতক্ষণে
    বিকশি উঠিল--দেবী না রে, দয়া না রে,
    ঘরের সে মেয়ে।
    প্রতিহারীর  প্রবেশ
    প্রতিহারী।
                      জয় মহারাজ, দ্বারে
    উপনীত বন্দী ক্ষেমংকর।
    রাজা।
                                  আনো তারে।
    শৃঙ্খলবদ্ধ ক্ষেমংকরের প্রবেশ
    নেত্র স্থির, ঊর্ধ্বশির, ভ্রূকুটির 'পরে
    ঘনায়ে রয়েছে ঝড়, হিমাদ্রিশিখরে
    স্তম্ভিত শ্রাবণসম।
    মালিনী।
                         লোহার শৃঙ্খল
    ধিক্কার মানিছে যেন লজ্জায় বিকল
    ওই অঙ্গ-'পরে। মহত্ত্বের অপমান
    মরে অপমানে। ধন্য মানি এ পরান
    ইন্দ্রতুল্য হেন মুর্তি হেরি।
    বন্দির প্রতি
    রাজা।
                                    কী বিধান
    হয়েছে শুনেছ?
    ক্ষেমংকর।
                    মৃত্যুদণ্ড।
    রাজা।
                                    যদি প্রাণ
    ফিরে দিই, যদি ক্ষমা করি!
    ক্ষেমংকর।
                               পুনর্বার
    তুলিয়া লইতে হবে কর্তব্যের ভার--
    যে পথে চলিতেছিনু আবার সে পথে
    যেতে হবে।
    রাজা।
                     বাঁচিতে চাহ না কোনোমতে!
    ব্রাহ্মণ, প্রস্তুত হও মমতা তেয়াগি
    জীবনের। এই বেলা লহ তবে মাগি
    প্রার্থনা যা-কিছু থাকে।
    ক্ষেমংকর।
                             আর কিছু নাহি
    বন্ধু সুপ্রিয়েরে শুধু দেখিবারে চাহি।
    প্রতিহারীর প্রতি
    রাজা।
           ডেকে আনো তারে।
    মালিনী।
                             হৃদয় কাঁপিছে বুকে।
    কী যেন পরমা শক্তি আছে ওই মুখে
    বজ্রসম ভয়ংকর। রক্ষা করো পিতঃ,
    আনিয়ো না সুপ্রিয়েরে।
    রাজা।
                                 কেন, মা, শঙ্কিত
    অকারণে? কোনো ভয় নাই।
    ক্ষেমংকরের নিকট সুপ্রিয়ের আগমন
     আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যান করিয়া
    ক্ষেমংকর।
                                 থাক্‌ থাক্‌
    যাহা বলিবার আছে  আগে হয়ে যাক--
    পরে হবে প্রণয়সম্মান। এসো হেথা।
    জান সখে, বাক্যদীন আমি-- বেশি কথা
    জোগায় না মুখে। সময় অধিক নাই,
    আমার বিচার হল শেষ--আমি চাই
    তোমার বিচার এবে। বলো মোর কাছে
    এ কাজ করেছ কেন?
    সুপ্রিয়।
                             বন্ধু এক আছে
    শ্রেষ্ঠতম, সে আমার আত্মার নিশ্বাস,
    সব ছেড়ে রাখিয়াছি তাহারি বিশ্বাস
    প্রাণসখে--ধর্ম সে আমার।
    ক্ষেমংকর।
                               জানি জানি
    ধর্ম কে তোমার। ওই স্তব্ধ মুখখানি
    অন্তর্জ্যোতির্ময়,মূর্তিমতী,  দৈববাণী
    রাজকন্যারূপে-- চতুর্বেদ হতে, সখে,
    কেড়ে লয়ে পিতৃধর্ম ওই নেত্রালোকে
    দিয়েছ আহুতি তুমি। ধর্ম ওই তব।
    ওই প্রিয়মুখে তুমি রচিয়াছ নব
    ধর্মশাস্ত্র আজি।
    সুপ্রিয়।
                         সত্য বুঝিয়াছ সখে।
    মোর ধর্ম অবতীর্ণ দীন মর্ত্যলোকে
    ওই নারীমূর্তি ধরি। শাস্ত্র এতদিন
    মোর কাছে ছিল অন্ধ জীবনবিহীন ;
    ওই দুটি নেত্রে জ্বলে যে উজ্জ্বল শিখা
    সে আলোকে পড়িয়াছি বিশ্বশাস্ত্রে লিখা--
    যেথা দয়া সেথা ধর্ম, যেথা প্রেমস্নেহ,
    যেথায় মানব, যেথা মানবের গেহ।
    বুঝিলাম, ধর্ম দেয় স্নেহ মাতারূপে,
    পুত্ররূপে স্নেহ লয় পুন; দাতারূপে
    করে দান, দীনরূপে করে তা গ্রহণ ;
    শিষ্যরূপে করে ভক্তি, গুরুরূপে করে
    আশীর্বাদ; প্রিয়া হয়ে পাষাণ-অন্তরে
    প্রেম-উৎস লয় টানি, অনুরক্ত হয়ে
    করে সর্বত্যাগ। ধর্ম বিশ্বলোকালয়ে
    ফেলিয়াছে চিত্তজাল, নিখিল ভুবন
    টানিতেছে প্রেমক্রোড়ে-- সে মহাবন্ধন
    ভরেছে অন্তর মোর আনন্দবেদনে
    চাহি ওই উষারুণ করুণ বদনে।
    ওই ধর্ম মোর।
    ক্ষেমংকর।
                     আমি কি দেখি নি ওরে?
    আমিও কি ভাবি নাই মুহূর্তের ঘোরে
    এসেছে অনাদি ধর্ম নারীমূর্তি ধরে
    কঠিন পুরুষমন কেড়ে নিয়ে যেতে
    স্বর্গপানে? ক্ষণতরে মুগ্ধ হৃদয়েতে
    জন্মে নি কি স্বপ্নাবেশ? অপূর্ব সংগীতে
    বক্ষের পঞ্জর মোর লাগিল কাঁদিতে
    সহস্র বংশীর মতো--সর্ব সফলতা
    জীবনের যৌবনের আশাকল্পলতা
    জড়ায়ে জড়ায়ে মোর অন্তরে অন্তরে
    মঞ্জরি উঠিল যেন পত্রপুষ্পভরে
    এক নিমেষের মাঝে। তবু কি সবলে
    ছিঁড়ি নি মায়ার বন্ধ, যাই নি কি চলে
    দেশে দেশে দ্বারে দ্বারে, ভিক্ষুকের মতো
    লই নি কি শিরে ধরি অপমান শত
    হীন হস্ত হতে--সহি নি কি অহরহ
    আজন্মের বন্ধু তুমি তোমার বিরহ?
    সিদ্ধি যবে লব্ধপ্রায়, তুমি হেথা বসে
    কী করেছ--রাজগৃহমাঝে সুখালসে
    কী ধর্ম মনের মতো করেছ সৃজন
    দীর্ঘ অবসরে!  
    সুপ্রিয়।
                      ওগো বন্ধু, এ ভুবন
    নহে কি বৃহৎ? নাই কি অসংখ্য জন,
    বিচিত্র স্বভাব? কাহার কী প্রয়োজন
    তুমি কি তা জান? গগনে অগণ্য তারা
    নিশিনিশি বিবাদ কি করিছে তাহারা
    ক্ষেমংকর? তেমনি জালায়ে নিজ জ্যোতি
    কত ধর্ম জাগিতেছে তাহে কোন্‌ ক্ষতি!
    ক্ষেমংকর।
     মিছে আর কেন বন্ধু। ফুরালো সময়,
    বাক্য লয়ে মিথ্যা খেলা, তর্ক আর নয়।
    সত্যমিথ্যা পাশাপাশি নির্বিরোধে রবে
    এত স্থান নাহি নাহি অনন্ত এ ভবে।
    অন্নরূপে ধান্য যেথা উঠে চিরদিন
    রোপিবে তাহারি মাঝে কন্টক নবীন,
    হে সুপ্রিয়, প্রেম এত সর্বপ্রেমী নয়।
    ছিল চিরদিবসের বিশ্রব্ধ প্রণয়,
    আনিবে বিশ্বাসঘাত বক্ষোমাঝে তার,
    বন্ধু মোর, উদারতা এত কি উদার!
    কেহ বা ধর্মের লাগি সহি নির্যাতন
    অকালে অস্থানে মরে চোরের মতন,
    কেহ বা ধর্মের ব্রত করিয়া নিষ্ফল
    বাঁচিবে সম্মানে সুখে, এ ধরণীতল
    হেন বিপরীত ধর্ম এক বক্ষে বহে--
    এত বড়ো এত দৃঢ় কভু নহে নহে।
    মালিনীর প্রতি ফিরিয়া
    সুপ্রিয়।
         হে দেবী, তোমারি জয়! নিজ পদ্মকরে
    যে পবিত্র শিখা তুমি আমার অন্তরে
    জ্বালায়েছ, আজি হল পরীক্ষা তাহার--
    তুমি হলে জয়ী। সর্ব অপমানভার
    সকল নিষ্ঠুরঘাত করিনু গ্রহণ।
    রক্ত উচ্ছ্বসিয়া উঠে উৎসের মতন
    বিদীর্ণ হৃদয় হতে-- তবু সমুজ্জ্বল
    তব শান্তি, তব প্রীতি, তব সুমঙ্গল
    অম্লান-অচল-দীপ্তি করিছে বিরাজ
    সর্বোপরি। ভক্তের পরীক্ষা হল আজ,
    জয় দেবী। ক্ষেমংকর, তুমি দিবে প্রাণ--
    আমার ধর্মের লাগি করিয়াছি দান
    প্রাণের অধিক প্রিয় তোমার প্রণয়,
    তোমার বিশ্বাস। তার কাছে প্রাণভয়
    তুচ্ছ শতবার।
    ক্ষেমংকর।
                     ছাড়ো এ প্রলাপবাণী।
    মৃত্যু যিনি তাঁহারেই ধর্মরাজ জানি--
    ধর্মের পরীক্ষা তাঁরি কাছে। বন্ধুবর,
    এস তবে কাছে এসো, ধরো মোর কর,
    চলো মোরা যাই সেথা দোঁহে এক সনে,
    যেমন সে বাল্যকালে-- সে কি পড়ে মনে,
    কতদিন সারারাত্রি তর্ক করি, শেষে
    প্রভাতে যেতেম দোঁহে গুরুর উদ্দেশে
    কে সত্য কে মিথ্যা তাহা করিতে নির্ণয়।
    তেমনি প্রভাত হোক। সকল সংশয়
    আজিকে লইয়া চলি অসংশয় ধামে,
    দাঁড়াই মৃত্যুর পাশে দক্ষিণে ও বামে
    দুই সখা, লয়ে দু জনের প্রশ্ন যত।
    সেথায় প্রত্যক্ষ সত্য উজ্জ্বল উন্নত--
    মুহূর্তে পর্বতপ্রায় বিচার-বিরোধ
    বাষ্পসম কোথা যাবে! দুইটি অবোধ
    আনন্দে হাসিব চাহি  দোঁহে দোঁহাকারে।
    সব চেয়ে বড়ো আজি মনে কর যারে
    তাহারে রাখিয়া দেখো মৃত্যুর সম্মুখে।
    সুপ্রিয়।
         বন্ধু, তাই হোক।
    ক্ষেমংকর।
                      এস তবে, এসো বুকে।
    বহুদূরে গিয়েছিলে এসো কাছে তবে
    যেথায় অনন্তকাল বিচ্ছেদ না হবে।
    লহো তবে বন্ধুহস্তে করুণ বিচার--
    এই লহ।
    শৃঙ্খল দ্বারা সুপ্রিয়ের মস্তকে আঘাত
     ও তাহার পতন
    সুপ্রিয়।
                     দেবী, তব জয়।
    [ মৃত্যু
    মৃতদেহের উপর পড়িয়া
    ক্ষেমংকর।
                                 এইবার
    ডাকো, ডাকো ঘাতকেরে।
    সিংহাসন ছাড়িয়া
    রাজা।
                                    কে আছিস ওরে!
    আন্‌ খড়্গ।
    মালিনী।
                    মহারাজ, ক্ষমো ক্ষেমংকরে।    
    [ মূর্ছিত
    •  
    •  

    Rendition

    Please Login first to submit a rendition. Click here for help.