শক্ত হল রোগ, হপ্তা-পাঁচেক ছিল আমার ভোগ। একটুকু যেই সুস্থ হলেম পরে লোক ধরে না ঘরে, ব্যামোর চেয়ে অনেক বেশি ঘটাল দুর্যোগ। এল ভবেশ, এল পালিত, এল বন্ধু ঈশান, এল পোলিটিশান, এল গোকুল সংবাদপত্রের, খবর রাখে সকল পাড়ার নাড়ীনক্ষত্রের। কেউ-বা বলে "বদল করো হাওয়া', কেউ-বা বলে "ভালো ক'রে করবে খাওয়াদাওয়া'। কেউ-বা বলে "মহেন্দ্র ডাক্তার এই ব্যামোতে তার মতো কেউ ওস্তাদ নেই আর'। দেয়াল ঘেঁষে ওই যে সবার পাছে সতীশ বসে আছে। থাকে সে এই পাড়ায়, চুলগুলো তার ঊর্ধ্বে তোলা পাঁচ আঙুলের নাড়ায়। চোখে চশমা আঁটা, এক কোণে তার ফেটে গেছে বাঁয়ের পরকলাটা। গলার বোতাম খোলা প্রশান্ত তার চাউনি ভাবে-ভোলা। সর্বদা তার হাতে থাকে বাঁধানো এক খাতা, হঠাৎ খুলে পাতা লুকিয়ে লুকিয়ে কী-যে লেখে, হয়তো বা সে কবি, কিম্বা আঁকে ছবি। নবীন আমায় শোনায় কানে-কানে, ওই ছেলেটার গোপন খবর নিশ্চিত সেই জানে -- যাকে বলে "স্পাই', সন্দেহ তার নাই। আমি বলি, হবেও বা, ভক্তিসম নিরীহ ওই মুখে খাতার কোণে রিপোর্ট করার খোরাক নিচ্ছে টুকে। ও মানুষটা সত্যি যদি তেমনি হেয় হয়, ঘৃণা করব, কেন করব ভয়। এই বছরে বছরখানেক বেড়িয়ে নিলেম পাঞ্জাবে কাশ্মীরে। এলেম যখন ফিরে; এল গণেশ পলটু এল, এল নবীন পাল, এল মাখনলাল। হাতে একটা মোড়ক নিয়ে প্রণাম করলে পাঁচু, মুখটা কাঁচুমাচু। "মনিব কোথায়' শুধাই আমি তারে, "সতীশ কোথায় হাঁ রে।' নবীন বললে, "খবর পান নি তবে দিন-পনেরো হবে উপোস করে মারা গেল সোনার-টুকরো ছেলে নন্-ভায়োলেন্স প্রচার করে গেল যখন আলিপুরের জেলে।' পাঁচু আমার হাতে দিল খাতা, খুলে দেখি পাতার পরে পাতা-- দেশের কথা কী বলেছি তাই লিখেছে গভীর অনুরাগে, পাঠিয়ে দিল জেলে যাবার আগে। আজকে বসে বসে ভাবি, মুখের কথাগুলো ঝরা পাতার মতোই তারা ধুলোয় হত ধুলো। সেইগুলোকে সত্য করে বাঁচিয়ে রাখবে কি এ মৃত্যুসুধার নিত্যপরশ দিয়ে।
ভাবি বসে বসে গত জীবনের কথা, কাঁচা মনে ছিল কী বিষম মূঢ়তা। শেষে ধিক্কারে বলি হাত নেড়ে, যাক গে সে কথা যাক গে। তরুণ বেলাতে যে খেলা খেলাতে ভয় ছিল হারবার, তারি লাগি, প্রিয়ে, সংশয়ে মোরে ফিরিয়েছ বার বার। কৃপণ কৃপার ভাঙা কণা একটুক মনে দেয় নাই সুখ। সে যুগের শেষে আজ বলি হেসে, কম কি সে কৌতুক যতটুকু ছিল ভাগ্যে, দুঃখের কথা থাক্ গে। পঞ্চমী তিথি বনের আড়াল থেকে দেখা দিয়েছিল ছায়া দিয়ে মুখ ঢেকে। মহা আক্ষেপে বলেছি সেদিন, এ ছল কিসের জন্য। পরিতাপে জ্বলি আজ আমি বলি, সিকি চাঁদিনীর আলো দেউলে নিশার অমাবস্যার চেয়ে যে অনেক ভালো। বলি আরবার, এসো পঞ্চমী, এসো, চাপা হাসিটুকু হেসো, আধখানি বেঁকে ছলনায় ঢেকে না জানিয়ে ভালোবেসো। দয়া, ফাঁকি নামে গণ্য, আমারে করুক ধন্য। আজ খুলিয়াছি পুরানো স্মৃতির ঝুলি, দেখি নেড়েচেড়ে ভুলের দুঃখগুলি। হায় হায় এ কী, যাহা কিছু দেখি সকলি যে পরিহাস্য। ভাগ্যের হাসি কৌতুক করি সেদিন সে কোন্ ছলে আপনার ছবি দেখিতে চাহিল আমার অশ্রুজলে। এসো ফিরে এসো সেই ঢাকা বাঁকা হাসি, পালা শেষ করো আসি। মূঢ় বলিয়া করতালি দিয়া যাও মোরে সম্ভাষি। আজ করো তারি ভাষ্য যা ছিল অবিশ্বাস্য। বয়স গিয়েছে, হাসিবার ক্ষমতাটি বিধাতা দিয়েছে, কুয়াশা গিয়েছে কাটি। দুখদুর্দিন কালো বরনের মুখোশ করেছে ছিন্ন। দীর্ঘ পথের শেষ গিরিশিরে উঠে গেছে আজ কবি। সেথা হতে তার ভূতভবিষ্য সব দেখে যেন ছবি। ভয়ের মূর্তি যেন যাত্রার সঙ্, মেখেছে কুশ্রী রঙ। দিনগুলি যেন পশুদলে চলে, ঘণ্টা বাজায়ে গলে। কেবল ভিন্ন ভিন্ন সাদা কালো যত চিহ্ন।