বাল্যকাল থেকে পশ্চিম-ভারত আমার কাছে রোম্যাণ্টিক কল্পনার বিষয় ছিল। এইখানেই নিরবচ্ছিন্নকাল বিদেশীয়দের সঙ্গে এ দেশের সংযোগ ও সংঘর্ষ ঘটে এসেছে। বহুশতাব্দী ধরে এইখানেই ইতিহাসের বিপুল পটভূমিকায় বহু সাম্রাজ্যের উত্থানপতন এবং নব নব ঐশ্বর্যের বিকাশ ও বিলয় আপন বিচিত্র বর্ণের ছবির ধারা অঙ্কিত করে চলেছে। অনেক দিন ইচ্ছা করেছি এই পশ্চিম-ভারতের কোনো-এক জায়গায় আশ্রয় নিয়ে ভারতবর্ষের বিরাট বিক্ষুব্ধ অতীত যুগের স্পর্শলাভ করব মনের মধ্যে। অবশেষে এক সময়ে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হলুম। এত দেশ থাকতে কেন যে গাজিপুর বেছে নিয়েছিলুম তার দুটো কারণ আছে। শুনেছিলুম গাজিপুরে আছে গোলাপের খেত। আমি যেন মনের মধ্যে গোলাপবিলাসী সিরাজের ছবি এঁকে নিয়েছিলুম। তারি মোহ আমাকে প্রবলভাবে টেনেছিল। সেখানে গিয়ে দেখলুম ব্যাবসাদারের গোলাপের খেত, এখানে বুলবুলের আমন্ত্রণ নেই, কবিরও নেই; হারিয়ে গেল সেই ছবি। অপর পক্ষে, গাজিপুরে মহিমাম্বিত প্রাচীন ইতিহাসের স্বাক্ষর কোথাও বড়ো রেখায় ছাপ দেয় নি। আমার চোখে এর চেহারা ঠেকল সাদা-কাপড়-পরা বিধবার মতো, সেও কোনো বড়োঘরের ঘরণী নয়। তবু গাজিপুরেই রয়ে গেলুম, তার একটা কারণ এখানে ছিলেন আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় গগনচন্দ্র রায়, আফিম-বিভাগের একজন বড়ো কর্মচারী। এখানে আমার সমস্ত ব্যবস্থা সহজ হল তাঁরই সাহায্যে। একখানা বড়ো বাংলা পাওয়া গেল, গঙ্গার ধারেও বটে, ঠিক গঙ্গার ধারেও নয়। প্রায় মাইলখানেক চর পড়ে গেছে, সেখানে যবের ছোলার শর্ষের খেত; দূর থেকে দেখা যায় গঙ্গার জলধারা, গুণ-টানা নৌকো চলেছে মন্থর গতিতে। বাড়ির সংলগ্ন অনেকখানি জমি, অনাদৃত, বাংলাদেশের মাটি হলে জঙ্গল হয়ে উঠত। ইঁদারা থেকে পূর চলছে নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে কলকল শব্দে। গোলাপচাঁপার ঘনপল্লব থেকে কোকিলের ডাক আসত রৌদ্রতপ্ত প্রহরের ক্লান্ত হাওয়ায়। পশ্চিম কোণে প্রাচীন একটা মহানিমগাছ, তার বিস্তীর্ণ ছায়াতলে বসবার জায়গা। সাদাধুলোর রাস্তা চলেছে বাড়ির গা ঘেঁষে, দূরে দেখা যায় খোলার-চাল-ওয়ালা পল্লী।
বেঠিকানা তব আলাপ শব্দভেদী দিল এ বিজনে আমার মৌন ছেদি। দাদুর পদবী পেয়েছি, তাহার দায় কোনো ছুতো করে কভু কি ঠেকানো যায়! স্পর্ধা করিয়া ছন্দে লিখেছ চিঠি; ছন্দেই তার জবাবটা যাক মিটি। নিশ্চিত তুমি জানিতে মনের মধ্যে-- গর্ব আমার খর্ব হবে না গদ্যে। লেখনীটা ছিল শক্ত জাতেরই ঘোড়া; বয়সের দোষে কিছু তো হয়েছে খোঁড়া। তোমাদের কাছে সেই লজ্জাটা ঢেকে মনে সাধ, যেন যেতে পারি মান রেখে। তোমার কলম চলে যে হালকা চালে, আমারো কলম চালাব সে ঝাঁপতালে; হাঁপ ধরে, তবু এই সংকল্পটা টেনে রাখি, পাছে দাও বয়সের খোঁটা। ভিতরে ভিতরে তবু জাগ্রত রয় দর্পহরণ মধুসূদনের ভয়। বয়স হলেই বৃদ্ধ হয়ে যে মরে বড়ো ঘৃণা মোর সেই অভাগার 'পরে। প্রাণ বেরোলেও তোমাদের কাছে তবু তাই তো ক্লান্তি প্রকাশ করি নে কভু। কিন্তু একটা কথায় লেগেছে ধোঁকা, কবি বলেই কি আমারে পেয়েছ বোকা। নানা উৎপাত করে বটে নানা লোকে, সহ্য তো করি পষ্ট দেখেছ চোখে-- সেই কারণেই তুমি থাক দূরে দূরে, বলেছ সে কথা অতি সকরুণ সুরে। বেশ জানি, তুমি জান এটা নিশ্চয়-- উৎপাত সে যে নানা রকমের হয়। কবিদের 'পরে দয়া করেছেন বিধি-- মিষ্টি মুখের উৎপাত আনে দিদি। চাটু বচনের মিষ্টি রচন জানে; ক্ষীরে সরে কেউ মিষ্টি বানিয়ে আনে। কোকিলকণ্ঠে কেউ বা কলহ করে; কেউ বা ভোলায় গানের তানের স্বরে। তাই ভাবি, বিধি যদি দরদের ভুলে এ উৎপাতের বরাদ্দ দেন তুলে, শুকনো প্রাণটা মহা উৎপাত হবে। উপমা লাগিয়ে কথাটা বোঝাই তবে।-- সামনে দেখো-না পাহাড়, শাবল ঠুকে ইলেক্ট্রিকের খোঁটা পোঁতে তার বুকে; সন্ধেবেলার মসৃণ অন্ধকারে এখানে সেখানে চোখে আলো খোঁচা মারে। তা দেখে চাঁদের ব্যথা যদি লাগে প্রাণে, বার্তা পাঠায় শৈলশিখর-পানে-- বলে, "আজ হতে জ্যোৎস্নার উৎপাতে আলোর আঘাত লাগাব না আর রাতে"-- ভেবে দেখো, তবে কথাটা কি হবে ভালো। তাপের জ্বলন আনে কি সবারই আলো। এখানেই চিঠি শেষ ক'রে যাই চলে-- ভেবো না যে তাহা শক্তি কমেছে ব'লে; বুদ্ধি বেড়েছে তাহারই প্রমাণ এটা; বুঝেছি, বেদম বাণীর হাতুড়ি পেটা কথারে চওড়া করে বকুনির জোরে, তেমনি যে তাকে দেয় চ্যাপটাও ক'রে। বেশি যাহা তাই কম, এ কথাটা মানি-- চেঁচিয়ে বলার চেয়ে ভালো কানাকানি। বাঙালি এ কথা জানে না ব'লেই ঠকে; দাম যায় আর দম যায় যত বকে। চেঁচানির চোটে তাই বাংলার হাওয়া রাতদিন যেন হিস্টিরিয়ায় পাওয়া। তারে বলে আর্ট না-বলা যাহার কথা; ঢাকা খুলে বলা সে কেবল বাচালতা। এই তো দেখো-না নাম-ঢাকা তব নাম; নামজাদা খ্যাতি ছাপিয়ে যে ওর দাম। এই দেখো দেখি, ভারতীর ছল কী এ। বকা ভালো নয়, এ কথা বোঝাতে গিয়ে খাতাখানা জুড়ে বকুনি যা হল জমা আর্টের দেবী করিবে কি তারে ক্ষমা। সত্য কথাটা উচিত কবুল করা-- রব যে উঠেছে রবিরে ধরেছে জরা, তারই প্রতিবাদ করি এই তাল ঠুকে; তাই ব'কে যাই যত কথা আসে মুখে। এ যেন কলপ চুলে লাগাবার কাজ-- ভিতরেতে পাকা, বাহিরে কাঁচার সাজ। ক্ষীণ কণ্ঠেতে জোর দিয়ে তাই দেখাই, বকবে কি শুধু নাতনিজনেরা একাই। মানব না হার কোনো মুখরার কাছে, সেই গুমোরের আজো ঢের বাকি আছে।