বিজ্ঞতা
Others
সৎকর্ম্ম-অনুষ্ঠানের অনেক বাধা আছে, কিন্তু সকলের চেয়ে বোধ করি একটি গুরু-তর বাধা আছে! যখন বড় বড় বিজ্ঞগণ ঠোঁট টিপিয়া, চোখে চশমা আঁটিয়া, শিশু অনুষ্ঠানটিকে ঘিরিয়া বসেন-- সোজা সোজা কাজের মধ্য হইতে বাঁকা বাঁকা উদ্দেশ্য বাহির করিতে থাকেন ও পরস্পর চোখ-টেপাটিপি করিয়া বলিতে থাকেন "ওহে , বুঝেছ এ সমস্ত কেন? " তখন বোধ করি উৎসাহের রক্ত জল হইয়া যায়, উদ্যমের হাত পা শিথিল হইয়া পড়ে। এই-সকল তীক্ষ্ণনাসিকা ক্ষুরোজ্জ্বলচক্ষু ধারাল ' -পেঁচাল '- বুদ্ধি-গণ তিল হইতে তাল, সামান্য হইতে অসামান্য, সৎ হইতে অসৎ আবিষ্কার করিয়া সদনুষ্ঠানের প্রাণে বাঁকা কটাক্ষপাত করিয়া তাহার চোখ দিয়া জল তাহার বুক দিয়া রক্ত বাহির করিয়া দেন। সর্পজাতি বোধ করি বড় বুদ্ধিমান হইবে, নহিলে তাহারা বাঁকিয়া চলে কেন? হে বিজ্ঞগণ, তোমরাও খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু একটা বিষয় তোমাদের জানা নাই -- পৃথিবীতে সিধা জিনিষও অনেক আছে। তোমাদের প্রাণের বাঁকা আর্শিতে যে একটা বাঁকা ছায়া দেখিতেছ, জগতের চেহারাখানা নিতান্তই অমনতর না। হায় হায়! জন্মেজয় যখন সর্পসত্র করিয়াছিলেন তখন কি গোটাকতক ঢোঁড়া সাপই মরিয়াছিল, তোমাদের মত বিষাক্ত বুদ্ধিমান সাপগুলা ছিল কোথায়?
তুমি সৎকার্য্য করিতেছ বলিয়া বিজ্ঞ লোকেরাও যে তাহাকে সৎ মনে করিবে, এ কি করিয়া আশা করা যায়? তাহা হইলে বিধাতা তাহাদিগকে বিজ্ঞ করিয়াই গড়িলেন কেন? বসন্ত আসিয়াছে বলিয়া কি কাক মিঠা ডাকিবে? তাহা হইলে বিধাতা তাহাকে কাক করিলেন কেন? সে যে বুদ্ধিমান পক্ষী! যখন কোকিল ডাকিতে থাকে, ফুল ফুটিয়া উঠে, বাতাস প্রাণ খুলিয়া দেয়, তখন সে শাখায় বসিয়া বুদ্ধিপূর্ণ ক্ষুদ্র চক্ষু মিটমিট করিতে থাকে, অবিশ্বাসের সহিত চারি দিকে চাহিয়া দেখে ও বেসুরে ডাকিয়া উঠে কা। বসন্তের সহিত তাহার সুর মেলে না বলিয়া সে কি চুপ করিয়া থাকিবে? সে যে বুদ্ধিমান জীব! সে বলে, বসন্তের সুর বেসুরা বলিতেছে! যখন কোকিল ডাকে অমনি সে ঘাড় নাড়িয়া বলে কা-- যখন ফুল ফুটে অমনি সে ঘাড় নাড়িয়া বলে কা-- অর্থাৎ কিছুতেই সে সায় দিতে পারে না; সে বলে যে, আগাগোড়া সুর মিলিতেছে না! শুনা গেছে, মনুষ্যলোকে এমন অঙ্গহীন দেখা যায় যাহার একটা কান নাই, এমন-কি দুইটা কানই খরচ হইয়া গেছে। হে কাক, স্বভাবতই-- জন্মাবধিই তোমার কানের অভাব-- অতএব কে তোমার কান ধরিয়া শিখাইবে যে তোমার গলাটাই বেসুরা! কিন্তু তবুও ফুল ফোটে কেন, তবুও কোকিল ডাকে কেন? বসন্তের প্রাণের মধ্যে বসিয়া কে এমন একটা তানপুরা বাজাইতেছে, যাহাতে এত বেসুরের মধ্যেও সে অমন সুর ঠিক রাখিতেছে! কিন্তু সুর কি ঠিক থাকে? সাধ কি যায় না গান বন্ধ করি? ক'জনের প্রাণ এমন আছে যাহারা বেতালা বেসুরা সঙ্গতের সহিত- অর্থাৎ অসঙ্গত সঙ্গতের সহিত গান গাহিয়া উঠিতে পারে? কোকিলও তাহা পারে না; যখন বর্ষার সময় ভেকগুলা অসম্ভব ফুলিয়া উঠিয়া জগৎ-সংসারে ভাঙ্গা গলায় নিজের মত জারি করিতে থাকে, তখন কোকিল চুপ করিয়া যায়। আচ্ছা, স্বীকার করিলাম-- হে ভেকগণ, তোমাদেরই জয়। তোমরা আরো ফুলিতে থাক, আরো লম্ফ দাও, আরো মক্ মক্ কর! তোমরা কর্কশ কণ্ঠ লইয়া জগতের গান বন্ধ করিতে পারিয়াছ, অতএব তোমরাই জিতিলে!
আরো দেখুন