আর্যগাথা
Essays
গ্রন্থখানি সংগীতপুস্তক, এইজন্য ইহার সম্পূর্ণ সমালোচনা সম্ভবে না। কারণ, গানে কথার অপেক্ষা সুরেরই প্রাধান্য। সুর খুলিয়া লইলে অনেক সময়ে গানের কথা অত্যন্ত শ্রীহীন এবং অর্থশূন্য হইয়া পড়ে এবং সেইরূপই হওয়া উচিত। কারণ, সংগীতের দ্বারা যখন আমরা ভাব ব্যক্ত করিতে চাহি তখন কথাকে উপলক্ষমাত্র করাই আবশ্যক; কথার দ্বারাই যদি সকল কথা বলা হইয়া যায় তবে সংগীত সেখানে খর্ব হইয়া পড়ে। কথার দ্বারা আমরা যাহা ব্যক্ত করিয়া থাকি তাহা বহুলপরিমাণে সুস্পষ্ট সুপরিস্ফুট-- কিন্তু আমাদের মনে অনেক সময় এমন-সকল ভাবের উদয় হয় যাহা নামরূপে নির্দেশ বা বর্ণনায় প্রকাশ করিতে পারি না, যাহা কথার অতীত, যাহা অহৈতুক-- সেই-সকল ভাব, অন্তরাত্মার সেই-সমস্ত আবেগ-উদ্বেগগুলি সংগীতেই বিশুদ্ধ রূপে ব্যক্ত হইতে পারে। হিন্দুস্থানি গানে কথা এতই যতসামান্য যে, তাহাতে আমাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করিতে পারে না-- ননদিয়া, গগরিয়া, চুনরিয়া, আমরা কানে শুনিয়া যাই মাত্র কিন্তু সংগীতের সহস্রবাহিনী নির্ঝরিণী সেই-সমস্ত কথাকে তুচ্ছ উপলখণ্ডের মতো প্লাবিত করিয়া দিয়া আমাদের হৃদয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যবেগ, এক অনির্বচনীয় আকুলতার আন্দোলন সঞ্চার করিয়া দেয়। সামান্যত পাথরের নুড়ি বালকের খেলনা মাত্র, হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ ছেলেখেলা-- কিন্তু নির্ঝরের তলে সেই নুড়িগুলি ঘাতে-প্রতিঘাতে জলস্রোতকে মুখরিত করিয়া তোলে, বেগবান প্রবাহকে বিবিধ বাধা দ্বারা উচ্ছ্বসিত করিয়া অপরূপ বৈচিত্র্য দান করে। হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ সুরপ্রবাহকে বিচিত্র শব্দসংঘর্ষ এবং বাধার দ্বারা উচ্ছ্বসিত ও প্রতিধ্বনিত করিয়া তোলে, অর্থগৌরব বা কাব্যসৌন্দর্যের দ্বারা তাহাকে অতিক্রম করিতে চেষ্টা করে না। ছন্দ-সম্বন্ধেও এ কথা খাটে। নদী যেমন আপনার পথ আপনি কাটিয়া যায় গানও তেমনি আপনার ছন্দ আপনি গড়িয়া গেলেই ভালো হয়। অধিকাংশ স্থলে হিন্দি গানের কথায় কোনো ছন্দ থাকে না-- সেইজন্যেই ভালো হিন্দি গানের তালের গতিবৈচিত্র্য এমন অভাবিতপূর্ব ও সুন্দর-- সে ইচ্ছামত হ্রস্বদীর্ঘের সামঞ্জস্য বিধান করিতে করিতে চলে, স্বাধীনতার সহিত সংযমের সমন্বয় সাধন করিতে করিতে বিজয়ী সম্রাটের ন্যায় গুরুগম্ভীর ভেরীধ্বনি-সহকারে অগ্রসর হইতে থাকে। তাহাকে পূর্বকৃত বাঁধা ছন্দের মধ্য দিয়া চালনা করিয়া লইয়া গেলে তাহার বৈচিত্র্য এবং গৌরবের হানি হইয়া থাকে। কাব্য স্বরাজ্যে একাধিপত্য করিতে পারে কিন্তু সংগীতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিতে গেলে তাহার পক্ষে অনধিকার চর্চা হয়।
বিশুদ্ধ কাব্য এবং বিশুদ্ধ সংগীত স্ব স্ব অধিকারের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে উৎকর্ষ লাভ করিয়া থাকে, কিন্তু বিদ্যাদেবীগণের মহল পৃথক হইলেও তাঁহারা কখনো কখনো একত্র মিলিয়া থাকেন। সংগীতে ও কাব্যে মধ্যে মধ্যে সেরূপ মিলন দেখা যায়। তখন উভয়েই পরস্পরের জন্য আপনাকে কথঞ্চিৎ সংকুচিত করিয়া লন, কাব্য আপন বিচিত্র অলংকার পরিত্যাগ করিয়া নিরতিশয় স্বচ্ছতা ও সরলতা অবলম্বন করেন, সংগীতও আপন তালসুরের উদ্দাম লীলাভঙ্গকে সম্বরণ করিয়া সখ্যভাবে কাব্যের সাহচর্য করিতে থাকেন।
সে কে? -- এ জগতে কেহ আছে, অতি উচ্চ মোর কাছে
যার প্রতি তুচ্ছ অভিলাষ;
সে কে? -- অধীন হইয়ে, তবু রহে যে আমার প্রভু;
প্রভু হয়ে আমি যার দাস;
সে কে? -- দূর হতে দূরাত্মীয়, প্রিয়তম হতে প্রিয়,
আপন হইতে যে আপন;
সে কে? -- লতা হতে ক্ষীণ তারে বাঁধে দৃঢ় যে আমারে,
ছাড়াতে পারি না আজীবন;
সে কে? -- দুর্বলতা যার বল, মর্মভেদী অশ্রুজল;
প্রেম-উচ্চারিত রোষ যার;
সে কে? -- যার পরিতোষ মম সফল জনমসম;
সুখ-সিদ্ধি সব সাধনার;
সে কে? -- হলে কঠিন চিক শিশুসম স্নেহভীত
যার কাছে পড়ি গিয়া নুয়ে;
সে কে? -- বিনা দোষে ক্ষমা চাই যার; অপমান নাই
শতবার পা দুখানি ছুঁয়ে;
সে কে? -- মধুর দাসত্ব যার, লীলাময় কারাগার;
শৃঙ্খল নূপুর হয়ে বাজে;
সে কে? -- হৃদয় খুঁজিতে গিয়া নিজে যাই হারাইয়া
যার হৃদি-প্রহেলিকা মাঝে।
ছিল বসি সে কুসুমকাননে।
আর অমল অরুণ উজল আভা
ভাসিতেছিল সে আননে।
ছিল এলায়ে সে কেশরাশি (ছায়াসম হে);
ছিল ললাটে দিব্য আলোক, শান্তি
অতুল গরিমারাশি।
সেথা ছিল না বিষাদভাষা (অশ্রুভরা গো);
সেথা বাঁধা ছিল শুধু সুখের স্মৃতি
হাসি, হরষ, আশা;
সেথা ঘুমায়ে ছিলরে পুণ্য, প্রীতি,
প্রাণভরা ভালোবাসা।
তার সরল সুঠাম দেহ (প্রভাময় গো, প্রাণভরা গো);
যেন যা-কিছু কোমল ললিত তা দিয়ে
রচিয়াছে তাহে কেহ;
পরে সৃজিল সেথায় স্বপন, সংগীত,
সোহাগ শরম স্নেহ।
যেন পাইল রে উষা প্রাণ (আলোময়ী রে);
যেন জীবন্ত কুসুম, কনকভাতি
সুমিলিত, সমতান।
যেন সজীব সুরভি মধুর মলয়
কোকিলকূজিত গান।
শুধু চাহিল সে মোর পানে (একবার গো);
যেন বাজিল বীণা মুরজ মুরলী
অমনি অধীর প্রাণে;
সে গেল কী দিয়া, কী নিয়া, বাঁধি মোর হিয়া
কী মন্ত্রগুণে কে জানে।
এসো এসো বঁধু এসো, আধো আঁচরে বসো,
নয়ন ভরিয়া তোমায় দেখি!
হরষে বরষ পরে যখন ফিরি রে ঘরে,
সে কে রে আমারি তরে আশা ক'রে রহে বলো;
স্বজন সুহৃদ সবে উজল নয়ন যবে,
কার প্রিয় আঁখি দুটি সব চেয়ে সমুজ্জ্বল!
চাহি অতৃপ্ত নয়নে তোর মুখপানে
ফিরিতে চাহে না আঁখি;
আমি আপনা হারাই, সব ভুলে যাই
অবাক হইয়ে থাকি!
একি রে তার ছেলেখেলা বকি তায় কি সাধে--
যা দেখবে বলবে, "ওমা, এনে দে, ওমা, দে।'
"নেব নেব' সদাই কি এ?
পেলে পরে ফেলে দিয়ে
কাঁদতে গিয়ে হেসে ফেলে, হাসতে গিয়ে কাঁদে
এত খেলার জিনিস ছেড়ে,
বলে কি না দিতে পেড়ে --
অসম্ভব যা-- তারায় মেঘে বিজলিরে চাঁদে!
শুনল কারো হবে বিয়ে,
ধরলো ধুয়ো অমনি গিয়ে
"ও মা, আমি বিয়ে করব' -- কান্নার ওস্তাদ এ!
শোনো কারো হবে ফাঁসি
অমনি আঁচল ধরল আসি--
"ও মা, আমি ফাঁসি যাব'-- বিনি অপরাধে!
আরো দেখুন