আমাকে এনে দিল এই বুনো চারাগাছটি । পাতার রঙ হলদে-সবুজ, ফুলগুলি যেন আলো পান করবার শিল্প-করা পেয়ালা,বেগুনি রঙের প্রশ্ন করি "নাম কী', জবাব নেই কোনোখানে । ও আছে বিশ্বের অসীম অপরিচিতের মহলে যেখানে আছে আকাশের নামহারা তারা । আমি ওকে ধরে এনেছি একটি ডাক-নামে আমার একলা জানার নিভৃতে । ওর নাম পেয়ালী । বাগানের নিমন্ত্রণে এসেছে ডালিয়া, এসেছে ফুশিয়া, এসেছে ম্যারিগোল্ড্, ও আছে অনাদরের অচিহ্নিত স্বাধীনতায়, জাতে বাঁধা পড়ে নি; ও বাউল,ও অসামাজিক । দেখতে দেখেতে ওই খসে পড়ল ফুল । যে শব্দটুকু হল বাতাসে কানে এল না । ওর কুষ্ঠির রাশিচক্র যে নিমেষগুলির সমবায়ে অণুপরিমাণ তার অঙ্ক, ওর বুকের গভীরে যে মধু আছে কণাপরিমাণ তার বিন্দু । একটুকু কালের মধ্যে সম্পূর্ণ ওর যাত্রা, একটি কল্পে যেমন সম্পূর্ণ আগুনের-পাপড়ি-মেলা সূর্যের বিকাশ । ওর ইতিহাসটুকু অতি ছোটো পাতার কোণে বিশ্বলিপিকারের অতি ছোটো কলমে লেখা । তবু তারই সঙ্গে সঙ্গে উদ্ঘাটিত হচ্ছে বৃহৎ ইতিহাস, দৃষ্টি চলে না এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায় । শতাব্দীর যে নিরন্তর স্রোত বয়ে চলেছে বিলম্বিত তালের তরঙ্গের মতো, যে ধারায় উঠল নামল কত শৈলশ্রেণী, সাগরে মরুতে কত হল বেশপরিবর্তন, সেই নিরবধি কালেরই দীর্ঘ প্রবাহে এগিয়ে এসেছে এই ছোটো ফুলটির আদিম সংকল্প সৃষ্টির ঘাতপ্রতিঘাতে । লক্ষ লক্ষ বৎসর এই ফুলের ফোটা-ঝরার পথে সেই পুরাতনসংকল্প রয়েছে নুতন,রয়েছে সজীবসচল ওর শেষ সমাপ্ত ছবি আজও দেয় নি দেখা । এই দেহহীন সংকল্প,সেই রেখাহীন ছবি নিত্য হয়ে আছে কোন্অদৃশ্যেরধ্যানে! যে অদৃশ্যের অন্তহীন কল্পনায় আমি আছি, যে অদৃশ্যে বিধৃত সকল মানুষের ইতিহাস অতীতে ভবিষ্যতে ।
শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু স্টীমার "রাজহংস' । গঙ্গা চিঠি লিখব কথা ছিল, দেখছি সেটা ভারি শক্ত। তেমন যদি খবর থাকে লিখতে পারি তক্ত তক্ত। খবর বয়ে বেড়ায় ঘুরে খবরওয়ালা ঝাঁকা-মুটে। আমি বাপু ভাবের ভক্ত বেড়াই নাকো খবর খুঁটে। এত ধুলো, এত খবর কলকাতাটার গলিতে! নাকে চোকে খবর ঢোকে দু-চার কদম চলিতে। এত খবর সয় না আমার মরি আমি হাঁপোষে। ঘরে এসেই খবরগুলো মুছে ফেলি পাপোষে। আমাকে তো জানই বাছা! আমি একজন খেয়ালি। কথাগুলো যা বলি, তার অধিকাংশই হেঁয়ালি। আমার যত খবর আসে ভোরের বেলা পুব দিয়ে। পেটের কথা তুলি আমি পেটের মধ্যে ডুব দিয়ে। আকাশ ঘিরে জাল ফেলে তারা ধরাই ব্যাবসা। থাক্ গে তোমার পাটের হাটে মথুর কুণ্ডু শিবু সা। কল্পতরুর তলায় থাকি নই গো আমি খবুরে। হাঁ করিয়ে চেয়ে আছি মেওয়া ফলে সবুরে। তবে যদি নেহাত কর খবর নিয়ে টানাটানি। আমি বাপু একটি কেবল দুষ্টু মেয়ের খবর জানি! দুষ্টুমি তার শোনো যদি অবাক হবে সত্যি! এত বড়ো বড়ো কথা তার মুখখানি একরত্তি। মনে মনে জানেন তিনি ভারি মস্ত লোকটা। লোকের সঙ্গে না-হক কেবল ঝগড়া করবার ঝোঁকটা। আমার সঙ্গেই যত বিবাদ কথায় কথায় আড়ি। এর নাম কি ভদ্র ব্যাভার! বড্ড বাড়াবাড়ি। মনে করেছি তার সঙ্গে কথাবার্তা বন্দ করি। প্রতিজ্ঞা থাকে না পাছে সেইটে ভারি সন্দ করি। সে না হলে সকাল বেলায় চামেলি কি ফুটবে! সে নইলে কি সন্ধে বেলায় সন্ধেতারা উঠবে। সে না হলে দিনটা ফাঁকি আগাগোড়াই মস্কারা। পোড়ারমুখী জানে সেটা তাই এত তার আস্কারা। চুড়ি-পরা হাত দুখানি কতই জানে ফন্দি। কোনোমতে তার সাথে তাই করে আছি সন্ধি। নাম যদি তার জিগেস কর নামটি বলা হবে না। কী জানি সে শোনে যদি প্রাণটি আমার রবে না। নামের খবর কে রাখে তার ডাকি তারে যা খুশি। দুষ্টু বলো, দস্যি বলো, পোড়ারমুখী, রাক্ষুসী! বাপ মায়ে যে নাম দিয়েছে বাপ মায়েরি থাক্ সে। ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি তুলে রাখুন বাক্সে! এক জনেতে নাম রাখবে অন্নপ্রাশনে। বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে বিষম শাসন এ! নিজের মনের মত সবাই করুক নামকরণ। বাবা ডাকুন "চন্দ্রকুমার' খুড়ো "রামচরণ'! ধার-করা নাম নেব আমি হবে না তো সিটি। জানই আমার সকল কাজে Originality। ঘরের মেয়ে তার কি সাজে সঙস্কৃত নাম। এতে কেবল বেড়ে ওঠে অভিধানের দাম। আমি বাপু ডেকে বসি যেটা মুখে আসে, যারে ডাকি সেই তা বোঝে আর সকলে হাসে! দুষ্টু মেয়ের দুষ্টুমি-- তায় কোথায় দেব দাঁড়ি! অকূল পাথার দেখে শেষে কলমের হাল ছাড়ি! শোনো বাছা, সত্যি কথা বলি তোমার কাছে-- ত্রিজগতে তেমন মেয়ে একটি কেবল আছে! বর্ণিমেটা কারো সঙ্গে মিলে পাছে যায়-- তুমুল ব্যাপার উঠবে বেধে হবে বিষম দায়! হপ্তাখানেক বকাবকি ঝগড়াঝাঁটির পালা, একটু চিঠি লিখে, শেষে প্রাণটা ঝালাফালা। আমি বাপু ভালোমানুষ মুখে নেইকো রা। ঘরের কোণে বসে বসে গোঁফে দিচ্ছি তা। আমি যত গোলে পড়ি শুনি নানান বাক্যি। খোঁড়ার পা যে খানায় পড়ে আমিই তাহার সাক্ষী। আমি কারো নাম করি নি তবু ভয়ে মরি। তুই পাছে নিস গায়ে পেতে সেইটো বড়ো ডরি! কথা একটা উঠলে মনে ভারি তোরা জ্বালাস। আমি বাপু আগে থাকতে বলে হলুম খালাস!