ছন্দের অর্থ
Essays
শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন তির্যক্ ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরও কিছু বেশি প্রকাশ করে। সেই বেশিটুকু যে কী তা বলাই শক্ত। কেননা তা কথার অতীত, সুতরাং অনির্বচনীয়। যা আমরা দেখছি শুনছি জানছি তার সঙ্গে যখন অনির্বচনীয়ের যোগ হয় তখন তাকেই আমরা বলি রস। অর্থাৎ সে-জিনিসটাকে অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। সকলে জানেন, এই রসই হচ্ছে কাব্যের বিষয়।
এইখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, অনির্বচনীয় শব্দটার মানে অভাবনীয় নয়। তা যদি হত তাহলে ওটা কাব্যে অকাব্যে কুকাব্যে কোথাও কোনো কাজে লাগত না। বস্তু-পদার্থের সংজ্ঞা নির্ণয় করা যায় কিন্তু রস-পদার্থের করা যায় না। অথচ রস আমাদের একান্ত অনুভূতির বিষয়। গোলাপকে আমরা বস্তুরূপে জানি, আর গোলাপকে আমরা রসরূপে পাই। এর মধ্যে বস্তু-জানাকে আমরা সাদা কথায় তার আকার আয়তন ভার কোমলতা প্রভৃতি বহুবিধ পরিচয়ের দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু রস-পাওয়া এমন একটি অখণ্ড ব্যাপার যে তাকে তেমন করে সাদা কথায় বর্ণনা করা যায় না; কিন্তু তাই বলেই সেটা অলৌকিক অদ্ভুত অসামান্য কিছুই নয়। বরঞ্চ রসের অনুভূতি বস্তুজ্ঞানের চেয়ে আরো নিকটতর প্রবলতর গভীরতর। এইজন্য গোলাপের আনন্দকে আমরা যখন অন্যের মনে সঞ্চার করতে চাই তখন একটা সাধারণ অভিজ্ঞতার রাস্তা দিয়েই করে থাকি। তফাত এই বস্তু-অভিজ্ঞতার ভাষা সাদা কথার বিশেষণ, কিন্তু রস-অভিজ্ঞতার ভাষা আকার ইঙ্গিত সুর এবং রূপক। পুরুষমানুষের যে পরিচয়ে তিনি আপিসের বড়োবাবু সেটা আপিসের খাতাপত্র দেখলেই জানা যায়, কিন্তু মেয়ের যে-পরিচয়ে তিনি গৃহলক্ষ্মী সেটা প্রকাশের জন্যে তাঁর সিঁথেয় সিঁদুর, তাঁর হাতে কঙ্কণ। অর্থাৎ, এটার মধ্যে রূপক চাই, অলংকার চাই, কেনা, কেবলমাত্র তথ্যের চেয়ে এ যে বেশি; এর পরিচয় শুধু জ্ঞানে নয়, হৃদয়ে। ঐ যে গৃহলক্ষ্মীকে লক্ষ্মী বলা গেলে এইটেই তো হল একটা কথার ইশারামাত্র; অথচ আপিসের বড়োবাবুকে তো আমাদের কেরানি-নারায়ণ বলবার ইচ্ছাও হয় না, যদিও ধর্মতত্ত্বে বলে থাকে সকল নরের মধ্যেই নারায়ণের আবির্ভাব আছে। তাহলেই বোঝা যাচ্ছে, আপিসের বড়োবাবুর মধ্যে অনির্বচনীয়তা নেই। কিন্তু যেখানে তাঁর গৃহিণী সাধ্বী সেখানে তাঁর মধ্যে আছে। তাই বলে এমন কথা বলা যায় না যে, ঐ বাবুটিকেই আমরা সম্পূর্ণ বুঝি আর মালক্ষ্মীকে বুঝি নে, বরঞ্চ উলটো। কেবল কথা এই যে, বোঝবার বেলায় মা-লক্ষ্মী যত সহজ বোঝাবার বেলায় তত নয়।
রজনী শাঙনঘন, ধন দেয়া-গরজন,
রিমিঝিমি শবদে বরিষে।
পালঙ্গে শয়ান রঙ্গে, বিগলিত চীর অঙ্গে,
নিন্দ যাই মনের হরিষে।
শ্রাবণমেঘে তিমিরঘন শর্বরী,
বরিষে জল কাননতল মর্মরি॥
জলদরব-ঝংকারিত ঝঞ্ঝাতে
বিজন ঘরে ছিলাম সুখ-তন্দ্রাতে,
অলস মম শিথিল তনু-বল্লরী।
মুখর শিখী শিখরে ফিরে সঞ্চরি॥
শারদ চন্দ্র পবন মন্দ, বিপিন ভরল কুসুমগন্ধ।
১ ২ ৩ ৪
শারদ চন্দ্র পবন মন্দ, বিপিন ভরল কুসুমগন্ধ,
৫ ৬ ৭ ৮
ফুল্ল মল্লি মালতি যুথি মত্তমধুপ- ভোরনী।
১ ২ ৩ ৪
মহাভার- তের কথা অমৃত স- মান,
৫ ৬ ৭ ৮
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্য- বান্।
ফিরে ফিরে আঁখি- নীরে পিছু পানে চায়।
পায়ে পায়ে বাধা প'ড়ে চলা হল দায়।
নয়ন- ধারায় পথ সে হারায়, চায় সে পিছন পানে,
চলিতে চলিতে চরণ চলে না, ব্যথার বিষম টানে।
যতই চলে চোখের জলে নয়ন ভ'রে ওঠে,
চরণ বাধে, পরান কাঁদে, পিছনে মন ছোটে।
কেন তোরে আনমন দেখি।
কাহে নখে ক্ষিতিতল লেখি।
মলিন বদন ভেল,
ধীরে ধীরে চলি গেল।
আওল রাইর পাশ।
কি কহিব জ্ঞান- দাস॥ ১॥
জাগিয়া জাগিয়া হইল খীন
অসিত চাঁদের উদয়দিন ॥ ২॥
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে
না চলে নয়ন- তারা।
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে
যেমত যোগিনী- পারা॥ ৩॥
বেলি অবসান- কালে
কবে গিয়াছিলা জলে।
তাহারে দেখিয়া ইষত হাসিয়া
ধরিলি সখীর গলে॥ ৪॥
চিকনকালা, গলায় মালা,
বাজন নূপুর পায়।
চূড়ার ফুলে ভ্রমর বুলে,
তেরছ নয়ানে চায়॥
পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে।
পাষাণ মূর্ছিয়া যায় গায়ের বাতাসে।
পাষাণ মূর্ছিয়া যায় অঙ্গের বাতাসে।
পাষাণ মূর্ছিয়া যায় অঙ্গের উচ্ছ্বাসে।
সংগীত তরঙ্গি উঠে অঙ্গের উচ্ছ্বাসে।
সংগীততরঙ্গরঙ্গ অঙ্গের উচ্ছ্বাস।
দুর্দান্তপাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত।
২ ২ ২ ২ ২ ২ ২
ধরণীর আঁখিনীর মোচনের ছলে
২ ২ ২ ২ ২ ২ ২
দেবতার অবতার বসুধার তলে।
ধরিত্রীর চক্ষুনীর মুঞ্চনের ছলে
কংসারির শঙ্খরব সংসারের তলে।
২ ২ ২ ২ ২ ২ ২ ২
হরি রিহ বিহরতি সরস বসন্তে।
পাষাণ মিলায় গায়ের বাতাসে।
গিরির গুহায় ঝরিছে নিঝর
পর্বত- কন্দরে ঝরিছে নির্ঝর
গিরিগুহাতল বেয়ে ঝরিছে নিঝর
পর্বতকন্দরতলে ঝরিছে নির্ঝর
অহহ কল- য়ামি বল- য়াদিমণি- ভূষণং
হরি্বিরহ- দহনবহ- নেন বহু- দূষণং।
বসন্ত পাঠায় দূত রহিয়া রহিয়া,
যে কাল গিয়েছে তারি নিশ্বাস বহিয়া।
ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে নাই,
পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।
ফাগুন এল দ্বারে-এ কেহ যে ঘরে না-আ-ই।
ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে না-আ-ই।
তালি তালি তালি তালি
ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে নাই,
পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।
তালি তালি তালি তালি
ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে নাই,
পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।
। । । ।
সে যে আপন মনে শুধু দিবস গণে,
তার চোখের বারি কাঁপে আঁখির কোণে।
। । । ।
নয়নের সলিলে যে কথাটি বলিলে
রবে তাহা স্মরণে জীবনে ও মরণে।
। । । ।
যে কথা নাহি শোনে সে থাক্ নিজমনে,
কে বৃথা নিবেদনে রে ফিরে তার সনে।
। । ।
চাহিছ বারে বারে আপনারে ঢাকিতে,
মন না মানে মানা মেলে ডানা আঁখিতে।
। । । ।
চাহিছ বারে বারে আপনারে ঢাকিতে,
মন না মানে মানা মেলে ডানা আঁখিতে।
। । । ।
ব্যাকুল বকুল ঝরিল পড়িল ঘাসে,
বাতাস উদাস আমের বোলের বাসে।
। ।
ব্যাকুল বকুল ঝরিল পড়িল ঘাসে,
বাতাস উদাস আমের বোলের বাসে।
। । ।
নীরবে গেলে ম্লানমুখে আঁচল টানি,
কাঁদিছে দুখে মোর বুকে না-বলা বাণী।
। । ।
নীরবে গেলে ম্লানমুখে আঁচল টানি,
কাঁদিছে দুখে মোর বুকে না-বলা বাণী।
ওহে পান্থ, চলো পথে, পথে বন্ধু আছে
একা বসে ম্লানমুখে, সে যে সঙ্গ যাচে।
চৈত্রের সেতারে বাজে বসন্তবাহার,
বাতাসে বাতাসে ওঠে তরঙ্গ তাহার।
চক্মকি-ঠোকাঠুকি-আগুনের প্রায়
চোখোচোখি ঘটিতেই হাসি ঠিকরায়।
তারাগুলি সারারাতি কানে কানে কয়,
সেই কথা ফুলে ফুলে ফুটে বনময়।
এইখানে দুই মাত্রার আয়োজন।
প্রেমের অমরাবতী প্রেয়সীর প্রাণে,
কে সেথা দেবাধিপতি সে কথা কে জানে।
গম্ভীর পাতাল, যেথা-কালরাত্রি করালবদনা
বিস্তারে একাধিপত্য। শ্বসয়ে অযুত ফণিফণা
দিবানিশি ফাটি রোষে; ঘোর নীল বিবর্ণ অনল
শিখাসংঘ আলোড়িয়া দাপাদাপি করে দেশময়
তমোহস্ত এড়াইতে-- প্রাণ যথা কালের কবল।
কশ্চিৎকান্তা- বিরহগুরুণা স্বাধিকার- প্রমত্তঃ।
।।। । । ।।। । ।।। । ।।। । ।।। । ।।। ।।। । । ।।।
দেখহ সুন্দর লৌহর- থে চড়ি লৌহপ- থে কত লোক চ- লে .. ,
ষষ্ঠ মূ- হূর্তক মধ্য ক- রে গতি যোজন পঞ্চ দ- শের প- থে ..।
লৌহবি- নির্মিত তার ত- রে বহু দূর অ- বস্থিত লোক স- বে .. ,
দূর অ- বস্থিত বন্ধুস- নে সুখ- চিত্ত প- রস্পর বাক্য ক- হে .. ।
দেখ দেখ মনোহরলোহার গা- ড়িতে চড়ি
লোহাপথে কত শত মানুষ চ- লিছে
দেখিতে দে- খিতে তারা যোজন যো- জন পথ
অনায়াসে তরে যায় টিকিট কি- নিয়া।
যেসব মা- নুষ আছে অনেক দূ- রের দেশে,
লোহা দিয়ে গড়া তার রয়েছে ব- লিয়া,
সুদূর বঁ- ধূর সাথে কত যে ম- নের সুখে
কথা চালা- চালি করে নিমেষে নি- মেষে॥
বৃষ্টি পড়ে টাপুর্ টুপুর্ নদেয়্ এল বান্।
শিব্ ঠাকুরের্ বিয়ে হবে তিন্ কন্যে দান্॥
এক্ কন্যে রাঁধেন্ বাড়েন্ এক্ কন্যে খান্।
এক্ কন্যে না পেয়ে বাপের্ বাড়ি যান্॥
বারি ঝরে ঝর ঝর নদিয়ায় বান।
শিবঠাকুরের বিয়ে তিন মেয়ে দান॥
এক মেয়ে রাঁধিছেন এক মেয়ে খান।
এক মেয়ে ক্ষুধাভরে পিতৃঘরে যান॥
মন্দ মন্দ বৃষ্টি পড়ে নবদ্বীপে বান।
শিবঠাকুরের বিয়া তিন কন্যা দান॥
এক কন্যা রান্ধিছেন এক কন্যা খান।
এক কন্যা ঊর্ধ্বশ্বাসে পিতৃগৃহে যান॥
পাঁচালী নাম বিখ্যাতা সাধারণ-মনোরমা।
পয়ার ত্রিপদী আদি প্রাকৃতে হয় চালনা॥
দ্বিপাদে শ্লোক সংপূর্ণ তুল্যসংখ্যার অক্ষরে।
পাঠে দুই পদে মাত্র শেষাক্ষর সদা মিলে॥
পঠনে সে সব ছন্দঃ রাখিতে তালগৌরব।
পঠিছে সর্বদা লোকে উচ্চারণ-বিপর্যয়ে॥
লঘুকে গুরু সম্ভাষে দীর্ঘবর্ণে কহে লঘু।
হ্রস্বে দীর্ঘে সমজ্ঞানে উচ্চারণ করে সবে॥
আরো দেখুন