খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে আমি যদি পারি বাসা নিতে-- তবে আমি একবার জগতের পানে তার চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে। তার রবি শশী তারা জানি নে কেমনধারা সভা করে আকাশের তলে, আমার খোকার সাথে গোপনে দিবসে রাতে শুনেছি তাদের কথা চলে। শুনেছি আকাশ তারে নামিয়া মাঠের পারে লোভায় রঙিন ধনু হাতে, আসি শালবন-'পরে মেঘেরা মন্ত্রণা করে খেলা করিবারে তার সাথে। যারা আমাদের কাছে নীরব গম্ভীর আছে, আশার অতীত যারা সবে, খোকারে তাহারা এসে ধরা দিতে চায় হেসে কত রঙে কত কলরবে। খোকার মনের ঠিক মাঝখান ঘেঁষে যে পথ গিয়েছে সৃষ্টিশেষে সকল-উদ্দেশ-হারা সকল-ভূগোল-ছাড়া অপরূপ অসম্ভব দেশে-- যেথা আসে রাত্রিদিন সর্ব-ইতিহাস-হীন রাজার রাজত্ব হতে হাওয়া, তারি যদি এক ধারে পাই আমি বসিবারে দেখি কারা করে আসা-যাওয়া। তাহারা অদ্ভুত লোক, নাই কারো দুঃখ শোক, নেই তারা কোনো কর্মে কাজে, চিন্তাহীন মৃত্যুহীন চলিয়াছে চিরদিন খোকাদের গল্পলোক-মাঝে। সেথা ফুল গাছপালা নাগকন্যা রাজবালা মানুষ রাক্ষস পশু পাখি, যাহা খুশি তাই করে, সত্যেরে কিছু না ডরে, সংশয়েরে দিয়ে যায় ফাঁকি।
জীবন-স্রোতে ঢেউয়ের 'পরে কোন্-আলো ওই বেড়ায় দুলে? ক্ষণে ক্ষণে দেখি যে তাই বসে বসে বিজন কূলে। ভাসে তবু যায় না ভেসে, হাসে আমার কাছে এসে, দু-হাত বাড়াই ঝাঁপ দিতে চাই মনে করি আনব তুলে। শান্ত হ রে শান্ত হ মন, ধরতে গেলে দেয় না ধরা-- নয় সে মণি নয় সে মানিক নয় সে কুসুম ঝরে-পড়া। দূরে কাছে আগে পাছে, মিলিয়ে আছে ছেয়ে আছে, জীবন হতে ছানিয়ে তারে তুলতে গেলে মরবি ভুলে।
যখন এ দেহ হতে রোগে ও জরায় দিনে দিনে সামর্থ্য ঝরায়, যৌবন এ জীর্ণ নীড় পিছে ফেলে দিয়ে যায় ফাঁকি, কেবল শৈশব থাকে বাকি। বদ্ধ ঘরে কর্মক্ষুব্ধ সংসার--বাহিরে অশক্ত সে শিশুচিত্ত মা খুঁজিয়া ফিরে। বিত্তহারা প্রাণ লুব্ধ হয় বিনা মূল্যে স্নেহের প্রশ্রয় কারো কাছে করিবারে লাভ, যার আবির্ভাব ক্ষীণজীবিতেরে করে দান জীবনের প্রথম সম্মান। "থাকো তুমি' মনে নিয়ে এইটুকু চাওয়া কে তারে জানাতে পারে তার প্রতি নিখিলের দাওয়া শুধু বেঁচে থাকিবার। এ বিস্ময় বারবার আজি আসে প্রাণে প্রাণলক্ষ্মী ধরিত্রীর গভীর আহ্বানে মা দাঁড়ায় এসে যে মা চিরপুরাতন নূতনের বেশে।