ছন্দের হসন্ত হলন্ত - ২
Essays
দিলীপকুমার আশ্বিনের "উত্তরা'য় ছন্দ সম্বন্ধে আমার দুই-একটি চিঠির খণ্ড ছাপিয়েছেন। সর্বশেষে যে নোটটুকু দিয়েছেন তার থেকে বোঝা গেল, আমি যে কথা বলতে চেয়েছি এখনো সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয় নি।
তিনি আমারই লেখার নজির তুলে দেখিয়েছেন যে, নিম্নলিখিত কবিতায় আমি "একেকটি' শব্দটাকে চার মাত্রার ওজন দিয়েছি।
ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।
একটি কথার লাগি তিনটি রজনী জাগি,
একটুও নাহি মেলে সাড়া।
সখীরা যখন জোটে মুখে তব বন্যা ছোটে,
গোলমালে তোলপাড় পাড়া॥
টোট্কা এই মুষ্টিযোগ লট্কানের ছাল,
সিট্কে মুখ খাবি, জ্বর আট্কে যাবে কাল।
এক্টি কথা শুনিবারে তিন্টে রাত্রি মাটি,
এর পরে ঝগ্ড়া হবে, শেষে দাঁত্কপাটি॥
এক্টি কথা শোনো, মনে খট্কা নাহি রেখে,
টাট্কা মাছ জুট্ল না তো, শুঁট্কি দেখো চেখে।
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।
শিবঠাকুরের বিয়ে হবে, তিন কন্যে দান।
বৃষ্টি । পড়ে- । টাপুর । টুপুর । নদেয় । এল- । বা-ন।
শিবঠা । কুরের । বিয়ে- । হবে- । তিন্ক । ন্নে । দা-ন।
বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর নদেয় আসছে বন্যা,
শিব ঠাকুরের বিয়ের বাসরে দান হবে তিন কন্যা।
মা আমায় ঘুরাবি কত
চোখবাঁধা বলদের মতো।
মা-আ । মায় ঘু । রাবি- । কত-।
হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই
চক্ষুবদ্ধ বৃষের মতোই।
হারিয়ে ফেলা বাঁশি আমার পালিয়েছিল বুঝি
লুকোচুরির ছলে।
১ ২ ৩ ৪
হারিয়ে ফেলা- । বাঁশি আমা-র । পালিয়েছিল । বুঝি--।
৫ ৬
লুকোচুরি-র । ছলে- ।
স্বপ্ন আমার বন্ধনহীন সন্ধ্যাতারার সঙ্গী
মরণযাত্রীদলে,
স্বর্ণবরণ কুজ্ঝটিকায় অস্তশিখর লঙ্ঘি
লুকায় মৌনতলে।
পাৎলা করিয়া কাটো কাৎলা মাছেরে,
উৎসুক নাৎনি যে চাহিয়া আছে রে।
পাৎলা করি কাটো, প্রিয়ে, কাৎলা মাছটিরে;
টাট্কা তেলে ফেলে দাও সরষে আর জিরে;
ভেট্কি যদি জোটে তাহে মাখো লঙ্কাবাঁটা,
যত্ন করে বেছে ফেলো টুক্রো যত কাঁটা।
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর--
নিখিল আকাশভরা আলোর মহিমা
তৃণের শিশির মাঝে লভিল প্রতিমা।
তপনের পানে চেয়ে সাগরের ঢেউ
বলে ওই পুতলিরে এনে দে না কেউ।
রাখি যাহা তার বোঝা কাঁধে চেপে রহে,
দিই যাহা তার ভার চরাচর বহে।
সারা দিবসের হায় যত কিছু আশা
রজনীর কারাগারে হারাবে কি ভাষা।
সুরাঙ্গনা নন্দনের নিকুঞ্জপ্রাঙ্গণে
মন্দারমঞ্জরি তোলে চঞ্চলকঙ্কণে।
বেণীবন্ধতরঙ্গিত কোন্ ছন্দ নিয়া,
স্বর্গবীণা গুঞ্জরিছে তাই সন্ধানিয়া।
হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা। স্তব্ধ হয়ে ছিল রাত্রিদিন
সপ্তর্ষির দৃষ্টিতলে । বাক্যহীন স্তব্ধতায় লীন
সেই নির্ঝরিণীধারা । রবিকরস্পর্শে উচ্ছ্বসিতা
দিগি্দগন্তে প্রচারিছে । অন্তহীন আনন্দের গীতা।
খুব তার বোল্চাল, সাজ ফিট্ফাট,
তক্রার হলে আর নাই মিট্মাট।
চশ্মায় চমকায় আড়ে চায় চোখ।
কোনো ঠাঁই ঠেকে নাই কোনো বড়ো লোক।
বাক্য তার অনর্গল মল্লসজ্জাশালী,
তর্কযুদ্ধে উগ্র তেজ, শেষ যুক্তি গালি।
ভ্রূকুটিপ্রচ্ছন্ন চক্ষু কটাক্ষিয়া চায়,
কুত্রাপিও মহত্ত্বের চিহ্ন নাহি পায়।
নিঃস্বতাসংকোচে দিন । অবসন্ন হলে
নিভৃতে নিঃশব্দ সন্ধ্যা । নেয় তার কোলে।
তরণী বেয়ে শেষে । এসেছি ভাঙা ঘাটে,
স্থলে না মেলে ঠাঁই । জলে না দিন কাটে।
তরণী । বেয়ে শেষে ॥ এসেছি । ভাঙা ঘাটে।
সায়াহ্ন-অন্ধকারে এসেছি ভগ্ন ঘাটে
অন্ধরাতে যবে । বন্ধ হল দ্বার,
ঝঞ্ঝাবাতে ওঠে । উচ্চ হাহাকার।
অন্ধরাতে । যবে বন্ধ । হল দ্বার,
ঝঞ্ঝাবাতে । ওঠে উচ্চ । হাহাকার।
অধীর বাতাস এল সকালে,
বনেরে বৃথাই শুধু বকালে।
দিনশেষে দেখি চেয়ে,
ঝরা ফুলে মাটি ছেয়ে--
লতারে কাঙাল ক'রে ঠকালে।
নবারুণচন্দনের তিলকে
দিক্ললাট এঁকে আজি দিল কে।
বরণের পাত্র হাতে
উষা এল সুপ্রভাতে,
জয়শঙ্খ বেজে ওঠে ত্রিলোকে।
শরতে শিশিরবাতাস লেগে
জল ভ'রে আসে উদাসী মেঘে।
বরষন তবু হয় না কেন,
ব্যথা নিয়ে চেয়ে রয়েছে যেন।
চাষের সময়ে যদিও করি নি হেলা,
ভুলিয়াছিলাম ফসল-কাটার বেলা।
শ্যামলঘন । বকুলবন । ছায়ে ছায়ে
যেন কী সুর । বাজে মধুর । পায়ে পায়ে।
রূপসাগরের তলে ডুব দিনু আমি
চৈতন্য নিমগ্ন হল রূপসিন্ধুতলে।
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা ক'রে
অচে- । তনে- । ছিলেম । ভালো-।
আমায় । চেতন । করলি । কেনে-।
হাসিয়া হাসিয়া মুখ নিরখিয়া
মধুর কথাটি কয়।
ছায়ার সহিতে ছায়া মিশাইতে
পথের নিকটে রয়।
মত্তরোষে বীরভদ্র ছুট্ল ঊর্ধ্বশ্বাসে,
ঘূর্ণিবেগে উড়্ল ধুলো রক্ত সন্ধ্যাকাশে।
ছুট্ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর,
টুট্ল কেন উর্বশীর মঞ্জীরের ডোর।
বৈকালে বৈশাখী এল আকাশলুণ্ঠনে,
শুক্লরাতি ঢাক্ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে।
চিম্নি ভেঙে গেছে দেখে গিন্নি রেগে খুন;
ঝি বলে, আমার দোষ নেই ঠাকরুন।
চিমনি ফেটেছে দেখে গৃহিণী সরোষে;
ঝি বলে, ঠাক্রুন মোর নাই কোনো দোষ।
কুস্তির আখড়ায় ভিস্তিকে ধরে
জল ছিটাইয়া দাও, ধুলা যাক মরে।
রাস্তা দিয়ে কুস্তিগির চলে ঘেঁষাঘেঁষি,
এক্টা নয় দুটো নয় একশোর বেশি।
পালোয়ানে পালোয়ানে চলে ঘেঁষাঘেষি।
রূপযৌবন উপঢৌকন দেবেন কন্যা তাহারে,
তাই পরেছেন চীনাংশুকের পট্টবসন বাহারে।
আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি,
প্রাক্টিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি।
শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো,
অক্সিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা করে তোলো।
কর্ণে দিলা ঝুম্কাফুল, নাসিকায় নথ,
অঙ্গসজ্জাসমাধানে ভূরি মেহন্নৎ।
আরো দেখুন