চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি
Others
নিজের প্রাণের মধ্যে, পরের প্রাণের মধ্যে ও প্রকৃতির প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিবার ক্ষমতাকেই বলে কবিত্ব। যাহারা প্রকৃতির বহির্দ্বারে বসিয়া কবি হইতে যায় তাহারা কতকগুলা বড় বড় কথা, টানাবোনা তুলনা ও কাল্পনিক ভাব লইয়া ছন্দ নির্ম্মাণ করে। মর্ম্মের মধ্যে প্রবেশ করিবার জন্য যে কল্পনা আবশ্যক করে তাহাই কবির কল্পনা; আর গোঁজামিলন দিবার কল্পনা -- না পড়িয়া পণ্ডিত হইবার-- না অনুভব করিয়া কবি হইবার এক প্রকার গিল্টি-করা কল্পনা আছে, তাহা জালিয়াতের কল্পনা। যিনি প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কবি হইয়াছেন তিনি সহজ কথার কবি, সহজ ভাবের কবি। কারণ, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তাহাকে দশ কথা বলিতে হয়, আর যিনি সত্য বলেন তাঁহাকে এক কথার বেশী বলিতে হয় না। তেমনি যিনি অনুভব করিয়া বলেন তিনি দুটি কথা বলেন, আর যে অনুভব না করিয়া বলে সে পাঁচ কথা বলে অথচ ভাব প্রকাশ করিতে পারে না। অতএব সহজ ভাষার, সহজ ভাবের, সহজ কবিতা লেখাই শক্ত, কারণ তাহাতে প্রাণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিতে হয়। সকলের প্রাণের মধ্যেই যে ব্যক্তি আতিথ্য পায়-- ফুল বলো, মেঘ বলো, দুঃখী বলো, সুখী বলো, সকলের প্রাণের মধ্যেই যাহার আসন আছে, সেই তাহা পারে। আর বড় বড় কথার মোটা মোটা ভাবের কবিতা লেখা সহজ, কারণ প্রাণের মধ্যে প্রবেশ না করিয়াও তাহা পারা যায়। বড় বড় কবির কবিতা অনেকের পক্ষে কুহেলিকাময়ী কেন? কারণ, তাঁহারা যাহা অনুভব করিয়াছেন অধিক বকিয়া যে তাহা সহজ করিতে হইবে ইহা তাঁহাদের মনেও হয় না। এবং তাঁহারা যাহা অনুভব করিয়াছেন তাহা সকলে অনুভব করে নাই; কাজেই সকলের কাছে তাঁহাদের সে সহজ কথা নিতান্ত শক্ত হইয়া পড়ে। সহজ কথা লিখিয়াছেন বলিয়াই শক্ত। সহজ কথার গুণ এই যে, তাহা যতটুকু বলে তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক বলে। সে সমস্তটা বলে না। পাঠকদিগকে কবি হইবার পথ দেখাইয়া দেয় -- যে দিকে কল্পনা ছুটাইতে হইবে সেই দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া দেয় মাত্র, আর অধিক কিছু করে না। নিজে যাহা আবিষ্কার করিয়াছে, পাঠকদিগকেও তাহাই আবিষ্কার করাইয়া দেয়। যাহাদের কল্পনা কম, যাহাদের চোখে আঙুল দিয়া দেখাইতে হয়, তাহারা এরূপ কবিতার পাঠক নহে।
আমাদের চণ্ডিদাস সহজ ভাষার সহজ ভাবের কবি, এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি। তিনি যে সকল কবিতা লেখেন নাই তাহারই জন্য কবি। তিনি এক ছত্র লেখেন ও দশ ছত্র পাঠকদের দিয়া লিখাইয়া লন। দুই-একটি সামান্য দৃষ্টান্ত দিলেই আমাদের কথা পরিস্ফুট হইবে। --
এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা,
কেমনে আইল বাটে?
আঙ্গিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়া,
দেখিয়া পরাণ ফাটে।
সই, কি আর বলিব তোরে,
বহু পুণ্যফলে সে-হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোরে।
ঘরে গুরুজন, ননদী দারুণ,
বিলম্বে বাহির হৈনু--
আহা মরি মরি, সঙ্কেত করিয়া
কত-না যাতনা দিনু।
বঁধুর পিরীতি আরতি দেখিয়া
মোর মনে হেন করে
কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া
আনল ভেজাই ঘরে!
এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা,
কেমনে আইল বাটে?
আঙ্গিনার কোণে তিতিছে বঁধুয়া
দেখিয়া পরাণ ফাটে!
সই, কি আর বলিব তোরে,
বহু পুণ্যফলে সে-হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলল মোরে!
সই, কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
আমার অন্তর যেমন করিছে
যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয়,
সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি
আর জানি কার হয়!
যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙ্গাইয়া
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!
সুখ দুখ দুটি ভাই?
সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি,
দুখ যায় তার ঠাঁই।'
সই, পিরীতি না জানে যারা,
এ তিন ভুবনে জনমে জনমে
কি সুখ জানয়ে তারা?
বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
ঘুচিত সকল দুখ।
চণ্ডিদাস কয়, এমতি হইলে
পিরীতির কিবা সুখ!
দারুণ ঋতুপতি যত দুখ দেল,
হরিমুখ হেরইতে সব দূর গেল।
যতহুঁ আছিল মঝু হৃদয়ক সাধ
সো সব পূরল পিয়া-পরসাদ।
রভস-আলিঙ্গনে পুলকিত ভেল,
অধরহি পান বিরহ দূর গেল।
চিরদিনে বিহি আজু পূরল আশ,
হেরইতে নয়ানে নাহি অবকাশ।
ভনহ বিদ্যাপতি আর নহ আধি,
সমুচিত ঔখদে না রহে বেয়াধি।
এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে,
না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি ছুটে।
গড়ন ভাঙ্গিতে, সই, আছে কত খল --
ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় বিরল।
যথা তথা যাই আমি যত দূর পাই,
চাঁদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে জুড়াই।
সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়!
চণ্ডিদাস কহে, রাই, ভাবিছ অনেক --
তোমার পিরীতি বিনে সে জীয়ে তিলেক।
সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।
কি মোহিনী জান বঁধু, কি মোহিনী জান!
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন!
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি --
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি!
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর--
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।
কোন্ বিধি সিরজিল সোতের সেঁওলি,
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।
তোমারে বুঝাই বঁধু, তোমারে বুঝাই,
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন কেহ নাই।
তোমারে বুঝাই বঁধু, তোমারে বুঝাই,
ডাকিয়া শুধায় মোরে হেন কেহ নাই।
অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে,
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।
এ ছার পরাণে আর কিবা আছে সুখ?
মোর আগে দাঁড়াও, তোমার দেখিব চাঁদ মুখ।
খাইতে সোয়াস্তি নাই, নাহি টুটে ভুক --
কে মোর ব্যথিত আছে, কারে কব দুখ!
অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে,
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।
যেন মলয়জ ঘষিতে শীতল,
অধিক সৌরভময়,
শ্যাম বঁধুয়ার পিরীতি ঐছন,
দ্বিজ চণ্ডিদাস কয়।
পিরীতি পিরীতি সব জন কহে,
পিরীতি সহজ কথা?
বিরিখের ফল নহে ত পিরীতি,
নাহি মিলে যথা তথা।
পিরীতি অন্তরে, পিরীতি মন্তরে,
পিরীতি সাধিল যে
পিরীতি রতন লভিল সে জন--
বড় ভাগ্যবান সে।
পিরীতি লাগিয়া আপনা ভুলিয়া
পরেতে মিশিতে পারে,
পরকে আপন করিতে পারিলে
পিরীতি মিলয়ে তারে।
পিরীতি-সাধন বড়ই কঠিন
কহে দ্বিজ চণ্ডিদাস,
দুই ঘুচাইয়া এক অঙ্গ হও
থাকিলে পিরীতি-আশ।
পিরীতি পিরীতি কি রীতি মূরতি
হৃদয়ে লাগল সে --
পরাণ ছাড়িলে পিরীতি না ছাড়ে,
পিরীতি গড়ল কে?
পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর
না জানি আছিল কোথা!
পিরীতি কণ্টক হিয়ায় ফুটল,
পরাণপুতলী যথা।
পিরীতি পিরীতি পিরীতি অনল
দ্বিগুণ জ্বলিয়া গেল!
বিষম অনল নিবাইলে নহে,
হিয়ার রহল শেল!
চণ্ডিদাস-বাণী শুন বিনোদিনি,
পিরীতি না কহে কথা--
পিরীতি লাগিয়ে পরাণ ছাড়িলে
পিরীতি মিলয়ে তথা!
পিরীতি বলিয়া এ তিন আখর,
এ তিন ভুবন- সার।
এই মোর মনে হয় রাতি দিনে
ইহা বই নাহি আর!
পরাণ-সমান পিরীতি রতন
জুকিনু হৃদয়-তুলে --
পিরীতি রতন অধিক হইল,
পরাণ উঠিল চূলে।
নিত্যই নূতন পিরীতি দুজন,
তিলে তিলে বাঢ়ি যায়।
ঠাঞি নাহি পায় তথাপি বাড়ায়,
পরিণামে নাহি খায়!
ইহার আর পরিণাম নাই।
সখি রে, কি পুছসি অনুভব মোয়!
সোই পিরীতি অনুরাগ বাখানিতে
তিলে তিলে নূতন হোয়।
জনম অবধি হম রূপ নেহারনু
নয়ন না তিরপিত ভেল
সোই মধুর বোল শ্রবণ হি শুননু
শ্রুতিপথে পরশ না গেল।
কত মধু-যামিনী রভসে গোয়ায়নু
না বুঝনু কৈছন কেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু
তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।
যত যত রসিকজন রস-অনুগমন --
অনুভব কহে, না পেখে!
বিদ্যাপতি কহে প্রাণ জুড়াইতে
লাখে না মিলল একে।
শুন রজকিনী রামি
ও দুটি চরণ শীতল জানিয়া
শরণ লইনু আমি।
তুমি বেদ-বাগিনী, হরের ঘরণী,
তুমি সে নয়নের তারা,
তোমার ভজনে ত্রিসন্ধ্যা-যাজনে,
তুমি সে গলার হারা।
রজকিনীরূপ কিশোরীস্বরূপ
কামগন্ধ নাহি তায়,
রজকিনী-প্রেম নিকষিত হেম
বড়ু চণ্ডিদাসে গায়।
রজনী দিবসে হব পরবশে,
স্বপনে রাখিব লেহা--
একত্র থাকিব নাহি পরশিব
ভাবিনী ভাবের দেহা।
পিরীতিনগরে বসতি করিব,
পিরীতে বাঁধিব ঘর।
পিরীতি দেখিয়া পড়শি করিব,
তা বিনু সকলি পর।
আরো দেখুন