নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি
Others
একটা কথা উঠিয়াছে, মানুষ মাত্রেই কবি। যাহার মনে ভাব আছে, যে দুঃখে কাঁদে, সুখে হাসে, সেই কবি! কথাটা খুব নূতনতর। সচরাচর লোকে কবি বলিতে এমন বুঝে না। সচরাচর লোকে যাহা বলে তাহার বিপরীত একটা কথা শুনিলে অনেক সময় আমাদিগের ভারী ভাল লাগিয়া যায়। যাহার মনোবৃত্তি আছে সেই কবি, এ কথাটা এখনকার যুবকদের মধ্যে অনেকেরই মুখে শুনা যায়। কবি শব্দের ঐরূপ অতিবিস্তৃত অর্থ এখন একটা ফ্যাষান হইয়াছে বলিলে অধিক বলা হয় না। এমন-কি নীরব-কবি বলিয়া একটি কথা বাহির হইয়া গিয়াছে ও সে কথা দিনে দিনে খুব চলিত হইয়া আসিতেছে। এত দূর পর্য্যন্ত চলিত হইয়াছে যে, আজ যদি আমি এমন একটা পুরাতন কথা বলি যে, নীরব-কবি বলিয়া একটা কোন পদার্থই নাই তাহা হইলে আমার কথাটাই লোকের নূতন বলিয়া ঠেকে। আমি বলি কি, যে নীরব সেই কবি নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমার যা মত অধিকাংশ লোকেরই আন্তরিক তাহাই মত। লোকে বলিবে, " ও কথা ত সকলেই বলে, উহার উল্টাটা যদি কোন প্রকারে প্রমাণ করাইয়া দিতে পার', তাহা হইলে বড় ভাল লাগে।" ভাল ত লাগে, কিন্তু বিষয়টা এমনতর যে তাহাতে একটা বই দুইটা কথা উঠিতে পারে না। কবি কথাটা এমন একটা সমস্যা নয় যে তাহাতে বুদ্ধির মারপ্যাঁচ খেলান যায়, "বীজ হইতে বৃক্ষ কি বৃক্ষ হইতে বীজ " এমন একটা তর্কের খেলেনা নয়। ভাবপ্রকাশের সুবিধার জন্য লোকসাধারণে একটি বিশেষ পদার্থের একটি বিশেষ নামকরণ করিয়াছে, সেই নামে তাহাকে সকলে ডাকিয়া থাকে ও অনেক দিন হইতে ডাকিয়া আসিতেছে, তাহা লইয়া আর তর্ক কি হইতে পারে? লোকে কাহাকে কবি বলে? যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রেণীর ভাবসমূহ (যাহাকে আমরা কবিতা বলি) ভাষায় প্রকাশ করে। * নীরব ও কবি দুটি অন্যোন্যবিরোধী কথা, তথাপি যদি তুমি বিশেষণ নীরবের সহিত বিশেষ্য কবির বিবাহ দিতে চাও, তবে এমন একটি পরস্পরধ্বংসী দম্পতির সৃষ্টি হয়, যে, শুভদৃষ্টির সময় পরস্পর চোখোচোখি হইবামাত্রেই উভয়ে প্রাণত্যাগ করে। উভয়েই উভয়ের পক্ষে ভস্মলোচন। এমনতর চোখোচোখিকে কি অশুভদৃষ্টি বলাই সঙ্গত নয়, অতএব এমনতর বিবাহ কি না দিলেই নয়? এমন হয় বটে, যে, তুমি যাহাকে কবি বল আমি তাহাকে কবি বলি না; এই যুক্তির উপর নির্ভর করিয়া তুমি বলিতে পার বটে, যে, "যখন বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন লোকে কবি বলিয়া থাকে, তখন কি করিয়া বলা যাইতে পারে যে কবি বলিতে সকলেই এক অর্থ বুঝে? " আমি বলি কি, একই অর্থ বুঝে! যখন পদ্যপুণ্ডরীকের গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত রামবাবুকে তুমি কবি বলিতেছ, আমি কবি বলিতেছি না ও কবিতাচন্দ্রিকার গ্রন্থকার শ্রীযুক্ত শ্যামবাবুকে আমি কবি বলিতেছি তুমি বলিতেছ না, তখন তোমাতে আমাতে এই তর্ক যে, "রামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?" বা, "শ্যামবাবু কি এমন কবি যে তাঁহাকে কবি বলা যাইতে পারে?" রামবাবু ও শ্যামবাবু এক স্কুলে পড়েন, তবে তাঁহাদের মধ্যে কে ফাষ্ট্ ক্লাসে পড়েন কে লাষ্ট্ ক্লাসে পড়েন তাহাই লইয়া কথা। রামবাবু ও শ্যামবাবু যে এক স্কুলে পড়েন, সে স্কুলটি কি? না, প্রকাশ করা। তাঁহাদের মধ্যে সাদৃশ্য কোথায়? না, প্রকাশ করা লইয়া। বৈসাদৃশ্য কোথায়? কিরূপে প্রকাশ করা হয় তাহা লইয়া। তবে, ভাল কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে তাহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা হইতে আরও দূরে গেলে তাহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে
প্রবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে বসা সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম।
হবি কি আমার প্রিয়া, র'বি মোর সাথে?
অরণ্য, প্রান্তর, নদী, পর্ব্বতগুহাতে
যত কিছু, প্রিয়তমে, সুখ পাওয়া যায়
দু-জনে মিলিয়া তাহা ভোগ করি আয়!
শুনিব শিখরে বসি পাখী গায় গান
নদীর শব্দ-সাথে মিশাইয়া তান;
দেখিব চাহিয়া সেই তটিনীর তীরে
রাখাল গরুর পাল চরাইয়া ফিরে।
রচি দিব গোলাপের শয্যা মনোমত,
সুরভি ফুলের তোড়া দিব কত শত;
গড়িব ফুলের টুপি, পরিবি মাথায়;
আঙিয়া রচিয়া দিব গাছের পাতায়।
লয়ে মেষশিশুদের কোমল পশম
বসন বুনিয়া দিব অতি অনুপম;
সুন্দর পাদুকা এক করিয়া রচিত
খাঁটি সোনা দিয়ে তাহা করিব খচিত।
কটিবন্ধ গড়ি দিব গাঁথি তৃণজাল,
মাঝেতে বসায়ে দিব একটি প্রবাল।
এই সব সুখ যদি তোর মনে ধরে
হ' আমার প্রিয়তমা, আয় মোর ঘরে।
হস্তিদন্তে গড়া এক আসনের 'পরে
আহার আনিয়া দিবে দুজনের তরে--
দেবতার উপভোগ্য, মহার্ঘ্য এমন,
রজতের পাত্রে দোঁহে করিব ভোজন।
রাখাল-বালক যত মিলি একত্তরে
নাচিবে গাইবে তোর আমোদের তরে।
এই সব সুখ যদি মনে ধরে তব
হ' আমার প্রিয়তমা, এক সাথে রব '।
আরো দেখুন