দরোয়ান
Essays
আমাদের কর্তা আমাদের যে স্থানে বিদ্যা শিক্ষার জন্য পাঠাইয়াছেন, সেখানে এত প্রকারের আপদ-বিপদের সম্ভাবনা আছে যে, আমাদের প্রত্যেকের মনের দেউড়িতে তিনি যুক্তি বা বুদ্ধি বলিয়া এক-একটা দরোয়ান খাড়া করিয়া রাখিয়াছেন। এ ব্যক্তি আমাদের কী ভয়ানক শাসনেই রাখিয়াছে। আমাদের উপরে ইহার কী দারুণ একাধিপত্য! ইনি যাহাদের না চেনেন, এমন কোনো লোককে ঘরে ঢুকিতে দেন না। সদা সর্বদা পাহারা। ইনি যে গণ্ডিটি দিয়া রাখিয়াছেন, তাহার বাহিরে আমাদের কোনো মতেই যাইতে দেন না। রাত্রি হইলে এ লোকটি ঘুমাইয়া পড়ে, সেই অবসরে অনেক প্রকারের লোক পা টিপিয়া পা টিপিয়া আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসে, কখনো বা উৎপাত করে কখনো বা আমোদে রাখে। যেই দরোয়ানটা জাগিয়া উঠে, ঘরের মধ্যে গোলযোগ শুনিতে পাইয়া সে ডাকিয়া উঠে, "কে রে? আমার হকুম না লইয়া ঘরে কে আসিয়াছিস?' অমনি আমাদের স্বপ্ন-নাটকের পাত্রগণ, আমাদের Dreamatis Person দরজা দিয়া, জানালা দিয়া, খিড়কি দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া পালায়। আমরা সকলে ছেলেমানুষ লোক, যে আসে তাহাকেই বিশ্বাস করি, এই নিমিত্ত দরোয়ান এমন কাহাকেও প্রবেশ করিতে দেয় না যে বিশ্বাসযোগ্য নহে। স্বপ্নে আমরা কাহাকে না বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করাই আমাদের স্বাভাবিক অবস্থা। কিন্তু আমাদের দরোয়ান হাজার হুঁশিয়ার হক-না-কেন, ভদ্রলোকের মতো কাপড়-চোপড় পরিয়া অনেক অবিশ্বাস্য লোক আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করে, তাহারা অনেক লোকসান করিয়া থাকে। অনেক সময়ে আমাদের প্রতিবেশীর দরোয়ান আমাদের দরোয়ানকে সাবধান করিয়া দেয়। যদি দরোয়ানের তাহাতে চৈতন্য হয় তবে তৎক্ষণাৎ তাহাকে ডাকিয়া গলাধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দেন। নানা চরিত্রের দরোয়ান আছে, ভাব অতিথিগণ তাহাদের নানা উপায়ে বশ করিতে পারে। কেহ-বা হীরার আংটি ঘড়ির চেন-পরা বাবুটিকে দেখিলেই ছাড়িয়া দেয়; কেহ-বা মিষ্ট কথা শুনিলেই গলিয়া যায়, অবিশ্বাস মন হইতে চলিয়া যায়; কেহ-বা বিশ্বাস করুক বা না করুক, সন্দেশের লোভ পাইলে চক্ষুকর্ণ বুজিয়া তাহাকে প্রবেশ করিতে দেয়। কত বড়ো বড়ো জাঁকালো-মত, ভুঁড়িবান ভাব হীরা জহরাৎ পরিয়া কত নাবালকের বৈঠকখানায় আদরের সহিত গৃহীত হইয়াছে, অথচ তাহারা আদরের যোগ্য নহে; কত মতকে আমরা মিঠা ভাষা মিঠা গলা শুনিয়া ডাকিয়া আনিয়াছি; আবার অনেক মতকে আমরা ঠিক বিশ্বাস করি না, কিন্তু বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করে বলিয়া, বিশ্বাস করিবার প্রলোভন আছে বলিয়া ঘরে ঢুকিতে দিই। অনেক সময়ে দিনের বেলায় দরোয়ান ঝিমায়। দুই প্রহরে চারি দিক হয়তো ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে, জানালা দিয়া অল্প অল্প বাতাস আসিতেছে, খাটিয়াটির উপরে পড়িয়া দরোয়ানের তন্দ্রা আসিয়াছে, সেই সময়ে কত শত পরস্পর অচেনা ভাব আমাদের হৃদয়ের প্রবেশ-দ্বার অরক্ষিত দেখিয়া আস্তে আস্তে প্রবেশ করে; কত প্রকার অদ্ভুত খেলা খেলিতে থাকে তাহার ঠিকানা নাই; অনেকের এইরূপ অলস দরোয়ান আছে। আবার এক-একটা এমন দুর্দান্ত ভাব আছে যে, আমাদের দরোয়ানদের ঠেঙাইয়া জোর-জবরদস্তি করিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। এই মনে করো, ভূতের ভয় বলিয়া এক ব্যক্তি যখন কাহারো মনের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন যুক্তিসিং হাজার ঢাল-তলোয়ার লইয়া আস্ফালন করুন-না-কেন, তাহার কাছে ঘেঁষিতে পারেন না। কাহারো বা রোগা দরোয়ান, কাহারো বা ভালো মানুষ দরোয়ান, কাহারো বা অলস দরোয়ান।
এক-একটি ছেলে আছে, যাহার এই দরোয়ানটির উপর দৃঢ় বিশ্বাস। তাহাকে না লইয়া কোথাও যাইতে চায় না; সকল কাজেই তাহাকে খাড়া করিয়া রাখিয়া দেয়। সে ভাবে, কে জানে কোথায় কে দুষ্ট লোক আছে, কোথায় কোন্খানে গিয়া পৌঁছাইব, তাহার ঠিক নাই। সে যেখানে আছে, যুক্তিও তাহার তক্মা পরিয়া পাগড়ি আঁটিয়া আসাসোঁটা ধরিয়া কাছে কাছে হাজির আছে। আবার এমন কে-একটা যথেচ্ছাচারী দুষ্ট ছেলে আছে, যে এই দরোয়ানটাকে দুচক্ষে দেখিতে পারে না। সে ভাবে, এ একটা কোথাকার মেড়ুয়াবাদী আমার স্বাধীনতা অপহরণ করিয়া বসিয়া আছে। একটা যে সংকীর্ণ গণ্ডি টানিয়া দিয়াছে, তাহার মধ্যে কষ্টই থাক্ আর দুঃখই থাক্, আগুনেই পুড়ি, আর জলেই হাবুডুবু খাই, তাহার বাহিরে কোনো মতেই যাইতে দেয় না। অবশেষে নিতান্ত জ্বালাতন হইয়া দুষ্টামি করিয়া তাহাকে মদ খাওয়াইয়া দেয়; এইরূপে বুদ্ধি যখন মাতাল হইয়া অচেতন হইয়া পড়ে, তাহারা গণ্ডির বাহিরে গিয়া উপস্থিত হয়। অনেক লোকে যে মদ খাইতে ভালোবাসে, তাহার কারণ এই যে, তাহারা স্বাধীনতা পাইতে চায়; বুদ্ধিটাকে কোনো প্রকারে অভিভূত করিয়া ফেলিয়া যথেচ্ছা বিচরণ করিতে চায়; ইহাতে যে বিপদই ঘটুক-না-কেন তাহারা ভাবে না। এই উভয় দলেই কিছু অন্যায় বাড়াবাড়ি করিয়া থাকেন। নিতান্তই যুক্তির নির্দিষ্ট চারটি দেয়ালের মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়ানো মনের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নহে, আবার সর্বতোভাবে যুক্তিকে অমান্য করিয়া যথেচ্ছাচার করিয়া বেড়ানোও ভালো নয় যুক্তির সীমানা ছাড়াইয়া যে নিরাপদ স্থান নাই, এমনত নহে! অতএব মাঝে মাঝে যুক্তির অনুমতি লইয়া কল্পনার রাজ্যে খুব খানিকটা ছুটিয়া বেড়াইয়া আসা উচিত। এইরূপে যুক্তিকে কাজ হইতে অব্যাহতি দিয়া মাঝে মাঝে ছুটি দিলে তাহার শরীরের পক্ষেও ভালো।
আরো দেখুন