১ বৈশাখ, ১৩৪৩


 

বারো (bosechhi oporahne parer kheyaghat)


বসেছি অপরাহ্নে পারের খেয়াঘাটে

                   শেষধাপের কাছটাতে ।

            কালো জল নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে পা ডুবিয়ে দিয়ে ।

   জীবনের পরিত্যক্ত ভোজের ক্ষেত্র পড়ে আছে পিছন দিকে

            অনেক দিনের ছড়ানো উচ্ছিষ্ট নিয়ে ।

মনে পড়ছে ভোগের আয়োজনে

                   ফাঁক পড়েছে বারম্বার ।

কতদিন যখন মূল্য ছিল হাতে

                   হাট জমে নি তখনো,

           বোঝাই নৌকো লাগল যখন ডাঙায়

তখন ঘণ্টা গিয়েছে বেজে,

            ফুরিয়েছে বেচাকেনার প্রহর ।

 

    অকালবসন্তে জেগেছিল ভোরের কোকিল;

       সেদিন তার চড়িয়েছি সেতারে,

                     গানে বসিয়েছি সুর ।

                           যাকে শোনাব তার চুল যখন হল বাঁধা,

                      বুকে উঠল জাফরানি রঙের আঁচল

                                তখন ঝিকিমিকি বেলা,

                    করুণ ক্লান্তি লেগেছে মূলতানে ।

                      ক্রমে ধূসর আলোর উপরে কালো মরচে পড়ে এল ।

                   থেমে-যাওয়া গানখানি নিভে-যাওয়া প্রদীপের ভেলার মতো

                 ডুবল বুঝি কোন্‌ একজনের মনের তলায়,

                           উঠল বুঝি তার দীর্ঘনিশ্বাস,

                               কিন্তু জ্বালানো হল না আলো ।

 

এ নিয়ে আজ নালিশ নেই আমার ।

                         বিরহের কালোগুহা ক্ষুধিত গহ্বর থেকে

             ঢেলে দিয়েছে ক্ষুভিত সুরের ঝর্না রাত্রিদিন ।

          সাত রঙের ছটা খেলেছে তার নাচের উড়নিতে

                             সারাদিনের সূর্যালোকে,

              নিশীথরাত্রের জপমন্ত্র ছন্দ পেয়েছে

                            তার তিমিরপুঞ্জ কলোচ্ছল ধারায় ।

আমার তপ্ত মধ্যাহ্নের শূন্যতা থেকে উচ্ছ্বসিত

              গৌড়-সারঙের আলাপ ।

   আজ বঞ্চিত জীবনকে বলি সার্থক --

           নিঃশেষ হয়ে এল তার দুঃখের সঞ্চয়

    মৃত্যুর অর্ঘ্যপাত্রে,

           তার দক্ষিণা রয়ে গেল কালের বেদিপ্রান্তে ।

জীবনের পথে মানুষ যাত্রা করে

নিজেকে খুঁজে পাবার জন্যে ।

গান যে মানুষ গায়, দিয়েছে সে ধরা,আমার অন্তরে;

যে মানুষ দেয় প্রাণ দেখা মেলে নি তার ।

 

          দেখেছি শুধু আপনার নিভৃত রূপ

                       ছায়ায় পরিকীর্ণ,

     যেন পাহাড়তলিতে একখানা অনুত্তরঙ্গ সরোবর ।

                    তীরের গাছ থেকে

                      সেখানে বসন্তশেষের ফুল পড়ে ঝ'রে,

                               ছেলেরা ভাসায় খেলার নৌকো,

                    কলস ভরে নেয় তরুণীরা

                                 বুদ্‌বুদফেনিল গর্গরধ্বনিতে ।

          নববর্ষার গম্ভীর বিরাট শ্যামমহিমা

                    তার বক্ষতলে পায় লীলাচঞ্চল দোসরটিকে ।

       কালবৈশাখী হঠাৎ মারে পাখার ঝাপট,

                         স্থির জলে আনে অশান্তির উন্মন্থন,

           অধৈর্যের আঘাত হানে তটবেষ্টনের স্থাবরতায়;

               হঠাৎ বুঝি তার মনে হয় --

                       গিরিশিখরের পাগলা-ঝোরা পোষ মেনেছে

                             গিরিপদতলের বোবা জলরাশিতে --

    বন্দী ভুলেছে আপনার উদ্‌বেলকে,উদ্দামকে--

  পাথর ডিঙিয়ে আপন সীমানা চূর্ণ করতে করতে নিরুদ্দেশের পথে

                   অজানার সংঘাতে বাঁকে বাঁকে

                      গর্জিত করল না সে আপন অবরুদ্ধ বাণী,

                             আবর্তে আবর্তে উৎক্ষিপ্ত করল না

                                                অন্তর্গূঢ়কে ।

 

       মৃত্যুর গ্রন্থি থেকে ছিনিয়ে ছিনিয়ে

                                যে উদ্ধার করে জীবনকে

সেই রুদ্র মানবের আত্মপরিচয়ে বঞ্চিত

                                       ক্ষীণ পাণ্ডুর আমি

   অপরিস্ফুটতার অসন্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে ।

দুর্গম ভীষণের ওপারে

          অন্ধকারে অপেক্ষা করছে জ্ঞানের বরদাত্রী;

মানবের অভ্রভেদী বন্ধনশালা

           তুলেছে কালো পাথরে গাঁথা উদ্ধত চূড়া

                                      সূর্যোদয়ের পথে;

           বহু শতাব্দীর ব্যথিত ক্ষত মুষ্টি

                       রক্তলাঞ্ছিত বিদ্রোহের ছাপ

                   লেপে দিয়ে যায় তার দ্বারফলকে;

ইতিহাসবিধাতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ

                   দৈত্যের লৌহদুর্গে প্রচ্ছন্ন;

   আকাশে দেবসেনাপতির কন্ঠ শোনা যায় ----

                       "এসো মৃত্যুবিজয়ী' ।

                               বাজল ভেরী,

          তবু জাগল না রণদুর্মদ

            এই নিরাপদ নিশ্চেষ্ট জীবনে;

ব্যূহ ভেদ ক'রে

স্থান নিই নি যুধ্যমান দেবলোকের সংগ্রাম-সহকারিতায় ।

                   কেবল স্বপ্নে শুনেছি ডমরুর গুরুগুরু,

           কেবল সমরযাত্রীর পদপাতকম্পন

                   মিলেছে হৃৎস্পন্দনে বাহিরের পথ থেকে ।

 

যুগে যুগে যে মানুষের সৃষ্টি প্রলয়ের ক্ষেত্রে

            সেই শ্মশানচারী ভৈরবের পরিচয়জ্যোতি

                             ম্লান হয়ে রইল আমার সত্তায়;

শুধু রেখে গেলেম নতমস্তকের প্রণাম

            মানবের হৃদয়াসীন সেই বীরের উদ্দেশে --

মর্তের অমরাবতী যাঁর সৃষ্টি

          মৃত্যুর মূল্যে, দুঃখের দীপ্তিতে ।

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
  •