তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে রূপ না দিলে যদি বিধি হে! পূজার তরে হিয়া উঠে যে ব্যাকুলিয়া, পূজিব তারে গিয়া কী দিয়ে! মনে গোপনে থাকে প্রেম, যায় না দেখা, কুসুম দেয় তাই দেবতায়। দাঁড়ায়ে থাকি দ্বারে, চাহিয়া দেখি তারে, কী ব'লে আপনারে দিব তায়? ভালো বাসিলে ভালো যারে দেখিতে হয় সে যেন পারে ভালো বাসিতে। মধুর হাসি তার দিক সে উপহার মাধুরী ফুটে যার হাসিতে। যার নবনীসুকুমার কপোলতল কী শোভা পায় প্রেমলাজে গো! যাহার ঢলঢল নয়নশতদল তারেই আঁখিজল সাজে গো। তাই লুকায়ে থাকি সদা পাছে সে দেখে, ভালোবাসিতে মরি শরমে। রুধিয়া মনোদ্বার প্রেমের কারাগার রচেছি আপনার মরমে। আহা এ তনু-আবরণ শ্রীহীন ম্লান ঝরিয়া পড়ে যদি শুকায়ে, হৃদয়মাঝে মম দেবতা মনোরম মাধুরী নিরুপম লুকায়ে। যত গোপনে ভালোবাসি পরান ভরি পরান ভরি উঠে শোভাতে-- যেমন কালো মেঘে অরুণ-আলো লেগে মাধুরী উঠে জেগে প্রভাতে। আমি সে শোভা কাহারে তো দেখাতে নারি, এ পোড়া দেহ সবে দেখে যায়-- প্রেম যে চুপে চুপে ফুটিতে চাহে রূপে, মনেরই অন্ধকূপে থেকে যায়। দেখো বনের ভালোবাসা আঁধারে বসি কুসুমে আপনারে বিকাশে, তারকা নিজ হিয়া তুলিছে উজলিয়া আপন আলো দিয়া লিখা সে। ভবে প্রেমের আঁখি প্রেম কাড়িতে চাহে, মোহন রূপ তাই ধরিছে। আমি যে আপনায় ফুটাতে পারি নাই, পরান কেঁদে তাই মরিছে। আমি আপন মধুরতা আপনি জানি পরানে আছে যাহা জাগিয়া, তাহারে লয়ে সেথা দেখাতে পারিলে তা যেত এ ব্যাকুলতা ভাগিয়া। আমি রূপসী নহি, তবু আমারো মনে প্রেমের রূপ সে তো সুমধুর। ধন সে যতনের শয়ন-স্বপনের, করে সে জীবনের তমোদূর। আমি আমার অপমান সহিতে পারি প্রেমের সহে না তো অপমান। অমরাবতী ত্যেজে হৃদয়ে এসেছে যে, তাহারো চেয়ে সে যে মহীয়ান। পাছে কুরূপ কভু তারে দেখিতে হয় কুরূপ দেহ-মাঝে উদিয়া, প্রাণের এক ধারে দেহের পরপারে তাই তো রাখি তারে রুধিয়া। তাই আঁখিতে প্রকাশিতে চাহি নে তারে, নীরবে থাকে তাই রসনা। মুখে সে চাহে যত নয়ন করি নত, গোপনে মরে কত বাসনা। তাই যদি সে কাছে আসে পালাই দূরে, আপন মনো-আশা দলে যাই, পাছে সে মোরে দেখে থমকি বলে "এ কে!" দু-হাতে মুখ ঢেকে চলে যাই। পাছে নয়নে বচনে সে বুঝিতে পারে আমার জীবনের কাহিনী-- পাছে সে মনে ভানে, "এও কি প্রেম জানে! আমি তো এর পানে চাহি নি!" তবে পরানে ভালোবাসা কেন গো দিলে রূপ না দিলে যদি বিধি হে! পূজার তরে হিয়া উঠে যে ব্যাকুলিয়া, পূজিব তারে গিয়া কী দিয়ে!
এ মুখের পানে চাহিয়া রয়েছ কেন গো অমন করে? তুমি চিনিতে নারিবে, বুঝিতে নারিবে মোরে। আমি কেঁদেছি হেসেছি, ভালো যে বেসেছি এসেছি যেতেছি সরে কী জানি কিসের ঘোরে। কোথা হতে এত বেদনা বহিয়া এসেছে পরান মম। বিধাতার এক অর্থবিহীন প্রলাপবচন-সম। প্রতিদিন যারা আছে সুখে দুখে আমি তাহাদের নই-- আমি এসেছি নিমেষে, যাইব নিমেষ বই। আমি আমারে চিনি নে, তোমারে জানি নে, আমার আলয় কই! জগৎ বেড়িয়া নিয়মের পাশ, অনিয়ম শুধু আমি। বাসা বেঁধে আছে কাছে কাছে সবে, কত কাজ করে কত কলরবে, চিরকাল ধরে দিবস চলিছে দিবসের অনুগামী-- শুধু আমি নিজবেগ সামালিতে নারি ছুটেছি দিবসযামী। প্রতিদিন বহে মৃদু সমীরণ, প্রতিদিন ফুটে ফুল। ঝড় শুধু আসে ক্ষণেকের তরে সৃজনের এক ভুল-- দুরন্ত সাধ কাতর বেদনা ফুকারিয়া উভরায় আঁধার হইতে আঁধারে ছুটিয়া যায়। এ আবেগ নিয়ে কার কাছে যাব, নিতে কে পারিবে মোরে! কে আমারে পারে আঁকড়ি রাখিতে দুখানি বাহুর ডোরে! আমি কেবল কাতর গীত! কেহ বা শুনিয়া ঘুমায় নিশীথে, কেহ জাগে চমকিত। কত-যে বেদনা সে কেহ বোঝে না, কত-যে আকুল আশা, কত-যে তীব্র পিপাসাকাতর ভাষা। ওগো তোমরা জগৎবাসী, তোমাদের আছে বরষ বরষ দরশ-পরশ-রাশি-- আমার কেবল একটি নিমেষ, তারি তরে ধেয়ে আসি। মহাসুন্দর একটি নিমেষ ফুটেছে কাননশেষে, আমি তারি পানে ধাই, ছিঁড়ে নিতে চাই, ব্যাকুল বাসনা-সংগীত গাই অসীমকালের আঁধার হইতে বাহির হইয়া এসে। শুধু একটি মুখের এক নিমেষের একটি মধুর কথা, তারি তরে বহি চিরদিবসের চিরমনোব্যাকুলতা। কালের কাননে নিমেষ লুটিয়া কে জানে চলেছি কোথা! ওগো, মিটে না তাহাতে মিটে না প্রাণের ব্যথা। অধিক সময় নাই। ঝড়ের জীবন ছুটে চলে যায় শুধু কেঁদে "চাই চাই"-- যার কাছে আসি তার কাছে শুধু হাহাকার রেখে যাই। ওগো, তবে থাক্, যে যায় সে যাক-- তোমরা দিয়ো না ধরা। আমি চলে যাব ত্বরা। মোরে কেহ কোরো ভয়, কেহ কোরো ঘৃণা, ক্ষমা কোরো যদি পারো! বিস্মিত চোখে ক্ষণেক চাহিয়া তার পরে পথ ছাড়ো! তার পরদিনে উঠিবে প্রভাত, ফুটিবে কুসুম কত, নিয়মে চলিবে নিখিল জগৎ প্রতিদিবসের মতো। কোথাকার এই শৃঙ্খল-ছেঁড়া সৃষ্টি-ছাড়া এ ব্যথা কাঁদিয়া কাঁদিয়া গাহিয়া গাহিয়া, অজানা আঁধার-সাগর বাহিয়া, মিশায়ে যাইবে কোথা! এক রজনীর প্রহরের মাঝে ফুরাবে সকল কথা।