বউ-ঠাকুরানীর হাট
Novels
অন্তর্বিষয়ী ভাবের কবিত্ব থেকে বহির্বিষয়ী কল্পনালোকে একসময়ে মন যে প্রবেশ করলে, ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগল, এ বোধ হয় কৌতূহল থেকে।
প্রাচীর-ঘেরা মন বেরিয়ে পড়ল বাইরে, তখন সংসারের বিচিত্র পথে তার যাতায়াত আরম্ভ হয়েছে। এই সময়টাতে তার লেখনী গদ্যরাজ্যে নূতন ছবি নূতন নূতন অভিজ্ঞতা খুঁজতে চাইলে। তারই প্রথম প্রয়াস দেখা দিল বউ-ঠাকুরানীর হাট গল্পে-- একটা রোমান্টিক ভূমিকায় মানবচরিত্র নিয়ে খেলার ব্যাপারে, সেও অল্পবয়সেরই খেলা। চরিত্রগুলির মধ্যে যেটুকু জীবনের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে সেটা পুতুলের ধর্ম ছাড়িয়ে উঠতে পারে নি। তারা আপন চরিত্রবলে অনিবার্য পরিণামে চালিত নয়, তারা সাজানো জিনিস একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে। আজও হয়তো এই গল্পটার দিকে ফিরে চাওয়া যেতে পারে। এ যেন অশিক্ষিত আঙুলের আঁকা ছবি; সুনিশ্চিত মনের পাকা হাতের চিহ্ন পড়ে নি তাতে। কিন্তু আর্টের খেলাঘরে ছেলেমানুষিরও একটা মূল্য আছে। বুদ্ধির বাধাহীন পথে তার খেয়াল যা-তা কাণ্ড করতে বসে, তার থেকে প্রাথমিক মনের একটা কিছু কারিগরি বেরিয়ে পড়ে।
"বঁধুয়া অসময়ে কেন হে প্রকাশ?
সকলি যে স্বপ্ন বলে হতেছে বিশ্বাস।
চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে ছিলে, সেথায় তো আদর মিলে?
এরি মধ্যে মিটিল কি প্রণয়েরি আশ?
এখনো তো রয়েছে রাত এখনো হয় নি প্রভাত,
এখনো এ রাধিকার ফুরায় নি তো অশ্রুপাত।
চন্দ্রাবলীর কুসুমসাজ এখনি কি শুকাল আজ?
চকোর হে, মিলাল কি সে চন্দ্রমুখের মধুর হাস?"
"আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে।
ভয় নাইকো সুখে থাকো,
অধিক ক্ষণ থাকব নাকো।
আসিয়াছি দুদণ্ডেরি তরে।
দেখব শুধু মুখখানি
শুনব দুটি মধুর বাণী
আড়াল থেকে হাসি দেখে চলে যাব দেশান্তরে।"
"মলিন মুখে ফুটুক হাসি জুড়াক দু-নয়ন।"
"মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু-নয়ন।
মলিন বসন ছাড়ো সখী, পরো আভরণ।"
হাসিরে পায়ে ধরে রাখিবি কেমন করে,
হাসির সে প্রাণের সাধ ও অধরে খেলা করে।
"সারা বরষ দেখি নে মা, মা তুই আমার কেমনধারা,
নয়নতারা হারিয়ে আমার অন্ধ হল নয়নতারা।
এলি কি পাষাণী ওরে
দেখব তোরে আঁখি ভরে
কিছুতেই থামে না যে মা, পোড়া এ নয়নের ধারা।"
"কবরীতে ফুল শুকাল, কাননের ফুল ফুটল বনে,
দিনের আলো প্রকাশিল, মনের সাধ রহিল মনে।"
"ওরে, যেতে হবে, আর দেরি নাই,
পিছিয়ে পড়ে রবি কত, সঙ্গীরা তোর গেল সবাই।
আয় রে ভবের খেলা সেরে, আঁধার করে এসেছে রে,
(ওরে) পিছন ফিরে বারে বারে কাহার পানে চাহিস রে ভাই।
খেলতে এল ভবের নাটে, নতুন লোকে নতুন খেলা,
হেথা হতে আয় রে সরে, নইলে তোরে মারবে ঢেলা,
নামিয়ে দে রে প্রাণের বোঝা, আর এক দেশে চল্ রে সোজা,
(সেথা) নতুন করে বাঁধবি বাসা, নতুন খেলা খেলবি সে ঠাঁই।"
"আমার যাবার সময় হল,
আমায় কেন রাখিস ধরে,
চোখের জলের বাঁধন দিয়ে
বাঁধিস নে আর মায়াডোরে।
ফুরিয়েছে জীবনের ছুটি,
ফিরিয়ে নে তোর নয়ন দুটি,
নাম ধরে আর ডাকসি নে ভাই,
যেতে হবে ত্বরা করে।"
"ভিক্ষা যদি দিবে রাই,
(আমার) সোনা রুপায় কাজ নাই,
(আমি) প্রাণের দায়ে এসেছি হে,
মান রতন ভিক্ষা চাই।
আমিই শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে, রইল যা তা কেবল ফাঁকি
আমার ব'লে ছিল যারা
আর তো তারা দেয় না সাড়া,
কোথায় তারা, কোথায় তারা? কেঁদে কেঁদে কারে ডাকি।
বল্ দেখি মা, শুধাই তোরে,
আমার কিছু রাখলি নে রে?
আমি কেবল আমায় নিয়ে কোন্ প্রাণেতে বেঁচে থাকি।
আমি শুধু রইনু বাকি।
যা ছিল তা গেল চলে,
রইল যা তা কেবল ফাঁকি।"
তাজবে তাজ নওবে নও।
আমি শুধু রইনু বাকি।
আর কি আমি ছাড়ব তোরে।
মন দিয়ে মন নাই বা পেলেম
জোর করে রাখিব ধরে।
শূন্য করে হৃদয়-পুরী প্রাণ যদি করিলে চুরি
তুমিই তবে থাকো সেথায়
শূন্য হৃদয় পূর্ণ করে।
আরো দেখুন