ছেলেভুলানো ছড়া: ১
Essays
বাংলা ভাষায় ছেলে ভুলাইবার জন্য যে-সব মেয়েলি ছড়া প্রচলিত আছে, কিছুকাল হইতে আামি তাহা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত ছিলাম। আমাদের ভাষা এবং সমাজের ইতিহাস-নির্ণয়ের পক্ষে সেই ছড়াগুলির বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে-একটি সহজ স্বাভাবিক কাব্যরস আছে সেইটিই আমার নিকট অধিকতর আদরণীয় বোধ হইয়াছিল।
আমার কাছে কোন্টা ভালো লাগে বা না লাগে সেই কথা বলিয়া সমালোচনার মুখবন্ধ করিতে ভয় হয়। কারণ, যাঁহারা সুনিপুণ সমালোচক, এরূপ রচনাকে তাঁহারা অহমিকা বলিয়া অপরাধ লইয়া থাকেন।
যমুনাবতী সরস্বতী, কাল যমুনার বিয়ে।
যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে॥
কাজিফুল কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা।
হাত-ঝুম্-ঝুম্ পা-ঝুম্-ঝুম্ সীতারামের খেলা॥
নাচো তো সীতারাম কাঁকাল বেঁকিয়ে।
আলোচাল দেব টাপাল ভরিয়ে॥
আলোচাল খেতে খেতে গলা হল কাঠ।
হেথায় তো জল নেই, ত্রিপূর্ণির ঘাট॥
ত্রিপূর্ণির ঘাটে দুটো মাছ ভেসেছে।
একটি নিলেন গুরুঠাকুর, একটি নিলেন কে।
তার বোনকে বিয়ে করি ওড়ফুল দিয়ে॥
ওড়ফুল কুড়োতে হয়ে গেল বেলা।
তার বোনকে বিয়ে করি ঠিক-দুক্ষুর বেলা॥
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদী এলো বান।
শিবু ঠাকুরের বিয়ে হল, তিন কন্যে দান॥
এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান।
এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান॥
এ পার গঙ্গা, ও পার গঙ্গা, মধ্যিখানে চর।
তারি মধ্যে বসে আছে শিব সদাগর॥
শিব গেল শ্বশুরবাড়ি, বসতে দিল পিঁড়ে।
জলপান করিতে দিল শালিধানের চিঁড়ে॥
শালিধানের চিঁড়ে নয় রে, বিন্নিধানের খই।
মোটা মোটা সব্রি কলা, কাগ্মারে দই।
নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোঁটন রেখেছে।
বড়ো সাহেবের বিবিগুলি নাইতে এসেছে॥
দু পারে দুই রুই কাৎলা ভেসে উঠেছে।
দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে॥
ও পারেতে দুটি মেয়ে নাইতে নেবেছে।
ঝুনু ঝুনু চুলগাছটি ঝাড়তে নেগেছে॥
কে রেখেছে, কে রেখেছে, দাদা রেখেছে।
আজ দাদার ঢেলা ফেলা, কাল দাদার বে।
দাদা যাবে কোন্ খান দে, বকুলতলা দে॥
বকুলফুল কুড়তে কুড়তে পেয়ে গেলুম মালা।
রামধনুকে বাদ্দি বাজে, সীতেনাথের খেলা॥
সীতেনাথ বলে রে ভাই, চালকড়াই খাব।
চালকড়াই খেতে খেতে গলা হল কাঠ।
হেথা হোথা, জল পাব চিৎপুরের মাঠ॥
চিৎপুরের মাঠেতে বালি চিক্ চিক্ করে।
সোনা-মুখে রোদ নেগে রক্ত ফেটে পড়ে॥
ও পারে জন্তি গাছটি, জন্তি বড়ো ফলে।
গো জন্তির মাথা খেয়ে প্রাণ কেমন করে॥
প্রাণ করে হাইঢাই, গলা হল কাঠ।
কতক্ষণে যাব রে ভাই হরগৌরীর মাঠ॥
হরগৌরীর মাঠে রে ভাই পাকা পাকা পান।
পান কিনলাম, চুন কিনলাম, ননদে ভাজে খেলাম।
একটি পান হারালে দাদাকে ব'লে দেলাম॥
দাদা দাদা ডাক ছাড়ি, দাদা নাইকো বাড়ি।
সুবল সুবল ডাক ছাড়ি, সুবল আছে বাড়ি॥
আজ সুবলের অধিবাস, কাল সুবলের বিয়ে।
সু'বলকে নিয়ে যাব আমি দিগ্নগর দিয়ে॥
দিগ্নগরের মেয়েগুলি নাইতে বসেছে।
মোটামোটা চুলগুলি গো পেতে বসেছে।
চিকন চিকন চুলগুলি ঝাড়তে নেগেছে॥
হাতে তাদের দেবশাঁখা মেঘ নেগেছে।
গলায় তাদের তক্তি মালা রক্ত ছুটেছে॥
পরনে তার ডুরে শাড়ি ঘুরে পড়েছে।
দুই দিকে দুই কাৎলা মাছ ভেসে উঠেছে।
একটি নিলেন গুরুঠাকুর, একটি নিলেন টিয়ে॥
টিয়ের মার বিয়ে
নাল গামছা দিয়ে॥
আশথের পাতা ধনে।
গৌরী বেটী কনে॥
নকা বেটা বর!
ঢ্যাম কুড়্ কুড়্ বাদ্দি বাজে, চড়কডাঙায় ঘর॥
দাদা দাদা ডাক ছাড়ি, দাদা নাইকো বাড়ি।
সুবল সুবল ডাক ছাড়ি, সুবল আছে বাড়ি॥
চিৎপুরের মাঠেতে বালি চিক্ চিক্ করে।
পরনে তার ডুরে শাড়ি ঘুরে পড়েছে।
পরনে তার ডুরে কাপড় উড়ে পড়েছে।
আয় ঘুম, আয় ঘুম বাগ্দিপাড়া দিয়ে।
বাগ্দিদের ছেলে ঘুমোয় জাল মুড়ি দিয়ে॥
আয় রে আয় ছেলের পাল মাছ ধরতে যাই।
মাছের কাঁটা পায়ে ফুটল দোলায় চেপে যাই।
দোলায় আছে ছ'পণ কড়ি, গুনতে গুনতে যাই॥
এ নদীর জলটুকু টল্মল্ করে।
এ নদীর ধারে রে ভাই বালি ঝুর্ঝুর্ করে।
চাঁদ মুখেতে রোদ লেগেছে, রক্ত ফুটে পড়ে॥
দাদা গো দাদা শহরে যাও।
তিন টাকা করে মাইনে পাও॥
দাদার গলায় তুলসীমালা।
বউ বরনে চন্দ্রকলা॥
হেই দাদা তোমার পায়ে পড়ি।
বউ এনে দাও খেলা করি॥
হেই দাদা তোমার পায়ে পড়ি।
বউ এনে দাও খেলা করি॥
উলু উলু মাদারের ফুল।
বর আসছে কত দূর॥
বর আসছে বাঘ্নাপাড়া।
বড়ো বউ গো রান্না চড়া॥
ছোটো বউ লো জলকে যা।
জলের মধ্যে ন্যাকাজোকা।
ফুল ফুটেছে চাকা চাকা।
ফুলের বরণ কড়ি।
নটে শাকের বড়ি॥
আয় রে আয় টিয়ে
নায়ে ভরা দিয়ে॥
না নিয়ে গেল বোয়াল মাছে।
তা দেখে দেখে ভোঁদর নাচে॥
ওরে ভোঁদর ফিরে চা।
খোকার নাচন দেখে যা॥
খোকা যাবে মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কূলে।
ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে, মাছ নিয়ে গেল চিলে॥
খোকা ব'লে পাখিটি কোন্ বিলে চরে।
খোকা ব'লে ডাক দিলে উড়ে এসে পড়ে॥
জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ।
চার কালো দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ॥
কাক কালো, কোকিল কালো, কালো ফিঙের বেশ।
তাহার অধিক কালো, কন্যে, তোমার মাথার কেশ।
জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ।
চার ধলো দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ॥
বক ধলো, বস্ত্র ধলো, ধলো রাজহংস।
তাহার আধিক ধলো, কন্যে, তোমার হাতের শঙ্খ॥
জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ।
চার রাঙা দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ॥
জবা রাঙা, করবী রাঙা, রাঙা কুসুমফুল।
তাহার অধিক রাঙা, কন্যে, তোমার মাথার সিঁদুর।
জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ।
চার তিতো দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ॥
নিম তিতো, নিসুন্দে তিতো, তিতো মাকাল ফল।
তাহার অধিক তিতো, কন্যে, বোন-সতিনের ঘর॥
জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ।
চার হিম দেখাতে পার যাব তোমার সঙ্গ॥
হিম জল, হিম স্থল, হিম শীতলপাটি।
তাহার অধিক হিম, কন্যে তোমার বুকের ছাতি॥
আয় আয় চাঁদামামা টী দিয়ে যা।
চাঁদের কপালে চাঁদ টী দিয়ে যা॥
মাছ কুটলে মুড়ো দেব।
ধান ভানলে কুঁড়ো দেব॥
কালো গোরুর দুধ দেব।
দুধ খাবার বাটি দেব॥
চাঁদের কপালে চাঁদ টী দিয়ে যা॥
ও পারেতে কালো রঙ।
বৃষ্টি পড়ে ঝম্ ঝম্॥
এ পারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুক্টুক্ করে।
গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে॥
"এ মাসটা থাক্ দিদি কেঁদে ককিয়ে।
ও মাসেতে নিয়ে যাব পাল্কি সাজিয়ে।'
হাড় হল ভাজা-ভাজা, মাস হল দড়ি।
আয় রে আয় নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি॥
ও পারেতে কালো রঙ বৃষ্টি পড়ে ঝম্ ঝম্।
মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তিচেতঃ।
... ... ...কিং পুনর্দূরসংস্থে॥
"গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।'
"হাড় হল ভাজা-ভাজা, মাস হল দড়ি।
আয় রে আয় নদীর জলে ঝাঁপ দিয়া পড়ি॥'
আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে।
দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি সংসার কাঁদায়ে॥
মা কাঁদেন, মা কাঁদেন ধুলায় লুটায়ে।
সেই-যে মা পলাকাটি দিয়েছেন গলা সাজায়ে॥
বাপ কাঁদেন, বাপ কাঁদেন দরবারে বসিয়ে।
সেই-যে বাপ টাকা দিয়েছেন সিন্ধুক সাজায়ে॥
মাসি কাঁদেন, মাসি কাঁদেন, হেঁশেলে বসিয়ে।
সেই-যে মাসি ভাত দিয়েছেন পাথর সাজিয়ে॥
পিসি কাঁদেন, পিসি কাঁদেন গোয়ালে বসিয়ে।
সেই-যে পিসি দুধ দিয়েছেন বাটি সাজিয়ে।
ভাই কাঁদেন, ভই কাঁদেন আঁচল ধরিয়ে।
সেই-যে ভাই কাপড় দিয়াছেন আলনা সাজিয়ে॥
বোন কাঁদেন, বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে।
সেই-যে বোন--
বোন কাঁদেন, বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে।
সেই-যে বোন গাল দিয়েছেন স্বামীখাকী বলে॥
দোল দোল দুলুনি।
রাঙা মাথায় চিরুনি॥
বর আসবে এখনি।
নিয়ে যাবে তখনি॥
কেঁদে কেন মর।
আপনি বুঝিয়া দেখো কার ঘর কর॥
পুঁটু যাবে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে যাবে কে।
ঘরে আছে কুনো বেড়াল, কোমর বেঁধেছে॥
আম-কাঁঠালের বাগান দেব ছায়ায় ছায়ায় যেতে।
চার মিন্সে কাহার দেব পলকি বহাতে॥
সরু ধানের চিঁড়ে দেব পথে জল খেতে।
চার মাগী দাসী দেব পায়ে তেল দিতে
উড়কি ধানের মুড়কি দেব শাশুড়ি ভুলাতে॥
ডালিম গাছে পর্ভু নাচে।
তাক্ধুমাধুম বাদ্দি বাজে॥
আয়ী গো চিনতে পার?
গোটাদুই অন্ন বাড়ো॥
আন্নপূর্ণা দুধের সর।
কাল যাব গো পরের ঘর॥
পরের বেটা মারলে চড়।
কানতে কানতে খুড়োর ঘর।
খুড়ো দিলে বুড়ো বর॥
হেই খুড়ো তোর পায়ে ধরি।
থুয়ে আয়গা মায়ের বাড়ি॥
মায়ে দিলে সরু শাঁখা, বাপে দিল শাড়ি।
ভাই দিলে হুড়কো ঠেঙা "চল্ শ্বশুরবাড়ি'।
তালগাছ কাটম বোসের বাটম গৌরী এল ঝি।
তোর কপালে বুড়ো বর আমি করব কী॥
টঙ্কা ভেঙে শঙ্কা দিলাম, কানে মদন কড়ি।
বিয়ের বেলা দেখে এলুম বুড়ো চাপদাড়ি॥
চোখ খাও গো বাপ-মা, চোখ খাও গো খুড়ো।
এমন বরকে বিয়ে দিয়েছিলে তামাক-খেগো বুড়ো॥
বুড়োর হুঁকো গেল ভেসে, বুড়ো মরে কেশে।
নেড়েচেড়ে দেখি বুড়ো মরে রয়েছে।
ফেন গালবার সময় বুড়ো নেচে উঠেছে॥
ধনকে নিয়ে বনকে যাব, সেখানে খাব কী।
নিরলে বসিয়া চাঁদের মুখ নিরখি॥
চাঁদ কোথা পাব বাছা, জাদুমণি!
মাটির চাঁদ নয় গড়ে দেব,
গাছের চাঁদ নয় পেড়ে দেব,
তোর মতন চাঁদ কোথায় পাব॥
তুই চাঁদের শিরোমণি।
ঘুমো রে আমার খোকামণি॥
হাটের ঘুম ঘাটের ঘুম পথে পথে ফেরে।
চার কড়া দিয়ে কিনলেম ঘুম মণির চোখ আয় রে॥
থেনা নাচেন থেনা। বট পাকুড়ের ফেনা॥
বলদে খালো চিনা, ছাগলে খালো ধান।
সোনার জাদুর জন্যে যায়ে নাচনা কিনে আন্॥
হাতের নাচন, পায়ের নাচন, বাটা মুখের নাচন।
নাটা চোখের নাচন, কাঁটালি ভুরুর নাচন।
বাঁশির নাকের নাচন, মাজা-বেঙ্কুর নাচন॥
আর নাচন কী।
অনেক সাধন ক'রে জাদু পেয়েছি॥
খোকা এল বেড়িয়ে। দুধ দাও গো জুড়িয়ে॥
দুধের বাটি তপ্ত। খোকা হলেন খ্যাপ্ত॥
খোকা যাবেন নায়ে। লাল জুতুয়া পায়ে॥
ধনকে নিয়ে বনকে যাব, সেখানে খাব কী।
নিরলে বসিয়া চাঁদের মুখ নিরখি॥
খোকা যাবে বেড়ু করতে তেলিমাগীদের পাড়া।
তেলিমাগীরা মুখ করেছে কেন্ রে মাখনচোরা--
"ভাঁড় ভেঙেছে, ননি খেয়েছে, আর কি দেখা পাব।
কদমতলায় দেখা পেলে বাঁশি কেড়ে নেব।'
আরো দেখুন