পিত্রার্কা ও লরা
Essays
এ কথা বোধ হয় বলাই বাহুল্য যে, দান্তের মতো পিত্রার্কাও একজন প্রখ্যাতনামা ইতালীয় কবি ছিলেন। দান্তে যেমন তাঁহার মহাকাব্যের মহান ভাব দ্বারা সমস্ত যুরোপমণ্ডল উত্তেজিত করিয়াছিলেন, পিত্রার্কাও তেমনি তাঁহার সুললিত গীতি ও গাথা দ্বারা সকলের মনোরঞ্জন করিয়াছিলেন। কিন্তু দান্তে ও পিত্রার্কে আবার অনেক বিষয়ে এমন সৌসাদৃশ্য ছিল যে, সকল বিষয় উল্লেখ করিতে হইলে আমাদের এই প্রবন্ধটি অতি দীর্ঘকায় হইয়া পড়ে, সেইজন্য কেবল তাঁহাদের প্রণয়ের কথাই বর্ণনা করিতেছি।
দান্তের যেমন বিয়াত্রিচে, পিত্রার্কার তেমনি লরা। দান্তের ন্যায় তাঁহার লরাও অপ্রাপ্য অনধিগম্য, দান্তের ন্যায় তিনিও দূর হইতে লরাকে দেখিয়াই আপনাকে কৃতার্থ মনে করিতেন। পিত্রার্কারও লরার সহিত তেমন ভালো করিয়া কথাবার্তা, আলাপ-পরিচয় হয় নাই। লরার ভবনে পিত্রার্কা কখনো যাইতে পান নাই, লরার নিকট হইতে তাঁহার প্রেমের কিছুমাত্র প্রত্যুপহার পান নাই। পিত্রার্কা কহিয়াছেন, লরা সংগীত ও কবিতার প্রতি উদাসীন। তাঁহার সমক্ষে তাহার মুখশ্রী সর্বদাই দৃঢ় ভাব প্রকাশ করিত। পিত্রার্কা তাঁহার অসংখ্য চিঠির মধ্যে একবার ভিন্ন কখনো লরার নামোল্লেখ করেন নাই, বোধ হয়, বন্ধুবর্গের প্রতি সাধারণ চিঠিপত্রে লরার নাম ব্যবহার করিতে তিনি কেমন সংকোচ বোধ করিতেন, বোধ হয় মনে করিতেন তাহাতে সে নামের গৌরব হানি হইবে। লরার যৌবনের অবসান, লরার মৃত্যু, তাঁহার প্রতি লরার ঔদাসীন্য কিছুই তাঁহার মহান প্রেমকে বিচলিত করিতে পারে নাই। বরঞ্চ লরার মৃত্যু তাঁহার প্রেমকে নূতন বল অর্পণ করে, কেননা এ পৃথিবীতে লরার সহিত তাঁহার সম্পর্ক অতি দূর ছিল, লরার প্রেম তাঁহার অপ্রাপ্য ও তাঁহার প্রেম লরার অগ্রাহ্য ছিল, কিন্তু লরা যখন দেহের সহিত সমাজ বন্ধন পরিত্যাগ করিয়া গেলেন, তখন পিত্রার্কা অসংকোচে লারা আত্মার চরণে তাঁহার প্রেম উপহার দিতেন ও লরা তাহা অসংকোচে গ্রহণ করিতেছেন কল্পনা করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেন। পিত্রার্কা কহিতেছেন--
প্রতি উচ্চ-শাখাময় সরল কানন
প্রতি স্নিগ্ধ ছায়া মোর ভ্রমণের স্থান;
শৈলে শৈলে তাঁর সেই পবিত্র-আনন
দেখিবারে পায় মোর মানস-নয়ন।
সহসা ভাবনা হতে উঠি যবে জাগি,
প্রেমে মগ্ন মন মোর বলে গো আমায়
"কোথায় ভ্রমিছ ওগো, ভ্রমিছ কী লাগি?
কোথা হতে আসিয়াছ, এসেছ কোথায়?'
হৃদে মোর এইসব চঞ্চল-স্বপন
ক্রমে ক্রমে স্থির চিন্তা করে আনয়ন,
আপনারে একেবারে যাই যেন ভুলি
দহে গো আমারে শুধু তারি চিন্তাগুলি।
মনে হয় প্রিয়া যেন আসিয়াছে কাছে
সে ভুলে উজলি উঠে নয়ন আমার,
চারি দিকে লরা যেন দাঁড়াইয়া আছে
এ স্বপ্ন না ভাঙে যদি কী চাহি গো আর?
দেখি যেন (কেবা তাহা করিবে বিশ্বাস?)
বিমল সলিল কিংবা হরিত কানন
অথবা তুষার-শুভ্র উষার আকাশ
তাঁহারি জীবন্ত-ছবি করিছে বহন!
...
দুর্গম-সংসারে যত করি গো ভ্রমণ,
ঘোরতর মরু মাঝে যতদূর যাই,
কল্পনা ততই তার মুরতি মোহন
দিশে দিশে আঁকে, যেন দেখিবারে পাই।
অবশেষে আসে ধীরে সত্য সুকঠোর
ভাঙি দেয় যৌবনের সুখস্বপ্ন মোর!
বিমল বাহিনী ওগো তরুন-তটিনী।
উজ্জ্বল-তরঙ্গে তব, প্রেয়সী আমার--
ভক্ত হৃদয়ের মম একমাত্র দেবী
সৌন্দর্য তাঁহার যত করেছেন দান!
শুন গো পাদপ তুমি, তব দেহ-"পরে
ভর দিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন সে দেবী,
নত হয়ে পড়েছিল ফুল পত্রগুলি
বসনের তলে; বক্ষ সুবিমল তার
পরশিয়াছিলে তব সুধা আলিঙ্গনে।
তুমি বায়ু সেইখানে বহিতেছ সদা
যেইখানে প্রেম আসি দেখাইলা মোরে
প্রিয়ার নয়নে শোভে ভাণ্ডার তাহার!
শুন গো তোমরা সবে আর-একবার
এই ভগ্ন-হৃদয়ের শেষ দুঃখ-গান!
অবশ্য ফmবে যদি ভাগ্যের লিখন!
অবশ্যই অবশেষে প্রেম যদি মোর
অশ্রুময় আঁখিদ্বয় করে গো মুদিত,
ভ্রমিবে যখন আত্মা স্বদেশ আকাশে
তখন দেখো গো যেন এই প্রিয়-স্থানে
অভাগার শেষ-চিহ্ন হয় গো নিহিত!
মরণের কঠোরতা হবে কত হ্রাস,
যদি এই প্রিয় আশা, সেই ভয়ানক
অনন্তের পথ করে পুষ্প-বিকীরিত!
এই কাননের মতো সুশীতল ছায়া
কোথা আছে পৃথিবীতে, শ্রান্ত আত্মা যেথা
এক মুহূর্তের তরে করিবে বিশ্রাম!
নাহিকো এমন শান্ত হরিত-কবর
যেখানে সংসার-শ্রমে পরিশ্রান্ত -দেহ
ঘুমাইবে পৃথিবীর দুখ শোক ভুলি!
...
বোধ হয় একদিন সে মোর প্রেয়সী
স্বর্গীয়-সুন্দরী সেই নিষ্ঠুর-দয়ালু--
একদিন এইখানে আসিবে কি ভাবি,
যেইখানে একদিন মুগ্ধ নেত্র মোর
উজ্জ্বল সে নেত্র-'পরে রহিত চাহিয়া!
হয়তো নয়ন তাঁর আপনা আপনি
খুঁজিয়া খুঁজিয়া মোরে চারি দিক পানে
আমার কবর সেই পাইবে দেখিতে!
হয়তো শিহরি তার উঠিবে অন্তর,
হয়তো একটি তার বিষাদ-নিশ্বাস
জাগাইবে মোর 'পরে স্বর্গের করুণা!
...
এখনো সে মনে পড়ে -- যবে পুষ্প বন
বসন্তের সমীরণে হইয়া বিনত
সুরভিকুসুমরাশি করিত বর্ষণ,
তখন রক্তিম-মেঘে হইয়া আবৃত
বসিতেন প্রকৃতির উপহার মাঝে।
কভু বা বসনে তাঁর কভু বা কুন্তলে
প্রকৃতি কুসুম-গুচ্ছ দিত সাজাইয়া।
চারি দিকে তাঁর, কভু তটিনী-সলিলে--
কভু বা তৃণের 'পরে পড়িত ঝরিয়া
পুষ্প বন হতে কত পুষ্প রাশি রাশি!
চারি দিকে তরুলতা কহিত মর্মরি
"প্রেম হেথা করিয়াছে সাম্রাজ্য বিস্তার!'
সুকোমল ম্লান ভাব কপোলে তাঁহার
ঢাকিল সে হাসি তাঁর, ক্ষুদ্র মেঘ যথা!
প্রেম হেন উথলিল হৃদয়ে আমার
আঁখি কৈল প্রাণপণ কহিবারে কথা!
তখন জানিনু আমি স্বরগ-আলয়ে
কী করিয়া কথা হয় আত্মায় আত্মায়
উজলি উঠিল তাঁর দয়া দিকচয়ে
আমি ছাড়া আর কেহ দেখে নি গো তায়!
...
সবিষাদে অবনত নয়ন তাঁহার
নীরবে আমারে যেন কহিল সে এসে,
"কে গো হায় বিশ্বাসী এ বন্ধুরে আমার
লইয়া যেতেছে ডাকি এত দূর-দেশে?'
হা রে হতভাগ্য বিহঙ্গম সঙ্গীহীন!
সুখ-ঋতু অবসানে গাহিছিস গীত!
ফুরাইছে গ্রীষ্ম ঋতু ফুরাইছে দিন
আসিছে রজনী ঘোর আসিতেছে শীত!
ওরে বিহঙ্গম, তুই দুখ-গান গাস
যদি জানিতিস কী যে দহিছে এ প্রাণ
তা হলে এ বক্ষে আসি করিতিস বাস,
এর সাথে মিশাতিস বিষাদের গান!
কিন্তু হা-- জানি না তোর কিসের বিষাদ,
ভ্রমিস রে যার লাগি গাহিয়া গাহিয়া,
হয়তো সে বেঁচে আছে বিহঙ্গিনী প্রিয়া,
কিন্তু মৃত্যু এ কপালে সাধিয়াছে বাদ!
সুখ দুঃখ চিন্তা আশা যা-কিছু অতীত,
তাই নিয়ে আমি শুধু গাহিতেছি গীত!
কী সৌন্দর্য-স্রোত হোথা পড়িছে ঝরিয়া!
স্বর্গ দিতেছেন ঢালি কী আলোক-রাশি!
...
চরণে হরিত-তৃণ উঠে অঙ্কুরিয়া
শত বর্ণময় ফুল উঠিছে বিকাশি!
হর্ষময় ভক্তিভরে সায়াহ্ন-বিমান
সমুদয় দীপ তার করেছে জ্বলিত,
প্রচারিতে দিশে দিশে তার যাশোগান
পাইয়া যাহার শোভা হয়েছে শোভিত।
স্তব্ধ সন্ধ্যাকালে যবে পশ্চিম আকাশে
রবি অস্তাচলগামী পড়েছে ঢলিয়া,
বৃদ্ধ যাত্রী কোন্ এক অজ্ঞাত প্রবাসে
শ্রান্ত-পদক্ষেপে একা যেতেছে চলিয়া।
তবু যবে ফুরাইয়া যাবে শ্রম তার,
তখন গভীর ঘুমে মজিয়া বিজনে
ভুলে যাবে দিবসের বিষাদের ভার,
যত ক্লেশ সহিয়াছি সুদূর-ভ্রমণে!
কিন্তু হায় প্রভাতের কিরণের সনে
যে জ্বালা জাগিয়া উঠে হৃদয়ে আমার
রবি যবে ঢলি পড়ে পশ্চিম গগনে
দ্বিগুণ সে জ্বালা হৃদি করে ছারখার!
প্রজ্বলন্ত রথচক্র নিম্ন পানে যবে
লয়ে যান সূর্যদেব, অসহায় ভবে
রাখি রাত্রি-কোলে, যার দীর্ঘীকৃত ছায়া
প্রত্যেক গিরিশিখর সমুন্নত-কায়া
উপত্যকা- 'পরে দেয় বিস্তারিত করি;
তখন কৃষক হল লয়ে স্কন্ধোপরি,
ধরি কোন্ গ্রাম্যগীত অশিক্ষিত স্বরে
চিন্তা ঢালি দেয় তার বন্য-বায়ু-'পরে!
...
চিরকাল সুখে তারা করুক যাপন!
আমার আঁধার দিনে হর্ষের কিরণ
এক তিল অভাগারে দেয় নি আরাম,
এক মুহূর্তের তরে দেয় নি বিরাম!
যে গ্রহ উঠিয়া কেন উজলে বিমান
আমার যে দশা তাহা রহিল সমান!
দগ্ধ হয়ে মর্মভেদী মর্ম-যন্ত্রণায়
এ বিলাপ করিতেছি, দেখিতেছি হায়--
অতি ধীর পদক্ষেপে স্বাধীনতা সুখে
হল-যুগ-মুক্ত বৃষ ধায় গৃহ-মুখে!
আমি কি হব না মুক্ত এ বিষাদ হতে,
সদাই ভাসিবে আঁখি অশ্রু-জল-স্রোতে।
তার সেই মুখপানে চাহিল যখন
কী খুঁজিতেছিল মোর নয়ন তখন?
এক দৃষ্টে চাহিনু স্বর্গীয় মুখপানে
সৌন্দর্য অমনি তার বসি গেল প্রাণে
কিছুতে সে মুছিবে না যত দিনে আসি
মৃত্যু এই জীর্ণ-দেহ না ফেলে বিনাশি!
আরো দেখুন