সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় বাষ্পের প্রভাব যখন বেশি তখন গ্রহনক্ষত্রে ল্যাজামুড়োর প্রভেদ থাকে না। আমাদের দেশে সেই দশা-- তাই সকলকেই সব কাজে লাগতে হয়, কবিকেও কাজের কথায় টানে। অতএব আমি আজকের এই সভায় দাঁড়ানোর জন্যে যদি ছন্দোভঙ্গ হয়ে থাকে তবে ক্ষমা করতে হবে। এখানকার আলোচ্য কথাটি সোজা। দেশের হিত করাটা যে দেশের লোকেরই কর্তব্য সেইটে এখানে স্বীকার করতে হবে। এ কথাটা দুর্বোধ নয়। কিন্তু নিতান্ত সোজা কথাও কপালদোষে কঠিন হয়ে ওঠে সেটা পূর্বে পূর্বে দেখেছি। খেতে বললে মানুষ যখন মারতে আসে তখন বুঝতে হবে সহজটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেইটেই সব চেয়ে মুশকিলের কথা।
বঙ্কিমের মৃত্যু উপলক্ষে শোকপ্রকাশ করিবার জন্য যাঁহারা সাধারণ সভা আহ্বানের চেষ্টা করিয়াছেন, শুনা যায়, তাঁহারা একটি গুরুতর বাধা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; সে বাঁধা সর্বাপেক্ষা বিস্ময়জনক এবং তাহা পূর্বে প্রত্যাশা করা যায় নাই। যাঁহারা বঙ্কিমের বন্ধুত্ব সম্পর্কে আপনাদিগকে গৌরবান্বিত জ্ঞান করেন এমন অনেক খ্যাতনামা লোক সভাস্থলে শোকপ্রকাশ করা কৃত্রিম আড়ম্বর বলিয়া তাহাতে যোগদান করিতে অসম্মত হইয়াছেন এবং সভার উদ্যোগিগণকে ভৎর্সনা করিতেও ক্ষান্ত হন নাই। এরূপ বিয়োগ উপলক্ষে আপন অন্তরের আবেগ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করাকে বোধ করি তাঁহারা পবিত্র শোকের অবমাননা বলিয়া জ্ঞান করেন।
এই আশ্রমের ছাত্র অধ্যাপক বন্ধু একে একে অনেকেই এখান থেকে চলে গেছেন, আজ তাঁদের সকলকে স্মরণ করতে হবে। আজ তাঁরা অন্য প্রবেশপথ দিয়ে চিরন্তনের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, তাঁরা অমৃতলোকে প্রবেশ করেছেন। আজ আমরা যেন তাঁদের মধ্যে নিত্যস্বরূপের পরিচয় পাই। যে-সব ছাত্র এখানে থেকে কিছু নেবার জন্য এসেছিল সেই নেওয়ার আনন্দের মধ্যেই তারা একটি বড়ো জিনিস এখানে রেখে গেছে। শিশু যেমন পৃথিবীতে মাতৃস্তন্যের ভিক্ষু হয়ে আসে আর তাদের সেই ক্ষুধার আবেদনের দ্বারাই এবং মাতৃস্নেহের দানকে সহজ আনন্দে গ্রহণ করার দ্বারাই মাতার স্বরূপকে সহজ করে দেয় তেমনি যে-সব ছাত্র এখানে আশ্রম-জননীর কাছ থেকে সূর্যোদয়ের আলোক-বাণী শুনেছে, অমৃতঅন্নের দান গ্রহণ করেছে তাদের সেই দান গ্রহণের সহজ আনন্দের দ্বারাই এখানকার আশ্রমের সত্যটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।