এ লতার কোনো-একটা বিদেশী নাম নিশ্চয় আছে-- জানি নে, জানার দরকারও নেই। আমাদের দেশের মন্দিরে এই লতার ফুলের ব্যবহার চলে না, কিন্তু মন্দিরের বাহিরে যে দেবতা মুক্তস্বরূপে আছেন তাঁর প্রচুর প্রসন্নতা এর মধ্যে বিকশিত। কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন, তাঁর ব্যবহারে এই ফুলকে লাগাব ঠিক করেছি, তাই নতুন করে নাম দিতে হল। রূপে রসে এর মধ্যে বিদেশী কিছুই নেই, এদেশের হাওয়ায় মাটিতে এর একটুও বিতৃষ্ণা দেখা যায় না, তাই দিশী নামে একে আপন করে নিলেম। প্রত্যাশী হয়ে ছিনু এতকাল ধরি, বসন্তে আজ দুয়ারে, আ মরি মরি, ফুলমাধুরীর অঞ্জলি দিল ভরি মধুমঞ্জরিলতা। কতদিন আমি দেখিতে এসেছি প্রাতে কচি ডালগুলি ভরি নিয়ে কচি পাতে আপন ভাষায় যেন আলোকের সাথে কহিতে চেয়েছে কথা। কতদিন আমি দেখেছি গোধূলিকালে সোনালি ছায়ার পরশ লেগেছে ডালে, সন্ধ্যাবায়ুর মৃদু-কাঁপনের তালে কী যেন ছন্দ শোনে। গহন নিশীথে ঝিল্লি যখন ডাকে, দেখেছি চাহিয়া জড়িত ডালের ফাঁকে কালপুরুষের ইঙ্গিত যেন কাকে দূর দিগন্তকোণে। শ্রাবণে সঘন ধারা ঝরে ঝরঝর পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে থরথর, মনে হয় ওর হিয়া যেন ভরভর বিশ্বের বেদনাতে। কতবার ওর মর্মে গিয়েছি চলি, বুঝিতে পেরেছি কেন উঠে চঞ্চলি, শরৎশিশিরে যখন সে ঝলমলি শিহরায় পাতে পাতে। ভুবনে ভুবনে যে প্রাণ সীমানাহারা গগনে গগনে সিঞ্চিল গ্রহতারা পল্লবপুটে ধরি লয় তারি ধারা, মজ্জায় লহে ভরি। কী নিবিড় যোগ এই বাতাসের সনে, যেন সে পরশ পায় জননীর স্তনে, সে পুলকখানি কত-যে, সে মোর মনে বুঝিব কেমন করি। বাতাসে আকাশে আলোকের মাঝখানে-- ঋতুর হাতের মায়ামন্ত্রের টানে কী-যে বাণী আছে প্রাণে প্রাণে ওই জানে, মন তা জানিবে কিসে। যে ইন্দ্রজাল দ্যুলোকে ভূলোকে ছাওয়া, বুকের ভিতর লাগে ওর তারি হাওয়া-- বুঝিতে যে চাই কেমন সে ওর পাওয়া, চেয়ে থাকি অনিমেষে। ফুলের গুচ্ছে আজি ও উচ্ছ্বসিত, নিখিলবাণীর রসের পরশামৃত গোপনে গোপনে পেয়েছে অপরিমিত ধরিতে না পারে তারে। ছন্দে গন্ধে রূপ-আনন্দে ভরা, ধরণীর ধন গগণের মন-হরা, শ্যামলের বীণা বাজিল মধুস্বরা ঝংকারে ঝংকারে। আমার দুয়ারে এসেছিল নাম ভুলি পাতা-ঝলমল অঙ্কুরখানি তুলি মোর আঁখিপানে চেয়েছিল দুলি দুলি করুণ প্রশ্নরতা। তার পরে কবে দাঁড়াল যেদিন ভোরে ফুলে ফুলে তার পরিচয়লিপি ধরে নাম দিয়ে আমি নিলাম আপন ক'রে-- মধুমঞ্জরিলতা। তার পরে যবে চলে যাব অবশেষে সকল ঋতুর অতীত নীরব দেশে, তখনো জাগাবে বসন্ত ফিরে এসে ফুল-ফোটাবার ব্যথা। বরষে বরষে সেদিনও তো বারে বারে এমনি করিয়া শূন্য ঘরের দ্বারে এই লতা মোর আনিবে কুসুমভারে ফাগুনের আকুলতা। তব পানে মোর ছিল যে প্রাণের প্রীতি ওর কিশলয়ে রূপ নেবে সেই স্মৃতি, মধুর গন্ধে আভাসিবে নিতি নিতি সে মোর গোপন কথা। অনেক কাহিনী যাবে যে সেদিন ভূলে, স্মরণচিহ্ন কত যাবে উন্মূলে; মোর দেওয়া নাম লেখা থাক্ ওর ফুলে মধুমঞ্জরিলতা।