রথের রশি (rather roshi)

১৫ আষাঢ়, ১৩১৮  শিলাইদহ


 

প্রথম দৃশ্য

রথযাত্রার মেলায় মেয়েরা
প্রথমা
এবার কী হল, ভাই!
উঠেছি কোন্‌ ভোরে, তখন কাক ডাকে নি।
কঙ্কালিতলার দিঘিতে দুটো ডুব দিয়েই
ছুটে এলুম রথ দেখতে, বেলা হয়ে গেল;
রথের নেই দেখা। চাকার নেই শব্দ।
দ্বিতীয়া
চারি দিকে সব যেন থম্‌থমে হয়ে আছে,
ছম্‌ছম্‌ করছে গা।
তৃতীয়া
দোকানি পসারিরা চুপচাপ ব'সে,
কেনাবেচা বন্ধ। রাস্তার ধারে ধারে
লোক জটলা করে তাকিয়ে আছে
কখন্‌ আসবে রথ। যেন আশা ছেড়ে দিয়েছে।
প্রথমা
দেশের লোকের প্রথম যাত্রার দিন আজ;
বেরবেন ব্রাহ্মণঠাকুর শিষ্য নিয়ে,--
বেরবেন রাজা, পিছনে চলবে সৈন্যসামন্ত,--
পণ্ডিতমশায় বেরবেন, ছাত্ররা চলবে পুঁথিপত্র হাতে।
কোলের ছেলে নিয়ে মেয়েরা বেরবে,
ছেলেদের হবে প্রথম শুভযাত্রা--
কিন্তু কেন সব গেল হঠাৎ থেমে।
দ্বিতীয়া
ওই দেখ্‌, পুরুতঠাকুর বিড়্‌ বিড় করছে ওখানে।
মহাকালের পাণ্ডা বসে মাথায় হাত দিয়ে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী
সর্বনাশ এল।
বাধবে যুদ্ধ, জ্বলবে আগুন, লাগবে মারী,
ধরণী হবে বন্ধ্যা, জল যাবে শুকিয়ে।
প্রথমা
এ কী অকল্যাণের কথা, ঠাকুর!
উৎসবে এসেছি মহাকালের মন্দিরে--
আজ রথযাত্রার দিন।
সন্ন্যাসী
দেখতে পাচ্ছ না-- আজ ধনীর আছে ধন,
তার মূল্য গেছে ফাঁক হয়ে গজভুক্ত কপিত্থের মতো।
ভরা ফসলের খেতে বাসা করেছে উপবাস।
যক্ষরাজ স্বয়ং তার ভাণ্ডারে বসেছে প্রায়োপবেশনে।
দেখতে পাচ্ছি না-- লক্ষ্ণীর ভাণ্ড আজ শতছিদ্র,
তাঁর প্রসাদধারা শুষে নিচ্ছে মরুভূমিতে--
ফলছে না কোনো ফল।
তৃতীয়া
হাঁ ঠাকুর, তাই তো দেখি।
সন্ন্যাসী
তোমরা কেবলই করেছ ঋণ,
কিছুই কর নি শোধ,
দেউলে করে দিয়েছ যুগের বিত্ত।
তাই নড়ে না আজ আর রথ--
ওই যে, পথের বুক জুড়ে পড়ে আছে তার অসাড় দড়িটা।
প্রথমা
তাই তো,বাপ রে, গা শিউরে ওঠে--
এ যে অজগর সাপ, খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে আর নড়ে না।
সন্ন্যাসী
ওই তো রথের দড়ি, যত চলে না ততই জড়ায়।
যখন চলে, দেয় মুক্তি।
দ্বিতীয়া
বুঝেছি আমাদের পুজো নেবেন ব'লে
হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন দড়ি-দেবতা।
পুজো পেলেই হবেন তুষ্ট।
প্রথমা
ও ভাই, পুজো তো আনি নি। ভুল হয়েছে।
তৃতীয়া
পুজোর কথা তো ছিল না--
ভেবেছিলেম রথের মেলায় কেবল বেচব কিনব,
বাজি দেখব জাদুকরের,
আর দেখব বাঁদর-নাচ।
চল্‌-না শিগগির, এখনো সময় আছে,
আনি গে পুজো।
[সকলের প্রস্থান
নাগরিকদের প্রবেশ
প্রথম নাগরিক
দেখ্‌ দেখ্‌ রে, রথের দড়িটা কেমন করে পড়ে আছে।
যুগযুগান্তরের দড়ি, দেশদেশান্তরের হাত পড়েছে ওই দড়িতে,
আজ অনড় হয়ে মাটি কামড়ে আছে
সর্বাঙ্গ কালো ক'রে।
দ্বিতীয় নাগরিক
ভয় লাগছে রে। সরে দাঁড়া, সরে দাঁড়া।
মনে হচ্ছে ওটা এখনি ধরবে ফণা, মারবে ছোবল।
তৃতীয় নাগরিক
একটু একটু নড়ছে যেন রে। আঁকুবাঁকু করছে বুঝি।
প্রথম নাগরিক
বলিস্‌ নে অমন কথা। মুখে আনতে নেই।
ও যদি আপনি নড়ে তা হলে কি আর রক্ষে আছে।
তৃতীয় নাগরিক
তা হলে ওর নাড়া খেয়ে সংসারের সব জোড়গুলো
বিজোড় হয়ে পড়বে। আমরা যদি না চালাই--
ও যদি আপনি চলে, তা হলে পড়ব যে চাকার তলায়।
প্রথম নাগরিক
ওই দেখ্‌ ভাই, পুরুতের গেছে মুখ শুকিয়ে,
কোণে বসে বসে পড়ছে মন্তর।
দ্বিতীয় নাগরিক
সেদিন নেই রে
যেদিন পুরুতের মন্তর-পড়া হাতের টানে চলত রথ।
ওরা ছিল কালের প্রথম বাহন।
তৃতীয় নাগরিক
তবু আজ ভোরবেলা দেখি ঠাকুর লেগেছেন টান দিতে--
কিন্তু একেবারেই উলটো দিকে, পিছনের পথে।
প্রথম নাগরিক
সেটাই তো ঠিক পথ, পবিত্র পথ, আদি পথ।
সেই পথ থেকে দূরে এসেই তো কালের মাথার ঠিক থাকছে না।
দ্বিতীয় নাগরিক
মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠলি দেখি। এত কথা শিখলি কোথা।
প্রথম নাগরিক
ওই পণ্ডিতেরই কাছে। তাঁরা বলেন--
মহাকালের নিজের নাড়ীর টান পিছনের দিকে,
পাঁচজনের দড়ির টানে অগত্যা চলেন সামনে।
নইলে তিনি পিছু হটতে হটতে একেবারে পৌছতেন
অনাদি কালের অতল গহ্বরে।
তৃতীয় নাগরিক
ওই রশিটার দিকে চাইতে ভয় করে।
ওটা যেন যুগান্তের নাড়ী--
সান্নিপাতিক জ্বরে আজ দব্‌দব্‌ করছে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী
সর্বনাশ এল।
গুরুগুরু শব্দ মাটির নীচে।
ভূমিকম্পের জন্ম হচ্ছে।
গুহার মধ্য থেকে আগুন লক্‌লক্‌ মেলছে রসনা।
পূর্বে পশ্চিমে আকাশ হয়েছে রক্তবর্ণ।
প্রলয়দীপ্তির আঙটি পরেছে দিক্‌চক্রবাল।
[ প্রস্থান
প্রথম নাগরিক
দেশে পুণ্যাত্মা কেউ নেই কি আজ।
ধরুক-না এসে দড়িটা।
দ্বিতীয় নাগরিক
এক-একটি পুণ্যাত্মাকে খুঁজে বের করতেই
এক-এক যুগ যায় বয়ে--
ততক্ষণ পাপাত্মাদের হবে কী দশা।
তৃতীয় নাগরিক
পাপাত্মাদের কী হবে তা নিয়ে ভগবানের মাথাব্যাথা নেই।
দ্বিতীয় নাগরিক
সে কী কথা। সংসার তো পাপাত্মাদের নিয়েই।
তারা না থাকলে তো লোকনাথের রাজত্ব উজাড়।
পুণ্যাত্মা কালেভদ্রে দৈবাৎ আসে,
আমাদের ঠেলায় দৌড় মারে বনে জঙ্গলে গুহায়।
প্রথম নাগরিক
দড়িটার রঙ যেন এল নীল হয়ে।
সামলে কথা কোস।
মেয়েদের প্রবেশ
প্রথমা
বাজা ভাই, শাঁখ বাজা--
রথ না চললে কিছুই চলবে না।
চড়বে না হাঁড়ি, বুলবুলিতে খেয়ে যাবে ধান।
এরই মধ্যে আমার মেজো ছেলের গেছে চাকরি,
তার বউটা শুষছে জ্বরে। কপালে কী আছে জানি নে।
প্রথম নাগরিক
মেয়েমানুষ, তোমরা এখানে কী করতে।
কালের রথযাত্রায় কোনো হাত নেই তোমাদের।
কুটনো কোটো গে ঘরে।
দ্বিতীয়া
কেন, পুজো দিতে তো পারি।
আমরা না থাকলে পুরুতের পেট হত না এত মোটা।
গড় করি তোমায় দড়ি-নারায়ণ! প্রসন্ন হও।
এনেছি তোমার ভোগ। ওলো, ঢাল্‌ ঢাল্‌ ঘি,
ঢাল্‌ দুধ, গঙ্গাজলের ঘটি কোথায়,
ঢেলে দে-না জল। পঞ্চগব্য রাখ্‌ ওইখানে,
জ্বালা পঞ্চপ্রদীপ। বাবা দড়ি-নারায়ণ,
এই আমার মানত রইল, তুমি যখন নড়বে
মাথা মুড়িয়ে চুল দেব ফেলে।
তৃতীয়া
এক মাস ছেড়ে দেব ভাত, খাব শুধু রুটি।
বলো-না ভাই, সবাই মিলে-- জয় দড়ি-নারায়ণের জয়।
প্রথম নাগরিক
কোথাকার মূর্খ তোরা--
দে মহাকালনাথের জয়ধ্বনি।
প্রথমা
কোথায় তোমাদের মহাকালনাথ? দেখি নে তো চক্ষে।
দড়ি-প্রভুকে দেখছি প্রত্যক্ষ,--
হনুমানপ্রভুর লঙ্কা-পোড়ানো লেজখানার মতো--
কী মোটা, কী কালো, আহা দেখে চক্ষু সার্থক হল।
মরণকালে ওই দড়ি-ধোওয়া জল ছিটিয়ে দিয়ো আমার মাথায়।
দ্বিতীয়া
গালিয়ে নেব আমার হার, আমার বাজুবন্দ,
দড়ির ডগা দেব সোনা-বাঁধিয়ে।
তৃতীয়া
আহা, কী সুন্দর রূপ গো।
প্রথমা
যেন যমুনানদীর ধারা।
দ্বিতীয়া
যেন নাগকন্যার বেণী।
তৃতীয়া
যেন গণেশঠাকুরের শুঁড় চলেছে লম্বা হয়ে,
দেখে জল আসে চোখে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
প্রথমা
দড়ি-ঠাকুরের পুজো এনেছি ঠাকুর!
কিন্তু পুরুত যে নড়েন না, মন্তর পড়বে কে।
সন্ন্যাসী
কী হবে মন্তরে।
কালের পথ হয়েছে দুর্গম।
কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও গভীর গর্ত।
করতে হবে সব সমান, তবে ঘুচবে বিপদ।
তৃতীয়া
বাবা, সাতজন্মে শুনি নি এমন কথা।
চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিচু মাথা হেঁট ক'রে।
উঁচু-নিচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে।
সন্ন্যাসী
দিনে দিনে গর্তগুলোর হাঁ উঠছে বেড়ে।
হয়েছে বাড়াবাড়ি, সাঁকো আর টিঁকছে না।
ভেঙে পড়ল ব'লে।
[ প্রস্থান
প্রথমা
চল্‌ ভাই, তবে পুজো দিই গে রাস্তা-ঠাকুরকে।
আর গর্ত-প্রভুকেও তো সিন্নি দিয়ে করতে হবে খুশি,
কী জানি ওঁরা শাপ দেন যদি। একটি-আধটি তো নন,
আছেন দু-হাত পাঁচ-হাত অন্তর।
নমো নমো দড়ি-ভগবান, রাগ কোরো না ঠাকুর,
ঘরে আছে ছেলেপুলে।
[ মেয়েদের প্রস্থান
সৈন্যদলের প্রবেশ
প্রথম সৈনিক
ওরে বাস্‌ রে। দড়িটা পড়ে আছে পথের মাঝখানে--
যেন একজটা ডাকিনীর জটা
দ্বিতীয় সৈনিক
মাথা দিল হেঁট করে।
স্বয়ং রাজা লাগালেন হাত, আমরাও ছিলুম পিছনে।
একটু ক্যাঁচ্‌কোঁচও করলে না চাকাটা।
তৃতীয় সৈনিক
ও যে আমাদের কাজ নয়, তাই।
ক্ষত্রিয় আমরা, শূদ্র নই, নই গোরু।
চিরদিন আমরা চড়েই এসেছি রথে।
চিরদিন রথ টানে ওই ওরা-- যাদের নাম করতে নেই।
প্রথম নাগরিক
শোনো ভাই, আমার কথা।
কালের অপমান করেছি আমরা, তাই ঘটেছে এ-সব অনাসৃষ্টি।
তৃতীয় সৈনিক
এ মানুষটা আবার বলে কী।
প্রথম নাগরিক
ত্রেতাযুগে শূদ্র নিতে গেল ব্রাহ্মণের মান--
চাইলে তপস্যা করতে, এত বড়ো আস্পর্ধা--
সেদিনও অকাল লাগল দেশে, অচল হল রথ।
দয়াময় রামচন্দ্রের হাতে কাটা গেল তার মাথা,
তবে তো হল আপদশান্তি।
দ্বিতীয় নাগরিক
সেই শূদ্ররা শাস্ত্র পড়ছেন আজকাল,
হাত থেকে কাড়তে গেলে বলেন, আমরা কি মানুষ নই।
তৃতীয় নাগরিক
মানুষ নই! বটে! কতই শুনব কালে কালে।
কোন্‌দিন বলবে, ঢুকব দেবালয়ে।
বলবে, ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়ের সঙ্গে নাইব এক ঘাটে।
প্রথম নাগরিক
এর পরেও রথ যে চলছে না, সে আমাদের প্রতি দয়া করে।
চললে চাকার তলায় গুঁড়িয়ে যেত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
প্রথম সৈনিক
আজ শূদ্র পড়ে শাস্ত্র,
কাল লাঙল ধরবে ব্রাহ্মণ। সর্বনাশ!
দ্বিতীয় সৈনিক
চল্‌-না ওদের পাড়ায় গিয়ে প্রমাণ করে আসি--
ওরাই মানুষ না আমরা।
দ্বিতীয় নাগরিক
এ দিকে আবার কোন্‌ বুদ্ধিমান বলেছে রাজাকে--
কলিযুগে না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র,
চলে কেবল স্বর্ণচক্র। তিনি ডাক দিয়েছেন শেঠজিকে।
প্রথম সৈনিক
রথ যদি চলে বেনের টানে
তবে গলায় অস্ত্র বেঁধে জলে দেব ডুব।
দ্বিতীয় সৈনিক
দাদা, রাগ কর মিছে, সময় হয়েছে বাঁকা।
এ যুগে পুষ্পধনুর ছিলেটাও
বেনের টানেই দেয় মিঠে সুরে টংকার।
তার তীরগুলোর ফলা বেনের ঘরে শানিয়ে না আনলে
ঠিক জায়গায় বাজে না বুকে।
তৃতীয় সৈনিক
তা সত্যি। এ কালের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে,
পিছনে থাকে বেনে। যাকে বলে অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্তি।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
প্রথম সৈনিক
এই-যে সন্ন্যাসী, রথ চলে না কেন আমাদের হাতে।
সন্ন্যাসী
তোমরা দড়িটাকে করেছ জর্জর।
যেখানে যত তীর ছুঁড়েছ, বিঁধেছে ওর গায়ে।
ভিতরে ভিতরে ফাঁক হয়ে গেছে, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর।
তোমরা কেবল ওর ক্ষত বাড়িয়েই চলবে,
বলের মাতলামিতে দুর্বল করবে কালকে।
সরে যাও, সরে যাও ওর পথ থেকে।
[ প্রস্থান
ধনপতির অনুচরবর্গের প্রবেশ
প্রথম ধনিক
এটা কী গো, এখনি হুঁচট খেয়ে পড়েছিলুম।
দ্বিতীয় ধনিক
ওটাই তো রথের দড়ি।
চতুর্থ ধনিক
বীভৎস হয়ে উঠেছে, যেন বাসুকি ম'রে উঠল ফুলে।
প্রথম সৈনিক
কে এরা সব।
দ্বিতীয় সৈনিক
আংটির হীরে থেকে আলোর উচ্চিংড়েগুলো
লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে চোখে।
প্রথম নাগরিক
ধনপতি শেঠির দল এরা।
প্রথম ধনিক
আমাদের শেঠজিকে ডেকেছেন রাজা।
সবাই আশা করছে, তাঁর হাতেই চলবে রথ।
দ্বিতীয় সৈনিক
সবাই বলতে বোঝায় কাকে বাপু?
আর তারা আশাই বা করে কিসের।
দ্বিতীয় ধনিক
তারা জানে, আজকাল চলছে যা-কিছু
সব ধনপতির হাতেই চলছে।
প্রথম সৈনিক
সত্যি নাকি! এখনি দেখিয়ে দিতে পারি, তলোয়ার চলে আমাদেরই হাতে।
তৃতীয় ধনিক
তোমাদের হাতখানাকে চালাচ্ছে কে।
প্রথম সৈনিক
চুপ, দুর্বিনীত!
দ্বিতীয় ধনিক
চুপ করব আমরা বটে।
আজ আমাদেরই আওয়াজ ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে জলে স্থলে আকাশে।
প্রথম সৈনিক
মনে ভাবছ, আমাদের শতঘ্নী ভুলেছে তার বজ্রনাদ।
দ্বিতীয় ধনিক
ভুললে চলবে কেন। তাকে যে আমাদেরই হুকুম
ঘোষণা করতে হয় এক হাট থেকে আরেক হাটে সমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।
প্রথম নাগরিক
ওদের সঙ্গে পারবে না তর্কে।
প্রথম সৈনিক
কী বলো, পারব না!
সবচেয়ে বড়ো তর্কটা ঝন্‌ঝন্‌ করছে খাপের মধ্যে।
প্রথম নাগরিক
তোমাদের তলোয়ারগুলোর কোনোটা খায় ওদের নিমক,
কোনোটা খেয়ে বসেছে ওদের ঘুষ।
প্রথম ধনিক
শুনলেম, নর্মদাতীরের বাবাজিকে আনা হয়েছিল
দড়িতে হাত লাগাবার জন্যে। জান খবর?
দ্বিতীয় ধনিক
জানি বৈকি।
রাজার চর পৌঁছল গুহায়,
তখন প্রভু আছেন চিত হয়ে বুকে দুই পা আটকে।
তুরী ভেরী দামামা জগঝম্পের চোটে ধ্যান যদি বা ভাঙল,
পা-দুখানা তখন আড়ষ্ট কাঠ।
নাগরিক
শ্রীচরণের দোষ কী দাদা!
পঁয়ষট্টি বছরের মধ্যে একবারও নাম করে নি চলাফেরার।
বাবাজি বলবেন কী।
দ্বিতীয় ধনিক
কথা কওয়ার বালাই নেই।
জিভটার চাঞ্চল্যে রাগ করে গোড়াতেই সেটা ফেলেছেন কেটে।
ধনিক
তার পরে?
দ্বিতীয় ধনিক
তার পরে দশ জোয়ানে মিলে আনলে তাঁকে রথতলায়।
দড়িতে যেমনি তাঁর হাত পড়া,
রথের চাকা বসে যেতে লাগল মাটির নীচে।
ধনিক
নিজের মনটা যেমন ডুবিয়েছেন রথটাকেও তেমনি তলিয়ে দেবার চেষ্টা।
দ্বিতীয় ধনিক
একদিন উপবাসেই মানুষের পা চায় না চলতে--
পঁয়ষট্টি বছরের উপবাসের ভার পড়ল চাকার 'পরে।
মন্ত্রী ও ধনপতির প্রবেশ
ধনপতি
ডাক পড়ল কেন মন্ত্রীমশায়?
মন্ত্রী
অনর্থপাত হলেই সর্বাগ্রে তোমাকে স্মরণ করি।
ধনপতি
অর্থপাতে যার প্রতিকার, আমার দ্বারা তাই সম্ভব।
মন্ত্রী
মহাকালের রথ চলছে না।
ধনপতি
এ পর্যন্ত আমরা কেবল চাকায় তেল দিয়েছি, রশিতে টান দিই নি।
মন্ত্রী
অন্য সব শক্তি আজ অর্থহীন,
তোমাদের অর্থবান হাতের পরীক্ষা হোক।
ধনপতি
চেষ্টা করা যাক।
দৈবক্রমে চেষ্টা যদি সফল হয়, অপরাধ নিয়ো না তবে।
দলের লোকের প্রতি
বলো সিদ্ধিরস্তু!
সকলে
সিদ্ধিরস্তু!
ধনপতি
লাগো তবে ভাগ্যবানেরা। টান দেও।
ধনিক
রশি তুলতেই পারি নে। বিষম ভারী।
ধনপতি
এসো কোষাধ্যক্ষ, ধরো তুমি কষে।
বলো সিদ্ধিরস্তু! টানো, সিদ্ধিরস্তু।
টানো, সিদ্ধিরস্তু!
দ্বিতীয় ধনিক
মন্ত্রীমশায়, রশিটা যেন আরো আড়ষ্ট হয়ে উঠল,
আর আমাদের হাতে হল যেন পক্ষাঘাত।
সকলে
দুয়ো দুয়ো!
সৈনিক
যাক, আমাদের মান রক্ষা হল।
পুরোহিত
আমাদের ধর্মরক্ষা হল।
সৈনিক
যদি থাকত সেকাল, আজ তোমার মাথা যেত কাটা।
ধনপতি
ওই সোজা কাজটাই জান তোমরা।
মাথা খাটাতে পার না, কাটতেই পার মাথা।
মন্ত্রীমশায়, ভাবছ কী।
মন্ত্রী
ভাবছি, সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল--
এখন উপায় কী।
ধনপতি
এবার উপায় বের করবেন স্বয়ং মহাকাল।
তাঁর নিজের ডাক যেখানে পৌঁছবে
সেখান থেকে বাহন আসবে ছুটে।
আজ যারা চোখে পড়ে না
কাল তারা দেখা দেবে সবচেয়ে বেশি।
ওহে খাতাঞ্চি, এই বেলা সামলাও গে খাতাপত্র--
কোষাধ্যক্ষ, সিন্ধুকগুলো বন্ধ করো শক্ত তালায়।
[ ধনপতি ও তার দলের প্রস্থান
মেয়েদের প্রবেশ
প্রথমা
হাঁ গা, রথ চলল না এখনো, দেশসুদ্ধ রইল উপোস করে!
কলিকালে ভক্তি নেই যে।
মন্ত্রী
তোমাদের ভক্তির অভাব কী বাছা,
দেখি না তার জোর কত।
প্রথমা
নমো নমো,
নমো নমো বাবা দড়ি-ঠাকুর, অন্ত পাই নে তোমার দয়ার।
নমো নমো!
দ্বিতীয়া
তিনকড়ির মা বললে সতেরো বছরের ব্রাহ্মণের মেয়ে,
ঠিকদুক্ষুর বেলা, বোম ভোলানাথ ব'লে
তালপুকুরে-- ঘাটের থেকে তিন হাতের মধ্যে--
এক ডুবে তিন গোছা পাট-শিয়ালা তুলে
ভিজে চুল দিয়ে বেঁধে দড়ি-প্রভুর কাছে পোড়ালে
প্রভুর টনক নড়বে। জোগাড় করেছি অনেক যত্নে,
সময়ও হয়েছে পোড়াবার।
আগে দড়ি-বাবার গায়ে সিঁদুর-চন্দন লাগা;
ভয় কিসের, ভক্তবৎসল তিনি--
মনে মনে শ্রীগুরুর নাম করে গায়ে হাত ঠেকালে
অপরাধ নেবেন না তিনি।
প্রথমা
তুই দে-না ভাই চন্দন লাগিয়ে, আমাকে বলিস কেন।
আমার দেওরপো পেট-রোগা,
কী জানি কিসের থেকে কী হয়।
তৃতীয়া
ওই তো ধোঁওয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।
কিন্তু জাগলেন না তো।
দয়াময়!
জয় প্রভু, জয় দড়ি-দয়াল প্রভু, মুখ তুলে চাও।
তোমাকে দেব পরিয়ে পঁয়তাল্লিশ ভরির সোনার আংটি--
গড়াতে দিয়েছি বেণী স্যাকরার কাছে।
দ্বিতীয়া
তিন বছর থাকব দাসী হয়ে, ভোগ দেব তিন বেলা।
ওলো বিনি, পাখাটা এনেছিস তো বাতাস কর্‌-না--
দেখছিস্‌ নে রোদ্‌দুরে তেতে উঠেছে ওঁর মেঘবরন গা।
ঘটি করে গঙ্গাজলটা ঢেলে দে।
ওইখানকার কাদাটা দে তো, ভাই, আমার কপালে মাখিয়ে।
এই তো আমাদের খেঁদি এনেছে খিচুড়ি-ভোগ।
বেলা হয়ে গেল, আহা, কত কষ্ট পেলেন প্রভু!
জয় দড়ীশ্বর, জয় মহাদড়ীশ্বর, জয় দেবদেবদড়ীশ্বর,
গড় করি তোমায়, টলুক তোমার মন।
মাথা কুটছি তোমার পায়ে, টলুক তোমার মন।
পাখা কর্‌ লো; পাখা কর্‌, জোরে জোরে।
প্রথমা
কী হবে গো, কী হবে আমাদের--
দয়া হল না যে! আমার তিন ছেলে বিদেশে,
তারা ভালোয় ভালোয় ফিরলে হয়।
চরের প্রবেশ
মন্ত্রী
বাছারা, এখানে তোমাদের কাজ হল--
এখন ঘরে গিয়ে জপতপ ব্রতনিয়ম করো গে।
আমাদের কাজ আমরা করি।
প্রথমা
যাচ্ছি, কিন্তু দেখো মন্ত্রীবাবা,
ওই ধোঁওয়াটা যেন শেষ পর্যন্ত থাকে--
আর ওই বিল্বিপত্রটা যেন পড়ে না যায়।
[ মেয়েদের প্রস্থান
চর
মন্ত্রীমশায়, গোল বেধেছে শূদ্রপাড়ায়।
মন্ত্রী
কী হল।
চর
দলে দলে ওরা আসছে ছুটে-- বলছে, রথ চালাব আমরা।
সকলে
বলে কী! রশি ছুঁতেই পাবে না।
চর
ঠেকাবে কে তাদের। মারতে মারতে তলোয়ার যাবে ক্ষয়ে। মন্ত্রীমশায়, বসে পড়লে
যে।
মন্ত্রী
দল বেঁধে আসছে বলে ভয় করি নে-- ভয় হচ্ছে পারবে ওরা।
সৈনিক
বল কী মন্ত্রীমহারাজ, শিলা জলে ভাসবে?
মন্ত্রী
নীচের তলাটা হঠাৎ উপরের তলা হয়ে ওঠাকেই বলে প্রলয়,
বরাবর যা প্রচ্ছন্ন তাই প্রকাশ হবার সময়টাই যুগান্তর।
সৈনিক
আদেশ করুন কী করতে হবে, ভয় করি নে আমরা।
মন্ত্রী
ভয় করতেই হবে, তলোয়ারের বেড়া তুলে বন্যা ঠেকানো যায় না।
চর
এখন কী আদেশ বলুন।
মন্ত্রী
বাধা দিয়ো না ওদের।
বাধা পেলে শক্তি নিজেকে নিজে চিনতে পারে--
চিনতে পারলেই আর ঠেকানো যায় না।
চর
ওই-যে এসে পড়েছে ওরা।
মন্ত্রী
কিছু কোরো না তোমরা, থাকো স্থির হয়ে।
শূদ্রদলের প্রবেশ
দলপতি
আমরা এলেম বাবার রথ চালাতে।
মন্ত্রী
তোমরাই তো বাবার রথ চালিয়ে আসছ চিরদিন।
দলপতি
এতদিন আমরা পড়তেম রথের চাকার তলায়,
দ'লে গিয়ে ধুলোয় যেতুম চ্যাপটা হয়ে।
এবার সেই বলি তো নিল না বাবা।
মন্ত্রী
তাই তো দেখলেম।
সকাল থেকে চাকার সামনে ধুলোয় করলে লুটোপুটি--
ভয়ে উপরে তাকালে না, পাছে ঠাকুরের দিকে চোখ পড়ে--
তবু তো চাকার মধ্যে একটুও দেখা গেল না ক্ষুধার লক্ষণ।
পুরোহিত
একেই বলে অগ্নিমান্দ্য,
তেজ ক্ষয় হলেই ঘটে এই দশা।
দলপতি
এবার তিনি ডাক দিয়েছেন তাঁর রশি ধরতে।
পুরোহিত
রশি ধরতে! ভারি বুদ্ধি তোমাদের। জানলে কী করে।
দলপতি
কেমন করে জানা গেল সে তো কেউ জানে না।
ভোরবেলায় উঠেই সবাই বললে সবাইকে,
ডাক দিয়েছেন বাবা। কথাটা ছড়িয়ে গেল পাড়ায় পাড়ায়,
পেরিয়ে গেল মাঠ, পেরিয়ে গেল নদী,
পাহাড় ডিঙিয়ে গেল খবর--
ডাক দিয়েছেন বাবা।
সৈনিক
রক্ত দেবার জন্যে।
দলপতি
না, টান দেবার জন্যে।
পুরোহিত
বরাবর সংসার যারা চালায়, রথের রশি তাদেরই হাতে।
দলপতি
সংসার কি তোমরাই চালাও ঠাকুর?
পুরোহিত
স্পর্ধা দেখো একবার। কথার জবাব দিতে শিখেছে--
লাগল বলে ব্রহ্মশাপ।
দলপতি
মন্ত্রীমশায়, তোমরাই কি চালাও সংসার।
মন্ত্রী
সে কী কথা। সংসার বলতে তো তোমরাই।
নিজগুণেই চল, তাই রক্ষে।
চালাক লোকে বলে আমরাই চালাচ্ছি।
আমরা মান রাখি লোক ভুলিয়ে।
দলপতি
আমরাই তো জোগাই অন্ন, তাই তোমরা বাঁচ;
আমরাই বুনি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জারক্ষা।
সৈনিক
সর্বনাশ! এতদিন মাথা হেঁট করে বলে এসেছে ওরা,
তোমরাই আমাদের অন্নবস্ত্রের মালিক।
আজ ধরেছে উলটো বুলি, এ তো সহ্য হয় না।
মন্ত্রী
সৈনিকের প্রতি
চুপ করো।
সর্দার, মহাকালের বাহন তোমরাই,
তোমরা নারায়ণের গরুড়।
এখন তোমাদের কাজ সাধন করে যাও তোমরা।
তার পরে আসবে আমাদের কাজের পালা।
দলপতি
আয় রে ভাই, লাগাই টান, মরি আর বাঁচি।
মন্ত্রী
কিন্তু বাবা, সাবধানে রাস্তা বাঁচিয়ে চোলো।
বরাবর যে রাস্তায় রথ চলেছে যেয়ো সেই রাস্তা ধরে।
পোড়ো না যেন একেবারে আমাদের ঘাড়ের উপর।
দলপতি
কখ#না বড়ো রাস্তায় চলতে পাই নি, তাই রাস্তা চিনি নে।
রথে আছেন যিনি তিনিই সামলাবেন।
আয় ভাই, দেখছিস রথচূড়ায় কেতনটা উঠছে দুলে।
বাবার ইশারা। ভয় নেই আর, ভয় নেই। ওই চেয়ে দেখ্‌ রে ভাই
মরা নদীতে যেমন বান আসে
দড়ির মধ্যে তেমনি প্রাণ এসে পৌঁচেছে।
পুরোহিত
ছুঁলো, ছুঁলো দেখছি, ছুলো শেষে রশি ছুঁলো পাষণ্ডেরা।
মেয়েদের ছুটিয়া প্রবেশ
সকলে
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, দোহাই বাবা--
ও গদাধর, ও বনমালী, এমন মহাপাপ কোরো না।
পৃথিবী যাবে যে রসাতলে।
আমাদের স্বামী ভাই বোন ছেলে
কাউকে পারব না বাঁচাতে।
চল্‌ রে চল্‌, দেখলেও পাপ আছে।
[ প্রস্থান
পুরোহিত
চোখ বোজো, চোখ বোজো তোমরা।
ভস্ম হয়ে যাবে ক্রুদ্ধ মহাকালের মূর্তি দেখলে।
সৈনিক
এ কি, এ কি, চাকার শব্দ নাকি--
না আকাশটা উঠল আর্তনাদ করে?
পুরোহিত
হতেই পারে না-- কিছুতেই হতে পারে না--
কোনো শাস্ত্রেই লেখে না।
নাগরিক
নড়েছে রে, নড়েছে, ওই তো চলেছে।
সৈনিক
কী ধুলোই উড়ল-- পৃথিবী নিশ্বাস ছাড়ছে।
অন্যায়, ঘোর অন্যায়! রথ শেষে চলল যে--
পাপ, মহাপাপ!
শূদ্রদল
জয় জয়, মহাকালনাথের জয়!
পুরোহিত
তাই তো, এও দেখতে হল চোখে!
সৈনিক
ঠাকুর, তুমিই হুকুম করো, ঠেকাব রথ-চলা।
বৃদ্ধ হয়েছেন মহাকাল, তাঁর বুদ্ধিভ্রংশ হল--
দেখলেম সেটা স্বচক্ষে।
পুরোহিত
সাহস হয় না হুকুম করতে।
অবশেষে জাত খোওয়াতেই বাবার যদি খেয়াল গেল
এবারকার মতো চুপ করে থাকো 'রঞ্জুলাল।
আসছে বারে ওঁকে হবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে।
হবেই, হবেই, হবেই।
ওঁর দেহ শোধন করতে গঙ্গা যাবে শুকিয়ে।
সৈনিক
গঙ্গার দরকার হবে না।
ঘড়ার ঢাকনার মতো শূদ্রগুলোর মাথা দেব উড়িয়ে,
ঢালব ওদের রক্ত।
নাগরিক
মন্ত্রীমশায়, যাও কোথায়?
মন্ত্রী
যাব ওদের সঙ্গে রশি ধরতে।
সৈনিক
ছি ছি, ওদের হাতে হাত মেলাবে তুমি!
মন্ত্রী
ওরাই যে আজ পেয়েছে কালের প্রসাদ।
স্পষ্টই গেল দেখা, এ মায়া নয়, নয় স্বপ্ন।
এবার থেকে মান রাখতে হবে ওদের সঙ্গে সমান হয়ে।
সৈনিক
তাই বলে ওদেরই এক সারে রশি ধরা!
ঠেকাবই আমরা, রথ চলুক আর নাই চলুক।
মন্ত্রী
এবার দেখছি চাকার তলায় পড়বার পালা তোমাদেরই।
সৈনিক
সেও ভালো। অনেক কাল চণ্ডালের রক্ত শুষে চাকা আছে
অশুচি, এবার পাবে শুদ্ধ রক্ত। স্বাদ বদল করুক।
পুরোহিত
কী হল মন্ত্রী, এ কোন্‌ শনিগ্রহের ভেলকি?
রথটা যে এরই মধ্যে নেমে পড়েছে রাজপথে।
পৃথিবী তবু তো নেমে গেল না রসাতলে।
মাতাল রথ কোথায় পড়ে কোন্‌ পল্লীর ঘাড়ে, কে জানে।
সৈনিক
ওই দেখো, ধনপতির দল আর্তনাদ করে ডাকছে আমাদের।
রথটা একেবারে সোজা চলেছে ওদেরই ভাণ্ডারের মুখে।
যাই ওদের রক্ষা করতে।
মন্ত্রী
নিজেদের রক্ষার কথা ভাবো।
দেখছ না, ঝুঁকেছে তোমাদের অস্ত্রশালার দিকে।
সৈনিক
উপায়?
মন্ত্রী
ওদের সঙ্গে মিলে ধরো-সে রশি।
বাঁচবার দিকে ফিরিয়ে আনো রথটাকে--
দো-মনা করবার সময় নেই।
[ প্রস্থান
সৈনিক
কী করবে ঠাকুর, তুমি কী করবে।
পুরোহিত
বীরগণ, তোমরা কী করবে বলো আগে।
সৈনিক
কী করতে হবে বলো-না, ভাইসকল!
সবাই যে একেবারে চুপ করে গেছ!
রশি ধরব না লড়াই করব?
ঠাকুর, তুমি কী করবে বলোই-না।
পুরোহিত
কী জানি, রশি ধরব না শাস্ত্র আওড়াব।
সৈনিক
গেল, গেল সব। রথের এমন হাঁক শুনি নি কোনো পুরুষে।
দ্বিতীয় সৈনিক
চেয়ে দেখো-না, ওরাই কি টানছে রথ
না রথটা আপনিই চলেছে ওদের ঠেলে নিয়ে।
তৃতীয় সৈনিক
এতকাল রথটা চলত যেন স্বপ্নে--
আমরা দিতেম টান আর ও পিছে পিছে আসত দড়িবাঁধা গোরুর মতো।
আজ চলছে জেগে উঠে। বাপ রে, কী তেজ।
মানছে না আমাদের বাপদাদার পথ--
একটা কাঁচা পথে ছুটেছে বুনো মহিষের মতো।
পিঠের উপর চড়ে বসেছে যম।
দ্বিতীয় সৈনিক
ওই যে আসছে কবি, ওকে জিঞ্জাসা করি ব্যাপারটা কী।
পুরোহিত
পাগলের মতো কথা বলছ তোমরা।
আমরাই বুঝলেম না মানে, বুঝবে কবি?
ওরা তো বানিয়ে বানিয়ে বলে কথা-- শাস্ত্র জানে কী?
কবির প্রবেশ
দ্বিতীয় সৈনিক
এ কী উলটোপালটা ব্যাপার, কবি।
পুরুতের হাতে চলল না রথ, রাজার হাতে না--
মানে বুঝলে কিছু?
কবি
ওদের মাথা ছিল অত্যন্ত উঁচু,
মহাকালের রথের চুড়ার দিকেই ছিল ওদের দৃষ্টি--
নীচের দিকে নামল না চোখ,
রথের দড়িটাকেই করলে তুচ্ছ।
মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন তাকে ওরা মানে নি।
রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে ল্যাজ আছড়াচ্ছে--
দেবে ওদের হাড় গুঁড়িয়ে।
পুরোহিত
তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান--
ওরাই কি দড়ির নিয়ম মেনে চলতে পারবে।
কবি
পারবে না হয়তো।
একদিন ওরা ভাববে, রথী কেউ নেই, রথের সর্বময় কর্তা ওরাই।
দেখো, কাল থেকেই শুরু করবে চেঁচাতে--
জয় আমাদের হাল লাঙল চরকা তাঁতের।
তখন এঁরাই হবেন বলরামের চেলা--
হলধরের মাতলামিতে জগৎটা উঠবে টলমলিয়ে।
পুরোহিত
তখন যদি রথ আর-একবার অচল হয়
বোধ করি তোমার মতো কবিরই ডাক পড়বে--
তিনি ফুঁ দিয়ে ঘোরাবেন চাকা।
কবি
নিতান্ত ঠাট্টা নয় পুরুতঠাকুর!
রথযাত্রায় কবির ডাক পড়েছে বারে বারে,
কাজের লোকের ভিড় ঠেলে পারে নি সে পৌঁছতে।
পুরোহিত
রথ তারা চালাবে কিসের জোরে। বুঝিয়ে বলো।
কবি
গায়ের জোরে নয়, ছন্দের জোরে।
আমরা মানি ছন্দ, জানি একঝোঁকা হলেই তাল কাটে।
মরে মানুষ সেই অসুন্দরের হাতে
চাল-চলন যার এক পাশে বাঁকা;
কুম্ভকর্ণের মতো গড়ন যার বেমানান,
যার ভোজন কুৎসিত,
যার ওজন অপরিমিত।
আমরা মানি সুন্দরকে। তোমরা মানো কঠোরকে--
অস্ত্রের কঠোরকে, শাস্ত্রের কঠোরকে।
বাইরে ঠেলা-মারার উপর বিশ্বাস,
অন্তরের তালমানের উপর নয়।
সৈনিক
তুমি তো লম্বা উপদেশ দিয়ে চললে,
ও দিকে যে লাগল আগুন।
কবি
যুগাবসানে লাগেই তো আগুন।
যা ছাই হবার তাই ছাই হয়,
যা টিঁকে যায় তাই নিয়ে সৃষ্টি হয় নবযুগের।
সৈনিক
তুমি কী করবে কবি!
কবি
আমি তাল রেখে রেখে গান গাব।
সৈনিক
কী হবে তার ফল?
কবি
যারা টানছে রথ তারা পা ফেলবে তালে তালে।
পা যখন হয় বেতালা
তখন ক্ষুদে ক্ষুদে খালখন্দগুলো মারমূর্তি ধরে।
মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর।
মেয়েদের প্রবেশ
প্রথমা
এ হল কী ঠাকুর!
তোমরা এতদিন আমাদের কী শিখিয়েছিলে!
দেবতা মানলে না পুজো, ভক্তি হল মিছে।
মানলে কিনা শুদ্দুরের টান, মেলেচ্ছের ছোঁওয়া!
ছি, ছি, কী ঘেন্না।
কবি
পুজো তোমরা দিলে কোথায়।
দ্বিতীয়া
এই তো এইখানেই।
ঘি ঢেলেছি, দুধ ঢেলেছি, ঢেলেছি গঙ্গাজল--
রাস্তা এখনো কাদা হয়ে আছে!
পাতায় ফুলে ওখানটা গেছে পিছল হয়ে।
কবি
পুজো পড়েছে ধুলোয়, ভক্তি করেছে মাটি।
রথের দড়ি কি পড়ে থাকে বাইরে।
সে থাকে মানুষে মানুষে বাঁধা, দেহে দেহে প্রাণে প্রাণে।
সেইখানে জমেছে অপরাধ, বাঁধন হয়েছে দুর্বল।
তৃতীয়া
আর ওরা-- যাদের নাম করতে নেই?
কবি
ওদের দিকেই ঠাকুর পাশ ফিরলেন--
নইলে ছন্দ মেলে না। এক দিকটা উঁচু হয়েছিল অতিশয় বেশি,
ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,
সেইখান থেকে মারলেন টান, বড়োটাকে দিলেন কাত করে।
সমান করে নিলেন তাঁর আসনটা।
প্রথমা
তার পরে হবে কী।
কবি
তার পরে কোন্‌-এক যুগে কোন্‌-একদিন
আসবে উলটোরথের পালা।
তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া।
এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন--
রথের দড়িটাকে নাও বুকে তুলে, ধুলোয় ফেলো না;
রাস্তাটাকে ভক্তিরসে দিয়ো না কাদা করে।
আজকের মতো বলো সবাই মিলে--
যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে;
যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী
জয়-- মহাকালনাথের জয়!

প্রথম দৃশ্য

রথযাত্রার মেলায় মেয়েরা
প্রথমা
এবার কী হল, ভাই!
উঠেছি কোন্‌ ভোরে, তখন কাক ডাকে নি।
কঙ্কালিতলার দিঘিতে দুটো ডুব দিয়েই
ছুটে এলুম রথ দেখতে, বেলা হয়ে গেল;
রথের নেই দেখা। চাকার নেই শব্দ।
দ্বিতীয়া
চারি দিকে সব যেন থম্‌থমে হয়ে আছে,
ছম্‌ছম্‌ করছে গা।
তৃতীয়া
দোকানি পসারিরা চুপচাপ ব'সে,
কেনাবেচা বন্ধ। রাস্তার ধারে ধারে
লোক জটলা করে তাকিয়ে আছে
কখন্‌ আসবে রথ। যেন আশা ছেড়ে দিয়েছে।
প্রথমা
দেশের লোকের প্রথম যাত্রার দিন আজ;
বেরবেন ব্রাহ্মণঠাকুর শিষ্য নিয়ে,--
বেরবেন রাজা, পিছনে চলবে সৈন্যসামন্ত,--
পণ্ডিতমশায় বেরবেন, ছাত্ররা চলবে পুঁথিপত্র হাতে।
কোলের ছেলে নিয়ে মেয়েরা বেরবে,
ছেলেদের হবে প্রথম শুভযাত্রা--
কিন্তু কেন সব গেল হঠাৎ থেমে।
দ্বিতীয়া
ওই দেখ্‌, পুরুতঠাকুর বিড়্‌ বিড় করছে ওখানে।
মহাকালের পাণ্ডা বসে মাথায় হাত দিয়ে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী
সর্বনাশ এল।
বাধবে যুদ্ধ, জ্বলবে আগুন, লাগবে মারী,
ধরণী হবে বন্ধ্যা, জল যাবে শুকিয়ে।
প্রথমা
এ কী অকল্যাণের কথা, ঠাকুর!
উৎসবে এসেছি মহাকালের মন্দিরে--
আজ রথযাত্রার দিন।
সন্ন্যাসী
দেখতে পাচ্ছ না-- আজ ধনীর আছে ধন,
তার মূল্য গেছে ফাঁক হয়ে গজভুক্ত কপিত্থের মতো।
ভরা ফসলের খেতে বাসা করেছে উপবাস।
যক্ষরাজ স্বয়ং তার ভাণ্ডারে বসেছে প্রায়োপবেশনে।
দেখতে পাচ্ছি না-- লক্ষ্ণীর ভাণ্ড আজ শতছিদ্র,
তাঁর প্রসাদধারা শুষে নিচ্ছে মরুভূমিতে--
ফলছে না কোনো ফল।
তৃতীয়া
হাঁ ঠাকুর, তাই তো দেখি।
সন্ন্যাসী
তোমরা কেবলই করেছ ঋণ,
কিছুই কর নি শোধ,
দেউলে করে দিয়েছ যুগের বিত্ত।
তাই নড়ে না আজ আর রথ--
ওই যে, পথের বুক জুড়ে পড়ে আছে তার অসাড় দড়িটা।
প্রথমা
তাই তো,বাপ রে, গা শিউরে ওঠে--
এ যে অজগর সাপ, খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে আর নড়ে না।
সন্ন্যাসী
ওই তো রথের দড়ি, যত চলে না ততই জড়ায়।
যখন চলে, দেয় মুক্তি।
দ্বিতীয়া
বুঝেছি আমাদের পুজো নেবেন ব'লে
হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন দড়ি-দেবতা।
পুজো পেলেই হবেন তুষ্ট।
প্রথমা
ও ভাই, পুজো তো আনি নি। ভুল হয়েছে।
তৃতীয়া
পুজোর কথা তো ছিল না--
ভেবেছিলেম রথের মেলায় কেবল বেচব কিনব,
বাজি দেখব জাদুকরের,
আর দেখব বাঁদর-নাচ।
চল্‌-না শিগগির, এখনো সময় আছে,
আনি গে পুজো।
[সকলের প্রস্থান
নাগরিকদের প্রবেশ
প্রথম নাগরিক
দেখ্‌ দেখ্‌ রে, রথের দড়িটা কেমন করে পড়ে আছে।
যুগযুগান্তরের দড়ি, দেশদেশান্তরের হাত পড়েছে ওই দড়িতে,
আজ অনড় হয়ে মাটি কামড়ে আছে
সর্বাঙ্গ কালো ক'রে।
দ্বিতীয় নাগরিক
ভয় লাগছে রে। সরে দাঁড়া, সরে দাঁড়া।
মনে হচ্ছে ওটা এখনি ধরবে ফণা, মারবে ছোবল।
তৃতীয় নাগরিক
একটু একটু নড়ছে যেন রে। আঁকুবাঁকু করছে বুঝি।
প্রথম নাগরিক
বলিস্‌ নে অমন কথা। মুখে আনতে নেই।
ও যদি আপনি নড়ে তা হলে কি আর রক্ষে আছে।
তৃতীয় নাগরিক
তা হলে ওর নাড়া খেয়ে সংসারের সব জোড়গুলো
বিজোড় হয়ে পড়বে। আমরা যদি না চালাই--
ও যদি আপনি চলে, তা হলে পড়ব যে চাকার তলায়।
প্রথম নাগরিক
ওই দেখ্‌ ভাই, পুরুতের গেছে মুখ শুকিয়ে,
কোণে বসে বসে পড়ছে মন্তর।
দ্বিতীয় নাগরিক
সেদিন নেই রে
যেদিন পুরুতের মন্তর-পড়া হাতের টানে চলত রথ।
ওরা ছিল কালের প্রথম বাহন।
তৃতীয় নাগরিক
তবু আজ ভোরবেলা দেখি ঠাকুর লেগেছেন টান দিতে--
কিন্তু একেবারেই উলটো দিকে, পিছনের পথে।
প্রথম নাগরিক
সেটাই তো ঠিক পথ, পবিত্র পথ, আদি পথ।
সেই পথ থেকে দূরে এসেই তো কালের মাথার ঠিক থাকছে না।
দ্বিতীয় নাগরিক
মস্ত পণ্ডিত হয়ে উঠলি দেখি। এত কথা শিখলি কোথা।
প্রথম নাগরিক
ওই পণ্ডিতেরই কাছে। তাঁরা বলেন--
মহাকালের নিজের নাড়ীর টান পিছনের দিকে,
পাঁচজনের দড়ির টানে অগত্যা চলেন সামনে।
নইলে তিনি পিছু হটতে হটতে একেবারে পৌছতেন
অনাদি কালের অতল গহ্বরে।
তৃতীয় নাগরিক
ওই রশিটার দিকে চাইতে ভয় করে।
ওটা যেন যুগান্তের নাড়ী--
সান্নিপাতিক জ্বরে আজ দব্‌দব্‌ করছে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী
সর্বনাশ এল।
গুরুগুরু শব্দ মাটির নীচে।
ভূমিকম্পের জন্ম হচ্ছে।
গুহার মধ্য থেকে আগুন লক্‌লক্‌ মেলছে রসনা।
পূর্বে পশ্চিমে আকাশ হয়েছে রক্তবর্ণ।
প্রলয়দীপ্তির আঙটি পরেছে দিক্‌চক্রবাল।
[ প্রস্থান
প্রথম নাগরিক
দেশে পুণ্যাত্মা কেউ নেই কি আজ।
ধরুক-না এসে দড়িটা।
দ্বিতীয় নাগরিক
এক-একটি পুণ্যাত্মাকে খুঁজে বের করতেই
এক-এক যুগ যায় বয়ে--
ততক্ষণ পাপাত্মাদের হবে কী দশা।
তৃতীয় নাগরিক
পাপাত্মাদের কী হবে তা নিয়ে ভগবানের মাথাব্যাথা নেই।
দ্বিতীয় নাগরিক
সে কী কথা। সংসার তো পাপাত্মাদের নিয়েই।
তারা না থাকলে তো লোকনাথের রাজত্ব উজাড়।
পুণ্যাত্মা কালেভদ্রে দৈবাৎ আসে,
আমাদের ঠেলায় দৌড় মারে বনে জঙ্গলে গুহায়।
প্রথম নাগরিক
দড়িটার রঙ যেন এল নীল হয়ে।
সামলে কথা কোস।
মেয়েদের প্রবেশ
প্রথমা
বাজা ভাই, শাঁখ বাজা--
রথ না চললে কিছুই চলবে না।
চড়বে না হাঁড়ি, বুলবুলিতে খেয়ে যাবে ধান।
এরই মধ্যে আমার মেজো ছেলের গেছে চাকরি,
তার বউটা শুষছে জ্বরে। কপালে কী আছে জানি নে।
প্রথম নাগরিক
মেয়েমানুষ, তোমরা এখানে কী করতে।
কালের রথযাত্রায় কোনো হাত নেই তোমাদের।
কুটনো কোটো গে ঘরে।
দ্বিতীয়া
কেন, পুজো দিতে তো পারি।
আমরা না থাকলে পুরুতের পেট হত না এত মোটা।
গড় করি তোমায় দড়ি-নারায়ণ! প্রসন্ন হও।
এনেছি তোমার ভোগ। ওলো, ঢাল্‌ ঢাল্‌ ঘি,
ঢাল্‌ দুধ, গঙ্গাজলের ঘটি কোথায়,
ঢেলে দে-না জল। পঞ্চগব্য রাখ্‌ ওইখানে,
জ্বালা পঞ্চপ্রদীপ। বাবা দড়ি-নারায়ণ,
এই আমার মানত রইল, তুমি যখন নড়বে
মাথা মুড়িয়ে চুল দেব ফেলে।
তৃতীয়া
এক মাস ছেড়ে দেব ভাত, খাব শুধু রুটি।
বলো-না ভাই, সবাই মিলে-- জয় দড়ি-নারায়ণের জয়।
প্রথম নাগরিক
কোথাকার মূর্খ তোরা--
দে মহাকালনাথের জয়ধ্বনি।
প্রথমা
কোথায় তোমাদের মহাকালনাথ? দেখি নে তো চক্ষে।
দড়ি-প্রভুকে দেখছি প্রত্যক্ষ,--
হনুমানপ্রভুর লঙ্কা-পোড়ানো লেজখানার মতো--
কী মোটা, কী কালো, আহা দেখে চক্ষু সার্থক হল।
মরণকালে ওই দড়ি-ধোওয়া জল ছিটিয়ে দিয়ো আমার মাথায়।
দ্বিতীয়া
গালিয়ে নেব আমার হার, আমার বাজুবন্দ,
দড়ির ডগা দেব সোনা-বাঁধিয়ে।
তৃতীয়া
আহা, কী সুন্দর রূপ গো।
প্রথমা
যেন যমুনানদীর ধারা।
দ্বিতীয়া
যেন নাগকন্যার বেণী।
তৃতীয়া
যেন গণেশঠাকুরের শুঁড় চলেছে লম্বা হয়ে,
দেখে জল আসে চোখে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
প্রথমা
দড়ি-ঠাকুরের পুজো এনেছি ঠাকুর!
কিন্তু পুরুত যে নড়েন না, মন্তর পড়বে কে।
সন্ন্যাসী
কী হবে মন্তরে।
কালের পথ হয়েছে দুর্গম।
কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও গভীর গর্ত।
করতে হবে সব সমান, তবে ঘুচবে বিপদ।
তৃতীয়া
বাবা, সাতজন্মে শুনি নি এমন কথা।
চিরদিনই তো উঁচুর মান রেখেছে নিচু মাথা হেঁট ক'রে।
উঁচু-নিচুর সাঁকোর উপর দিয়েই তো রথ চলে।
সন্ন্যাসী
দিনে দিনে গর্তগুলোর হাঁ উঠছে বেড়ে।
হয়েছে বাড়াবাড়ি, সাঁকো আর টিঁকছে না।
ভেঙে পড়ল ব'লে।
[ প্রস্থান
প্রথমা
চল্‌ ভাই, তবে পুজো দিই গে রাস্তা-ঠাকুরকে।
আর গর্ত-প্রভুকেও তো সিন্নি দিয়ে করতে হবে খুশি,
কী জানি ওঁরা শাপ দেন যদি। একটি-আধটি তো নন,
আছেন দু-হাত পাঁচ-হাত অন্তর।
নমো নমো দড়ি-ভগবান, রাগ কোরো না ঠাকুর,
ঘরে আছে ছেলেপুলে।
[ মেয়েদের প্রস্থান
সৈন্যদলের প্রবেশ
প্রথম সৈনিক
ওরে বাস্‌ রে। দড়িটা পড়ে আছে পথের মাঝখানে--
যেন একজটা ডাকিনীর জটা
দ্বিতীয় সৈনিক
মাথা দিল হেঁট করে।
স্বয়ং রাজা লাগালেন হাত, আমরাও ছিলুম পিছনে।
একটু ক্যাঁচ্‌কোঁচও করলে না চাকাটা।
তৃতীয় সৈনিক
ও যে আমাদের কাজ নয়, তাই।
ক্ষত্রিয় আমরা, শূদ্র নই, নই গোরু।
চিরদিন আমরা চড়েই এসেছি রথে।
চিরদিন রথ টানে ওই ওরা-- যাদের নাম করতে নেই।
প্রথম নাগরিক
শোনো ভাই, আমার কথা।
কালের অপমান করেছি আমরা, তাই ঘটেছে এ-সব অনাসৃষ্টি।
তৃতীয় সৈনিক
এ মানুষটা আবার বলে কী।
প্রথম নাগরিক
ত্রেতাযুগে শূদ্র নিতে গেল ব্রাহ্মণের মান--
চাইলে তপস্যা করতে, এত বড়ো আস্পর্ধা--
সেদিনও অকাল লাগল দেশে, অচল হল রথ।
দয়াময় রামচন্দ্রের হাতে কাটা গেল তার মাথা,
তবে তো হল আপদশান্তি।
দ্বিতীয় নাগরিক
সেই শূদ্ররা শাস্ত্র পড়ছেন আজকাল,
হাত থেকে কাড়তে গেলে বলেন, আমরা কি মানুষ নই।
তৃতীয় নাগরিক
মানুষ নই! বটে! কতই শুনব কালে কালে।
কোন্‌দিন বলবে, ঢুকব দেবালয়ে।
বলবে, ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়ের সঙ্গে নাইব এক ঘাটে।
প্রথম নাগরিক
এর পরেও রথ যে চলছে না, সে আমাদের প্রতি দয়া করে।
চললে চাকার তলায় গুঁড়িয়ে যেত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।
প্রথম সৈনিক
আজ শূদ্র পড়ে শাস্ত্র,
কাল লাঙল ধরবে ব্রাহ্মণ। সর্বনাশ!
দ্বিতীয় সৈনিক
চল্‌-না ওদের পাড়ায় গিয়ে প্রমাণ করে আসি--
ওরাই মানুষ না আমরা।
দ্বিতীয় নাগরিক
এ দিকে আবার কোন্‌ বুদ্ধিমান বলেছে রাজাকে--
কলিযুগে না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র,
চলে কেবল স্বর্ণচক্র। তিনি ডাক দিয়েছেন শেঠজিকে।
প্রথম সৈনিক
রথ যদি চলে বেনের টানে
তবে গলায় অস্ত্র বেঁধে জলে দেব ডুব।
দ্বিতীয় সৈনিক
দাদা, রাগ কর মিছে, সময় হয়েছে বাঁকা।
এ যুগে পুষ্পধনুর ছিলেটাও
বেনের টানেই দেয় মিঠে সুরে টংকার।
তার তীরগুলোর ফলা বেনের ঘরে শানিয়ে না আনলে
ঠিক জায়গায় বাজে না বুকে।
তৃতীয় সৈনিক
তা সত্যি। এ কালের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে,
পিছনে থাকে বেনে। যাকে বলে অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্তি।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
প্রথম সৈনিক
এই-যে সন্ন্যাসী, রথ চলে না কেন আমাদের হাতে।
সন্ন্যাসী
তোমরা দড়িটাকে করেছ জর্জর।
যেখানে যত তীর ছুঁড়েছ, বিঁধেছে ওর গায়ে।
ভিতরে ভিতরে ফাঁক হয়ে গেছে, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর।
তোমরা কেবল ওর ক্ষত বাড়িয়েই চলবে,
বলের মাতলামিতে দুর্বল করবে কালকে।
সরে যাও, সরে যাও ওর পথ থেকে।
[ প্রস্থান
ধনপতির অনুচরবর্গের প্রবেশ
প্রথম ধনিক
এটা কী গো, এখনি হুঁচট খেয়ে পড়েছিলুম।
দ্বিতীয় ধনিক
ওটাই তো রথের দড়ি।
চতুর্থ ধনিক
বীভৎস হয়ে উঠেছে, যেন বাসুকি ম'রে উঠল ফুলে।
প্রথম সৈনিক
কে এরা সব।
দ্বিতীয় সৈনিক
আংটির হীরে থেকে আলোর উচ্চিংড়েগুলো
লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে চোখে।
প্রথম নাগরিক
ধনপতি শেঠির দল এরা।
প্রথম ধনিক
আমাদের শেঠজিকে ডেকেছেন রাজা।
সবাই আশা করছে, তাঁর হাতেই চলবে রথ।
দ্বিতীয় সৈনিক
সবাই বলতে বোঝায় কাকে বাপু?
আর তারা আশাই বা করে কিসের।
দ্বিতীয় ধনিক
তারা জানে, আজকাল চলছে যা-কিছু
সব ধনপতির হাতেই চলছে।
প্রথম সৈনিক
সত্যি নাকি! এখনি দেখিয়ে দিতে পারি, তলোয়ার চলে আমাদেরই হাতে।
তৃতীয় ধনিক
তোমাদের হাতখানাকে চালাচ্ছে কে।
প্রথম সৈনিক
চুপ, দুর্বিনীত!
দ্বিতীয় ধনিক
চুপ করব আমরা বটে।
আজ আমাদেরই আওয়াজ ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে জলে স্থলে আকাশে।
প্রথম সৈনিক
মনে ভাবছ, আমাদের শতঘ্নী ভুলেছে তার বজ্রনাদ।
দ্বিতীয় ধনিক
ভুললে চলবে কেন। তাকে যে আমাদেরই হুকুম
ঘোষণা করতে হয় এক হাট থেকে আরেক হাটে সমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।
প্রথম নাগরিক
ওদের সঙ্গে পারবে না তর্কে।
প্রথম সৈনিক
কী বলো, পারব না!
সবচেয়ে বড়ো তর্কটা ঝন্‌ঝন্‌ করছে খাপের মধ্যে।
প্রথম নাগরিক
তোমাদের তলোয়ারগুলোর কোনোটা খায় ওদের নিমক,
কোনোটা খেয়ে বসেছে ওদের ঘুষ।
প্রথম ধনিক
শুনলেম, নর্মদাতীরের বাবাজিকে আনা হয়েছিল
দড়িতে হাত লাগাবার জন্যে। জান খবর?
দ্বিতীয় ধনিক
জানি বৈকি।
রাজার চর পৌঁছল গুহায়,
তখন প্রভু আছেন চিত হয়ে বুকে দুই পা আটকে।
তুরী ভেরী দামামা জগঝম্পের চোটে ধ্যান যদি বা ভাঙল,
পা-দুখানা তখন আড়ষ্ট কাঠ।
নাগরিক
শ্রীচরণের দোষ কী দাদা!
পঁয়ষট্টি বছরের মধ্যে একবারও নাম করে নি চলাফেরার।
বাবাজি বলবেন কী।
দ্বিতীয় ধনিক
কথা কওয়ার বালাই নেই।
জিভটার চাঞ্চল্যে রাগ করে গোড়াতেই সেটা ফেলেছেন কেটে।
ধনিক
তার পরে?
দ্বিতীয় ধনিক
তার পরে দশ জোয়ানে মিলে আনলে তাঁকে রথতলায়।
দড়িতে যেমনি তাঁর হাত পড়া,
রথের চাকা বসে যেতে লাগল মাটির নীচে।
ধনিক
নিজের মনটা যেমন ডুবিয়েছেন রথটাকেও তেমনি তলিয়ে দেবার চেষ্টা।
দ্বিতীয় ধনিক
একদিন উপবাসেই মানুষের পা চায় না চলতে--
পঁয়ষট্টি বছরের উপবাসের ভার পড়ল চাকার 'পরে।
মন্ত্রী ও ধনপতির প্রবেশ
ধনপতি
ডাক পড়ল কেন মন্ত্রীমশায়?
মন্ত্রী
অনর্থপাত হলেই সর্বাগ্রে তোমাকে স্মরণ করি।
ধনপতি
অর্থপাতে যার প্রতিকার, আমার দ্বারা তাই সম্ভব।
মন্ত্রী
মহাকালের রথ চলছে না।
ধনপতি
এ পর্যন্ত আমরা কেবল চাকায় তেল দিয়েছি, রশিতে টান দিই নি।
মন্ত্রী
অন্য সব শক্তি আজ অর্থহীন,
তোমাদের অর্থবান হাতের পরীক্ষা হোক।
ধনপতি
চেষ্টা করা যাক।
দৈবক্রমে চেষ্টা যদি সফল হয়, অপরাধ নিয়ো না তবে।
দলের লোকের প্রতি
বলো সিদ্ধিরস্তু!
সকলে
সিদ্ধিরস্তু!
ধনপতি
লাগো তবে ভাগ্যবানেরা। টান দেও।
ধনিক
রশি তুলতেই পারি নে। বিষম ভারী।
ধনপতি
এসো কোষাধ্যক্ষ, ধরো তুমি কষে।
বলো সিদ্ধিরস্তু! টানো, সিদ্ধিরস্তু।
টানো, সিদ্ধিরস্তু!
দ্বিতীয় ধনিক
মন্ত্রীমশায়, রশিটা যেন আরো আড়ষ্ট হয়ে উঠল,
আর আমাদের হাতে হল যেন পক্ষাঘাত।
সকলে
দুয়ো দুয়ো!
সৈনিক
যাক, আমাদের মান রক্ষা হল।
পুরোহিত
আমাদের ধর্মরক্ষা হল।
সৈনিক
যদি থাকত সেকাল, আজ তোমার মাথা যেত কাটা।
ধনপতি
ওই সোজা কাজটাই জান তোমরা।
মাথা খাটাতে পার না, কাটতেই পার মাথা।
মন্ত্রীমশায়, ভাবছ কী।
মন্ত্রী
ভাবছি, সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল--
এখন উপায় কী।
ধনপতি
এবার উপায় বের করবেন স্বয়ং মহাকাল।
তাঁর নিজের ডাক যেখানে পৌঁছবে
সেখান থেকে বাহন আসবে ছুটে।
আজ যারা চোখে পড়ে না
কাল তারা দেখা দেবে সবচেয়ে বেশি।
ওহে খাতাঞ্চি, এই বেলা সামলাও গে খাতাপত্র--
কোষাধ্যক্ষ, সিন্ধুকগুলো বন্ধ করো শক্ত তালায়।
[ ধনপতি ও তার দলের প্রস্থান
মেয়েদের প্রবেশ
প্রথমা
হাঁ গা, রথ চলল না এখনো, দেশসুদ্ধ রইল উপোস করে!
কলিকালে ভক্তি নেই যে।
মন্ত্রী
তোমাদের ভক্তির অভাব কী বাছা,
দেখি না তার জোর কত।
প্রথমা
নমো নমো,
নমো নমো বাবা দড়ি-ঠাকুর, অন্ত পাই নে তোমার দয়ার।
নমো নমো!
দ্বিতীয়া
তিনকড়ির মা বললে সতেরো বছরের ব্রাহ্মণের মেয়ে,
ঠিকদুক্ষুর বেলা, বোম ভোলানাথ ব'লে
তালপুকুরে-- ঘাটের থেকে তিন হাতের মধ্যে--
এক ডুবে তিন গোছা পাট-শিয়ালা তুলে
ভিজে চুল দিয়ে বেঁধে দড়ি-প্রভুর কাছে পোড়ালে
প্রভুর টনক নড়বে। জোগাড় করেছি অনেক যত্নে,
সময়ও হয়েছে পোড়াবার।
আগে দড়ি-বাবার গায়ে সিঁদুর-চন্দন লাগা;
ভয় কিসের, ভক্তবৎসল তিনি--
মনে মনে শ্রীগুরুর নাম করে গায়ে হাত ঠেকালে
অপরাধ নেবেন না তিনি।
প্রথমা
তুই দে-না ভাই চন্দন লাগিয়ে, আমাকে বলিস কেন।
আমার দেওরপো পেট-রোগা,
কী জানি কিসের থেকে কী হয়।
তৃতীয়া
ওই তো ধোঁওয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।
কিন্তু জাগলেন না তো।
দয়াময়!
জয় প্রভু, জয় দড়ি-দয়াল প্রভু, মুখ তুলে চাও।
তোমাকে দেব পরিয়ে পঁয়তাল্লিশ ভরির সোনার আংটি--
গড়াতে দিয়েছি বেণী স্যাকরার কাছে।
দ্বিতীয়া
তিন বছর থাকব দাসী হয়ে, ভোগ দেব তিন বেলা।
ওলো বিনি, পাখাটা এনেছিস তো বাতাস কর্‌-না--
দেখছিস্‌ নে রোদ্‌দুরে তেতে উঠেছে ওঁর মেঘবরন গা।
ঘটি করে গঙ্গাজলটা ঢেলে দে।
ওইখানকার কাদাটা দে তো, ভাই, আমার কপালে মাখিয়ে।
এই তো আমাদের খেঁদি এনেছে খিচুড়ি-ভোগ।
বেলা হয়ে গেল, আহা, কত কষ্ট পেলেন প্রভু!
জয় দড়ীশ্বর, জয় মহাদড়ীশ্বর, জয় দেবদেবদড়ীশ্বর,
গড় করি তোমায়, টলুক তোমার মন।
মাথা কুটছি তোমার পায়ে, টলুক তোমার মন।
পাখা কর্‌ লো; পাখা কর্‌, জোরে জোরে।
প্রথমা
কী হবে গো, কী হবে আমাদের--
দয়া হল না যে! আমার তিন ছেলে বিদেশে,
তারা ভালোয় ভালোয় ফিরলে হয়।
চরের প্রবেশ
মন্ত্রী
বাছারা, এখানে তোমাদের কাজ হল--
এখন ঘরে গিয়ে জপতপ ব্রতনিয়ম করো গে।
আমাদের কাজ আমরা করি।
প্রথমা
যাচ্ছি, কিন্তু দেখো মন্ত্রীবাবা,
ওই ধোঁওয়াটা যেন শেষ পর্যন্ত থাকে--
আর ওই বিল্বিপত্রটা যেন পড়ে না যায়।
[ মেয়েদের প্রস্থান
চর
মন্ত্রীমশায়, গোল বেধেছে শূদ্রপাড়ায়।
মন্ত্রী
কী হল।
চর
দলে দলে ওরা আসছে ছুটে-- বলছে, রথ চালাব আমরা।
সকলে
বলে কী! রশি ছুঁতেই পাবে না।
চর
ঠেকাবে কে তাদের। মারতে মারতে তলোয়ার যাবে ক্ষয়ে। মন্ত্রীমশায়, বসে পড়লে
যে।
মন্ত্রী
দল বেঁধে আসছে বলে ভয় করি নে-- ভয় হচ্ছে পারবে ওরা।
সৈনিক
বল কী মন্ত্রীমহারাজ, শিলা জলে ভাসবে?
মন্ত্রী
নীচের তলাটা হঠাৎ উপরের তলা হয়ে ওঠাকেই বলে প্রলয়,
বরাবর যা প্রচ্ছন্ন তাই প্রকাশ হবার সময়টাই যুগান্তর।
সৈনিক
আদেশ করুন কী করতে হবে, ভয় করি নে আমরা।
মন্ত্রী
ভয় করতেই হবে, তলোয়ারের বেড়া তুলে বন্যা ঠেকানো যায় না।
চর
এখন কী আদেশ বলুন।
মন্ত্রী
বাধা দিয়ো না ওদের।
বাধা পেলে শক্তি নিজেকে নিজে চিনতে পারে--
চিনতে পারলেই আর ঠেকানো যায় না।
চর
ওই-যে এসে পড়েছে ওরা।
মন্ত্রী
কিছু কোরো না তোমরা, থাকো স্থির হয়ে।
শূদ্রদলের প্রবেশ
দলপতি
আমরা এলেম বাবার রথ চালাতে।
মন্ত্রী
তোমরাই তো বাবার রথ চালিয়ে আসছ চিরদিন।
দলপতি
এতদিন আমরা পড়তেম রথের চাকার তলায়,
দ'লে গিয়ে ধুলোয় যেতুম চ্যাপটা হয়ে।
এবার সেই বলি তো নিল না বাবা।
মন্ত্রী
তাই তো দেখলেম।
সকাল থেকে চাকার সামনে ধুলোয় করলে লুটোপুটি--
ভয়ে উপরে তাকালে না, পাছে ঠাকুরের দিকে চোখ পড়ে--
তবু তো চাকার মধ্যে একটুও দেখা গেল না ক্ষুধার লক্ষণ।
পুরোহিত
একেই বলে অগ্নিমান্দ্য,
তেজ ক্ষয় হলেই ঘটে এই দশা।
দলপতি
এবার তিনি ডাক দিয়েছেন তাঁর রশি ধরতে।
পুরোহিত
রশি ধরতে! ভারি বুদ্ধি তোমাদের। জানলে কী করে।
দলপতি
কেমন করে জানা গেল সে তো কেউ জানে না।
ভোরবেলায় উঠেই সবাই বললে সবাইকে,
ডাক দিয়েছেন বাবা। কথাটা ছড়িয়ে গেল পাড়ায় পাড়ায়,
পেরিয়ে গেল মাঠ, পেরিয়ে গেল নদী,
পাহাড় ডিঙিয়ে গেল খবর--
ডাক দিয়েছেন বাবা।
সৈনিক
রক্ত দেবার জন্যে।
দলপতি
না, টান দেবার জন্যে।
পুরোহিত
বরাবর সংসার যারা চালায়, রথের রশি তাদেরই হাতে।
দলপতি
সংসার কি তোমরাই চালাও ঠাকুর?
পুরোহিত
স্পর্ধা দেখো একবার। কথার জবাব দিতে শিখেছে--
লাগল বলে ব্রহ্মশাপ।
দলপতি
মন্ত্রীমশায়, তোমরাই কি চালাও সংসার।
মন্ত্রী
সে কী কথা। সংসার বলতে তো তোমরাই।
নিজগুণেই চল, তাই রক্ষে।
চালাক লোকে বলে আমরাই চালাচ্ছি।
আমরা মান রাখি লোক ভুলিয়ে।
দলপতি
আমরাই তো জোগাই অন্ন, তাই তোমরা বাঁচ;
আমরাই বুনি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জারক্ষা।
সৈনিক
সর্বনাশ! এতদিন মাথা হেঁট করে বলে এসেছে ওরা,
তোমরাই আমাদের অন্নবস্ত্রের মালিক।
আজ ধরেছে উলটো বুলি, এ তো সহ্য হয় না।
মন্ত্রী
সৈনিকের প্রতি
চুপ করো।
সর্দার, মহাকালের বাহন তোমরাই,
তোমরা নারায়ণের গরুড়।
এখন তোমাদের কাজ সাধন করে যাও তোমরা।
তার পরে আসবে আমাদের কাজের পালা।
দলপতি
আয় রে ভাই, লাগাই টান, মরি আর বাঁচি।
মন্ত্রী
কিন্তু বাবা, সাবধানে রাস্তা বাঁচিয়ে চোলো।
বরাবর যে রাস্তায় রথ চলেছে যেয়ো সেই রাস্তা ধরে।
পোড়ো না যেন একেবারে আমাদের ঘাড়ের উপর।
দলপতি
কখ#না বড়ো রাস্তায় চলতে পাই নি, তাই রাস্তা চিনি নে।
রথে আছেন যিনি তিনিই সামলাবেন।
আয় ভাই, দেখছিস রথচূড়ায় কেতনটা উঠছে দুলে।
বাবার ইশারা। ভয় নেই আর, ভয় নেই। ওই চেয়ে দেখ্‌ রে ভাই
মরা নদীতে যেমন বান আসে
দড়ির মধ্যে তেমনি প্রাণ এসে পৌঁচেছে।
পুরোহিত
ছুঁলো, ছুঁলো দেখছি, ছুলো শেষে রশি ছুঁলো পাষণ্ডেরা।
মেয়েদের ছুটিয়া প্রবেশ
সকলে
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, দোহাই বাবা--
ও গদাধর, ও বনমালী, এমন মহাপাপ কোরো না।
পৃথিবী যাবে যে রসাতলে।
আমাদের স্বামী ভাই বোন ছেলে
কাউকে পারব না বাঁচাতে।
চল্‌ রে চল্‌, দেখলেও পাপ আছে।
[ প্রস্থান
পুরোহিত
চোখ বোজো, চোখ বোজো তোমরা।
ভস্ম হয়ে যাবে ক্রুদ্ধ মহাকালের মূর্তি দেখলে।
সৈনিক
এ কি, এ কি, চাকার শব্দ নাকি--
না আকাশটা উঠল আর্তনাদ করে?
পুরোহিত
হতেই পারে না-- কিছুতেই হতে পারে না--
কোনো শাস্ত্রেই লেখে না।
নাগরিক
নড়েছে রে, নড়েছে, ওই তো চলেছে।
সৈনিক
কী ধুলোই উড়ল-- পৃথিবী নিশ্বাস ছাড়ছে।
অন্যায়, ঘোর অন্যায়! রথ শেষে চলল যে--
পাপ, মহাপাপ!
শূদ্রদল
জয় জয়, মহাকালনাথের জয়!
পুরোহিত
তাই তো, এও দেখতে হল চোখে!
সৈনিক
ঠাকুর, তুমিই হুকুম করো, ঠেকাব রথ-চলা।
বৃদ্ধ হয়েছেন মহাকাল, তাঁর বুদ্ধিভ্রংশ হল--
দেখলেম সেটা স্বচক্ষে।
পুরোহিত
সাহস হয় না হুকুম করতে।
অবশেষে জাত খোওয়াতেই বাবার যদি খেয়াল গেল
এবারকার মতো চুপ করে থাকো 'রঞ্জুলাল।
আসছে বারে ওঁকে হবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে।
হবেই, হবেই, হবেই।
ওঁর দেহ শোধন করতে গঙ্গা যাবে শুকিয়ে।
সৈনিক
গঙ্গার দরকার হবে না।
ঘড়ার ঢাকনার মতো শূদ্রগুলোর মাথা দেব উড়িয়ে,
ঢালব ওদের রক্ত।
নাগরিক
মন্ত্রীমশায়, যাও কোথায়?
মন্ত্রী
যাব ওদের সঙ্গে রশি ধরতে।
সৈনিক
ছি ছি, ওদের হাতে হাত মেলাবে তুমি!
মন্ত্রী
ওরাই যে আজ পেয়েছে কালের প্রসাদ।
স্পষ্টই গেল দেখা, এ মায়া নয়, নয় স্বপ্ন।
এবার থেকে মান রাখতে হবে ওদের সঙ্গে সমান হয়ে।
সৈনিক
তাই বলে ওদেরই এক সারে রশি ধরা!
ঠেকাবই আমরা, রথ চলুক আর নাই চলুক।
মন্ত্রী
এবার দেখছি চাকার তলায় পড়বার পালা তোমাদেরই।
সৈনিক
সেও ভালো। অনেক কাল চণ্ডালের রক্ত শুষে চাকা আছে
অশুচি, এবার পাবে শুদ্ধ রক্ত। স্বাদ বদল করুক।
পুরোহিত
কী হল মন্ত্রী, এ কোন্‌ শনিগ্রহের ভেলকি?
রথটা যে এরই মধ্যে নেমে পড়েছে রাজপথে।
পৃথিবী তবু তো নেমে গেল না রসাতলে।
মাতাল রথ কোথায় পড়ে কোন্‌ পল্লীর ঘাড়ে, কে জানে।
সৈনিক
ওই দেখো, ধনপতির দল আর্তনাদ করে ডাকছে আমাদের।
রথটা একেবারে সোজা চলেছে ওদেরই ভাণ্ডারের মুখে।
যাই ওদের রক্ষা করতে।
মন্ত্রী
নিজেদের রক্ষার কথা ভাবো।
দেখছ না, ঝুঁকেছে তোমাদের অস্ত্রশালার দিকে।
সৈনিক
উপায়?
মন্ত্রী
ওদের সঙ্গে মিলে ধরো-সে রশি।
বাঁচবার দিকে ফিরিয়ে আনো রথটাকে--
দো-মনা করবার সময় নেই।
[ প্রস্থান
সৈনিক
কী করবে ঠাকুর, তুমি কী করবে।
পুরোহিত
বীরগণ, তোমরা কী করবে বলো আগে।
সৈনিক
কী করতে হবে বলো-না, ভাইসকল!
সবাই যে একেবারে চুপ করে গেছ!
রশি ধরব না লড়াই করব?
ঠাকুর, তুমি কী করবে বলোই-না।
পুরোহিত
কী জানি, রশি ধরব না শাস্ত্র আওড়াব।
সৈনিক
গেল, গেল সব। রথের এমন হাঁক শুনি নি কোনো পুরুষে।
দ্বিতীয় সৈনিক
চেয়ে দেখো-না, ওরাই কি টানছে রথ
না রথটা আপনিই চলেছে ওদের ঠেলে নিয়ে।
তৃতীয় সৈনিক
এতকাল রথটা চলত যেন স্বপ্নে--
আমরা দিতেম টান আর ও পিছে পিছে আসত দড়িবাঁধা গোরুর মতো।
আজ চলছে জেগে উঠে। বাপ রে, কী তেজ।
মানছে না আমাদের বাপদাদার পথ--
একটা কাঁচা পথে ছুটেছে বুনো মহিষের মতো।
পিঠের উপর চড়ে বসেছে যম।
দ্বিতীয় সৈনিক
ওই যে আসছে কবি, ওকে জিঞ্জাসা করি ব্যাপারটা কী।
পুরোহিত
পাগলের মতো কথা বলছ তোমরা।
আমরাই বুঝলেম না মানে, বুঝবে কবি?
ওরা তো বানিয়ে বানিয়ে বলে কথা-- শাস্ত্র জানে কী?
কবির প্রবেশ
দ্বিতীয় সৈনিক
এ কী উলটোপালটা ব্যাপার, কবি।
পুরুতের হাতে চলল না রথ, রাজার হাতে না--
মানে বুঝলে কিছু?
কবি
ওদের মাথা ছিল অত্যন্ত উঁচু,
মহাকালের রথের চুড়ার দিকেই ছিল ওদের দৃষ্টি--
নীচের দিকে নামল না চোখ,
রথের দড়িটাকেই করলে তুচ্ছ।
মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন তাকে ওরা মানে নি।
রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে ল্যাজ আছড়াচ্ছে--
দেবে ওদের হাড় গুঁড়িয়ে।
পুরোহিত
তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান--
ওরাই কি দড়ির নিয়ম মেনে চলতে পারবে।
কবি
পারবে না হয়তো।
একদিন ওরা ভাববে, রথী কেউ নেই, রথের সর্বময় কর্তা ওরাই।
দেখো, কাল থেকেই শুরু করবে চেঁচাতে--
জয় আমাদের হাল লাঙল চরকা তাঁতের।
তখন এঁরাই হবেন বলরামের চেলা--
হলধরের মাতলামিতে জগৎটা উঠবে টলমলিয়ে।
পুরোহিত
তখন যদি রথ আর-একবার অচল হয়
বোধ করি তোমার মতো কবিরই ডাক পড়বে--
তিনি ফুঁ দিয়ে ঘোরাবেন চাকা।
কবি
নিতান্ত ঠাট্টা নয় পুরুতঠাকুর!
রথযাত্রায় কবির ডাক পড়েছে বারে বারে,
কাজের লোকের ভিড় ঠেলে পারে নি সে পৌঁছতে।
পুরোহিত
রথ তারা চালাবে কিসের জোরে। বুঝিয়ে বলো।
কবি
গায়ের জোরে নয়, ছন্দের জোরে।
আমরা মানি ছন্দ, জানি একঝোঁকা হলেই তাল কাটে।
মরে মানুষ সেই অসুন্দরের হাতে
চাল-চলন যার এক পাশে বাঁকা;
কুম্ভকর্ণের মতো গড়ন যার বেমানান,
যার ভোজন কুৎসিত,
যার ওজন অপরিমিত।
আমরা মানি সুন্দরকে। তোমরা মানো কঠোরকে--
অস্ত্রের কঠোরকে, শাস্ত্রের কঠোরকে।
বাইরে ঠেলা-মারার উপর বিশ্বাস,
অন্তরের তালমানের উপর নয়।
সৈনিক
তুমি তো লম্বা উপদেশ দিয়ে চললে,
ও দিকে যে লাগল আগুন।
কবি
যুগাবসানে লাগেই তো আগুন।
যা ছাই হবার তাই ছাই হয়,
যা টিঁকে যায় তাই নিয়ে সৃষ্টি হয় নবযুগের।
সৈনিক
তুমি কী করবে কবি!
কবি
আমি তাল রেখে রেখে গান গাব।
সৈনিক
কী হবে তার ফল?
কবি
যারা টানছে রথ তারা পা ফেলবে তালে তালে।
পা যখন হয় বেতালা
তখন ক্ষুদে ক্ষুদে খালখন্দগুলো মারমূর্তি ধরে।
মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর।
মেয়েদের প্রবেশ
প্রথমা
এ হল কী ঠাকুর!
তোমরা এতদিন আমাদের কী শিখিয়েছিলে!
দেবতা মানলে না পুজো, ভক্তি হল মিছে।
মানলে কিনা শুদ্দুরের টান, মেলেচ্ছের ছোঁওয়া!
ছি, ছি, কী ঘেন্না।
কবি
পুজো তোমরা দিলে কোথায়।
দ্বিতীয়া
এই তো এইখানেই।
ঘি ঢেলেছি, দুধ ঢেলেছি, ঢেলেছি গঙ্গাজল--
রাস্তা এখনো কাদা হয়ে আছে!
পাতায় ফুলে ওখানটা গেছে পিছল হয়ে।
কবি
পুজো পড়েছে ধুলোয়, ভক্তি করেছে মাটি।
রথের দড়ি কি পড়ে থাকে বাইরে।
সে থাকে মানুষে মানুষে বাঁধা, দেহে দেহে প্রাণে প্রাণে।
সেইখানে জমেছে অপরাধ, বাঁধন হয়েছে দুর্বল।
তৃতীয়া
আর ওরা-- যাদের নাম করতে নেই?
কবি
ওদের দিকেই ঠাকুর পাশ ফিরলেন--
নইলে ছন্দ মেলে না। এক দিকটা উঁচু হয়েছিল অতিশয় বেশি,
ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,
সেইখান থেকে মারলেন টান, বড়োটাকে দিলেন কাত করে।
সমান করে নিলেন তাঁর আসনটা।
প্রথমা
তার পরে হবে কী।
কবি
তার পরে কোন্‌-এক যুগে কোন্‌-একদিন
আসবে উলটোরথের পালা।
তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া।
এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন--
রথের দড়িটাকে নাও বুকে তুলে, ধুলোয় ফেলো না;
রাস্তাটাকে ভক্তিরসে দিয়ো না কাদা করে।
আজকের মতো বলো সবাই মিলে--
যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে;
যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।
সন্ন্যাসীর প্রবেশ
সন্ন্যাসী
জয়-- মহাকালনাথের জয়!

Rendition

Please Login first to submit a rendition. Click here for help.