বনফুল
Others
কাব্যোপন্যাস
"অনাঘ্রাতং পুষ্পং কিসলয়মলূনং কররুহৈঃ"
চাই না জ্ঞেয়ান, চাই না জানিতে
সংসার, মানুষ কাহারে বলে।
বনের কুসুম ফুটিতাম বনে
শুকায়ে যেতাম বনের কোলে!
--
দীপ নির্ব্বাণ
নিশার আঁধার রাশি করিয়া নিরাস
রজতসুষমাময়, প্রদীপ্ত তুষারচয়
হিমাদ্রি-শিখর-দেশে পাইছে প্রকাশ
অসংখ্য শিখরমালা বিশাল মহান্;
ঝর্ঝরে নির্ঝর ছুটে, শৃঙ্গ হ'তে শৃঙ্গ উঠে
দিগন্তসীমায় গিয়া যেন অবসান!
শিরোপরি চন্দ্র সূর্য্য, পদে লুটে পৃথ্বীরাজ্য
মস্তকে স্বর্গের ভার করিছে বহন;
তুষারে আবরি শির ছেলেখেলা পৃথিবীর
ভুরুক্ষেপে যেন সব করিছে লোকন।
কত নদী কত নদ, কত নির্ঝরিণী হ্রদ
পদতলে পড়ি তার করে আস্ফালন!
মানুষ বিস্ময়ে ভয়ে দেখে রয় স্তব্ধ হয়ে,
অবাক্ হইয়া যায় সীমাবদ্ধ মন!
...
চৌদিকে পৃথিবী ধরা নিদ্রায় মগন,
তীব্র শীতসমীরণে দুলায়ে পাদপগণে
বহিছে নির্ঝরবারি করিয়া চুম্বন,
হিমাদ্রিশিখরশৈল করি আবরিত
গভীর জলদরাশি তুষার বিভায় নাশি
স্থির ভাবে হেথা সেথা রহেছে নিদ্রিত।
পর্ব্বতের পদতলে ধীরে ধীরে নদী চলে
উপলরাশির বাধা করি অপগত,
নদীর তরঙ্গকুল সিক্ত করি বৃক্ষমূল
নাচিছে পাষাণতট করিয়া প্রহত!
চারি দিকে কত শত কলকলে অবিরত
পড়ে উপত্যকা-মাঝে নির্ঝরের ধারা।
আজি নিশীথিনী কাঁদে আঁধারে হারায়ে চাঁদে
মেঘ-ঘোমটায় ঢাকি কবরীর তারা।
...
কল্পনে! কুটীর কার তটিনীর তীরে
তরুপত্র-ছায়ে-ছায়ে পাদপের গায়ে গায়ে
ডুবায়ে চরণদেশ স্রোতস্বিনীনীরে?
চৌদিকে মানববাস নাহিক কোথায়,
নাহি জনকোলাহল গভীর বিজনস্থল
শান্তির ছায়ায় যেন নীরবে ঘুমায়!
কুসুমভূষিত বেশে কুটীরের শিরোদেশে
শোভিছে লতিকামালা প্রসারিয়া কর,
কুসুমস্তবকরাশি দুয়ার-উপরে আসি
উঁকি মারিতেছে যেন কুটীরভিতর!
কুটীরের এক পাশে শাখাদীপ ধূমশ্বাসে
স্তিমিত আলোকশিখা করিছে বিস্তার।
অস্পষ্ট আলোক, তায় আঁধার মিশিয়া যায়--
ম্লান ভাব ধরিয়াছে গৃহ-ঘর-দ্বার!
গভীর নীরব ঘর, শিহরে যে কলেবর!
হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধ হয়ে বয়--
বিষাদের অন্ধকারে গভীর শোকের ভারে
গভীর নীরব গৃহ অন্ধকারময়!
কে ওগো নবীনা বালা উজলি পরণশালা
বসিয়া মলিনভাবে তৃণের আসনে?
কোলে তার সঁপি শির কে শুয়ে হইয়া স্থির
থেক্যে থেক্যে দীর্ঘশ্বাস টানিয়া সঘনে--
সুদীর্ঘ ধবল কেশ ব্যাপিয়া কপোলদেশ,
শ্বেতশ্মশ্রু ঢাকিয়াছে বক্ষের বসন--
অবশ জ্ঞেয়ানহারা, স্তিমিত লোচনতারা,
পলক নাহিক পড়ে নিস্পন্দ নয়ন!
বালিকা মলিনমুখে বিশীর্ণা বিষাদদুখে,
শোকে ভয়ে অবশ সে সুকোমল-হিয়া।
আনত করিয়া শির বালিকা হইয়া স্থির
পিতার-বদন-পানে রয়েছে চাহিয়া।
এলোথেলো বেশবাস, এলোথেলো কেশপাশ
অবিচল আঁখিপার্শ্ব করেছে আবৃত!
নয়নপলক স্থির, হৃদয় পরাণ ধীর,
শিরায় শিরায় রহে স্তবধ শোণিত।
হৃদয়ে নাহিক জ্ঞান, পরাণে নাহিক প্রাণ,
চিন্তার নাহিক রেখা হৃদয়ের পটে!
নয়নে কিছু না দেখে, শ্রবণে স্বর না ঠেকে,
শোকের উচ্ছ্বাস নাহি লাগে চিত্ততটে!
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলি, সুধীরে নয়ন মেলি
ক্রমে ক্রমে পিতা তাঁর পাইলেন জ্ঞান!
সহসা সভয়প্রাণে দেখি চারিদিক পানে
আবার ফেলিল শ্বাস ব্যাকুলপরাণ --
কি যেন হারায়ে গেছে, কি যেন আছে না আছে,
শোকে ভয়ে ধীরে ধীরে মুদিল নয়ন--
সভয়ে অস্ফুট স্বরে সরিল বচন,
"কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী!"
চমকি উঠিল যেন নীরব রজনী!
চমকি উঠিল যেন নীরব অবনী!
ঊর্ম্মিহীন নদী যথা ঘুমায় নীরবে--
সহসা করণক্ষেপে সহসা উঠে রে কেঁপে,
সহসা জাগিয়া উঠে চলঊর্ম্মি সবে!
কমলার চিত্তবাপী সহসা উঠিল কাঁপি
পরাণে পরাণ এলো হৃদয়ে হৃদয়!
স্তবধ শোণিতরাশি আস্ফালিল হৃদে আসি,
আবার হইল চিন্তা হৃদয়ে উদয়!
শোকের আঘাত লাগি পরাণ উঠিল জাগি,
আবার সকল কথা হইল স্মরণ!
বিষাদে ব্যাকুল হৃদে নয়নযুগল মুদে
আছেন জনক তাঁর, হেরিল নয়ন।
স্থির নয়নের পাতে পড়িল পলক,
শুনিল কাতর স্বরে ডাকিছে জনক,
"কোথা মা কমলা মোর কোথা মা জননী!"
বিষাদে ষোড়শী বালা চমকি অমনি
(নেত্রে অশ্রুধারা ঝরে) কহিল কাতর স্বরে
পিতার নয়ন-'পরে রাখিয়া নয়ন,
"কেন পিতা! কেন পিতা! এই-যে রয়েছি হেতা"--
বিষাদে নাহিক আর সরিল বচন!
বিষাদে মেলিয়া আঁখি বালার বদনে রাখি
এক দৃষ্টে স্থিরনেত্রে রহিল চাহিয়া!
নেত্রপ্রান্তে দরদরে, শোক-অশ্রুবারি ঝরে,
বিষাদে সন্তাপে শোকে আলোড়িত হিয়া!
গভীরনিশ্বাসক্ষেপে হৃদয় উঠিল কেঁপে,
ফাটিয়া বা যায় যেন শোণিত-আধার!
ওষ্ঠপ্রান্ত থরথরে কাঁপিছে বিষাদভরে
নয়নপলক-পত্র কাঁপে বার বার--
শোকের স্নেহের অশ্রু করিয়া মোচন
কমলার পানে চাহি কহিল তখন,
"আজি রজনীতে মা গো! পৃথিবীর কাছে
বিদায় মাগিতে হবে, এই শেষ দেখা ভবে!
জানি না তোমার শেষে অদৃষ্টে কি আছে--
পৃথিবীর ভালবাসা পৃথিবীর সুখ আশা,
পৃথিবীর স্নেহ প্রেম ভক্তি সমুদায়,
দিনকর নিশাকর গ্রহ তারা চরাচর,
সকলের কাছে আজি লইব বিদায়!
গিরিরাজ হিমালয়! ধবল তুষারচয়!
অয়ি গো কাঞ্চনশৃঙ্গ মেঘ-আবরণ!
অয়ি নির্ঝরিণীমালা! স্রোতস্বিনী শৈলবালা!
অয়ি উপত্যকে! অয়ি হিমশৈলবন!
আজি তোমাদের কাছে মুমূর্ষু বিদায় যাচে,
আজি তোমাদের কাছে অন্তিম বিদায়।
কুটীর পরণশালা সহিয়া বিষাদজ্বালা
আশ্রয় লইয়াছিনু যাহার ছায়ায়--
স্তিমিত দীপের প্রায় এত দিন যেথা হায়
অন্তিম জীবনরশ্মি করেছি ক্ষেপণ,
আজিকে তোমার কাছে মুমূর্ষু বিদায় যাচে,
তোমারি কোলের পরে সঁপিব জীবন!
নেত্রে অশ্রুবারি ঝরে, নহে তোমাদের তরে,
তোমাদের তরে চিত্ত ফেলিছে না শ্বাস--
আজি জীবনের ব্রত উদ্যাপন করিব ত,
বাতাসে মিশাবে আজি অন্তিম নিশ্বাস!
কাঁদি না তাহার তরে, হৃদয় শোকের ভরে
হতেছে না উৎপীড়িত তাহারো কারণ।
আহা হা! দুখিনী বালা সহিবে বিষাদজ্বালা
আজিকার নিশিভোর হইবে যখন?
কালি প্রাতে একাকিনী অসহায়া অনাথিনী
সংসারসমুদ্র-মাঝে ঝাঁপ দিতে হবে!
সংসারযাতনাজ্বালা কিছু না জানিস্, বালা,
আজিও!-- আজিও তুই চিনিস নে ভবে!
ভাবিতে হৃদয় জ্বলে,-- মানুষ কারে যে বলে
জানিস্ নে কারে বলে মানুষের মন।
কার দ্বারে কাল প্রাতে দাঁড়াইবি শূন্যহাতে,
কালিকে কাহার দ্বারে করিবি রোদন!
অভাগা পিতার তোর-- জীবনের নিশা ভোর--
বিষাদ নিশার শেষে উঠিবেক রবি
আজ রাত্রি ভোর হলে! কারে আর পিতা বলে
ডাকিবি, কাহার কোলে হাসিবি খেলিবি?
জীবধাত্রী বসুন্ধরে! তোমার কোলের 'পরে
অনাথা বালিকা মোর করিনু অর্পণ!
দিনকর! নিশাকর! আহা এ বালার 'পর
তোমাদের স্নেহদৃষ্টি করিও বর্ষণ!
শুন সব দিক্বালা! বালিকা না পায় জ্বালা
তোমরা জননীস্নেহে করিও পালন!
শৈলবালা! বিশ্বমাতা! জগতের স্রষ্টা পাতা!
শত শত নেত্রবারি সঁপি পদতলে--
বালিকা অনাথা বোলে স্থান দিও তব কোলে,
আবৃত করিও এরে স্নেহের আঁচলে!
মুছ মা গো অশ্রুজল! আর কি কহিব বলো!
অভাগা পিতারে ভোলো জন্মের মতন!
আটকি আসিছে স্বর!-- অবসন্ন কলেবর।
ক্রমশঃ মুদিয়া, মা গো, আসিছে নয়ন!
মুষ্টিবদ্ধ করতল, শোণিত হইছে জল,
শরীর হইয়া আসে শীতল পাষাণ!
এই-- এই শেষবার-- কুটিরের চারি ধার
দেখে লই! দেখে লই মেলিয়া নয়ান!
শেষবার নেত্র ভোরে এই দেখে লই তোরে
চিরকাল তরে আঁখি হইবে মুদ্রিত!
সুখে থেকো চিরকাল!-- সুখে থেকো চিরকাল!
শান্তির কোলেতে বালা থাকিও নিদ্রিত!"
স্তবধ হৃদয়োচ্ছ্বাস! স্তবধ হইল শ্বাস!
স্তবধ লোচনতারা! স্তবধ শরীর!
বিষম শোকের জ্বালা-- মুর্চ্ছিয়া পড়িল বালা,
কোলের উপরে আছে জনকের শির!
গাইল নির্ঝরবারি বিষাদের গান,
শাখার প্রদীপ ধীরে হইল নির্ব্বাণ!
যেও না! যেও না!
দুয়ারে আঘাত করে কে ও পান্থবর?
"কে ওগো কুটিরবাসি! দ্বার খুলে দাও আসি!"
তবুও কেন রে কেউ দেয় না উত্তর?
আবার পথিকবর আঘাতিল ধীরে!
"বিপন্ন পথিক আমি, কে আছে কুটিরে?"
তবুও উত্তর নাই, নীরব সকল ঠাঁই--
তটিনী বহিয়া যায় আপনার মনে!
পাদপ আপন মনে প্রভাতের সমীরণে
দুলিছে, গাইছে গান সরসর স্বনে!
সমীরে কুটীরশিরে লতা দুলে ধীরে ধীরে
বিতরিয়া চারি দিকে পুষ্পপরিমল!
আবার পথিকবর আঘাতে দুয়ার-'পর--
ধীরে ধীরে খুলে গেল শিথিল অর্গল।
বিস্ফারিয়া নেত্রদ্বয় পথিক অবাক্ রয়,
বিস্ময়ে দাঁড়ায়ে আছে ছবির মতন।
কেন পান্থ, কেন পান্থ, মৃগ যেন দিক্ভ্রান্ত
অথবা দরিদ্র যেন হেরিয়া রতন!
কেন গো কাহার পানে দেখিছ বিস্মিত প্রাণে--
অতিশয় ধীরে ধীরে পড়িছে নিশ্বাস?
দারুণ শীতের কালে ঘর্ম্মবিন্দু ঝরে ভালে,
তুষারে করিয়া দৃঢ় বহিছে বাতাস!
ক্রমে ক্রমে হয়ে শান্ত সুধীরে এগোয় পান্থ,
থর থর করি কাঁপে যুগল চরণ--
ধীরে ধীরে তার পরে সভয়ে সঙ্কোচভরে
পথিক অনুচ্চ স্বরে করে সম্বোধন--
"সুন্দরি! সুন্দরি!" হায়। উত্তর নাহিক পায়!
আবার ডাকিল ধীরে "সুন্দরি! সুন্দরি!"
শব্দ চারি দিকে ছুটে, প্রতিধ্বনি জাগি উঠে,
কুটীর গম্ভীরে কহে "সুন্দরি! সুন্দরি!"
তবুও উত্তর নাই, নীরব সকল ঠাঁই,
এখনো পৃথিবী ধরা নীরবে ঘুমায়!
নীরব পরণশালা, নীরব ষোড়শী বালা,
নীরবে সুধীর বায়ু লতারে দুলায়!
পথিক চমকি প্রাণে দেখিল চৌদিক-পানে--
কুটীরে ডাকিছে কেও "কমলা! কমলা!"
অবাক্ হইয়া রহে, অস্ফুটে কে ওগো কহে?
সুমধুর স্বরে যেন বালকের গলা!
পথিক পাইয়া ভয়, চমকি দাঁড়ায়ে রয়,
কুটীরের চারি ভাগে নাই কোনজন!
এখনো অস্ফুটস্বরে "কমলা! কমলা!' ক'রে
কুটীর আপনি যেন করে সম্ভাষণ!
কে জানে কাহাকে ডাকে, কে জানে কেন বা ডাকে,
কেমনে বলিব কেবা ডাকিছে কোথায়?
সহসা পথিকবর দেখে দণ্ডে করি ভর
"কমলা! কমলা!' বলি শুক গান গায়!
আবার পথিকবর হন ধীরে অগ্রসর,
"সুন্দরি! সুন্দরি!' বলি ডাকিয়া আবার!
আবার পথিক হায় উত্তর নাহিক পায়,
বসিল ঊরুর 'পরে সঁপি দেহভার!
সঙ্কোচ করিয়া কিছু পান্থবর আগুপিছু
একটু একটু ক'রে হন অগ্রসর!
আনমিত করি শিরে পথিকটি ধীরে ধীরে
বালার নাসার কাছে সঁপিলেন কর!
হস্ত কাঁপে থরথরে, বুক ধুক্ ধুক্ করে,
পড়িল অবশ বাহু কপোলের 'পর--
লোমাঞ্চিত কলেবরে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম্ম ঝরে,
কে জানে পথিক কেন টানি লয় কর!
আবার কেন কি জানি বালিকার হস্তখানি
লইলেন আপনার করতল-'পরি--
তবুও বালিকা হায় চেতনা নাহিক পায়--
অচেতনে শোক জ্বালা রয়েছে পাশরি!
রুক্ষ রুক্ষ কেশরাশি বুকের উপরে আসি
থেকে থেকে কাঁপি উঠে নিশ্বাসের ভরে!
বাঁহাত আঁচল-'পরে অবশ রয়েছে পড়ে
এলো কেশরাশি মাঝে সঁপি ডান করে।
ছাড়ি বালিকার কর ত্রস্ত উঠে পান্থবর
দ্রুতগতি চলিলেন তটিনীর ধারে,
নদীর শীতল নীরে ভিজায়ে বসন ধীরে
ফিরি আইলেন পুনঃ কুটীরের দ্বারে।
বালিকার মুখে চোখে শীতল সলিল-সেকে
সুধীরে বালিকা পুনঃ মেলিল নয়ন।
মুদিতা নলিনীকলি মরমহুতাশে জ্বলি
মূরছি সলিলকোলে পড়িল যেমন--
সদয়া নিশির মন হিম সেঁচি সারাক্ষণ
প্রভাতে ফিরায়ে তারে দেয় গো চেতন।
মেলিয়া নয়নপুটে বালিকা চমকি উঠে
একদৃষ্টে পথিকেরে করে নিরীক্ষণ।
পিতা মাতা ছাড়া কারে মানুষে দেখে নি হা রে,
বিস্ময়ে পথিকে তাই করিছে লোকন!
আঁচল গিয়াছে খ'সে, অবাক্ রয়েছে ব'সে
বিস্ফারি পথিক-পানে যুগল নয়ন!
দেখেছে কভু কেহ কি এহেন মধুর আঁখি?
স্বর্গের কোমল জ্যোতি খেলিছে নয়নে--
মধুর-স্বপনে-মাখা সারল্য-প্রতিমা-আঁকা
"কে তুমি গো?' জিজ্ঞাসিছে যেন প্রতিক্ষণে।
পৃথিবী-ছাড়া এ আঁখি স্বর্গের আড়ালে থাকি
পৃথ্বীরে জিজ্ঞাসে "কে তুমি? কে তুমি'?
মধুর মোহের ভুল, এ মুখের নাই তুল--
স্বর্গের বাতাস বহে এ মুখটি চুমি!
পথিকের হৃদে আসি নাচিছে শোণিত রাশি,
অবাক্ হইয়া বসি রয়েছে সেথায়!
চমকি ক্ষণেক-পরে কহিল সুধীর স্বরে
বিমোহিত পান্থবর কমলাবালায়,
"সুন্দরি, আমি গো পান্থ দিক্ভ্রান্ত পথশ্রান্ত
উপস্থিত হইয়াছি বিজন কাননে!
কাল হতে ঘুরি ঘুরি শেষে এ কুটীরপুরী
আজিকার নিশিশেষে পড়িল নয়নে!
বালিকা! কি কব আর, আশ্রয় তোমার দ্বার
পান্থ পথহারা আমি করি গো প্রার্থনা।
জিজ্ঞাসা করি গো শেষে মৃতে লয়ে ক্রোড়দেশে
কে তুমি কুটীরমাঝে বসি সুধাননা?"
পাগলিনীপ্রায় বালা হৃদয়ে পাইয়া জ্বালা
চমকিয়া বসে যেন জাগিয়া স্বপনে।
পিতার বদন-'পরে নয়ন নিবিষ্ট ক'রে
স্থির হ'য়ে বসি রয় ব্যাকুলিত মনে।
নয়নে সলিল ঝরে, বালিকা সমুচ্চ স্বরে
বিষাদে ব্যাকুলহৃদে কহে "পিতা-- পিতা"।
কে দিবে উত্তর তোর, প্রতিধ্বনি শোকে ভোর
রোদন করিছে সেও বিষাদে তাপিতা।
ধরিয়া পিতার গলে আবার বালিকা বলে
উচ্চৈস্বরে "পিতা-- পিতা", উত্তর না পায়!
তরুণী পিতার বুকে বাহুতে ঢাকিয়া মুখে,
অবিরল নেত্রজলে বক্ষ ভাসি যায়।
শোকানলে জল ঢালা সাঙ্গ হ'লে উঠে বালা,
শূন্য মনে উঠি বসে আঁখি অশ্রুময়!
বসিয়া বালিকা পরে নিরখি পথিকবরে
সজল নয়ন মুছি ধীরে ধীরে কয়,
"কে তুমি জিজ্ঞাসা করি, কুটীরে এলে কি করি--
আমি যে পিতারে ছাড়া জানি না কাহারে!
পিতার পৃথিবী এই, কোনদিন কাহাকেই
দেখি নি ত এখানে এ কুটীরের দ্বারে!
কোথা হ'তে তুমি আজ আইলে পৃথিবীমাঝ?
কি ব'লে তোমারে আমি করি সম্বোধন?
তুমি কি তাহাই হবে পিতা যাহাদের সবে
"মানুষ' বলিয়া আহা করিত রোদন?
কিম্বা জাগি প্রাতঃকালে যাদের দেবতা ব'লে
নমস্কার করিতেন জনক আমার?
বলিতেন যার দেশে মরণ হইলে শেষে
যেতে হয়, সেথাই কি নিবাস তোমার?--
নাম তার স্বর্গভূমি, আমারে সেথায় তুমি
ল'য়ে চল, দেখি গিয়া পিতায় মাতায়!
ল'য়ে চল দেব তুমি আমারে সেথায়।
যাইব মায়ের কোলে, জননীরে মাতা ব'লে
আবার সেখানে গিয়া ডাকিব তাঁহারে।
দাঁড়ায়ে পিতার কাছে জল দিব গাছে গাছে,
সঁপিব তাঁহার হাতে গাঁথি ফুলহারে!
হাতে ল'য়ে শুকপাখী বাবা মোর নাম ডাকি
"কমলা' বলিতে আহা শিখাবেন তারে!
লয়ে চল, দেব, তুমি সেথায় আমারে!
জননীর মৃত্যু হ'লে, ওই হোথা গাছতলে
রাখিয়াছিলেন তাঁরে জনক তখন!
ধবলতুষার ভার ঢাকিয়াছে দেহ তাঁর,
স্বরগের কুটীরেতে আছেন এখন!
আমিও তাঁহার কাছে করিব গমন!"
বালিকা থামিল সিক্ত হয়ে আঁখিজলে
পথিকেরো আঁখিদ্বয় হ'ল আহা অশ্রুময়,
মুছিয়া পথিক তবে ধীরে ধীরে বলে,
"আইস আমার সাথে, স্বর্গরাজ্য পাবে হাতে,
দেখিতে পাইবে তথা পিতায় মাতায়।
নিশা হ'ল অবসান, পাখীরা করিছে গান,
ধীরে ধীরে বহিতেছে প্রভাতের বায়!
আঁধার ঘোমটা তুলি প্রকৃতি নয়ন খুলি
চারি দিক ধীরে যেন করিছে বীক্ষণ--
আলোকে মিশিল তারা, শিশিরের মুক্তাধারা
গাছ পালা পুষ্প লতা করিছে বর্ষণ!
হোথা বরফের রাশি, মৃত দেহ রেখে আসি
হিমানীক্ষেত্রের মাঝে করায়ে শয়ান,
এই লয়ে যাই চ'লে, মুছে ফেল অশ্রুজলে--
অশ্রুবারিধারে আহা পুরেছে নয়ান!"
পথিক এতেক কয়ে মৃত দেহ তুলে লয়ে
হিমানীক্ষেত্রের মাঝে করিল প্রোথিত।
কুটীরেতে ধীরি ধীরি আবার আইল ফিরি,
কত ভাবে পথিকের চিত্ত আলোড়িত।
ভবিষ্যৎ-কলপনে কত কি আপন মনে
দেখিছে, হৃদয়পটে আঁকিতেছে কত--
দেখে পূর্ণচন্দ্র হাসে নিশিরে রজতবাসে
ঢাকিয়া, হৃদয় প্রাণ করি অবারিত--
জাহ্নবী বহিছে ধীরে, বিমল শীতল নীরে
মাখিয়া রজতরশ্মি গাহি কলকলে--
হরষে কম্পিত কায়, মলয় বহিয়া যায়
কাঁপাইয়া ধীরে ধীরে কুসুমের দলে--
ঘাসের শয্যার 'পরে ঈষৎ হেলিয়া পড়ে
শীতল করিছে প্রাণ শীত সমীরণ--
কবরীতে পুষ্পভার কে ও বাম পাশে তার,
বিধাতা এমন দিন হবে কি কখন?
অদৃষ্টে কি আছে আহা! বিধাতাই জানে তাহা
যুবক আবার ধীরে কহিল বালায়,
"কিসের বিলম্ব আর? ত্যজিয়া কুটীরদ্বার
আইস আমার সাথে, কাল বহে যায়!"
তুলিয়া নয়নদ্বয় বালিকা সুধীরে কয়,
বিষাদে ব্যাকুল আহা কোমল হৃদয়--
"কুটীর! তোদের সবে ছাড়িয়া যাইতে হবে,
পিতার মাতার কোলে লইব আশ্রয়।
হরিণ! সকালে উঠি কাছেতে আসিত ছুটি,
দাঁড়াইয়া ধীরে ধীরে আঁচল চিবায়--
ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি মুখেতে দিতাম তুলি
তাকায়ে রহিত মোর মুখপানে হায়!
তাদের করিয়া ত্যাগ যাইব কোথায়?
যাইব স্বরগভূমে, আহা হা! ত্যজিয়া ঘুমে
এতক্ষণে উঠেছেন জননী আমার--
এতক্ষণে ফুল তুলি গাঁথিছেন মালাগুলি,
শিশিরে ভিজিয়া গেছে আঁচল তাঁহার--
সেথাও হরিণ আছে, ফুল ফুটে গাছে গাছে,
সেখানেও শুক পাখী ডাকে ধীরে ধীরে!
সেথাও কুটীর আছে, নদী বহে কাছে কাছে,
পূর্ণ হয় সরোবর নির্ঝরের নীরে।
আইস! আইস দেব! যাই ধীরে ধীরে!
আয় পাখি! আয় আয়! কার তরে রবি হায়,
উড়ে যা উড়ে যা পাখি! তরুর শাখায়!
প্রভাতে কাহারে পাখি! জাগাবি রে ডাকি ডাকি
"কমলা!' "কমলা!' বলি মধুর ভাষায়?
ভুলে যা কমলা নামে, চলে যা সুখের ধামে,
"কমলা!' "কমলা!' ব'লে ডাকিস নে আর।
চলিনু তোদের ছেড়ে, যা শুক শাখায় উড়ে--
চলিনু ছাড়িয়া এই কুটীরের দ্বার।
তবু উড়ে যাবি নে রে, বসিবি হাতের 'পরে?
আয় তবে, আয় পাখি, সাথে সাথে আয়,
পিতার হাতের 'পরে আমার নামটি ধ'রে--
আবার আবার তুই ডাকিস্ সেথায়।
আইস পথিক তবে কাল ব'হে যায়।"
সমীরণ ধীরে ধীরে চুম্বিয়া তটিনীনীরে
দুলাইতে ছিল আহা লতায় পাতায়--
সহসা থামিল কেন প্রভাতের বায়?
সহসা রে জলধর নব অরুণের কর
কেন রে ঢাকিল শৈল অন্ধকার ক'রে?
পাপিয়া শাখার 'পরে ললিত সুধীর স্বরে
তেমনি কর-না গান, থামিলি কেন রে?
ভুলিয়া শোকের জ্বালা ওই রে চলিছে বালা।
কুটীর ডাকিছে যেন "যেও না-- যেও না!'--
তটিনীতরঙ্গকুল ভিজায়ে গাছের মূল
ধীরে ধীরে বলে যেন "যেও না! যেও না' --
বনদেবী নেত্র খুলি পাতার আঙ্গুল তুলি
যেন বলিছেন আহা "যেও না!-- যেও না!' --
নেত্র তুলি স্বর্গ-পানে দেখে পিতা মেঘযানে
হাত নাড়ি বলিছেন "যেও না!-- যেও না!' --
বালিকা পাইয়া ভয় মুদিল নয়নদ্বয়,
এক পা এগোতে আর হয় না বাসনা--
আবার আবার শুন কানের কাছেতে পুনঃ
কে কহে অস্ফুট স্বরে "যেও না!-- যেও না!'
"যমুনার জল করে থল্ থল্
কলকলে গাহি প্রেমের গান।
নিশার আঁচোলে পড়ে ঢোলে ঢোলে
সুধাকর খুলি হৃদয় প্রাণ!
বহিছে মলয় ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
নুয়ে নুয়ে পড়ে কুসুমরাশি!
ধীরি ধীরি ধীরি ফুলে ফুলে ফিরি
মধুকরী প্রেম আলাপে আসি!
আয় আয় সখি! আয় দুজনায়
ফুল তুলে তুলে গাঁথি লো মালা।
ফুলে ফুলে আলা বকুলের তলা,
হেথায় আয় লো বিপিনবালা।
নতুন ফুটেছে মালতীর কলি,
ঢলি ঢলি পড়ে এ ওর পানে!
মধুবাসে ভুলি প্রেমালাপ তুলি
অলি কত কি-যে কহিছে কানে!
আয় বলি তোরে, আঁচলটি ভোরে
কুড়া-না হোথায় বকুলগুলি!
মাধবীর ভরে লতা নুয়ে পড়ে,
আমি ধীরি ধীরি আনি লো তুলি।
গোলাপ কত যে ফুটেছে কমলা,
দেখে যা দেখে যা বনের মেয়ে!
দেখ্সে হেথায় কামিনী পাতায়
গাছের তলাটি পড়েছে ছেয়ে।
আয় আয় হেথা, ওই দেখ্ ভাই,
ভ্রমরা একটি ফুলের কোলে--
কমলা, ফুঁ দিয়ে দে-না লো উড়িয়ে,
ফুলটা আমি লো নেব যে তুলে।
পারি না লো আর, আয় হেথা বসি
ফুলগুলি নিয়ে দুজনে গাঁথি!
হেথায় পবন খেলিছে কেমন
তটিনীর সাথে আমোদে মাতি!
আয় ভাই হেথা, কোলে রাখি মাথা
শুই একটুকু ঘাসের 'পরে--
বাতাস মধুর বহে ঝুর ঝুর,
আঁখি মুদে আসে ঘুমের তরে!
বল্ বনবালা এত কি লো জ্বালা!
রাত দিন তুই কাঁদিবি বসে!
আজো ঘুমঘোর ভাঙ্গিল না তোর,
আজো মজিলি না সুখের রসে!
তবে যা লো ভাই! আমি একেলাই
রাশ্ রাশ্ করি গাঁথিয়া মালা।
তুই নদীতীরে কাঁদ্গে লো ধীরে
যমুনারে কহি মরমজ্বালা!
আজো তুই বোন! ভুলিবি নে বন?
পরণকুটীর যাবি নে ভুলে?
তোর ভাই মন কে জানে কেমন।
আজো বলিলি নে সকল খুলে?"
"কি বলিব বোন! তবে সব শোন্!"
কহিল কমলা মধুর স্বরে,
"লভেছি জনম করিতে রোদন
রোদন করিব জীবন ভোরে!
ভুলিব সে বন?-- ভুলিব সে গিরি?
সুখের আলয় পাতার কুঁড়ে?
মৃগে যাব ভুলে-- কোলে লয়ে তুলে
কচি কচি পাতা দিতাম ছিঁড়ে।
হরিণের ছানা একত্রে দুজনা
খেলিয়ে খেলিয়ে বেড়াত সুখে!
শিঙ্গ ধরি ধরি খেলা করি করি
আঁচল জড়িয়ে দিতাম মুখে!
ভুলিব তাদের থাকিতে পরাণ?
হৃদয়ে সে সব থাকিতে লেখা?
পারিব ভুলিতে যত দিন চিতে
ভাবনার আহা থাকিবে রেখা?
আজ কত বড় হয়েছে তাহারা,
হয়ত আমার না দেখা পেয়ে
কুটীরের মাঝে খুঁজে খুঁজে খুঁজে
বেড়াতেছে আহা ব্যাকুল হয়ে!
শুয়ে থাকিতাম দুপরবেলায়
তাহাদের কোলে রাখিয়ে মাথা,
কাছে বসি নিজে গলপ কত যে
করিতেন আহা তখন মাতা!
গিরিশিরে উঠি করি ছুটাছুটি
হরিণের ছানাগুলির সাথে
তটিনীর পাশে দেখিতাম বসে
মুখছায়া যবে পড়িত তাতে!
সরসীভিতরে ফুটিলে কমল
তীরে বসি ঢেউ দিতাম জলে,
দেখি মুখ তুলে-- কমলিনী দুলে
এপাশে ওপাশে পড়িতে ঢলে!
গাছের উপরে ধীরে ধীরে ধীরে
জড়িয়ে জড়িয়ে দিতেম লতা,
বসি একাকিনী আপনা-আপনি
কহিতাম ধীরে কত কি কথা!
ফুটিলে গো ফুল হরষে আকুল
হতেম, পিতারে কতেম গিয়ে!
ধরি হাতখানি আনিতাম টানি,
দেখাতেম তাঁরে ফুলটি নিয়ে!
তুষার কুড়িয়ে আঁচল ভরিয়ে
ফেলিতাম ঢালি গাছের তলে--
পড়িলে কিরণ, কত যে বরণ
ধরিত, আমোদে যেতাম গলে!
দেখিতাম রবি বিকালে যখন
শিখরের শিরে পড়িত ঢোলে
করি ছুটাছুটি শিখরেতে উঠি
দেখিতাম দূরে গিয়াছে চোলে!
আবার ছুটিয়ে যেতাম সেখানে
দেখিতাম আরও গিয়াছে সোরে!
শ্রান্ত হয়ে শেষে কুটীরেতে এসে
বসিতাম মুখ মলিন কোরে!
শশধরছায়া পড়িলে সলিলে
ফেলিতাম জলে পাথরকুচি--
সরসীর জল উঠিত উথুলে,
শশধরছায়া উঠিত নাচি।
ছিল সরসীতে এক-হাঁটু জল,
ছুটিয়া ছুটিয়া যেতেম মাঝে,
চাঁদের ছায়ারে গিয়া ধরিবারে
আসিতাম পুনঃ ফিরিয়া লাজে।
তটদেশে পুনঃ ফিরি আসি পর
অভিমানভরে ঈষৎ রাগি
চাঁদের ছায়ায় ছুsয়া পাথর
মারিতাম-- জল উঠিত জাগি।
যবে জলধর শিখরের 'পর
উড়িয়া উড়িয়া বেড়াত দলে,
শিখরেতে উঠি বেড়াতাম ছুটি--
কাপড়-চোপড় ভিজিত জলে!
কিছুই-- কিছুই-- জানিতাম না রে,
কিছুই হায় রে বুঝিতাম না।
জানিতাম হা রে জগৎমাঝারে
আমরাই বুঝি আছি কজনা!
পিতার পৃথিবী পিতার সংসার
একটি কুটীর পৃথিবীতলে
জানি না কিছুই ইহা ছাড়া আর--
পিতার নিয়মে পৃথিবী চলে!
আমাদেরি তরে উঠে রে তপন,
আমাদেরি তরে চাঁদিমা উঠে,
আমাদেরি তরে বহে গো পবন,
আমাদেরি তরে কুসুম ফুটে!
চাই না জ্ঞেয়ান, চাই না জানিতে
সংসার, মানুষ কাহারে বলে।
বনের কুসুম ফুটিতাম বনে,
শুকায়ে যেতেম বনের কোলে।
জানিব আমারি পৃথিবী ধরা,
খেলিব হরিণশাবক-সনে--
পুলকে হরষে হৃদয় ভরা,
বিষাদভাবনা নাহিক মনে।
তটিনী হইতে তুলিব জল,
ঢালি ঢালি দিব গাছের তলে।
পাখীরে বলিব "কমলা বল্',
শরীরের ছায়া দেখিব জলে!
জেনেছি মানুষ কাহারে বলে।
জেনেছি হৃদয় কাহারে বলে!
জেনেছি রে হায় ভাল বাসিলে
কেমন আগুনে হৃদয় জ্বলে!
এখন আবার বেঁধেছি চুলে,
বাহুতে পরেছি সোনার বালা।
উরসেতে হার দিয়েছি তুলে,
কবরীর মাঝে মণির মালা!
বাকলের বাস ফেলিয়াছি দূরে--
শত শ্বাস ফেলি তাহার তরে,
মুছেছি কুসুম রেণুর সিঁদুরে
আজো কাঁদে হৃদি বিষাদভরে!
ফুলের বলয় নাইক হাতে,
কুসুমের হার ফুলের সিঁথি--
কুসুমের মালা জড়ায়ে মাথে
স্মরণে কেবল রাখিনু গাঁথি!
এলো এলো চুলে ফিরিব বনে
রুখো রুখো চুল উড়িবে বায়ে।
ফুল তুলি তুলি গহনে বনে
মালা গাঁথি গাঁথি পরিব গায়ে!
হায় রে সে দিন ভুলাই ভালো!
সাধের স্বপন ভাঙ্গিয়া গেছে!
এখন মানুষে বেসেছি ভালো,
হৃদয় খুলিব মানুষ-কাছে!
হাসিব কাঁদিব মানুষের তরে,
মানুষের তরে বাঁধিব চুলে--
মাখিব কাজল আঁখিপাত ভ'রে,
কবরীতে মণি দিব রে তুলে।
মুছিনু নীরজা! নয়নের ধার,
নিভালাম সখি হৃদয়জ্বালা!
তবে সখি আয় আয় দুজনায়
ফুল তুলে তুলে গাঁথি লো মালা!
এই যে মালতী তুলিয়াছ সতি!
এই যে বকুল ফুলের রাশি;
জুঁই আর বেলে ভরেছ আঁচলে,
মধুপ ঝাঁকিয়া পড়িছে আসি!
এই হল মালা, আর না লো বালা--
শুই লো নীরজা! ঘাসের 'পরে।
শুন্ছিস বোন! শোন্ শোন্ শোন্!
কে গায় কোথায় সুধার স্বরে!
জাগিয়া উঠিল হৃদয় প্রাণ!
স্মরণের জ্যোতি উঠিল জ্বলে!
ঘা দিয়েছে আহা মধুর গান
হৃদয়ের অতি গভীর তলে!
সেই-যে কানন পড়িতেছে মনে
সেই-যে কুটীর নদীর ধারে!
থাক্ থাক্ থাক্ হৃদয়বেদন
নিভাইয়া ফেলি নয়নধারে!
সাগরের মাঝে তরণী হতে
দূর হতে যথা নাবিক যত--
পায় দেখিবারে সাগরের ধারে
মেঘ্লা মেঘ্লা ছায়ার মত!
তেমনি তেমনি উঠিয়াছে জাগি--
অফুট অফুট হৃদয়-'পরে
কি দেশ কি জানি, কুটীর দুখানি,
মাঠের মাঝেতে মহিষ চরে!
বুঝি সে আমার জনমভূমি
সেখান হইতে গেছিনু চলে!
আজিকে তা মনে জাগিল কেমনে
এত দিন সব ছিলুম ভুলে।
হেথায় নীরজা, গাছের আড়ালে
লুকিয়ে লুকিয়ে শুনিব গান,
যমুনাতীরেতে জ্যোছনার রেতে
গাইছে যুবক খুলিয়া প্রাণ!
কেও কেও ভাই? নীরদ বুঝি?
বিজয়ের আহা প্রাণের সখা!
গাইছে আপন ভাবেতে মজি
যমুনা পুলিনে বসিয়ে একা!
যেমন দেখিতে গুণও তেমন,
দেখিতে শুনিতে সকলি ভালো--
রূপে গুণে মাখা দেখি নি এমন,
নদীর ধারটি করেছে আলো!
আপনার ভাবে আপনি কবি
রাত দিন আহা রয়েছে ভোর!
সরল প্রকৃতি মোহনছবি
অবারিত সদা মনের দোর
মাথার উপরে জড়ান মালা--
নদীর উপরে রাখিয়া আঁখি
জাগিয়া উঠেছে নিশীথবালা
জাগিয়া উঠেছে পাপিয়া পাখী!
আয় না লো ভাই গাছের আড়ালে
আয় আর একটু কাছেতে সরে
এই খানে আয় শুনি দুজনায়
কি গায় নীরদ সুধার স্বরে!"
গান।
"মোহিনী কল্পনে! আবার আবার--
মোহিনী বীণাটি বাজাও না লো!
স্বর্গ হতে আনি অমৃতের ধার
হৃদয়ে শ্রবণে জীবনে ঢালো!
ভুলিব সকল-- ভুলেছি সকল--
কমলচরণে ঢেলেছি প্রাণ!
ভুলেছি-- ভুলিব-- শোক-অশ্রুজল,
ভুলিছি বিষয়, গরব, মান!
শ্রবণ জীবন হৃদয় ভরি
বাজাও সে বীণা বাজাও বালা!
নয়নে রাখিব নয়নবারি
মরমে নিবারি মরমজ্বালা!
অবোধ হৃদয় মানিবে শাসন
শোকবারিধারা মানিবে বারণ,
কি যে ও বীণার মধুর মোহন
হৃদয় পরাণ সবাই জানে--
যখনি শুনি ও বীণার স্বরে
মধুর সুধায় হৃদয় ভরে,
কি জানি কিসের ঘুমের ঘোরে
আকুল করে যে ব্যাকুল প্রাণে!
কি জানি লো বালা! কিসের তরে
হৃদয় আজিকে কাঁদিয়া উঠে।
কি জানি কি ভাব ভিতরে ভিতরে
জাগিয়া উঠেছে হৃদয় পুটে!
অফুট মধুর স্বপনে যেমন
জাগি উঠে হৃদে কি জানি কেমন
কি ভাব কে জানে কিসের লাগি!
বাঁশরীর ধ্বনি নিশীথে যেমন
সুধীর গভীরে মোহিয়া শ্রবণ
জাগায় হৃদয়ে কি জানি কেমন
কি ভাব কে জানে কিসের লাগি।
দিয়াছে জাগায়ে ঘুমন্ত এ মনে,
দিয়াছে জাগায়ে ঘুমন্ত স্মরণে,
ঘুমন্ত পরাণ উঠেছে জাগি!
ভেবেছিনু হায় ভুলিব সকল
সুখ দুখ শোক হাসি অশ্রুজল
আশা প্রেম যত ভুলিব-- ভুলিব--
আপনা ভুলিয়া রহিব সুখে!
ভেবেছিনু হায় কল্পনাকুমারী
বীণাস্বরসুধা পিইয়া তোমারি
হৃদয়ের ক্ষুধা রাখিব নিবারি
পাশরি সকল বিষাদ দুখে!
প্রকৃতিশোভায় ভরিব নয়নে,
নদীকলস্বরে ভরিব শ্রবণে
বীণার সুধায় হৃদয় ভরি!
ভুলিব প্রেম যে আছে এ ধরায়,
ভুলিব পরের বিষাদ ব্যথায়
ফেলে কি না ধরা নয়নবারি!
কই তা পারিনু শোভনা কল্পনে!
বিস্মৃতির জলে ডুবাইতে মনে!
আঁকা যে মূরতি হৃদয়ের তলে
মুছিতে লো তাহা যতন করি!
দেখ লো এখন অবারি হৃদয়
মরম-আধার হুতাশনময়,
শিরায় শিরায় বহিছে অনল
জ্বলন্ত জ্বালায় হৃদয় ভরি!
প্রেমের মূরতি হৃদয়গুহায়
এখনো স্থাপিত রয়েছে রে হায়!
বিষাদ-অনলে আহুতি দিয়া
বলো তুমি তবে বলো কলপনে
যে মূরতি আঁকা হৃদয়ের সনে
কেমনে ভুলিব থাকিতে হিয়া।
কেমনে ভুলিব থাকিতে পরাণ
কেমনে ভুলিব থাকিতে জ্ঞেয়ান
পাষাণ না হলে হৃদয় দেহ!
তাই বলি বালা! আবার-- আবার
স্বর্গ হতে আনি অমৃতের ধার--
ঢাল গো হৃদয়ে সুধার স্নেহ।
শুকায়ে যাউক সজল নয়ান,
হৃদয়ের জ্বালা নিবুক হৃদে,
রেখো না হৃদয়ে একটুকু খান
বিষাদ বেদনা যেখানে বিঁধে।
কেন লো-- কেন লো-- ভুলিব কেন লো--
এত দিন যারে বেসেছিনু ভাল
হৃদয় পরাণ দেছিনু যারে--
স্থাপিয়া যাহারে হৃদয়াসনে
পূজা করেছিনু দেবতা-সনে
কোন্ প্রাণে আজি ভুলিব তারে!--
দ্বিগুণ জ্বলুক হৃদয়-আগুন।
দ্বিগুণ বহুক বিষাদধারা।
স্মরণের আভা ফুটুক দ্বিগুণ।
হোক হৃদিপ্রাণ পাগল পারা।
প্রেমের প্রতিমা আছে যা হৃদয়ে
মরমশোণিতে আছে যা গাঁথা--
শত শত শত অশ্রু বারিচয়ে
দিব উপহার দিব রে তথা।
এত দিন যার তরে অবিরল
কেঁদেছিনু হায় বিষাদভরে,
আজিও-- আজিও-- নয়নের জল
বরষিবে আঁখি তাহারি তরে।
এত দিন ভাল বেসেছিনু যারে
হৃদয় পরাণ দেছিনু খুলে--
আজিও রে ভাল বাসিব তাহারে,
পরাণ থাকিতে যাব না ভুলে।
হৃদয়ের এই ভগনকুটীরে
প্রেমের প্রদীপ করেছে আলা--
যেন রে নিবিয়া না যায় কখনো
সহস্র কেন রে পাই-না জ্বালা।
কেবল দেখিব সেই মুখখানি,
দেখিব সেই সে গরব হাসি।
উপেক্ষার সেই কটাক্ষ দেখিব,
অধরের কোণে ঘৃণার রাশি।
তবু কল্পনা কিছু ভুলিব না!
সকলি হৃদয়ে থাকুক গাঁথা--
হৃদয়ে, মরমে, বিষাদবেদনা
যত পারে তারে দিক না ব্যথা।
ভুলিব না আমি সেই সন্ধ্যাবায়,
ভুলিব না ধীরে নদী ব'হে যায়,
ভুলিব না হায় সে মুখশশী।
হব না-- হব না-- হব না বিস্মৃত,
যত দিন দেহে রহিবে শোণিত,
জীবন তারকা না যাবে খসি।
প্রেমগান কর তুমি কল্পনা!
প্রেমগীতে মাতি বাজুক বীণা!
শুনিব, কাঁদিব হৃদয় ঢালি!
নিরাশ প্রণয়ী কাঁদিবে নীরবে।--
বাজাও বাজাও বীণাসুধারবে
নব অনুরাগ হৃদয়ে জ্বালি!
প্রকৃতিশোভায় ভরিব নয়নে,
নদীকলস্বরে ভরিব শ্রবণে,
প্রেমের প্রতিমা হৃদয়ে রাখি।
গাও গো তটিনী প্রেমের গান,
ধরিয়া অফুট মধুর তান
প্রেমগান কর বনের পাখী।"
কহিল কমলা "শুনেছিস্ ভাই
বিষাদে দুঃখে যে ফাটিছে প্রাণ!
কিসের লাগিয়া, মরমে মরিয়া
করিছে অমন খেদের গান?
কারে ভাল বাসে? কাঁদে কার তরে?
কার তরে গায় খেদের গান?
কার ভালবাসা পায় নাই ফিরে
সঁপিয়া তাহারে হৃদয় প্রাণ?
ভালবাসা আহা পায় নাই ফিরে!
অমন দেখিতে অমন আহা!
নবীন যুবক ভাল বাসে কি রে?
কারে ভাল বাসে জানিস্ তাহা?
বসেছিনু কাল ওই গাছতলে
কাঁদিতে ছিলেম কত কি ভাবি--
যুবক তখনি সুধীরে আপনি
প্রাসাদ হইতে আইল নাবি।
কহিল "শোভনে! ডাকিছে বিজয়,
আমার সহিত আইস তথা।'
কেমন আলাপ! কেমন বিনয়!
কেমন সুধীর মধুর কথা!
চাইতে নারিনু মুখপানে তাঁর,
মাটির পানেতে রাখিয়ে মাথা
শরমে পাশরি বলি বলি করি
তবুও বাহির হ'ল না কথা!
কাল হতে ভাই! ভাবিতেছি তাই
হৃদয় হয়েছে কেমন ধারা!
থাকি থাকি থাকি উঠি লো চমকি,
মনে হয় কার পাইনু সাড়া!
কাল হ'তে তাই মনের মতন
বাঁধিয়াছি চুল করিয়া যতন,
কবরীতে তুলে দিয়াছি রতন,
চুলে সঁপিয়াছি ফুলের মালা,
কাজল মেখেছি নয়নের পাতে,
সোনার বলয় পরিয়াছি হাতে,
রজতকুসুম সঁপিয়াছি মাথে,
কি কহিব সখি! এমন জ্বালা!"
নিভৃত যমুনাতীরে বসিয়া রয়েছে কি রে
কমলা নীরদ দুই জনে?
যেন দোঁহে জ্ঞানহত-- নীরব চিত্রের মত
দোঁহে দোঁহা হেরে একমনে।
দেখিতে দেখিতে কেন অবশ পাষাণ হেন,
চখের পলক নাহি পড়ে।
শোণিত না চলে বুকে, কথাটি না ফুটে মুখে,
চুলটিও না নড়ে না চড়ে!
মুখ ফিরাইল বালা, দেখিল জ্যোছনামালা
খসিয়া পড়িছে নীল যমুনার নীরে--
অস্ফুট কল্লোলস্বর উঠিছে আকাশ-'পর
অর্পিয়া গভীর ভাব রজনী-গভীরে!
দেখিছে লুটায় ঢেউ আবার লুটায়,
দিগন্তে খেলায়ে পুনঃ দিগন্তে মিলায়!
দেখে শূন্য নেত্র তুলি-- খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি
জ্যোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়।
একখণ্ড উড়ে যায় আর খণ্ড আসে
ঢাকিয়া চাঁদের ভাতি মলিন করিয়া রাতি
মলিন করিয়া দিয়া সুনীল আকাশে।
পাখী এক গেল উড়ে নীল নভোতলে,
ফেনখণ্ড গেল ভেসে নীল নদীজলে,
দিবা ভাবি অতিদূরে আকাশ সুধায় পূরে
ডাকিয়া উঠিল এক প্রমুগ্ধ পাপিয়া।
পিউ, পিউ, শূন্যে ছুটে উচ্চ হতে উচ্চে উঠে--
আকাশ সে সূক্ষ্ম স্বরে উঠিল কাঁপিয়া।
বসিয়া গণিল বালা কত ঢেউ করে খেলা,
কত ঢেউ দিগন্তের আকাশে মিলায়,
কত ফেন করি খেলা লুটায়ে চুম্বিছে বেলা,
আবার তরঙ্গে চড়ি সুদূরে পলায়।
দেখি দেখি থাকি থাকি আবার ফিরায়ে আঁখি
নীরদের মুখপানে চাহিল সহসা--
আধেক মুদিত নেত্র অবশ পলকপত্র--
অপূর্ব্ব মধুর ভাবে বালিকা বিবশা!
নীরদ ক্ষণেক পরে উঠে চমকিয়া,
অপূর্ব্ব স্বপন হতে জাগিল যেন রে।
দূরেতে সরিয়া গিয়া থাকিয়া থাকিয়া
বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে--
"সে কি কথা শুধাইছ বিপিনরমণী!
ভালবাসি কিনা আমি তোমারে কমলে?
পৃথিবী হাসিয়া যে লো উঠিবে এখনি!
কলঙ্ক রমণী নামে রটিবে তা হ'লে?
ও কথা শুধাতে আছে? ও কথা ভাবিতে আছে!
ওসব কি স্থান দিতে আছে মনে মনে?
বিজয় তোমার স্বামী বিজয়ের পত্মী তুমি
সরলে! ও কথা তবে শুধাও কেমনে?
তবুও শুধাও যদি দিব না উত্তর!--
হৃদয়ে যা লিখা আছে দেখাবো না কারো কাছে,
হৃদয়ে লুকান রবে আমরণ কাল!
রুদ্ধ অগ্নিরাশিসম দহিবে হৃদয় মম
ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া যাবে হৃদিগ্রন্থিজাল।
যদি ইচ্ছা হয় তবে লীলা সমাপিয়া ভবে
শোণিতধারায় তাহা করিব নির্ব্বাণ।
নহে অগ্নিশৈলসম জ্বলিবে হৃদয় মম
যত দিন দেহমাঝে রহিবেক প্রাণ!
যে তোমারে বন হতে এনেছে উদ্ধারি
যাহারে করেছ তুমি পাণি সমর্পণ
প্রণয় প্রার্থনা তুমি করিও তাহারি--
তারে দিও যাহা তুমি বলিবে আপন!
চাই না বাসিতে ভাল, ভাল বাসিব না।
দেবতার কাছে এই করিব প্রার্থনা--
বিবাহ করেছ যারে সুখে থাক লয়ে তারে
বিধাতা মিটান তব সুখের কামনা!"
"বিবাহ কাহারে বলে জানি না তা আমি"
কহিল কমলা তবে বিপিনকামিনী,
"কারে বলে পত্মী আর কারে বলে স্বামী,
কারে বলে ভালবাসা আজিও শিখি নি।
এইটুকু জানি শুধু এইটুকু জানি,
দেখিবারে আঁখি মোর ভালবাসে যারে
শুনিতে বাসি গো ভাল যার সুধাবাণী--
শুনিব তাহার কথা দেখিব তাহারে!
ইহাতে পৃথিবী যদি কলঙ্ক রটায়
ইহাতে হাসিয়া যদি উঠে সব ধরা
বল গো নীরদ আমি কি করিব তার?
রটায়ে কলঙ্ক তবে হাসুক না তারা।
বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না--
তাহারে বাসিব ভাল, ভালবাসি যারে!
তাহারই ভালবাসা করিব কামনা
যে মোরে বাসে না ভাল, ভালবাসি যারে।"
নীরদ অবাক রহি কিছুক্ষণ পরে
বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে,
"সে কি কথা বল বালা, যে জন তোমারে
বিজন কানন হতে করিয়া উদ্ধার
আনিল, রাখিল যত্নে সুখের আগারে--
সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?
হৃদয় সঁপেছে যে লো তোমারে নবীনা
সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?"
কমলা কহিল ধীরে, "আমি তা জানি না।"
নীরদ সমুচ্চ স্বরে কহিল আবার--
"তবে যা লো দুশ্চারিণী! যেথা ইচ্ছা তোর
কর্ তাই যাহা তোর কহিবে হৃদয়--
কিন্তু যত দিন দেহে প্রাণ রবে মোর--
তোর এ প্রণয়ে আমি দিব না প্রশ্রয়!
আর তুই পাইবি না দেখিতে আমারে
জ্বলিব যদিন আমি জীবন-অনলে--
স্বরগে বাসিব ভাল যা খুসী যাহারে
প্রণয়ে সেথায় যদি পাপ নাহি বলে!
কেন বল্ পাগলিনী! ভালবাসি মোরে
অনলে জ্বালিতে চাস্ এ জীবন ভোরে!
বিধাতা যে কি আমার লিখেছে কপালে!
যে গাছে রোপিতে যাই শুকায় সমূলে।"
ভর্ৎসনা করিবে ছিল নীরদের মনে--
আদরেতে স্বর কিন্তু হয়ে এল নত!
কমলা নয়নজল ভরিয়া নয়নে
মুখপানে চাহি রয় পাগলের মত!
নীরদ উদ্গামী অশ্রু করি নিবারিত
সবেগে সেখান হতে করিল প্রয়াণ।
উচ্ছ্বাসে কমলা বালা উন্মত্ত চিত
অঞ্চল করিয়া সিক্ত মুছিল নয়ান।
বিজয় নিভৃতে কি কহে নিশীথে?
কি কথা শুধায় নীরজা বালায়--
দেখেছ, দেখেছ হোথা?
ফুলপাত্র হতে ফুল তুলি হাতে
নীরজা শুনিছে, কুসুম গুণিছে,
মুখে নাই কিছু কথা।
বিজয় শুধায়-- কমলা তাহারে
গোপনে, গোপনে ভালবাসে কি রে?
তার কথা কিছু বলে কি সখীরে?
যতন করে কি তাহার তরে।
আবার কহিল, "বলো কমলায়
বিজন কানন হইতে যে তায়
করিয়া উদ্ধার সুখের ছায়ায়
আনিল, হেলা কি করিবে তারে?
যদি সে ভাল না বাসে আমায়
আমি কিন্তু ভালবাসিব তাহায়
যত দিন দেহে শোণিত চলে।"
বিজয় যাইল আবাস ভবনে
নিদ্রায় সাধিতে কুসুমশয়নে।
বালিকা পড়িল ভূমির তলে।
বিবর্ণ হইল কপোল বালার,
অবশ হইয়ে এল দেহভার--
শোণিতের গতি থামিল যেন!
ও কথা শুনিয়া নীরজা সহসা
কেন ভূমিতলে পড়িল বিবশা?
দেহ থর থর কাঁপিছে কেন?
ক্ষণেকের পরে লভিয়া চেতন,
বিজয়-প্রাসাদে করিল গমন,
দ্বারে ভর দিয়া চিন্তায় মগন
দাঁড়ায়ে রহিল কেন কে জানে?
বিজয় নীরবে ঘুমায় শয্যায়,
ঝুরু ঝুরু ঝুরু বহিতেছে বায়,
নক্ষত্রনিচয় খোলা জানালায়
উঁকি মারিতেছে মুখের পানে!
খুলিয়া মেলিয়া অসংখ্য নয়ন
উঁকি মারিতেছে যেন রে গগন,
জাগিয়া ভাবিয়া দেখিলে তখন
অবশ্য বিজয় উঠিত কাঁপি!
ভয়ে, ভয়ে ধীরে মুদিত নয়ন
পৃথিবীর শিশু ক্ষুদ্র-প্রাণমন--
অনিমেষ আঁখি এড়াতে তখন
অবশ্য দুয়ার ধরিত চাপি!
ধীরে, ধীরে, ধীরে খুলিল দুয়ার,
পদাঙ্গুলি 'পরে সঁপি দেহভার
কেও বামা ডরে প্রবেশিছে ঘরে
ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলিয়া ভয়ে!
একদৃষ্টে চাহি বিজয়ের মুখে
রহিল দাঁড়ায়ে শয্যার সমুখে,
নেত্রে বহে ধারা মরমের দুখে,
ছবিটির মত অবাক্ হয়ে!
ভিন্ন ওষ্ঠ হতে বহিছে নিশ্বাস--
দেখিছে নীরজা, ফেলিতেছে শ্বাস,
সুখের স্বপন দেখিয়ে তখন
ঘুমায় যুবক প্রফুল্লমুখে!
"ঘুমাও বিজয়! ঘুমাও গভীরে--
দেখো না দুখিনী নয়নের নীরে
করিছে রোদন তোমারি কারণ--
ঘুমাও বিজয় ঘুমাও সুখে!
দেখো না তোমারি তরে একজন
সারা নিশি দুখে করি জাগরণ
বিছানার পাশে করিছে রোদন--
তুমি ঘুমাইছ ঘুমাও ধীরে!
দেখো না বিজয়! জাগি সারা নিশি
প্রাতে অন্ধকার যাইলে গো মিশি
আবাসেতে ধীরে যাইব গো ফিরে--
তিতিয়া বিষাদে নয়ননীরে
ঘুমাও বিজয়। ঘুমাও ধীরে!'
"কমলা ভুলিবে সেই শিখর কানন,
কমলা ভুলিবে সেই বিজন কুটীর--
আজ হতে নেত্র! বারি কোরো না বর্ষণ,
আজ হ'তে মন প্রাণ হও গো সুস্থির।
অতীত ও ভবিষ্যত হইব বিস্মৃত।
জুড়িয়াছে কমলার ভগন হৃদয়!
সুখের তরঙ্গ হৃদে হয়েছে উত্থিত,
সংসার আজিকে হোতে দেখি সুখময়।
বিজয়েরে আর করিব না তিরস্কার
সংসারকাননে মোরে আনিয়াছে বলি।
খুলিয়া দিয়াছে সে যে হৃদয়ের দ্বার,
ফুটায়েছে হৃদয়ের অস্ফুটিত কলি!
জমি জমি জলরাশি পর্ব্বতগুহায়
একদিন উথলিয়া উঠে রে উচ্ছ্বাসে,
একদিন পূর্ণ বেগে প্রবাহিয়া যায়,
গাহিয়া সুখের গান যায় সিন্ধুপাশে।--
আজি হতে কমলার নূতন উচ্ছ্বাস,
বহিতেছে কমলার নূতন জীবন।
কমলা ফেলিবে আহা নূতন নিশ্বাস,
কমলা নূতন বায়ু করিবে সেবন।
কাঁদিতে ছিলাম কাল বকুলতলায়,
নিশার আঁধারে অশ্রু করিয়া গোপন!
ভাবিতে ছিলাম বসি পিতায় মাতায়--
জানি না নীরদ আহা এয়েছে কখন।
সেও কি কাঁদিতে ছিল পিছনে আমার?
সেও কি কাঁদিতে ছিল আমারি কারণ?
পিছনে ফিরিয়া দেখি মুখপানে তার,
মন যে কেমন হল জানে তাহা মন।
নীরদ কহিল হৃদি ভরিয়া সুধায়--
"শোভনে! কিসের তরে করিছ রোদন?'
আহা হা! নীরদ যদি আবার শুধায়,
"কমলে! কিসের তরে করিছ রোদন?'
বিজয়েরে বলিয়াছি প্রাতঃকালে কাল--
একটি হৃদয়ে নাই দুজনের স্থান!
নীরদেই ভালবাসা দিব চিরকাল,
প্রণয়ের করিব না কভু অপমান।
ওই যে নীরজা আসে পরাণ-সজনী,
একমাত্র বন্ধু মোর পৃথিবীমাঝার!
হেন বন্ধু আছে কি রে নির্দ্দয় ধরণী!
হেন বন্ধু কমলা কি পাইবেক আর?
ওকি সখি কোথা যাও? তুলিবে না ফুল?
নীরজা, আজিকে সই গাঁথিবে না মালা?
ওকি সখি আজ কেন বাঁধ নাই চুল?
শুকনো শুকনো মুখ কেন আজি বালা?
মুখ ফিরাইয়া কেন মুছ আঁখিজল?
কোথা যাও, কোথা সই, যেও না, যেও না!
কি হয়েছে? বল্বি নে-- বল্ সখি বল্!
কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা?"
"কি হয়েছে, কে দিয়েছে, বলি গো সকল।
কি হয়েছে, কে দিয়েছে কিসের যাতনা--
ফেলিব যে চিরকাল নয়নের জল
নিভায়ে ফেলিতে বালা মরমবেদনা!
কে দিয়েছে মনমাঝে জ্বালায়ে অনল?
বলি তবে তুই সখি তুই! আর নয়--
কে আমার হৃদয়েতে ঢেলেছে গরল?
কমলারে ভালবাসে আমার বিজয়!
কেন হলুম না বালা আমি তোর মত,
বন হতে আসিতাম বিজয়ের সাথে--
তোর মত কমলা লো মুখ আঁখি যত
তা হলে বিজয়-মন পাইতাম হাতে!
পরাণ হইতে অগ্নি নিভিবে না আর
বনে ছিলি বনবালা সে ত বেশ ছিলি--
জ্বালালি!-- জ্বলিলি বোন! খুলি মর্ম্মদ্বার--
কাঁদিতে করিগে যত্ন যেথা নিরিবিলি।"
কমলা চাহিয়া রয়, নাহি বহে শ্বাস।
হৃদয়ের গূঢ় দেশে অশ্রুরাশি মিলি
ফাটিয়া বাহির হতে করিল প্রয়াস--
কমলা কহিল ধীরে "জ্বালালি জ্বলিলি!"
আবার কহিল ধীরে, আবার হেরিল নীরে
যমুনাতরঙ্গে খেলে পূর্ণ শশধর--
তরঙ্গের ধারে ধারে রঞ্জিয়া রজতধারে
সুনীল সলিলে ভাসে রজন্ময় কর!
হেরিল আকাশ-পানে সুনীল জলদযানে
ঘুমায়ে চন্দ্রিমা ঢালে হাসি এ নিশীথে।
কতক্ষণ চেয়ে চেয়ে পাগল বনের মেয়ে
আকুল কত কি মনে লাগিত ভাবিতে!
"ওই খানে আছে পিতা, ওই খানে আছে মাতা,
ওই জ্যোৎস্নাময় চাঁদে করি বিচরণ
দেখিছেন হোথা হোতে দাঁড়ায়ে সংসারপথে
কমলা নয়নবারি করিছে মোচন।
একি রে পাপের অশ্রু? নীরদ আমার--
নীরদ আমার যথা আছে লুক্কায়িত,
সেই খান হোতে এই অশ্রুবারিধার
পূর্ণ উৎস-সম আজ হ'ল উৎসারিত।
এ ত পাপ নয় বিধি! পাপ কেন হবে?
বিবাহ করেছি বলে নীরদে আমার
ভাল বাসিব না? হায় এ হৃদয় তবে
বজ্র দিয়া দিক বিধি ক'রে চুরমার!
এ বক্ষে হৃদয় নাই, নাইক পরাণ,
একখানি প্রতিমূর্ত্তি রেখেছি শরীরে--
রহিবে, যদিন প্রাণ হবে বহমান
রহিবে, যদিন রক্ত রবে শীরে শীরে!
সেই মূর্ত্তি নীরদের! সে মূর্ত্তি মোহন
রাখিলে বুকের মধ্যে পাপ কেন হবে?
তবুও সে পাপ-- আহা নীরদ যখন
বলেছে, নিশ্চয় তারে পাপ বলি তবে!
তবু মুছিব না অশ্রু এ নয়ান হোতে,
কেন বা জানিতে চাব পাপ কারে বলি?
দেখুক জনক মোর ওই চন্দ্র হোতে
দেখুন জননী মোর আঁখি দুই মেলি!
নীরজা গাইত "চল্ চন্দ্রলোকে র'বি।
সুধাময় চন্দ্রলোক, নাই সেথা দুখ শোক,
সকলি সেথায় নব ছবি!
ফুলবক্ষে কীট নাই, বিদ্যুতে অশনি নাই,
কাঁটা নাই গোলাপের পাশে!
হাসিতে উপেক্ষা নাই, অশ্রুতে বিষাদ নাই,
নিরাশার বিষ নাই শ্বাসে।
নিশীথে আঁধার নাই, আলোকে তীব্রতা নাই,
কোলাহল নাইক দিবায়!
আশায় নাইক অন্ত, নূতনত্বে নাই অন্ত,
তৃপ্তি নাই মাধুর্য্যশোভায়।
লতিকা কুসুমময়, কুসুম সুরভিময়,
সুরভি মৃদুতাময় যেথা!
জীবন স্বপনময়, স্বপন প্রমোদময়,
প্রমোদ নূতনময় সেথা!
সঙ্গীত উচ্ছ্বাসময়, উচ্ছ্বাস মাধুর্য্যময়,
মাধুর্য্য মত্ততাময় অতি।
প্রেম অস্ফুটতামাখা, অস্ফুটতা স্বপ্নমাখা,
স্বপ্নে-মাখা অস্ফুটিত জ্যোতি!
গভীর নিশীথে যেন, দূর হোতে স্বপ্ন-হেন
অস্ফুট বাঁশীর মৃদু রব--
সুধীরে পশিয়া কানে শ্রবণ হৃদয় প্রাণে
আকুল করিয়া দেয় সব।
এখানে সকলি যেন অস্ফুট মধুর-হেন,
উষার সুবর্ণ জ্যোতি-প্রায়।
আলোকে আঁধার মিশে মধু জ্যোছনায় দিশে
রাখিয়াছে ভরিয়া সুধায়!
দূর হোতে অপ্সরার মধুর গানের ধার,
নির্ঝরের ঝর ঝর ধ্বনি।
নদীর অস্ফুট তান মলয়ের মৃদুগান
একত্তরে মিশেছে এমনি!
সকলি অস্ফুট হেথা মধুর স্বপনে-গাঁথা
চেতনা মিশান' যেন ঘুমে।
অশ্রু শোক দুঃখ ব্যথা কিছুই নাহিক হেথা
জ্যোতির্ম্ময় নন্দনের ভূমে!'
আমি যাব সেই খানে পুলকপ্রমত্ত প্রাণে
সেই দিনকার মত বেড়াব খেলিয়া--
বেড়াব তটিনীতীরে, খেলাব তটিনীনীরে,
বেড়াইব জ্যোছনায় কুসুম তুলিয়া!
শুনিছি মৃত্যুর পিছু পৃথিবীর সব-কিছু
ভুলিতে হয় নাকি গো যা আছে এখানে!
ওমা! সে কি করে হবে? মরিতে চাই না তবে
নীরদে ভুলিতে আমি চাব কোন্ প্রাণে?"
কমলা এতেক পরে হেরিল সহসা
নীরদ কাননপথে যাইছে চলিয়া--
মুখপানে চাহি রয় বালিকা বিবশা,
হৃদয়ে শোণিতরাশি উঠে উথলিয়া।
নীরদের স্কন্ধে খেলে নিবিড় কুন্তল,
দেহ আবরিয়া রহে গৈরিক বসন,
গভীর ঔদাস্যে যেন পূর্ণ হৃদিতল--
চলিছে যে দিকে যেন চলিছে চরণ।
যুবা কমলারে দেখি ফিরাইয়া লয় আঁখি,
চলিল ফিরায়ে মুখ দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
যুবক চলিয়া যায় বালিকা তবুও হায়!
চাহি রয় একদৃষ্টে আঁখিদ্বয় মেলি।
ঘুম হতে যেন জাগি সহসা কিসের লাগি
ছুটিয়া পড়িল গিয়া নীরদের পায়।
যুবক চমকি প্রাণে হেরি চারি দিক-পানে
পুনঃ না করিয়া দৃষ্টি ধীরে চলি যায়।
"কোথা যাও-- কোথা যাও-- নীরদ! যেও না!
একটি কহিব কথা শুন একবার!
মুহূর্ত্ত-- মুহূর্ত্ত রও-- পুরাও কামনা!
কাতরে দুখিনী আজি কহে বার বার!
জিজ্ঞাসা করিবে নাকি আজি যুবাবর
"কমলা কিসের তরে করিছ রোদন?'
তা হলে কমলা আজি দিবেক উত্তর,
কমলা খুলিবে আজি হৃদয়বেদন।
দাঁড়াও-- দাঁড়াও যুবা! দেখি একবার,
যেথা ইচ্ছা হয় তুমি যেও তার পর!
কেন গো রোদন করি শুধাও আবার,
কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর!
কমলা আজিকে তার দিবেক উত্তর,
কমলা হৃদয় খুলি দেখাবে তোমায়--
সেথায় রয়েছে লেখা দেখো তার পর
কমলা রোদন করে কিসের জ্বালায়!"
"কি কব কমলা আর কি কব তোমায়,
জনমের মত আজ লইব বিদায়!
ভেঙ্গেছে পাষাণ প্রাণ, ভেঙ্গেছে সুখের গান--
এ জন্মে সুখের আশা রাখি নাক আর!
এ জন্মে মুছিব নাক নয়নের ধার!
কত দিন ভেবেছিনু যোগীবেশ ধরে
ভ্রমিব যেথায় ইচ্ছা কানন-প্রান্তরে।
তবু বিজয়ের তরে এত দিন ছিনু ঘরে
হৃদয়ের জ্বালা সব করিয়া গোপন--
হাসি টানি আনি মুখে এত দিন দুখে দুখে
ছিলাম, হৃদয় করি অনলে অর্পণ!
কি আর কহিব তোরে-- কালিকে বিজয় মোরে
কহিল জন্মের মত ছাড়িতে আলয়!
জানেন জগৎস্বামী-- বিজয়ের তরে আমি
প্রেম বিসর্জ্জিয়াছিনু তুষিতে প্রণয়।"
এত বলি নীরবিল ক্ষুব্ধ যুবাবর!
কাঁপিতে লাগিল কমলার কলেবর,
নিবিড় কুন্তল যেন উঠিল ফুলিয়া--
যুবারে সম্ভাষে বালা, এতেক বলিয়া--
"কমলা তোমারে আহা ভালবাসে বোলে
তোমারে করেছে দূর নিষ্ঠুর বিজয়!
প্রেমেরে ডুবাব আজি বিস্মৃতির জলে,
বিস্মৃতির জলে আজি ডুবাব হৃদয়!
তবুও বিজয় তুই পাবি কি এ মন?
নিষ্ঠুর! আমারে আর পাবি কি কখন?
পদতলে পড়ি মোর দেহ কর ক্ষয়--
তবু কি পারিবি চিত্ত করিবারে জয়?
তুমিও চলিলে যদি হইয়া উদাস--
কেন গো বহিব তবে এ হৃদি হতাশ?
আমিও গো আভরণ ভূষণ ফেলিয়া
যোগিনী তোমার সাথে যাইব চলিয়া।
যোগিনী হইয়া আমি জন্মেছি যখন
যোগিনী হইয়া প্রাণ করিব বহন।
কাজ কি এ মণি মুক্তা রজত কাঞ্চন--
পরিব বাকলবাস ফুলের ভূষণ।
নীরদ! তোমার পদে লইনু শরণ--
লয়ে যাও যেথা তুমি করিবে গমন!
নতুবা যমুনাজলে এখনই অবহেলে
ত্যজিব বিষাদদগ্ধ নারীর জীবন!"
পড়িল ভূতলে কেন নীরদ সহসা?
শোণিতে মৃত্তিকাতল হইল রঞ্জিত!
কমলা চমকি দেখে সভয়ে বিবশা
দারুণ ছুরিকা পৃষ্ঠে হয়েছে নিহিত!
কমলা সভয়ে শোকে করিল চিৎকার।
রক্তমাখা হাতে ওই চলিছে বিজয়!
নয়নে আঁচল চাপি কমলা আবার --
সভয়ে মুদিয়া আঁখি স্থির হ'য়ে রয়।
আবার মেলিয়া আঁখি মুদিল নয়নে,
ছুটিয়া চলিল বালা যমুনার জলে--
আবার আইল ফিরি যুবার সদনে,
যুমনা-শীতল জলে ভিজায়ে আঁচলে।
যুবকের ক্ষত স্থানে বাঁধিয়া আঁচল
কমলা একেলা বসি রহিল তথায়--
এক বিন্দু পড়িল না নয়নের জল,
এক বারো বহিল না দীর্ঘশ্বাস-বায়।
তুলি নিল যুবকের মাথা কোল-'পরে--
একদৃষ্টে মুখপানে রহিল চাহিয়া।
নির্জ্জীব প্রতিমা-প্রায় না নড়ে না চড়ে,
কেবল নিশ্বাস মাত্র যেতেছে বহিয়া।
চেতন পাইয়া যুবা কহে কমলায়,
"যে ছুরীতে ছিঁড়িয়াছে জীবনবন্ধন
অধিক সুতীক্ষ্ণ ছুরী তাহা অপেক্ষায়
আগে হোতে প্রেমরজ্জু করেছে ছেদন।
বন্ধুর ছুরিকা-মাখা দ্বেষহলাহলে
করেছে হৃদয়ে দেহে আঘাত ভীষণ,
নিবেছে দেহের জ্বালা হৃদয়-অনলে--
ইহার অধিক আর নাইক মরণ!
বকুলের তলা হোক্ রক্তে রক্তময়!
মৃত্তিকা রঞ্জিত হোক্ লোহিত বরণে!
বসিবে যখন কাল হেথায় বিজয়
আচ্ছন্ন বন্ধুতা পুনঃ উদিবে না মনে?
মৃত্তিকার রক্তরাগ হোয়ে যাবে ক্ষয়--
বিজয়ের হৃদয়ের শোণিতের দাগ
আর কি কখনো তার হবে অপচয়?
অনুতাপ-অশ্রুজলে মুছিবে সে রাগ?
বন্ধুতার ক্ষীণ জ্যোতি প্রেমের কিরণে
(রবিকরে হীনভাতি নক্ষত্র যেমন)
বিলুপ্ত হয়েছে কি রে বিজয়ের মনে?
উদিত হইবে না কি আবার কখন?
একদিন অশ্রুজল ফেলিবে বিজয়!
একদিন অভিশাপ দিবে ছুরিকারে!
একদিন মুছিবারে হইতে হৃদয়
চাহিবে সে রক্তধারা অশ্রুবারিধারে!
কমলে! খুলিয়া ফেল আঁচল তোমার!
রক্তধারা যেথা ইচ্ছা হোক প্রবাহিত!
বিজয় শুধেছে আজি বন্ধুতার ধার
প্রেমেরে করায়ে পান বন্ধুর শোণিত!
চলিনু কমলা আজ ছাড়িয়া ধরায়--
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িয়া বন্ধন,
জলাঞ্জলি দিয়া পৃথিবীর মিত্রতায়,
প্রেমের দাসত্ব রজ্জু করিয়া ছেদন!"
অবসন্ন হোয়ে প'ল যুবক তখনি,
কমলার কোল হোতে পড়িল ধরায়!
উঠিয়া বিপিনবালা সবেগে অমনি
ঊর্দ্ধহস্তে কহে উচ্চ সুদৃঢ় ভাষায়--
"জলন্ত জগৎ! ওগো চন্দ্র সূর্য্য তারা!
দেখিতেছ চিরকাল পৃথিবীর নরে!
পৃথিবীর পাপ পুণ্য, হিংসা, রক্তধারা
তোমরাই লিখে রাখ জ্বলদ্ অক্ষরে!
সাক্ষী হও তোমরা গো করিও বিচার!--
তোমরা হও গো সাক্ষী পৃথ্বী চরাচর!
ব'হে যাও!-- ব'হে যাও যমুনার ধার,
নিষ্ঠুর কাহিনী কহি সবার গোচর!
এখনই অস্তাচলে যেও না তপন!
ফিরে এসো, ফিরে এসো তুমি দিনকর!
এই, এই রক্তধারা করিয়া শোষণ
লয়ে যাও, লয়ে যাও স্বর্গের গোচর!
ধুস্ নে যমুনাজল! শোণিতের ধারে!
বকুল তোমার ছায়া লও গো সরিয়ে!
গোপন ক'রো না উহা নিশীথ! আঁধারে!
জগৎ! দেখিয়া লও নয়ন ভরিয়ে!
অবাক হউক্ পৃথ্বী সভয়ে, বিস্ময়ে!
অবাক হইয়া যাক্ আঁধার নরক!
পিশাচেরা লোমাঞ্চিত হউক সভয়ে!
প্রকৃতি মুদুক ভয়ে নয়নপলক!
রক্তে লিপ্ত হয়ে যাক্ বিজয়ের মন!
বিস্মৃতি! তোমার ছায়ে রেখো না বিজয়ে;
শুকালেও হৃদিরক্ত এ রক্ত যেমন
চিরকাল লিপ্ত থাকে পাষাণ হৃদয়ে!
বিষাদ! বিলাসে তার মাখি হলাহল
ধরিও সমুখে তার নরকের বিষ!
শান্তির কুটীরে তার জ্বালায়ো অনল!
বিষবৃক্ষবীজ তার হৃদয়ে রোপিস্!
দূর হ-- দূর হ তোরা ভূষণ রতন!
আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!
আবার কবরি! তোরে করিনু মোচন!
আজিকে কমলা যে রে হোয়েছে বিধবা!
কি বলিস্ যমুনা লো! কমলা বিধবা!
জাহ্নবীরে বল্ গিয়ে "কমলা বিধবা'!
পাখী! কি করিস্ গান "কমলা বিধবা'!
দেশে দেশে বল্ গিয়ে "কমলা বিধবা'!
আয়! শুক ফিরে যা লো বিজন শিখরে,
মৃগদের বল্ গিয়া উঁচু করি গলা--
কুটীরকে বল্ গিয়ে, তটিনী,নির্ঝরে--
"বিধবা হয়েছে সেই বালিকা কমলা!'
উহুহু! উহুহু-- আর সহিব কেমনে?
হৃদয়ে জ্বলিছে কত অগ্নিরাশি মিলি।
বেশ ছিনু বনবালা, বেশ ছিনু বনে!--
নীরজা বলিয়া গেছে "জ্বালালি! জ্বলিলি'!"
শ্মশান
গভীর আঁধার রাত্রি শ্মশান ভীষণ!
ভয় যেন পাতিয়াছে আপনার আঁধার আসন!
সর সর মরমরে সুধীরে তটিনী বহে যায়।
প্রাণ আকুলিয়া বহে ধূমময় শ্মশানের বায়!
গাছপালা নাই কোথা প্রান্তর গম্ভীর!
শাখাপত্রহীন বৃক্ষ, শুষ্ক, দগ্ধ, উঁচু করি শির
দাঁড়াইয়া দূরে-- দূরে নিরখিয়া চারি দিক-পান
পৃথিবীর ধ্বংসরাশি, রহিয়াছে হোয়ে ম্রিয়মাণ?
শ্মশানের নাই প্রাণ যেন আপনার,
শুষ্ক তৃণরাজি তার ঢাকিয়াছে বিশাল বিস্তার!
তৃণের শিশির চুমি বহে নাকো প্রভাতের বায়
কুসুমের পরিমল ছড়াইয়া হেথায় হোথায়।
শ্মশানে আঁধার ঘোর ঢালিয়াছে বুক!
হেথা হোথা অস্থিরাশি ভস্মমাঝে লুকাইয়া মুখ!
পরশিয়া অস্থিমালা তটিনী আবার সরি যায়
ভস্মরাশি ধুয়ে ধুয়ে, নিভাইয়া অঙ্গারশিখায়!
বিকট দশন মেলি মানবকপাল--
ধ্বংসের স্মরণস্তূপ, ছড়াছড়ি দেখিতে ভয়াল!
গভীর আঁখিকোটর আঁধারেরে দিয়েছে আবাস,
মেলিয়া দশনপাঁতি পৃথিবীরে করে উপহাস!
মানবকঙ্কাল শুয়ে ভস্মের শয্যায়--
কাণের কাছেতে গিয়া বায়ু কত কথা ফুসলায়!
তটিনী কহিছে কাণে "উঠ! উঠ! উঠ নিদ্রা হোতে'
ঠেলিয়া শরীর তার ফিরে ফিরে তরঙ্গ-আঘাতে!
উঠ গো কঙ্কাল! কত ঘুমাইবে আর!
পৃথিবীর বায়ু এই বহিতেছে উঠ আরবার!
উঠ গো কঙ্কাল! দেখ স্রোতস্বিনী ডাকিছে তোমায়
ঘুমাইবে কত আর বিসর্জ্জন দিয়া চেতনায়!
বল না, বল না তুমি ঘুমাও কি বোলে?
কাল যে প্রেমের মালা পরাইয়াছিল এই গলে
তরুণী ষোড়শী বালা! আজ তুমি ঘুমাও কি বলে!
অনাথারে একাকিনী সঁপিয়া এ পৃথিবীর কোলে!
উঠ গো-- উঠ গো-- পুনঃ করিনু আহ্বান!
শুন, রজনীর কাণে ওই সে করিছে খেদ গান!
সময় তোমার আজো ঘুমাবার হয় নাই ত রে!
কোল বাড়াইয়া আছে পৃথিবীর সুখ তোমা-তরে!
তুমি গো ঘুমাও, আমি বলি না তোমারে!
জীবনের রাত্রি তব ফুরায়েছে নেত্রধারে-ধারে!
এক বিন্দু অশ্রুজল বরষিতে কেহ নাই তোর,
জীবনের নিশা আহা এত দিনে হইয়াছে ভোর!
ভয় দেখাইয়া আহা নিশার তামসে--
একটি জ্বলিছে চিতা, গাঢ় ঘোর ধূমরাশি শ্বসে!
একটি অনলশিখা জ্বলিতেছে বিশাল প্রান্তরে,
অসংখ্য স্ফুলিঙ্গকণা নিক্ষেপিয়া আকাশের 'পরে।
কার চিতা জ্বলিতেছে কাহার কে জানে?
কমলা! কেন গো তুমি তাকাইয়া চিতাগ্নির পানে?
একাকিনী অন্ধকারে ভীষণ এ শ্মশানপ্রদেশে
ভূষণবিহীনদেহে, শুষ্কমুখে, এলোথেলো কেশে?
কার চিতা জান কি গো কমলে জিজ্ঞাসি!
দেখিতেছ কার চিতা শ্মশানেতে একাকিনী আসি?
নীরদের চিতা? নীরদের দেহ অগ্নিমাঝে জ্বলে?
নিবায়ে ফেলিবে অগ্নি, কমলে, কি নয়নের জলে?
নীরব নিস্তব্ধ ভাবে কমলা দাঁড়ায়ে!
গভীর নিশ্বাসবায়ু উচ্ছ্বাসিয়া উঠে!
ধূমময় নিশীথের শ্মশানের বায়ে
এলোথেলো কেশরাশি চারি দিকে ছুটে!
ভেদি অমা নিশীথের গাঢ় অন্ধকার
চিতার অনলোত্থিত অস্ফুট আলোক
পড়িয়াছে ঘোর ম্লান মুখে কমলার,
পরিস্ফুট করিতেছে সুগভীর শোক!
নিশীথে শ্মশানে আর নাই জন প্রাণী,
মেঘান্ধ অমান্ধকারে মগ্ন চরাচর!
বিশাল শ্মশানক্ষেত্রে শুধু একাকিনী
বিষাদপ্রতিমা বামা বিলীন-অন্তর!
তটিনী চলিয়া যায় কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
নিশীথশ্মশানবায়ু স্বনিছে উচ্ছ্বাসে!
আলেয়া ছুটিছে হোথা আঁধার ভেদিয়া!
অস্থির বিকট শব্দ নিশার নিশ্বাসে!
শৃগাল চলিয়া গেল সমুচ্চে কাঁদিয়া
নীরব শ্মশানময় তুলি প্রতিধ্বনি!
মাথার উপর দিয়া পাখা ঝাপটিয়া
বাদুড় চলিয়া গেল করি ঘোরধ্বনি!
এ-হেন ভীষণ স্থানে দাঁড়ায়ে কমলা!
কাঁপে নাই কমলার একটিও কেশ!
শূন্যনেত্রে শূন্যহৃদে চাহি আছে বালা
চিতার অনলে করি নয়ননিবেশ!
কমলা চিতায় নাকি করিবে প্রবেশ?
বালিকা কমলা নাকি পশিবে চিতায়?
অনলে সংসারলীলা করিবি কি শেষ?
অনলে পুড়াবি নাকি সুকুমার কায়?
সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম হায়--
ছুটিতিস্ ফুল তুলে কাননে কাননে
ফুলে ফুল সাজাইয়া ফুলসম কায়--
দেখাতিস্ সাজসজ্জা পিতার সদনে!
দিতিস হরিণশৃঙ্গে মালা জড়াইয়া!
হরিণশিশুরে আহা বুকে লয়ে তুলি
সুদূর কাননভাগে যেতিস্ ছুটিয়া,
ভ্রমিতিস্ হেথা হোথা পথ গিয়া ভুলি!
সুধাময়ী বীণাখানি লোয়ে কোল-'পরে
সমুচ্চ হিমাদ্রিশিরে বসি শিলাসনে
বীণার ঝঙ্কার দিয়া মধুময় স্বরে
গাহিতিস্ কত গান আপনার মনে!
হরিণেরা বন হোতে শুনিয়া সে স্বর
শিখরে আসিত ছুটি তৃণাহার ভুলি!
শুনিত,ঘিরিয়া বসি ঘাসের উপর
বড় বড় আঁখিদুটি মুখ-পানে তুলি!
সেই যে বালিকা তোরে দেখিতাম বনে
চিতার অনলে আজ হবে তোর শেষ?
সুখের যৌবন হায় পোড়াবি আগুনে?
সুকুমার দেহ হবে ভস্ম-অবশেষ!
না, না, না, সরলা বালা, ফিরে যাই চল্
এসেছিলি যেথা হোতে সেই সে কুটীরে!
আবার ফুলের গাছে ঢালিবি লো জল!
আবার ছুটিবি গিয়ে পর্ব্বতের শিরে!
পৃথিবীর যাহা কিছু ভুলে যা লো সব,
নিরাশযন্ত্রণাময় পৃথ্বীর প্রণয়!
নিদারুণ সংসারে ঘোর কলরব,
নিদারুণ সংসারের জ্বালা বিষময়।
তুই স্বরগের পাখী পৃথিবীতে কেন!
সংসারকণ্টকবনে পারিজাত ফুল!
নন্দনের বনে গিয়া গাইবি খুলিয়া হিয়া,
নন্দনমলয়বায়ু করিবি আকুল।
আয় তবে ফিরে যাই বিজন শিখরে--
নির্ঝর ঢালিছে যেথা স্ফটিকের জল,
তটিনী বহিছে যথা কলকলস্বরে,
সুবাস নিশ্বাস ফেলে বনফুলদল!
বন-ফুল ফুটেছিলি ছায়াময় বনে,
শুকাইলি মানবের নিশ্বাসের বায়ে!
দয়াবয়ী বনদেবী শিশিরসেচনে
আবার জীবন তোরে দিবেন ফিরায়ে।
এখনো কমলা ওই রয়েছে দাঁড়িয়ে
জ্বলন্ত চিতার 'পরে মেলিয়ে নয়ন!
ওই রে সহসা ওই মূর্চ্ছিয়ে পড়িয়ে
ভস্মের শয্যার পরে করিল শয়ন!
এলায়ে পড়িল ভস্মে সুনিবিড় কেশ!
অঞ্চলবসন ভস্মে পড়িল এলায়ে!
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আলুথালু বেশ
কমলার বক্ষ হোতে, শ্মশানের বায়ে!
নিবে গেল ধীরে ধীরে চিতার অনল!
এখনো কমলা বালা মূর্চ্ছায় মগন!
শুকতারা উজলিল গগনের তল,
এখনো কমলা বালা স্তব্ধ অচেতন!
ওই রে কুমারী উষা বিলোল চরণে
উঁকি মারি পূর্ব্বাশার সুবর্ণ তোরণে
রক্তিম অধরখানি হাসিতে ছাইয়া
সিঁদুর প্রকৃতিভালে দিল পরাইয়া।
এখনো কমলা বালা ঘোর অচেতন,
কমলা-কপোল চুমে অরুণকিরণ!
গণিছে কুন্তলগুলি প্রভাতের বায়,
চরণে তটিনী বালা তরঙ্গ দুলায়!
কপোলে, আঁখির পাতে পড়েছে শিশির!
নিস্তেজ সুবর্ণকরে পিতেছে মিহির!
শিথিল অঞ্চলখানি লোয়ে ঊর্ম্মিমালা
কত কি-- কত কি কোরে করিতেছে খেলা!
ক্রমশঃ বালিকা ওই পাইছে চেতন!
ক্রমশঃ বালিকা ওই মেলিছে নয়ন!
বক্ষোদেশ আবরিয়া অঞ্চলবসনে
নেহারিল চারি দিক বিস্মিত নয়নে।
ভস্মরাশিসমাকুল শ্মশানপ্রদেশ!
মলিনা কমলা ছাড়া যেদিকে নেহারি
বিশাল শ্মশানে নাই সৌন্দর্য্যের লেশ,
জন প্রাণী নাই আর কমলারে ছাড়ি!
সূর্য্যকর পড়িয়াছে শুষ্কম্লানপ্রায়,
ভস্মমাখা ছুটিতেছে প্রভাতের বায়!
কোথাও নাই রে যেন আঁখির বিশ্রাম,
তটিনী ঢালিছে কাণে বিষাদের গান!
বালিকা কমলা ক্রমে করিল উত্থান
ফিরাইল চারি দিকে নিস্তেজ নয়ান।
শ্মশানের-ভস্ম-মাখা অঞ্চল তুলিয়া
যেদিকে চরণ চলে যাইল চলিয়া!
বিসর্জ্জন
আজিও পড়িছে ওই সেই সে নির্ঝর!
হিমাদ্রির বুকে বুকে শৃঙ্গে শৃঙ্গে ছুটে সুখে,
সরসীর বুকে পড়ে ঝর ঝর ঝর।
আজিও সে শৈলবালা বিস্তারিয়া ঊর্ম্মিমালা,
চলিছে কত কি কহি আপনার মনে!
তুষারশীতল বায় পুষ্প চুমি চুমি যায়,
খেলা করে মনোসুখে তটিনীর সনে।
কুটীর তটিনীতীরে লতারে ধরিয়া শিরে
মুখছায়া দেখিতেছে সলিলদর্পণে!
হরিণেরা তরুছায়ে খেলিতেছে গায়ে গায়ে,
চমকি হেরিছে দিক পাদপকম্পনে।
বনের পাদপপত্র আজিও মানবনেত্র
হিংসার অনলময় করে নি লোকন!
কুসুম লইয়া লতা প্রণত করিয়া মাথা
মানবেরে উপহার দেয় নি কখন!
বনের হরিণগণে মানবের শরাসনে
ছুটে ছুটে ভ্রমে নাই তরাসে তরাসে!
কানন ঘুমায় সুখে নীরব শান্তির বুকে,
কলঙ্কিত নাহি হোয়ে মানবনিশ্বাসে।
কমলা বসিয়া আছে উদাসিনী বেশে
শৈলতটিনীর তীরে এলোথেলো কেশে
অধরে সঁপিয়া কর, অশ্রু বিন্দু ঝর ঝর
ঝরিছে কপোলদেশে-- মুছিছে আঁচলে।
সম্বোধিয়া তটিনীরে ধীরে ধীরে বলে,
"তটিনী বহিয়া যাও আপনার মনে!
কিন্তু সেই ছেলেবেলা যেমন করিতে খেলা
তেমনি করিয়ে খেলো নির্ঝরের সনে!
তখন যেমন স্বরে কল কল গান করে
মৃদু বেগে তীরে আসি পড়িতে লো ঝাঁপি
বালিকা ক্রীড়ার ছলে পাথর ফেলিয়া জলে
মারিতাম-- জলরাশি উঠিত লো কাঁপি
তেমনি খেলিয়ে চল্ তুই লো তটিনীজল!
তেমনি বিতরি সুখ নয়নে আমার।
নির্ঝর তেমনি কোরে ঝাঁপিয়া সরসী-'পরে
পড়্ লো উগরি শুভ্র ফেনরাশিভার!
মুছিতে লো অশ্রুবারি এয়েছি হেথায়।
তাই বলি পাপিয়ারে! গান কর্ সুধাধারে
নিবাইয়া হৃদয়ের অনলশিখায়!
ছেলেবেলাকার মত বায়ু তুই অবিরত
লতার কুসুমরাশি কর্ লো কম্পিত!
নদী চল্ দুলে দুলে! পুষ্প দে হৃদয় খুলে!
নির্ঝর সরসীবক্ষ কর্ বিচলিত!
সেদিন আসিবে আর হৃদিমাঝে যাতনার
রেখা নাই, প্রমোদেই পূরিত অন্তর!
ছুটাছুটি করি বনে বেড়াইব ফুল্লমনে,
প্রভাতে অরুণোদয়ে উঠিব শিখর!
মালা গাঁথি ফুলে ফুলে জড়াইব এলোচুলে,
জড়ায়ে ধরিব গিয়ে হরিণের গল!
বড় বড় দুটি আঁখি মোর মুখপানে রাখি
এক দৃষ্টে চেয়ে রবে হরিণ বিহ্বল!
সেদিন গিয়েছে হা রে-- বেড়াই নদীর ধারে
ছায়াকুঞ্জে শুনি গিয়ে শুকদের গান!
না থাক্, হেথায় বসি, কি হবে কাননে পশি--
শুক আর গাবে নাকো খুলিয়ে পরাণ!
সেও যে গো ধরিয়াছে বিষাদের তান!
জুড়ায়ে হৃদয়ব্যথা দুলিবে না পুষ্পলতা,
তেমন জীবন্ত ভাবে বহিবে না বায়!
প্রাণহীন যেন সবি-- যেন রে নীরব ছবি--
প্রাণ হারাইয়া যেন নদী বহে যায়!
তবুও যাহাতে হোক্ নিবাতে হইবে শোক,
তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল!
তবুও ত আপনারে ভুলিতে হইবে হা রে!
তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!
যাই তবে বনে বনে ভ্রমিগে আপনমনে,
যাই তবে গাছে গাছে ঢালি দিই জল!
শুকপাখীদের গান শুনিয়া জুড়াই প্রাণ,
সরসী হইতে তবে তুলিগে কমল!
হৃদয় নাচে না ত গো তেমন উল্লাসে!
ভ্রমিত ভ্রমিই বনে ম্রিয়মাণ শূন্যমনে,
দেখি ত দেখিই বোসে সলিল-উচ্ছ্বাসে!
তেমন জীবন্ত ভাব নাই ত অন্তরে--
দেখিয়া লতার কোলে ফুটন্ত কুসুম দোলে,
কুঁড়ি লুকাইয়া আছে পাতার ভিতবে--
নির্ঝরের ঝরঝরে হৃদয়ে তেমন কোরে
উল্লাসে শোণিতরাশি উঠে না নাচিয়া!
কি জানি কি করিতেছি, কি জানি কি ভাবিতেছি,
কি জানি কেমনধারা শূন্যপ্রায় হিয়া!
তবুও যাহাতে হোক্ নিবাতে হইবে শোক,
তবুও মুছিতে হবে নয়নের জল।
তবুও ত আপনারে ভুলিতে হইবে হা রে,
তবুও নিবাতে হবে হৃদয়-অনল!
কাননে পশিগে তবে শুক যেথা সুধারবে
গান করে জাগাইয়া নীরব কানন।
উঁচু করি করি মাথা হরিণেরা বৃক্ষপাতা
সুধীরে নিঃশঙ্কমনে করিছে চর্ব্বণ!"
সুন্দরী এতেক বলি পশিল কাননস্থলী,
পাদপ রৌদ্রের তাপ করিছে বারণ।
বৃক্ষছায়ে তলে তলে ধীরে ধীরে নদী চলে
সলিলে বৃক্ষের মূল করি প্রক্ষালন।
হরিণ নিঃশঙ্কমনে শুয়ে ছিল ছায়াবনে,
পদশব্দ পেয়ে তারা চমকিয়া উঠে।
বিস্তারি নয়নদ্বয় মুখপানে চাহি রয়,
সহসা সভয় প্রাণে বনান্তরে ছুটে।
ছুটিছে হরিণচয়, কমলা অবাক্ রয়--
নেত্র হতে ধীরে ধীরে ঝরে অশ্রুজল।
ওই যায়-- ওই যায় হরিণ হরিণী হায়--
যায় যায় ছুটে ছুটে মিলি দলে দল।
কমলা বিষাদভরে কহিল সমুচ্চস্বরে--
প্রতিধ্বনি বন হোতে ছুটে বনান্তরে--
"যাস্ নে-- যাস্ নে তোরা, আয় ফিরে আয়!
কমলা-- কমলা সেই ডাকিতেছে তোরে!
সেই যে কমলা সেই থাকিত কুটীরে,
সেই যে কমলা সেই বেড়াইত বনে!
সেই যে কমলা পাতা ছিঁড়ি ধীরে ধীরে
হরষে তুলিয়া দিত তোদের আননে!
কোথা যাস্-- কোথা যাস্-- আয় ফিরে আয়!
ডাকিছে তোদের আজি সেই সে কমলা!
কারে ভয় করি তোরা যাস্ রে কোথায়?
আয় হেথা দীর্ঘশৃঙ্গ! আয় লো চপলা!
এলি নে-- এলি নে তোরা এখনো এলি নে--
কমলা ডাকিছে যে রে,তবুও এলি নে!
ভুলিয়া গেছিস্ তোরা আজি কমলারে?
ভুলিয়া গেছিস্ তোরা আজি বালিকারে?
খুলিয়া ফেলিনু এই কবরীবন্ধন,
এখনও ফিরিবি না হরিণের দল?
এই দেখ্-- এই দেখ্ ফেলিয়া বসন
পরিনু সে পুরাতন গাছের বাকল!
যাক্ তবে, যাক্ চ'লে-- যে যায় যেখানে--
শুক পাখী উড়ে যাক্ সুদূর বিমানে!
আয়-- আয়-- আয় তুই আয় রে মরণ!
বিনাশশক্তিতে তোর নিভা এ যন্ত্রণা!
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!
বহিতে অনল হৃদে আর ত পারি না!
নীরদ স্বরগে আছে, আছেন জনক
স্নেহময়ী মাতা মোর কোল রাখি পাতি--
সেথায় মিলিব গিয়া, সেথায় যাইব--
ভোর করি জীবনের বিষাদের রাতি!
নীরদে আমাতে চড়ি প্রদোষতারায়
অস্তগামী তপনেরে করিব বীক্ষণ,
মন্দাকিনী তীরে বসি দেখিব ধরায়
এত কাল যার কোলে কাটিল জীবন।
শুকতারা প্রকাশিবে উষার কপোলে
তখন রাখিয়া মাথা নীরদের কোলে--
অশ্রুজলসিক্ত হয়ে কব সেই কথা
পৃথিবী ছাড়িয়া এনু পেয়ে কোন্ ব্যথা!
নীরদের আঁখি হোতে ব'বে অশ্রুজল!
মুছিব হরষে আমি তুলিয়া আঁচল!
আয়-- আয়-- আয় তুই, আয় রে মরণ!
পৃথিবীর সাথে সব ছিঁড়িব বন্ধন!"
এত বলি ধীরে ধীরে উঠিল শিখর!
দেখে বালা নেত্র তুলে--
চারি দিক গেছে খুলে
উপত্যকা, বনভূমি, বিপিন, ভূধর!
তটিনীর শুভ্র রেখা--
নেত্রপথে দিল দেখা--
বৃক্ষছায়া দুলাইয়া ব'হে ব'হে যায়!
ছোট ছোট গাছপালা--
সঙ্কীর্ণ নির্ঝরমালা--
সবি যেন দেখা যায় রেখা-রেখা-প্রায়।
গেছে খুলে দিগ্বিদিক--
নাহি পাওয়া যায় ঠিক
কোথা কুঞ্জ-- কোথা বন-- কোথায় কুটীর!
শ্যামল মেঘের মত--
হেথা হোথা কত শত
দেখায় ঝোপের প্রায় কানন গভীর!
তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!
মাথায় জলদ ঠেকে,
চরণে চাহিয়া দেখে
গাছপালা ঝোপে-ঝাপে ভূধর আবরি!
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা-রেখা
হেথা হোথা যায় দেখা
কে কোথা পড়িয়া আছে কে দেখে কোথায়!
বন, গিরি, লতা, পাতা আঁধারে মিশায়!
অসংখ্য শিখরমালা ব্যাপি চারি ধার--
মধ্যের শিখর-'পরে
(মাথায় আকাশ ধরে)
কমলা দাঁড়ায়ে আছে, চৌদিকে তুষার!
চৌদিকে শিখরমালা--
মাঝেতে কমলা বালা
একেলা দাঁড়ায়ে মেলি নয়নযুগল!
এলোথেলো কেশপাশ,
এলোথেলো বেশবাস,
তুষারে লুটায়ে পড়ে বসন-আঁচল!
যেন কোন্ সুরবালা
দেখিতে মর্ত্ত্যের লীলা
স্বর্গ হোতে নামি আসি হিমাদ্রিশিখরে
চড়িয়া নীরদ-রথে--
সমুচ্চ শিখর হোতে
দেখিলেন পৃথ্বীতল বিস্মিত অন্তরে!
তুষাররাশির মাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!
হিমময় বায়ু ছুটে,
অন্তরে অন্তরে ফুটে
হৃদয়ে রুধিরোচ্ছ্বাস স্তব্ধপ্রায় করি!
শীতল তুষারদল
কোমল চরণতল
দিয়াছে অসাড় ক'রে পাষাণের মত!
কমলা দাঁড়ায়ে আছে যেন জ্ঞানহত!
কোথা স্বর্গ-- কোথা মর্ত্ত্য-- আকাশ পাতাল!
কমলা কি দেখিতেছে!
কমলা কি ভাবিতেছে!
কমলার হৃদয়েতে ঘোর গোলমাল!
চন্দ্র সূর্য্য নাই কিছু--
শূন্যময় আগু পিছু!
নাই রে কিছুই যেন ভূধর কানন!
নাইক শরীর দেহ,
জগতে নাইক কেহ--
একেলা রয়েছে যেন কমলার মন!
কে আছে-- কে আছে-- আজি কর গো বারণ!
বালিকা ত্যজিতে প্রাণ করেছে মনন!
বারণ কর গো তুমি গিরি হিমালয়!
শুনেছ কি বনদেবী-- করুণা-আলয়--
বালিকা তোমার কোলে করিত ক্রন্দন,
সে নাকি মরিতে আজ করেছে মনন?
বনের কুসুমকলি
তপনতাপনে জ্বলি
শুকায়ে মরিবে নাকি করেছে মনন!
শীতল শিশিরধারে
জীয়াও জীয়াও তারে
বিশুষ্ক হৃদয়মাঝে বিতরি জীবন!
উদিল প্রদোষতারা সাঁঝের আঁচলে--
এখনি মুদিবে আঁখি?
বারণ করিবে না কি?
এখনি নীরদকোলে মিশাবে কি বোলে?
অনন্ত তুষারমাঝে দাঁড়ায়ে সুন্দরী!
মোহস্বপ্ন গেছে ছুটে--
হেরিল চমকি উঠে
চৌদিকে তুষাররাশি শিখর আবরি!
উচ্চ হোতে উচ্চ গিরি
জলদে মস্তক ঘিরি
দেবতার সিংহাসন করিছে লোকন!
বনবালা থাকি থাকি
সহসা মুদিল আঁখি
কাঁপিয়া উঠিল দেহ! কাঁপি উঠে মন!
অনন্ত আকাশমাঝে একেলা কমলা!
অনন্ত তুষারমাঝে একেলা কমলা!
সমুচ্চ শিখর-'পরে একেলা কমলা!
আকাশে শিখর উঠে
চরণে পৃথিবী লুটে--
একেলা শিখর-'পরে বালিকা কমলা!
ওই-- ওই-- ধর্-- ধর্-- পড়িল বালিকা!
ধবলতুষারচ্যুতা পড়িল বিহ্বল!--
খসিল পাদপ হোতে কুসুমকলিকা!
খসিল আকাশ হোতে তারকা উজ্জ্বল!
প্রশান্ত তটিনী চলে কাঁদিয়া কাঁদিয়া!
ধরিল বুকের পরে কমলাবালায়!
উচ্ছ্বাসে সফেন জল উঠিল নাচিয়া!
কমলার দেহ ওই ভেসে ভেসে যায়!
কমলার দেহ বহে সলিল-উচ্ছ্বাস!
কমলার জীবনের হোলো অবসান!
ফুরাইল কমলার দুখের নিঃশ্বাস,
জুড়াইল কমলার তাপিত পরাণ!
কল্পনা! বিষাদে দুখে গাইনু সে গান!
কমলার জীবনের হোলো অবসান!
দীপালোক নিভাইল প্রচণ্ড পবন!
কমলার-- প্রতিমার হ'ল বিসর্জ্জন!
আরো দেখুন