ডাক্তার শ্রীসুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তকে লিখিত বন্ধু, চিরপ্রশ্নের বেদীসম্মুখে চিরনির্বাক রহে বিরাট নিরুত্তর, তাহারি পরশ পায় যবে মন নম্রললাটে বহে আপন শ্রেষ্ঠ বর। খনে খনে তারি বহিরঙ্গণদ্বারে পুলকে দাঁড়াই, কত কী যে হয় বলা; শুধু মনে জানি বাজিল না বীণাতারে পরমের সুরে চরমের গীতিকলা। চকিত আলোকে কখনো সহসা দেখা দেয় সুন্দর, দেয় না তবুও ধরা-- মাটির দুয়ার ক্ষণেক খুলিয়া আপন গোপন ঘর দেখায় বসুন্ধরা। আলোকধামের আভাস সেথায় আছে মর্তের বুকে অমৃত পাত্রে ঢাকা; ফাগুন সেথায় মন্ত্র লাগায় গাছে, অরূপের রূপ পল্লবে পড়ে আঁকা। তারি আহ্বানে সাড়া দেয় প্রাণ, জাগে বিস্মিত সুর, নিজ অর্থ না জানে; ধুলিময় বাধা-বন্ধ এড়ায়ে চলে যাই বহুদূর আপনারি গানে গানে। "দেখেছি দেখেছি' এই কথা বলিবারে সুর বেধে যায়, কথা না জোগায় মুখে; ধন্য যে আমি, সে কথা জানাই কারে-- পরশাতীতের হরষ জাগে যে বুকে। দুঃখ পেয়েছি, দৈন্য ঘিরেছে, অশ্লীল দিনে রাতে দেখেছি কুশ্রীতারে, মানুষের প্রাণে বিষ মিশায়েছে মানুষ আপন হাতে, ঘটেছে তা বারে বারে। তবু তো বধির করে নি শ্রবণ কভু, বেসুর ছাপায়ে কে দিয়েছে সুর আনি; পুরুষকলুষ ঝঞ্ঝায় শুনি তবু চিরদিবসের শান্ত শিবের বাণী। যাহা জানিবার কোনোকালে তার জেনেছি যে কোনোকিছু কে তাহা বলিতে পারে-- সকল পাওয়ার মাঝে না-পাওয়ার চলিয়াছি পিছু পিছু অচেনার অভিসারে। অবুও চিত্ত অহেতু আনন্দেতে বিশ্বনৃত্যলীলায় উঠেছে মেতে; সেই ছন্দেই মুক্তি আমার পাব, মৃত্যুর পথে মৃত্যু এড়ায়ে যাব। ওই শুনি আমি চলেছে আকাশে বাঁধন-ছেঁড়ার রবে নিখিল আত্মহারা; ওই দেখি আমি অন্তবিহীন সত্তার উৎসবে ছুটেছে প্রাণের ধারা। সে ধারার বেগ লেগেছে আমার মনে এ ধরণী হতে বিদায় নেবার ক্ষণে; নিবায়ে ফেলিব ঘরের কোণের বাতি, যাব অলক্ষ্যে সূর্যতারার সাথি। কী আছে জানি না দিন-অবসানে মৃত্যুর অবশেষে; এ প্রাণের কোনো ছায়া শেষ আলো দিয়ে ফেলিবে কি রঙ অন্তরবির দেশে, রচিবে কি কোনো মায়া। জীবনেরে যাহা জেনেছি অনেক তাই; সীমা থাকে থাক্, তবু তার সীমা নাই। নিবিড় তাহার সত্য আমার প্রাণে নিখিল ভুবন ব্যাপিয়া নিজেরে জানে।
তিন বছরের বিরহিণী জানলাখানি ধরে কোন্ অলক্ষ্য তারার পানে তাকাও অমন করে। অতীত কালের বোঝার তলায় আমরা চাপা থাকি, ভাবী কালের প্রদোষ-আলোয় মগ্ন তোমার আঁখি। তাই তোমার ওই কাঁদন-হাসির সবটা বুঝি না যে, স্বপন দেখে অনাগত তোমার প্রাণের মাঝে। কোন্ সাগরের তীর দেখেছ জানে না তো কেউ, হাসির আভায় নাচে সে কোন্ সুদূর অশ্রু-ঢেউ। সেখানে কোন্ রাজপুত্তুর চিরদিনের দেশে তোমার লাগি সাজতে গেছে প্রতিদিনের বেশে। সেখানে সে বাজায় বাঁশি রূপকথারই ছায়ে, সেই রাগিণীর তালে তোমার নাচন লাগে গায়ে। আপনি তুমি জানো না তো আছ কাহার আশায়, অনামারে ডাক দিয়েছ চোখের নীরব ভাষায়। হয়তো সে কোন্ সকালবেলা শিশির-ঝলা পথে জাগরণের কেতন তুলে আসবে সোনার রথে, কিম্বা পূর্ণ চাঁদের লগ্নে, বৃহস্পতির দশায়-- দুঃখ আমার, আর সে যে হোক, নয় সে দাদামশায়।
এই তীর্থ-দেবতার ধরণীর মন্দির-প্রাঙ্গণে যে পূজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে সায়াহ্নের শেষ আয়োজন; যে পূর্ণ প্রণামখানি মোর সারা জীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপ-মুখে সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সম্মুখে হে মোর অতিথি যত। তোমরা এসেছ এ জীবনে কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে, শ্রাবণ-বরিষনে; কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ বা কম্পিত দীপশিখা এনেছিলে মোর ঘরে; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে। যখন গিয়েছ চলে দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে। আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম; রহিল পূজায় মোর তোমাদের সবারে প্রণাম।