দ্বিতীয় ভাগ
Others
বাদল করেছে মেঘের রং ঘন নীল। ঢং ঢং ক’রে ৯টা বাজল। বংশু ছাতা মাথায় কোথায় যাবে? ও যাবে সংসারবাবুর বাসায়। সেখানে কংসবধের অভিনয় হবে। আজ মহারাজ হংসরাজসিংহ আসবেন। কংসবধ অভিনয় তাঁকে দেখাবে। বাংলাদেশে তাঁর বাড়ি নয়। তিনি পাংশুপুরের রাজা। সংসারবাবু তাঁরি সংসারে কাজ করেন। কাংলা,তুই বুঝি সংসারবাবুর বাসায় চলেছিস? সেখানে কংসবধে সং সাজতে হবে। কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসারবাবুর মা চেয়েছেন।
কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি —
বোঝাই-করা কল্সি হাঁড়ি ।
গাড়ি চালায় বংশীবদন ,
সঙ্গে-যে যায় ভাগ্নে মদন ।
হাট বসেচে শুক্রবারে
বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে ।
জিনিষপত্র জুটিয়ে এনে
গ্রামের মানুষ বেচে কেনে ।
উচ্ছে বেগুন পটল মূলো ,
বেতের বোনা ধামা কুলো ,
সর্ষে ছোলা ময়দা আটা ,
শীতের র্যাপার নক্শাকাটা ।
ঝাঁঝ্রি কড়া বেড়ি হাতা ,
শহর থেকে সস্তা ছাতা ।
কল্সি-ভরা এখো গুড়ে
মাছি যত বেড়ায় উড়ে ।
খড়ের আঁটি নৌকো বেয়ে
আনল ঘাটে চাষীর মেয়ে ।
অন্ধ কানাই পথের ‘ পরে
গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে!
পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে
জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে ।
ঐখানে মা পুকুর পাড়ে
জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে
হোথায় হব বনবাসী—
কেউ কোত্থাও নেই।
ঐখানে ঝাউতলা জুড়ে
বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে,
শুক্নো পাতা বিছিয়ে ঘরে
থাকব দুজনেই।
বাঘ ভাল্লুক, অনেক আছে—
আসবে না কেউ তোমার কাছে,
দিনরাত্তির কোমর বেঁধে
থাকব পাহারাতে।
রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে
মারবে উঁকি আড়ে আড়ে,
দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি
ধনুক নিয়ে হাতে।
আঁচলেতে খই নিয়ে তুই
যেই দাঁড়াবি দ্বারে
অম্নি যত বনের হরিণ
আসবে সারে সারে।
শিংগুলি সব আঁকাবাঁকা,
গায়েতে দাগ চাকা চাকা,
লুটিয়ে তারা পড়বে ভুঁয়ে
পায়ের কাছে এসে।
ওরা সবাই আমায় বোঝে,
করবে না ভয় একটুও-যে
হাত বুলিয়ে দেব গায়ে—
বসবে কাছে ঘেঁসে।
ফল্সাবনে গাছে গাছে
ফল ধ’রে মেঘ ঘনিয়ে আছে,
ঐখানেতে ময়ূর এসে
নাচ দেখিয়ে যাবে।
শালিখরা সব মিছিমিছি
লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি,
কাঠবেড়ালি ল্যাজটি তুলে
হাত থেকে ধান খাবে।
আমি-যে রোজ সকাল হ’লে
যাই শহরের দিকে চ’লে
তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চ’ড়ে
সকাল থেকে সারা দুপুর
ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর
খেয়ালমত দেয়াল তুলি গ’ড়ে।
সমস্ত দিন ছাতপিটুনী
গান গেয়ে ছাত পিটোয় শুনি,
অনেক নীচে চলচে গাড়ি ঘোড়া।
বাসনওয়ালা থালা বাজায়,
সুর ক’রে ঐ হাঁক দিয়ে যায়
আতাওয়ালা নিয়ে ফলের ঝোড়া,
সাড়ে চারটে বেজে ওঠে,
ছেলেরা সব বাসায় ছোটে
হোহো ক’রে উড়িয়ে দিয়ে ধুলো,—
রোদ্দুর যেই আসে প’ড়ে
পুবের মুখে কোথা ওড়ে
দলে দলে ডাক দিয়ে কাকগুলো।
আমি তখন দিনের শেষে
ভারার থেকে নেমে এসে
আবার ফিরে আসি আপন গাঁয়ে,
জানো না কি আমার পাড়া
যেখানে ওই খুঁটি-গাড়া
পুকুরপাড়ে গাজনতলার বাঁয়ে।
সেদিন ভোরে দেখি উঠে
বৃষ্টি বাদল গেছে ছুটে,
রোদ উঠেছে ঝিল্মিলিয়ে
বাঁশের ডালে ডালে,
ছুটির দিনে কেমন সুরে
পূজোর সানাই বাজায় দূরে,
তিনটে শালিখ ঝগড়া করে
রান্নাঘরের চালে।
শীতের বেলায় দুই পহরে
দূরে কাদের ছাদের ‘পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয়
বেগনি রঙের শাড়ি,
চেয়ে চেয়ে চুপ ক’রে রই—
তেপান্তরের পার বুঝি ওই,
মনে ভাবি ঐখানেতেই
আছে রাজার বাড়ি।
থাকতো যদি মেঘে-ওড়া
পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া
তক্ষনি-যে যেতেম তারে
লাগাম দিয়ে ক’ষে,
যেতে যেতে নদীর তীরে
ব্যঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে
পথ শুধিয়ে নিতেম আমি
গাছের তলায় ব’সে।
আকাশপারে পুবের কোণে
কখন যেন অন্যমনে
ফাঁক ধরে ঐ মেঘে,
মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে
বন্ধ চোখের পাতা মেলে
আকাশ ওঠে জেগে।
ছিঁড়ে-যাওয়া মেঘের থেকে
পুকুরে রোদ পড়ে বেঁকে
লাগায় ঝিলিমিলি,
বাঁশবাগানের মাথায় মাথায়
তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায়
হাসায় খিলিখিলি।
হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে
ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে
বাদলবেলার কথা,
হারিয়ে পাওয়া আলোটিরে
নাচায় ডালে ফিরে ফিরে
ঝুমকো ফুলের লতা।
একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু
“চেয়ে দেখো” “চেয়ে দেখো” বলে যেন বিনু।
চেয়ে দেখি, ঠোকাঠুকি বরগা কড়িতে,
কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।
ইঁটে-গড়া গণ্ডার বাড়িগুলো সোজা
চলিয়াছে দুদ্দাড় জানালা দরজা।
রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ,
পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্ ধাপ্।
দোকান বাজার সব নামে আর উঠে,
ছাদের গায়েতে ছাদ মরে মাথা কুটে।
হাওড়ার ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে,
হ্যারিসন্ রোড চলে তার পিছে পিছে।
মনুমেণ্টের দোল যেন ক্ষ্যাপা হাতি
শূন্যে দুলায়ে শুঁড় উঠিয়াছে মাতি।
আমাদের ইস্কুল ছোটে হন্হন্,
অঙ্কের বই ছোটে, ছোটে ব্যাকরণ।
ম্যাপগুলো দেয়ালেতে করে ছট্ফট্,
পাখি যেন মারিতেছে পাখার ঝাপট।
ঘণ্টা কেবলি দোলে ঢঙ্ ঢঙ্ বাজে—
যত কেন বেলা হোক তবু থামে না-যে।
লক্ষ লক্ষ লোক বলে, “থামো থামো”।
কোথা হতে কোথা যাবে এ কী পাগ্লামো।”
কলিকাতা শোনে না কো চলার খেয়ালে—
নৃত্যের নেশা তার স্তম্ভে দেয়ালে।
আমি মনে মনে ভাবি চিন্তা তো নাই,
কলিকাতা যাক নাকো সোজা বোম্বাই।
দিল্লি লাহোরে যাক, যাক না আগরা,
মাথায় পাগ্ড়ি দেবো, পায়েতে নাগ্রা।
কিম্বা সে যদি আজ বিলাতেই ছোটে
ইংরেজ হবে সবে বুট হ্যাট্ কোটে।
কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যেই
দেখি, কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই।।
ষ্টীমার আসিছে ঘাটে, প’ড়ে আসে বেলা,
পূজার ছুটির দল, লোকজন মেলা
এলো দূর দেশ হ’তে; বৎসরের পরে
ফিরে আসে যে-যাহার আপনার ঘরে।
জাহাজের ছাদে ভীড়; নানা লোকে নানা
মাদুরে কম্বলে লেপে পেতেচে বিছানা
ঠেসাঠেসি ক’রে। তারি মাঝে হরেরাম
মাথা নেড়ে বাজাইতেছে হারমোনিয়াম।
বোঝা আছে কত শত— বাক্স কত রূপ
টিন বেত চামড়ার, পুঁটুলির স্তূপ,
থলি ঝুলি ক্যাম্বিশের, ডালা ঝুড়ি ধামা
সব্জিতে ভরা। গায়ে রেশমের জামা,
কোমরে চাদর বাঁধা, চন্ডী অবিনাশ
কলিকাতা হ’তে আসে,বঙ্কু শ্যামদাস
অম্বিকা অক্ষয়; নূতন চীনের জুতো
করে মস্মস্, মেরে কুনুয়ের গুঁতা
ভিড় ঠেলে আগে চলে— হাতে বাঁধা ঘড়ি,
চোখেতে চশমা কারো, সরু এক ছড়ি
সবেগে দুলায়। ঘন ঘন ডাক ছাড়ে
ষ্টীমারের বাঁশি; কে পড়ে কাহার ঘাড়ে,
সবাই সবার আগে যেতে চায় চ’লে—
ঠেলাঠেলি, বকাবকি। শিশু মার কোলে
চীৎকারস্বরে কাঁদে। গড় গড় করে
নোঙর ডুবিল জলে; শিকলের ডোরে
জাহাজ পড়িল বাঁধা; সিঁড়ি গেল নেমে,
এঞ্জিনের ধকধকি সব গেল থেমে।
‘কুলি’ ‘কুলি’ ডাক পড়ে ডাঙা হ’তে মুটে
দুড়দাড় ক’রে এলো দলে দলে ছুটে।
তীরে বাজাইয়া হাঁড়ি গাহিছে ভজন
অন্ধ বেণী। যাত্রীদের আত্মীয় স্বজন।
অপেক্ষা করিয়া আছে; নাম ধ’রে ডাকে,
খুঁজে খুঁজে বের করে যে চায় যাহাকে।
চলিল গোরুর গাড়ি, চলে পালকী ডুলি,
শ্যাক্রা-গাড়ির ঘোড়া উড়াইল ধূলি।
সূর্য গেল অস্তাচলে; আঁধার ঘনালো;
হেথা হোথা কেরোসিন লন্ঠনের আলো
দুলিতে দুলিতে যায়, তার পিছে পিছে
মাথায় বোঝাই নিয়ে মুটেরা চলিছে।
শূন্য হয়ে গেল তীর। আকাশের কোণে
পঞ্চমীর চাঁদ ওঠে। দূরে বাঁশবনে
শেয়াল উঠিল ডেকে। মুদির দোকানে
টিম্ টিম্ ক’রে দীপ জ্বলে একখানে।।
অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল-ধরা— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর,
আছে এক ল্যাজ-কাটা ভক্ত কুকুর।
আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধ’রে
গুন্ গুন্ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে।
গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন
দু-মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন।
সাতকড়ি ভঞ্জের মস্ত দালান,
কুঞ্জ সেখানে করে প্রত্যূষে গান।
“হরি হরি” রব উঠে অঙ্গনমাঝে,
ঝনঝনি ঝনঝনি খঞ্জনী বাজে।
ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান,
কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান।
চিঁড়ে মুড়কিতে তার ভরি দেন ঝুলি,
পৌষে খাওয়ান ডেকে মিঠে পিঠে-পুলি।
আশ্বিনে হাট বসে ভারী ধূম ক’রে,
মহাজনী নৌকায় ঘাট যায় ভ’রে—
হাঁকাহাঁকি ঠেলাঠেলি মহা সোরগোল,
পশ্চিমী মাল্লারা বাজায় মাদোল।
বোঝা নিয়ে মন্থর চলে গোরুগাড়ি,
চাকাগুলো ক্রন্দন করে ডাক ছাড়ি।
কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি
অন্ধের কন্ঠের গান আগমনী।
সেই গান মিলে যায় দূর হতে দূরে
শরতের আকাশেতে সোনা রোদ্দুরে।।
আরো দেখুন