সোহং সোহং সোহং।

ব'সে ব'সে আওড়াচ্ছ কী।

গুরুমন্ত্র।

কতদূর এগোলো।

ঐ আমার ছিঁচকাঁদুনি খুকিটার কীর্তি। মন্তরটা গুরগুর করতে করতে দিব্যি উঠেছিল উপরের দিকে ঠেলে। বোধ হয় আর সিকি ইঞ্চি হলেই পিঙ্গলার মধ্যে ঢুকে পড়ত, এমন সময় মেয়েটা নাকিসুরে চীৎকার করে উঠল-- বাবা, নচঞ্চুস্‌। দিলুম ঠাস করে গালে এক চড়, ভ্যাঁ করে উঠল কেঁদে, অমনি এক চমকে মন্তরটা নেমে পড়ল পিঙ্গলার মুখ থেকে একেবারে নাভীগহ্বর পর্যন্ত। সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।

তোমার গুরুর মন্তরটা কি অজীর্ণরোগের মতো। নাড়ির মধ্যে গিয়ে--

হাঁ দিদি, নাড়ির মধ্যে ঘুটঘাট ঘুটঘাট করছেই-- ওটা বায়ু কিনা।

বায়ু নাকি।

তা না তো কী। শব্দব্রহ্ম-- ওতে বায়ু ছাড়া আর কিছুই নেই। ঋষিরা যখন কেবলই বায়ু খেতেন তখন কেবলই বানাতেন মন্তর।

বল কী।

নইলে অতটা বায়ু জমতে দিলে পেট যেত ফেটে। নাড়ী যেত পটপট করে ছিঁড়ে বিশখানা হয়ে।

উঃ, তাই তো বটে-- একেবারে চার বেদ-ভরা মন্ত্র-- কম হাওয়া তো লাগে নি।

শুনলেই তো বুঝতে পার, ঐ-যে ও--ম্‌, ওটা তো নিছক বায়ু-উদ্‌গার। পুণ্যবায়ু, জগৎ পবিত্র করে।

এত সব জ্ঞানের কথা পেলে কোথা থেকে। আমরা হলে তো পাগল হয়ে যেতুম।

সবই গুরুর মুখ থেকে। তিনি বলেন, কলিতে গুরুর মুখই গোমুখী-- মন্ত্রগঙ্গা বেরচ্ছে কল্‌কল্‌ করে।

বি| এ| তে সংস্কৃতে অনার্স্‌ নিয়ে খেটে মরেছি মিথ্যে। অজীর্ণ রোগেও ভুগেছি, সেটা কিন্তু পাকযন্ত্রের, ইড়াপিঙ্গলার নয়।

এতেই বুঝে নাও-- গুরুর কৃপা। তাই তো আমার নাড়ির মধ্যে মন্তরটা প্রায়ই ডাক ছাড়ে গুরু গুরু গুরু শব্দে।

আচ্ছা, ডাকটা কি আহারের পরে বাড়ে।

তা বাড়ে বটে।

গুরু কী বলেন।

তিনি বলেন, পেটের মধ্যে স্থূলে সূক্ষ্মে লড়াই, যেন দেবে দৈত্যে। খাদ্যের সঙ্গে মন্ত্রের বেধে যায় যেন গোলাগুলি-বর্ষণ, নাড়িগুলো উচ্চস্বরে গুরুকে স্মরণ করতে থাকে।

দুঃখের কথা আর কী বলব দিদি, পেটের মধ্যে গুরুর স্মরণ চলছে, বাইরেও বিরাম নেই। চরণদাস বাবাজি আছেন ওঁর গুরুভাই, সে লোকটার দয়ামায়া নেই, ওঁকে গান শেখাচ্ছেন। পাড়ার লোকেরা--

চুপ চুপ চুপ, পতিব্রতা তুমি। স্বামীর কণ্ঠ যখন চলে, সাধ্বীরা প্রাণপণে থাকেন নীরবে। ফকিরদা, গলায় গান শানাচ্ছ কেন, গান্ধিজির অহিংসানীতির কথা শোন নি।

তোমরা দুজনে তত্ত্বকথা নিয়ে থাকো। আমাকে যেতে হবে মাছ কুটতে। আমি চললুম।

আমার কথাটা বুঝিয়ে বলি। গুরুর মন্ত্র, যাকে বলে গুরুপাক। খুব বেশি যখন জমে ওঠে অন্তরে, তখন সমস্ত শরীরটা ওঠে পাক দিয়ে; নাচের ঘূর্ণি উঠতে থাকে পায়ের তলা থেকে উপরের দিকে; আর, ঘানি ঘুরলে যেরকম আওয়াজ দিতে চায়, ভক্তির ঘোরে সেইরকম গানের আওয়াজ ওঠে গলার ভিতর দিয়ে। এই দেখো-না এখনি সাধনার নাড়া লেগেছে একেবারে মূলাধার থেকে--উঃ!

কী সর্বনাশ! ডাক্তার ডাকব নাকি।

কিছু করতে হবে না। একবার পেট ভরে নেচে নিতে হবে। গুরু বলেছেন, গুরুর মন্ত্রটা হল ধারক, আর নৃত্যটা হল সারক, দুটোরই খুব দরকার। (উঠে দাঁড়িয়ে নৃত্য)

গুরুচরণ করো শরণ-অ

ভবতরঙ্গ হবে তরণ-অ

সুধাক্ষরণ প্রাণভরণ-অ

মরণভয় হবে হরণ-অ।

শুধু মরণভয়-হরণ নয়, দাদা। গুরুদক্ষিণার চোটে স্ত্রীর গয়না,বাপের তহবিল-হরণও চলছে পুরো দমে।

ঐ দেখো, বাবা আসছেন বৌকে নিয়ে। বড়ো ব্যাঘাত, বড়ো ব্যাঘাত। গুরো।

ব্যাঘাতটা কিসের।

স্থূলরূপে ওঁরা আমাকে ফকির বলেই জানেন।

আরো একটা রূপ আছে না কি।

ক্ষয় হয়ে গেছে আমার ফকির-দেহটা ভিতরে ভিতরে। কেবলই মিলে যাচ্ছে গুরুদেহের সূক্ষ্মরূপে। বাইরে পড়ে আছে খোলসটা মাত্র। ওঁরা আসলটাকে কিছুতেই দেখবেন না।

খোলসটা যে অত্যন্ত বেশি দেখা যাচ্ছে। একেবারেই স্বচ্ছ নয়।

দৃষ্টিশুদ্ধি হতে দেরি হয়। কিন্তু সব আগে চাই বিশ্বাসটা। ভগবৎকৃপায় এঁদের মনে যদি কখনো বিশ্বাস জাগে, তা হলে গুরুদেহে আর ফকিরের দেহে একেবারে অভেদ রূপ দেখতে পাবেন-- তখন বাবা--

তখন বাবা গয়ায় পিণ্ডি দিতে বেরবেন।

(হৈমর প্রতি) বেয়াই ব্যাঙ্কে তোমার নামে কিছু টাকা রেখে গেছেন। ফকির সেটা জানে, তাই তো ওর কিছু হল না।

আর কী হলে আর কী হত, সে ভাবতে গেলে মাথা ধরে যায়।

ম্যাকিননের হেড্‌বাবু আমার বন্ধুর শ্যালীপতি, সে বলেছিল, ফকির যা-হয় একটা কিছু পাস করলেই তাকে এসিস্টেণ্ট স্টোর্‌কীপার করে দেবে। বাঁদরটা কেবল জেদ করেই বারে বারে ফেল করতে লাগল।

ফেল করবার বিশ্রী জেদ আরো অনেক ছেলের দেখেছি। মিত্তিরদের বাড়ির মোতিলাল আমার সঙ্গে একসঙ্গেই পড়া আরম্ভ করেছিল। ম্যাট্রিকের এ পারের খোঁটা এমনি বিষম জেদ করে আঁকড়িয়ে রইল, ওর পিসেমশায় ওর কানে ধরে ঝিঁকে মারতে মারতে কান প্রায় ছিঁড়ে দিলেন কিন্তু পার করতে পারলেন না। চল্‌ ভাই হৈমি, পড়া করবি আয়-- স্বামীর হয়ে পাস করার কাজটা তুই সেরে রাখবি চল্‌।

যাও পড়তে, কিন্তু শোনো মা,-- ফকির টাকা চাইলেই তুমি ওকে দাও কেন।

কী করব বাবা, টাকা টাকা করে উনি বড়ো অশান্তি বাধান।

ঐ দেখো-না, একটা রোঁওয়া-ওঠা বাঘের চামড়ার উপর বসে বিড়বিড় করে বকছে। এই ফকির, শুনে যা, বাঁদর। শুনে যা বলছি।

মেসোমশায়, তোমার বুঝি সাহস হয় না ওকে ওর গণ্ডিটা থেকে টেনে আনতে!

সত্যি কথা বলি, মা, ভয়-ভয় করে। ওর সব মন্তর-তন্তর ঠিক যে মানি তাও নয়, আবার না মানবার মতো বুকের পাটাও নেই। দেখো-না, ওখানটায় কিরকম খুদে পাগলা-গারদ সাজিয়েছে। গুরু কবে পাঁঠা খেয়েছিল, তার মুড়োর খুলিটা রেখেছে পশমের আসনে।

ঐ জায়গাটাকে ও নাম দিয়েছে মোক্ষধাম। গুরুর সিগারেট-খাওয়া দেশলাই-কাঠিগুলো কাটা কাঁচকলার টুকরোর উপর পুঁতে পুঁতে গণ্ডি বানিয়েছে। ও বলে, কাঠিগুলোর আলো কিছুতেই নেবে না, যার দিব্যদৃষ্টি আছে সে চোখ বুজলেই দেখতে পায়। গুরুর একটা চা সেটের ভাঙা পিরিচ এনেছে, সেটার প্রতিষ্ঠা হয়েছে গুরুর বর্মা চুরুটের প্যাকবাক্সে। গুরু ভালোবাসেন সাড়ে আঠারো ভাজা, কিনে এনে নৈবেদ্য দেয় ঐ পিরিচ ভরে। বলে, ঐ পিরিচে যে পেয়ালা ছিল এক কালে, তার অদৃশ্যরূপ গুরুর অদৃশ্য প্রসাদ ঢালতে থাকে। মোক্ষধাম ভরে যায় দার্জিলিং চায়ের গন্ধে।

আচ্ছা মা, ঐ বড়ো বড়ো বোতলগুলো কী করতে সাজিয়ে রেখেছে! ওর মধ্যে গুরুর ফীভার-মিক্‌শ্চারের অদৃশ্যরূপ ভরে রেখেছে না কি!

বল্‌-না হৈমি, ওগুলো কিসের জন্যে।

দক্ষিণা পেলেই গুরু তালপাতার উপর গীতার শ্লোক লিখে সেগুলো জল দিয়ে ধুয়ে দেন। গীতা-ধোওয়া জলে ঐ বোতলগুলো ভরা। তিন সন্ধে স্নান করে তিন চুমুক করে খান। ওঁর বিশ্বাস, ওঁর রক্তে গীতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আমার সংসার-খরচের দশ টাকার পাঁচখানা নোট ঐ বন্যায় গেছে ভেসে। যাই, আমার কাজ আছে।

ওরে ও ফক্‌রে!

আচ্ছা, আমি ওকে নিয়ে আসছি। (কাছের দিকে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে) ও ফকিরদা, করেছ কী!

কেন, কী হয়েছে।

গুরু হাঁসের ডিমের বড়া খেয়েছিলেন, তার খোলাটা পড়ে গেছে তোমার চাদর থেকে বারান্দার কোণে।

(লাফ দিয়ে উঠে) এঃ ছি ছি, করেছি কী!

হতভাগা হাঁসটাকে পর্যন্ত বঞ্চিত করলে তুমি! সে তোমার পিছনে পিছনে প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে যেত বৈকুণ্ঠধামে-- সেখানে পাড়ত স্বর্গীয় ডিম।

(বেরিয়ে এসে খোলাটা নিয়ে বারবার মাথায় ঠেকালে) ক্ষমা কোরো গুরু, ক্ষমা কোরো-- এ অণ্ড জগদ্‌ব্রহ্মাণ্ডের বিগ্রহ; এর মধ্যে আছে চন্দ্র সূর্য, আছে লোকপাল দিকপালরা সবাই। গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে আনিগে।

(চাদর চেপে ধ'রে) এনো, এখন তোমার বাবার কথাটা শুনে নাও।

বাপু, ভক্তিটা খাটো করে আমার উক্তিটা মানো।

কী আদেশ করেন।

আর-একবার পাস করবার চেষ্টা করে দেখো।

পারব না, বাবা।

কী পারবি নে। পাস করতে না পাস করবার চেষ্টা করতে?

চেষ্টা আমার দ্বারা হবে না।

কেন হবে না।

গুরুজি বলেন, পাশ শব্দের অর্থ বন্ধন। প্রথমে পাস, তার পরেই চাকরি।

লক্ষ্মীছাড়া! কী করে চলবে তোমার! আমার পেন্সেনের উপর? আমি কি তোমাকে খাওয়াবার জন্যে অমর হয়ে থাকব। একাট কথা জিজ্ঞাসা করি-- বৌমার কাছে টাকা চাইতে তোর লজ্জা করে না? পুরুষমানুষ হয়ে স্ত্রীর কাছে কাঙালপনা!

আমি নিজের জন্যে এক পয়সা নিই নে।

তবে নিস্‌ কার জন্যে।

ওঁরই সদ্‌গতির জন্যে।

বটে? তার মানে?

আমি তো সবই নিবেদন করি গুরুজির ভোগে। তার ফলের অংশ উনিও পাবেন।

অংশ পাবেন বটে! উনিই ফল পাবেন আঁঠিসুদ্ধ। ছেলেপুলেরা মরবে শুকিয়ে।

আমি কিছুই জানি নে। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে) যা করেন গুরু।

বেরো, বেরো আমার সামনে থেকে লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর। তোর মুখ দেখতে চাই নে।

কা তব কান্তা--

কী বকছ।

কা তব কান্তা। কোন্‌ কান্তা হ্যায়।

হিন্দুস্থানী ধরেছ? বাংলায় বলো।

বলি, কাঁদছে কে।

তোমারই মেয়ে মিন্তু।

হায় রে, একেই বলে সংসার। কাঁদিয়ে ভাসিয়ে দিলে।

কাকে বলে সংসার।

তোমাকে।

আর, তুমি কী! মুক্তির জাহাজ আমার! তোমরা বাঁধ না, আমরাই বাঁধি!

গুরু বলেছেন, বাঁধন তোমাদেরই হাতে।

আমি তোমাকে যদি বেঁধে থাকি সাত পাকে, তোমার গুরু বেঁধেছেন সাতান্ন পাকে।

মেয়েমানুষ-- কী বুঝবে তুমি তত্ত্বকথা! কামিনী কাঞ্চন--

দেখো, ভণ্ডামি কোরো না। কাঞ্চনের দাম তোমার গুরুজি কতখানি বোঝেন সে আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর, কামিনীর কথা বলছ! ঐ মূর্খ কামিনীগুলোই পায়ের ধুলো নিয়ে পায়ে কাঞ্চন যদি না ঢালত তা হলে তোমার গুরুজির পেট অত মোটা হত না। একটা খবর তোমাকে দিয়ে রাখি। এ বাড়ি থেকে একটা মায়া তোমার কাটবে। কাঞ্চনের বাঁধন খসল তোমার। শ্বশুরমশায় আমাকে দিব্যি গালিয়ে নিয়েছেন, আমার মাসহারা থেকে তোমাকে এক পয়সাও আর দিত পারব না।

ফকিরদা! মানে কী। তোমার শোবার ঘর থেকে পাওয়া গেল মাণ্ডূক্যোপনিষৎ! অনিদ্রার পাঁচন না কি!

(ঈষৎ হেসে) তোমরা কী বুঝবে-- মেয়েমানুষ!

কৃপা করে বুঝিয়ে দিতে দোষ কী!

কী জানি ভাই, ওখানা উনি বালিশের নীচে রেখে রাত্তিরে ঘুমোন।

বেদমন্ত্রগুলোকে তলিয়ে দেন ঘুমের তলায়। এ বই পড়তে গেলে যে তোমাকে ফিরে যেতে হবে সাতজন্ম পূর্বে।

গুরুকৃপায় আমাকে পড়তে হয় না।

ঘুমিয়ে পড়তে হয়।

এই পুঁথি হাতে তুলে নিয়ে তিনি এর পাতায় পাতায় ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন, জ্বলে উঠেছে এর আলো, মলাট ফুঁড়ে জ্যেতি বেরতে থাকে অক্ষরের ফাঁকে ফাঁকে, ঢুকতে থাকে সুষুম্না নাড়ির পাকে পাকে।

সেজন্যে ঘুমের দরকার?

খুবই। আমি স্বয়ং দেখেছি গুরুজিকে, দুপুরবেলা আহারের পর ভগবদগীতা পেটের উপর নিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়-- গভীর নিদ্রা। বারণ করে দিয়েছেন সাধনায় ব্যাঘাত করতে। তিনি বলেন, ইড়াপিঙ্গলার মধ্য দিয়ে শ্লোকগুলো অন্তরাত্মায় প্রবেশ করতে থাকে, তার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। অবিশ্বাসীরা বলে, নাক ডাকে। তিনি হাসেন; বলেন, মূঢ়দের নাক ডাকে, ইড়াপিঙ্গলা ডাকে জ্ঞানীদের-- নাসারন্ধ# আর ব্রহ্মরন্ধ# ঠিক এক রাস্তায়, যেন চিৎপুর আর চৌরঙ্গী।

ভাই হৈমি, ফকিরদার ইড়াপিঙ্গলা আজকাল কী রকম আওয়াজ দিচ্ছে।

খুব জোরে। মনে হয়, পেটের মধ্যে তিনটে চারটে ব্যাঙ মরীয়া হয়ে উঠেছে।

ঐ দেখো, শুনলে পুষ্পদিদি? আশ্চর্য ব্যাপার! সত্যি কথা না জেনেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। গুরুজি বলে দিয়েছেন, মাণ্ডূক্য উপনিষদের ডাকটাই হচ্ছে ব্যাঙের ডাক। অন্তরাত্মা চরম অবস্থায় নাভীগহ্বরে প্রবেশ করে হয়ে পড়েন, কূপমণ্ডূক, চার দিকে কিছুতেই আর নজর পড়ে না। তখনি পেটের মধ্যে কেবলই শিবোহং শিবোহং শিবোহং করে নাড়িগুলো ডাক ছাড়তে থাকে। সেই ঘুমেতে কী গভীর আনন্দ সে আমিই জানি-- যোগনিদ্রা একেই বলে।

একদিন মিন্তু কেঁদে উঠে ওঁর সেই ব্যাঙডাকা ঘুম ভাঙিয়ে দিতেই তাকে মেরে খুন করেন আর কি।

ফকিরদা, সংস্কৃতে অনার্স নিয়েছিলুম, আমাকে পড়তে হয়েছিল মাণ্ডূক্যের কিছু কিছু। নাকের মধ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে হেঁচে হেঁচে ঘুম ভাঙিয়ে রাখতে হত। হাঁচির চোটে নিরেট ব্রহ্মজ্ঞানের বারো আনা তরল হয়ে নাক দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। ইড়াপঙ্গলা রইল বেকার হয়ে। অভাগিনী আমি, গুরুর ফুঁয়ের জোরে অজ্ঞানসমুদ্র পার হতে পারলেম না।

(ঈষৎ হেসে) অধিকারভেদ আছে।

আছে বই কি। দেখো-না, ঐ শাস্ত্রেই ঋষি কোন্‌-এক শিষ্যকে দেখিয়ে বলেছেন, সোয়মাত্মা চতুষ্পাৎ-- এর আত্মাটা চার-পা-ওয়ালা। অধিকারভেদকেই তো বলে দু-পা চার-পায়ের ভেদ। হৈম, রাত্রে তো ব্যাঙের ডাক শুনে জেগে থাকিস, আর কোনো জাতের ডাক শুনিস কি দিনের বেলায়।

কী জানি ভাই, মিন্তু দৈবাৎ ওঁর মন্ত্রপড়া জলের ঘটি উলটিয়ে দিতেই উনি যে হাঁক দিয়ে উঠেছিলেন সেটা--

হাঁ, সেটা চারপেয়ে ডাক। মিলছে এই শাস্ত্রের সঙ্গে।

সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।

ফকিরদা, তপস্যা যখন ভেঙেছিল শিব এসেছিলেন তাঁর বরদাত্রীর কাছে-- তোমার তপস্যা এবার গুটিয়ে নাও; এই দেখো, বরদাত্রী অপেক্ষা করে আছেন লালপেড়ে শাড়িখানি পরে।

পুষ্পদিদি, বরদাত্রীর জন্যে ভাবনা নেই; পাড় দেখা দিচ্ছে রঙ-বেরঙের।

বুঝেছি, গেরুয়া রঙের ছটা বুঝি ঘরের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে?

এরই মধ্যে আসতে আরম্ভ করেছেন দুটি একটি করে বরদাত্রী। গেরুয়া রঙের নেশা মেয়েরা সামলাতে পারে না। পোড়াকপালীদের মরণদশা আর কি! সেদিন এসেছিল একজন বেহায়া মেয়ে ওঁর কাছে মুক্তিমন্ত্র নেবে ব'লে। হবি তো হ, আমারই ঘরে এসে পড়েছিল-- দুটো-একটা খাঁটি কথা শুনিয়েছিলুম, মুক্তিমন্ত্রেরই কাজ করেছিল, গেল মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বেরিয়ে।

দেখো, আমার মাণ্ডূক্যটা দাও।

কী করবে।

নারীর হাত লেগেছে, গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে আনিগে।

সেই ভালো, বুদ্ধি দিয়ে ধোওয়াটা তো হল না এ জন্মে।

শুনে যাও, হৈম। আজকে গুরুগৃহে নবরত্নদান ব্রত। আমি তাঁকে দেব সোনা, একটা গিনি চাই।

দিতে পারব না, শ্বশুরমশায় পা ছুঁইয়ে বারণ করেছেন।

তোমার গুরুজির বুঝি কাঞ্চনে অরুচি নেই!

তাঁর মহিমা কী বুঝবে তোমরা! কাঞ্চন পড়তে থাকে তাঁর ঝুলির মধ্যে আর তিনি চোখ বুজে বলেন-- হুং ফট্‌। বাস্‌, একেবারে ছাই হয়ে যায়। যারা তাঁর ভক্ত তাদের এ স্বচক্ষে দেখা।

ঝুলিতে যদি ছাই ভরবারই দরকার থাকে, কাঠের ছাই আছে, কয়লার ছাই আছে, সোনার ছাই দিয়ে বোকামি কর কেন।

হায় রে, এইটেই বুঝলে না! গুরুজি বলেছেন, মহাদেবের তৃতীয় নেত্রে দগ্ধ হয়েছিলেন কন্দর্প, সোনার আসক্তি ছাই করতেই গুরুজির আবির্ভাব ধরাধামে। স্থূল সোনার কামনা ভস্ম করে কানে দেবেন-সূক্ষ্ম শোনা, গুরুমন্ত্র।

আর সহ্য হচ্ছে না, চল্‌ ভাই হৈমি, তোর পড়া বাকি আছে।

সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।

(খানিক দূরে গিয়ে ফিরে এসে) রোসো ভাই, একটা কথা আছে, বলে যাই। ফকিরদা, শুনেছি তোমার গুরু আমার সঙ্গে একবার দেখা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।

হাঁ, তিনি শুনেছেন, তুমি বেদান্ত পাস করেছ। তিনি আমাকে বলে রেখেছেন, নিশ্চয় তোমাকে তাঁর পায়ে এসে পড়তে হবে, বেদান্ত যাবে কোথায় ভেসে! সময় প্রায় হয়ে এল।

বুঝতে পারছি। ক'দিন ধরে কেবলই বাঁ চোখ নাচছে।

নাচছে? বটে! ঐ দেখো, অব্যর্থ তাঁর বাক্য। টান ধরেছে।

কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি, ছাই করে দেবার মতো মালমসলা আমার মধ্যে বেশি পাবেন না। যা ছিল সব পাস করতে করতে য়ুনিভার্সিটির আঁস্তাকুড়ে ভর্তি করে দিয়েছি।

কী বলছ ভাই, পুষ্পদিদি! কোন্‌ ভূতে আবার তোমাকে পেল।

কী জানি ভাই, দেশের হাওয়ায় এটা ঘটায়। বুদ্ধিতে কাঁপন দিয়ে হঠাৎ আসে যেন ম্যালেরিয়ার গুরুগুরুনি। মনে হচ্ছে, রবি ঠাকুরের একটা গান শুনেছিলুম--

গেরুয়া ফাঁদ পাতা ভুবনে,

কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!

পুষ্পদি, তুমি যে এতদূর এগিয়েছ তা আমি জানতুম না। পূর্বজন্মের কর্মফল আর কি!

নিশ্চয়ই, অনেক জন্মের অবুদ্ধিকে দম দিতে দিতে এমন অদ্ভূত বুদ্ধি হঠাৎ পাক খেয়ে ওঠে-- তার পরে আর রক্ষে নেই।

উঃ, আশ্চর্য! ধন্য তুমি! সংসারে কেউ কেউ থাকে যাকে একেবারেই-- কী বলব!

একেবারে শেষের দিক থেকেই শুরু করে। রবি ঠাকুর বলেছেন--

যখন জাগিলে বিশ্বে পূর্ণপ্রস্ফুটিতা

বা বা, বেশ বলেছেন রবি ঠাকুর-- আমি তো কখনো পড়ি নি!

ভালো করেছ, পড়লে বিপদেই পড়তে। ভাই হৈমি, তোর সেই মটরদানার দুনলী হারটা আমাকে দে দেখি। মহাপুরুষদের দর্শনে খালি হাতে যেতে নেই।

কী বল, দিদি! ও যে আমার শাশুড়ির দেওয়া!

এ মানুষটিও তো তোর শাশুড়ির দেওয়া, এও যেখানে তলিয়েছে ওটাও সেখানে যাবে নাহয়।

অবোধ নারী, আসক্তি ত্যাগ করো, গুরুচরণে নিবেদন করো যা কিছু আছে তোমার।

হৈমি, বিশ্বাস করে দাও আমার হাতে, লোকসান হবে না।

আহা, বিশ্বাস-- বিশ্বাসই সব! আমার ছোটো ছেলেটার নাম দেব-- অমূল্যধন বিশ্বাস।

হৈমি, ভয় নেই, আমার সাধনা হারাধন ফেরানো। গুরুকৃপায় সিদ্ধিলাভ হবে।

(হঠাৎ চোখ খুলে) এই-যে, তোমরা সবাই এসেছ, জানতেই পারি নি। সিদ্ধিরস্তু সিদ্ধিরস্তু। এখন মন দিয়ে শোনো আমার কথা।

মন তো প'ড়েই আছে গুরুর চরণে।

আজ তোমাদের বড়ো কঠিন পরীক্ষা। মুক্তির সাতটা দরজার মধ্যে এইটে হল তিনের দরজা। শিবোহং শিবোহং শিবোহং। এইটে কোনোমতে পেরলে হয়। যাদের ধনের থলি ফেঁপে উঠেছে উদুরি-রুগির পেটের মতো, তারা এই সরু দরজায় যায় আটকে, জাঁতাকলের মতো।

হায় হায় হায়, হায় হায় হায়!

এইখেনে এসে মুক্তির ইচ্ছেতেই ঘটে বাধা। কেউ বসে পড়ে, কেউ ফিরে যায়। তার পরে এক দুই তিন, ঘণ্টা পড়ল, বাস্‌-- হয়ে গেল, ডুবল নৌকো, আর টিকি দেখবার জো থাকে না। ক্রিং হ্রিং ক্রম্‌।

হায় হায় হায়, হায় হায় হায়!

এতকাল আমার সংসর্গে থেকে তোমাদের ধনের লোভ কিছু হাল্কা হয়েছে যদি দেখি, তা হলে আর মার নেই। এইবার তবে শুরু হোক। ওহে চরণদাস, গানটা ধরো।

                     গুরুপদে মন করো অর্পণ,

                       ঢালো ধন তাঁর ঝুলিতে--

                        লঘু হবে ভার, রবে নাকো আর

                       ভবের দোলায় দুলিতে।

                   হিসাবের খাতা নাড় ব'সে ব'সে,

                   মহাজনে নেয় সুদ কষে কষে--

                       খাঁটি যেই জন সেই মহাজনে

                         কেন থাক হায় ভুলিতে,

                       দিন চলে যায় ট্যাঁকে টাকা হায়

                            কেবলি খুলিতে তুলিতে।

কী নিতাই, চুপ করে বসে বসে মাথা চুলকোচ্ছ যে? মন খারাপ হয়ে গেছে বুঝি! আচ্ছা, এই নে, পায়ের ধুলো নে।

তা, গুরুর কাছে মিথ্যে কথা বলব না। খুবই ভাবনা আছে মনে। কাল সারারাত ধস্তাধস্তি করে স্ত্রীর বাক্স ভেঙে বাজুবন্দজোড়া এনেছি।

এনেছ, তবে আর ভাবনা কী।

প্রভো, ভাবনা তো এখন থেকেই। বউ বলেছে, ঘরে যদি ফিরি তবে ঝাঁটাপেটা করে দূর করে দেবে।

সেজন্যে এত ভয় কেন।

এ মারটা প্রভুর জানা নেই, তাই বলছেন।

নারদসংহিতায় বলে, দাম্পত্যকলহে চৈব-- ঝগড়া দুদিনে যাবে মিটে।

ঐ নারীটিকে চেনেন না। সীতা সাবিত্রীর সঙ্গে মেলে না। নাম দিয়েছি হিড়িম্বা। তা, বরঞ্চ যদি অনুমতি পাই তা হলে দ্বিতীয় সংসার করে শান্তিপুরে বাসা বাঁধব।

দোষ কী! বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিরা বলেছেন, অধিকন্তু ন দোষায়। সেইরকম দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন। পুরুষের পক্ষে স্ত্রী গৌরবে বহুবচন।

তার মানে একাই এক সহস্র।

উল্টো। আধ্যাত্মিক অর্থে পুরুষের পক্ষে এক সহস্রই একা। বড়ো বড়ো সজ্জন কুলীন বহু কষ্টে তার প্রমাণ দিয়েছেন। সেই জন্যেই এ দেশকে বলে পুণ্যভূমি-- পূণ্যবিবাহকর্মে আমাদের পুরুষদের ক্লান্তি নেই।

আহা, এ দেশের আধ্যাত্মিক বিবাহের এমন সুন্দর ব্যাখ্যা আর কখনও শুনি নি।

কী গো বিপিন, প্রস্তুত তো? যেমন বলেছিলুম, কাল তো সারারাত জপ করেছিলে-- সোনা মিথ্যে, সোনা মিথ্যে, সব ছাই,সব ছাই?

জপেছি। মোহরটা আরো যেন তারার মতো জ্বল জ্বল করতে লাগল মনের মধ্যে। (গুরুর পা জড়িয়ে ধ'রে) প্রভু, আমি পাপিষ্ঠ, এবারকার মতো মাপ করো, আরো কিছুদিন সময় দাও।

এই রে! মোলো, মোলো দেখছি। সর্বনাশ হল। দিতে এসে ফিরিয়ে নেওয়া, এ যে গুরুর ধন চুরি করা! (ঝুলি এগিয়ে দিয়ে) ফেল্‌ ফেল্‌ বল্‌ছি, এখ্‌খনি ফেল্‌।

এইবার সবাই মিলে বলো দেখি,--

সোনা ছাই, সোনা ছাই, সোনা ছাই।

নাহি চাই, নাহি চাই, নাহি চাই।

নয়ন মুদিলে পরে কিছু নাই, কিছু নাই, কিছু নাই।

এই-যে, মা তারিণী! এস এস, এই নাও আশীর্বাদ। তোমার ভাবনা নেই, তুমি অনেক দূরে এগিয়েছ। তোমরা মেয়েমানুষ, তোমাদের সরল ভক্তি, দেখে পুরুষদের শিক্ষা হোক।

(গুরু হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে) গুরুভার বটে-- বন্ধনটা বেশ একটু চাপ দিয়েছিল মনটাকে। যাকগে, এত দিনে হাতের বেড়ি তোমার খসল। লোহার বেড়ির চেয়ে অনেক কঠিন-- ঠিক কিনা, মা?

খুব ঠিক, বাবা। মনে হচ্ছে, খানিকটা মাংস কেটে নিলে।

মাংস নয়, মাংস নয়, মোহপাশ। গ্রন্থি এই সবে আল্গা হতে শুরু করল, তার পরে ক্রমে ক্রমে--

না বাবা, আর পারব না। মেয়ের বিয়ের জন্যে শাশুড়ির আমলের গয়নাগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

(থলির মধ্যে বালাজোড়া ফেলে দিয়ে) আচ্ছা আচ্ছা, এখনকার মতো এই পর্যন্তই থাক্‌। তোমরা বলো সবাই-- সোনা ছাই ইত্যাদি।

(পায়ের কাছে হাজার টাকার নোট রেখে) খবর আঁখসে দেখ্‌ লিজিয়ে হজরৎ।

ভালা ভালা, দিল তো খুশ হ্যায়?

পহেলা তো বহুৎ ঘবড়া গিয়া থা। রাত ভর মেরে জীবাত্মানেসে হাজারো দফে বাতায়া লিয়া কি, কুছ্‌ নেই, কুছ নেই, ইয়ে তো শ্রেফ কাগজ হ্যায়, হাওয়াসে চলা জাতা, আগসে জ্বল্‌ জাতা, পানীমেসে গল্‌ জাতা, ইস্‌কো কিম্মৎ কৌড়িসে ভি কমতি হ্যায়। লিকেন আত্মারাম সারা বখৎ ঘড়বড় কর্‌তে থে। মেরে ঐসি বুদ্ধি লগি যে ইয়ে কাগজ তো গুরুজিকে পাঁও পর ডারনেকে লায়েক একদম নেই হ্যায়-- ইস্‌সে দো এক রূপৈয়া ভি অচ্ছি হ্যায়। পিছে ফজিরমে দো লোটা ভর ভাঙ যব পী লিয়া, তব সব দুরস্ত হো গয়া। মেরে দিল হাল্কা হো গিয়া ইয়ে কাগজকা মাফিক।

জীতা রহো বাবা, পরমাত্মা তুঝকো ভালা করে। বলো সবাই--

নোটগুলো সব ঝুটো, সব ঝুটো, সব ঝুটো--

ওরা সব খড়কুটো, খড়কুটো, খড়কুটো--

ছাই হয়ে উড়ে যাবে মুঠো মুঠো, মুঠো মুঠো, মুঠো মুঠো।

আজ ফকিরকে দেখছি নে যে বড়ো।

এক ঔরৎ ফকিরচাঁদজিকো আপনি সাথ লেকে আয়ি হ্যায়। নয়া আদমি, হমারা মালুম দিয়া কি ভিথর আকে চিল্লায়েগি-- ইস্‌বাস্তে দোনোকো বাহার খাড়া রখ্‌খা হ্যায়। হুকুম মিল্‌নেসে লে আয়গা।

কী সর্বনাশ! ঔরৎ! আরে নিয়ে আয়, এখ্‌খনি নিয়ে আয়। এইখানে একটা ভালো আসন পেতে দে, মেয়েটা হাতছাড়া না হয়!

এস এস, মা, এস। মুখ দেখেই বুঝছি, দৈববাণীর বাহন হয়ে এসেছ।

ভুল বুঝছেন। আমি ছাই ফেলবার ভাঙা কুলো হয়েই এসেছি। এই আমার সঙ্গে যাকে দেখছেন, এত বড়ো বিশুদ্ধ ছাইয়ের গাদা কোম্পানির মুল্লুকে আর পাবেন না। কোনোদিন ওঁর মধ্যে পৈত্রিক সোনার আভাস হয়তো কিছু ছিল-- গুরুর আশীর্বাদে চিহ্নমাত্রই নেই।

এসব কথার অর্থ কী।

অর্থ এই যে, এঁর বাপ এঁকে ত্যাগ করেছেন, ইনি ত্যাগ করতে যাচ্ছেন এঁর স্ত্রীকে। এক পয়সার সম্বল এঁর নেই। শুনেছি, আপনার এখানে সকলরকম আবর্জনারই স্থান আছে, তাই রইলেন ইনি আপনার শ্রীপাদপদ্মে।

অ্যাঁ, এসব কথা কী বলছ, পুষ্পদি। ঐ তো, সোনার হারগাছা নিয়ে আসা গেল-- গুরুচরণে রাখবে না?

রাখব বৈকি। (গুরুর হাতে দিয়ে) তৃপ্ত হলেন তো?

(হারখানা হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ ক'রে) আমার অতি যৎসামান্যেই তৃপ্তি। পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং।

ভুল করবেন না প্রভু, ওটা আমারই দান।

ভুল ভাঙানো জরুরি দরকার, নইলে আসন্ন বিপদ। ওঁর বাবা বিশ্বেশ্বরবাবু পুলিসে খবর দিয়েছেন, তাঁর হার চুরি গেছে। খানাতল্লাসি করতে এখনি আসছে মখলুগঞ্জের বড়ো দারোগা দবিরুদ্দিন সাহেব।

(দাঁড়িয়ে উঠে) কী সর্বনাশ!

কোনো ভয় নেই,এখ্‌খনি সোনাগুলোকে ভস্ম করে ফেলুন, পুলিসের উপর সেটা প্রকাণ্ড একটা কানমলা হবে।

(কাতরস্বরে) বলদেও!

(লাঠি বাগিয়ে) কুছ পরোয়া নেই, ভগবান। আপ তো পরমাত্মা হো, আপকো হুকুমসে হম লঢ়াই করেঙ্গে।

গুরুজি, ওর ভরসায় থাকবেন না। ওর ভাঙের নেশা এখনো ভাঙে নি। লালপাগড়ি দেখলেই যাবে ছুটে। আপাতত আপনি দৌড় দিন। কী জানি, এই নোটখানা পরমাত্মার ভরসায় ওর কোন্‌ মনিবের বাক্স ভেঙে নিয়ে এসছে!

অ্যাঁ, বল কি মথুর। পালাব কোথায়। ওরা যে আমার বাসার ঠিকানা জানে। এখন এই ঝুলিটা তোমরা কে রাখবে।

কেউ না, কেউ না।

আমার বালা জোড়া ফিরিয়ে দাও।

এখ্‌খনি, এখ্‌খনি। আর বলদেও, তোমার নোটখানা তুমি নাও, বাবা।

অব্‌ভি তো নেই সকেঙ্গে। পুলিস চলা জানেসে পিছে লেউঙ্গা।

আচ্ছা, আমারই হাতে ঝুলিটা দিন। পুলিসের কর্তার সঙ্গে পরিচয় আছে। যার যার জিনিস সবাইকে ফিরিয়ে দেব।

ওরে বাস্‌ রে, স্পাই রে স্পাই| কারও রক্ষা নেই আজ।

স্পাই! সর্বনাশ। (উর্ধ্বশ্বাসে) চললুম আমি। মোটরটা আছে?

আছে।

(পায়ে ধ'রে) প্রভো, আমি কিন্তু ছাড়ছি নে তোমার সঙ্গ।

দূর দূর দূর। ছাড়্‌, ছাড়্‌ বলছি। লক্ষ্মীছাড়া! হতভাগা!

তা, আমার কী দশা হবে! আমার কোথায় গতি!

তোমরা গতি গো-ভাগাড়ে।

মা গো, ঐ ঝুলির মধ্যে আমার আছে মোহরটা।

আর, আমার আছে বাজুবন্দ।

এই নাও তোমরা।

তুমিই রক্ষা করলে মা, ধড়ে প্রাণ এল।

মাইজি, উয়ো নোট হমকো দে দীজিয়ে। আফিস্‌কে বখৎমে থোড়ি দের হ্যায়।

এই নাও, ঠিক জায়গায় পৌঁছিয়ে দেবে তো?

জরুর। পরমাত্মাজি তো ফেরার হো গয়া, দুসরা লেনেওয়ালা কোই হ্যায় নেই সওয়ায় মনিব ঔর ডাকু। মালুম থা কি নোট ভস্‌ম হো জায়গা, উস্‌কো পত্তা নহি মিলেগা, মেরা পুণ্য ঔর পুলিসকী ডাণ্ডা ফরক্‌ রহেগা। অভি দেখতা হুঁ কি হিসাবকি থোড়ি গলতি থী। হর হর, বোম্‌ বোম্‌।

ফকিরদা, মাথায় হাত দিয়ে ভাবছ কী। গুরুর পদধূলি তো আঠারো আনা মিলেছে। এখন ঘরে চলো।

যাব না।

কোথায় যাবে।

রাস্তায়।

আচ্ছা বেশ, ছান্দোগ্যটা তো নিয়ে আসতে হবে!

সে আমার সঙ্গে আছে।

কিন্তু, তোমার গুরু?

রইলেন আমার অন্তরে।

আর, ডিমের খোলাটা?

সে ঝুলছে গামছায় বাঁধা বুকের কাছে।

(পিছন থেকে) সোয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।

বিশ্বাস করতে পারিস নে বুঝি? এই নে তোর হার।

আর, অন্যটি?

এখনকার মতো চার পা তুলে সে বেড়া ডিঙিয়েছে।

তার পর?

লম্বা দড়ি আছে।

আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে।

তুই হাঁউমাউ করিস নে তো। চতুষ্পদ একটু চরে বেড়াক-না!

উনি ছান্দোগ্য নিয়ে যখন বেরলেন তখনি বুঝলুম, ফিরবেন না। মণ্ডূক মানে ব্যাঙ বুঝি, ভাই?

হাঁ।

উনি আজকাল বলতে আরম্ভ করেছেন, মানুষের আত্মা হচ্ছে ব্যঙ। সেই পরম ব্যাঙ যখন অন্তরে কুড়ুর কুড়ুর করে ডাকে তখনি বোঝা যায়, সে পরমানন্দে আছে।

তাই হোক-না, ওর আত্মা দেশে বিদেশে ডেকে বেড়াক, তোর আত্মা-ব্যঙ এখন কিছুদিনের মতো ঘুমিয়ে নিক।

মনটা যে হু হু করবে, তার চেয়ে ব্যাঙের ডাক যে ভালো।

ভয় নেই, আনব তোর মাণ্ডূক্যকে ফিরিয়ে।

পুষ্প

মা, শরণ নিলুম তোমার।

খবর নিয়েছি পাড়ায়, তোমার নাতি মাখন পলাতক সাত বছর থেকে-- সংসারের দুনলা বন্দুক লেগেছে তার বুকে, দুঃখ এখনো ভুলতে পারে নি। একটা বিয়ে করলে পুরুষের পা পড়ে না মাটিতে, তোলা থাকে স্ত্রীর মাথার উপরে; আর, দুটো বিয়ে করলেই দুজোড়া মল বাজতে থাকে ওদের পিঠে, শিরদাঁড়া যায় বেঁকে।

কী না জান তুমি, মা। নবগ্রাম থেকে আরম্ভ করে মখ্‌লুগঞ্জ পর্যন্ত সব কটা গাঁ যে তুমি জিতে নিয়েছ। বিধাতাপুরুষ নিষ্ঠুর, তাই তোমায় মোলাম করতে হয় তাঁর শাসন।

না জ্যাঠামশায়, বাড়িয়ে বোলো না। আমি মজা দেখতে বেরিয়েছি-- ছুটি পেয়েছি বই পড়ার গারদ থেকে। দেখতে এলুম কেমন ক'রে নিজের পায়ে বেড়ি আর নিজের গলায় ফাঁস পরাতে নিস্‌পিস্‌ করতে থাকে মানুষের হাত দুটো। এ না হলে ভবের খেলা জমত না। ভগবান বোধ হয় রসিক লোক, হাসতে ভালোবাসেন।

না মা, সবই অদৃষ্ট। হাতে হাতে দেখো-না! বড়ো বৌয়ের ছেলেপুলের দেখা নেই। ভাবলেম, পিতৃপুরুষ পিণ্ডি না পেয়ে শুকিয়ে মরবেন বৈতরণীতীরে। ধ'রে বেঁধে দিলেম মাখনের দ্বিতীয় বিয়ে, আর সবুর সইল না, দেখতে দেখতে পরে পরে দুই পক্ষেরই কল্যাণে চারটি মেয়ে তিনটি ছেলে দেখা দিল আমার ঘরে।

এবারে পিতৃপুরুষের অজীর্ণ রোগের আশঙ্কা দেখছি।

মা, তোমার সব ভালো, কেবল একটা বড়ো খট্‌কা লাগে-- মনে হয়, তুমি দেবতা ব্রাহ্মণ মানই না।

কথাটা সত্যি।

কেন মা, ঐ খুঁৎটুকু কেন থেকে যায়।

সংসারে দেবতাব্রাহ্মণের অবিচারের বিরুদ্ধেই যে লড়াই করতে হয়, ওদের মানলে জোর পেতুম না। সে কথা পরে হবে, আমি মাখনের খোঁজেই আছি।

জান তো মা, ও কিরকম হো হো করে বেড়াত-- কেবল খেলাধুলো, কেবল ঠাট্টাতামাসা। ভয় হত, কোথায় কী করে বসে! তাই তো ওর গলায় একটা নোঙরের পর আর-একটা নোঙর ঝুলিয়ে দিলুম।

নোঙর বেড়েই চলল, ভারে নৌকো তলিয়ে যাবার জো। আমি তোমাদের পাড়ায় এসেছি হৈমির খবর নেবার জন্যে। শুনলুম, সে তোমার এখানেই আছে।

হাঁ মা, এতদিন আমি ছিলুম নামেই মামা। তার বিয়ের পর থেকে এই তাকে দেখলুম। বুক জুড়িয়ে গেল তার মধুর স্বভাবে। তারও স্বামী পালিয়েছে। হল কি বলো তো! কন্‌গ্রেসওয়ালারা এর কিছু করে উঠতে পারলে না?

মহাত্মাজিকে বললে এখনি তিনি মেয়েদের লাগিয়ে দেবেন অসহযোগ আন্দোলনে। দেশে হাতাবেড়ির আওয়াজ একেবারে হবে বন্ধ। গলির মোড়ে খুদু ময়রার দোকানে তেলে-ভাজা ফুলুরি খেয়ে বাবুদের আপিসে ছুটতে হবে-- দুদিন বাদেই সিক্‌ লীভের দরখাস্ত।

ও সর্বনাশ!

ভয় নেই, মেয়েদের হয়ে আমি মহাত্মাজিকে দরবার জানাব না। বরঞ্চ রবি ঠাকুরকে ধরব, যদি তিনি একটা প্রহসন লিখে দেন।

কিন্তু, রবি ঠাকুর কি আজকাল লিখতে পারে। আমার শ্যালার কাছে--

আর বলতে হবে না। কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে দেখছি। কিন্তু ভাবনা নেই, লেখন্দাজ ঢের জুটে গেছে। দ্বাদশ আদিত্য বললেই হয়।

বরঞ্চ লিখতেই যদি হয়, আমি তো মনে করি, আজকাল মেয়েরা যেরকম--

অসহ্য, অসহ্য। জামা শেমিজ পরার পর থেকে ওদের লজ্জা শরম সব গেছে।

সেদিন কলকাতায় গিয়েছিলুম; দেখি, মেয়েরা ট্র৻ামে বাসে এমনি ভিড় করেছে--

যে পুরুষ বেচারারা খালি গাড়ি পেলেও নড়তে চায় না। ও কথা যাক্‌গে-- মাখনের জন্যে ভেবো না।

সেই ভালো, তোমার উপরেই ভার রইল।

শুনলুম তুমি এসেছ, তাই তাড়াতাড়ি এলুম।

ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, তাই গান্ধারী চোখে কাপড় বেঁধে অন্ধ সাজলেন। তোমারও সেই দশা। স্বামী এল বেরিয়ে রাস্তায়, স্ত্রী এল বেরিয়ে মামার বাড়িতে।

মন টেঁকে না ভাই, কী করি! তুমি বলেছিলে, হারাধন ফিরিয়ে আনবে।

একটু সবুর করো-- ছিপ ফেলতে হয় সাবধানে; একটা ধরতে যাই, দুটো এসে পড়ে টোপ গিলতে।

আমার তো দুটোতে দরকার নেই।

যেরকম দিন কাল পড়েছে, দুটো একটা বাড়তি হাতে রাখা ভালো। কে জানে কোন্‌টা কখন ফস্‌কে যায়।

আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। দেখলুম কাগজে তোমার নাম দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে--

হাঁ, সেটা আমারই কীর্তি।

তাতে লিখেছে, প্রাইভেট সিনেমায় সেতুবন্ধ নাটকের জন্যে লোক চাই, হনুমানের পার্ট অভিনয় করবে। তোমার আবার সিনেমা কোথায়।

এই তো চার দিকেই চলচ্ছবির নাট্যশালা, তোমাদের সবাইকে নিয়েই।

তা যেন বুঝলুম, এর মধ্যে হনুমানের অভাব ঘটল কবে থেকে।

দল পুরু আছে ঘরে ঘরে। একটা পাগলা পালিয়েছে লেজ তুলে, ডাক দিচ্ছি তাকে।

সাড়া মিলেছে?

মিলেছে।

তার পরে?

রহস্য এখন ভেদ করব না।

যা খুশি কোরো, আমার প্রাণীটিকে বেশি দিন ছাড়া রেখো না। ঐ কে আসছে ভাই, দাড়িগোঁফঝোলা চোহারা-- ওকে তাড়িয়ে দিতে বলে দিই।

না না, তুমি বরঞ্চ যাও, আমি ওর সঙ্গে কাজ সেরে নিই।

তুমি কে?

সেটা প্রকাশের যোগ্য নয় গোড়া থেকেই, জন্মকাল থেকেই। আমি বিধাতার কুকীর্তি, হাতের কাজের যে নমুনা দেখিয়েছেন তাতে তাঁর সুনাম হয় নি।

মন্দ তো লাগছে না!

অর্থাৎ, মজা লাগছে। ঐ গুণেই বেঁচে গেছি। প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিলেই লোকের মজা লাগে। লোক হাসিয়েছি বিস্তর।

কিন্তু, সব জায়গায় মজা লাগে নি।

খবর পেয়েছ দেখছি। তা হলে আর লুকিয়ে কী হবে। নাম আমার শ্রীমাখনচন্দ্র। বুঝতেই পারছ, যাত্রার দলের সরকারি গোঁফদাড়ি পরে এসেছি কেন। এ পাড়ায় মুখ দেখাবার সাহস নেই, পিঠ দেখানোই অভ্যেস হয়ে গেছে।

এলে যে বড়ো?

চলেছিলুম নাজিরপুরে ইলিশ মাছ ধরার দলে। ইস্টেশনে দেখি বিজ্ঞাপন, হনুমানের দরকার। রইল পড়ে জেলেগিরি। জেলেরা ছাড়তে চায় না, আমাকে ভালোবাসে। আমি বললুম, ভাই, এদের বিজ্ঞাপনের পয়সা বেবাক লোকসান হবে আমি যদি না যাই-- আর দ্বিতীয় মানুষ নেই যার এত বড়ো যোগ্যতা। এ তো আর ত্রেতাযুগ নয়!

খাওয়াপরার কিছু টানাটানি পড়েছে বুঝি?

নিতান্ত অসহ্য হয় নি। কেবল যখন ধনেশাক দিয়ে ডিমওয়ালা কই মাছের ঝোলের গন্ধস্মৃতি অন্তরাত্মার মধ্যে পাক খেয়ে ওঠে, তখন আমার শ্রীমতী বাঁয়া আর শ্রীমতী তবলার তেরেকেটে মেরেকেটে ভিরকুটি মিরকুটির তালে তালে দূর থেকে মন কেমন ধড়ফড়্‌ করতে থাকে।

তাই বুঝি ধরা দিতে এসেছ?

না না, মনটা এখনো তত দূর পর্যন্ত শক্ত হয় নি। শেষে বিজ্ঞাপনদাতার খবর নিতে এসে যখন দেখলুম, ঠিকানাটা এই আঙিনারই সীমানার মধ্যে তখন প্রথমটা ভাবলুম বিজ্ঞাপনের মান রক্ষা করব, দেব এক লম্ফ। কিন্তু, রইলুম কেবল মজার লোভে। পণ করলুম শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। দিদি আমার,কেমন সন্দেহ হচ্ছে, কোনো সূত্রে বুঝি আমাকে চিনতে, নইলে অমন বিজ্ঞাপন তোমার মাথায় আসত না।

তোমার আঁচিলওয়ালা নাকের খ্যাতি পাড়ার লোকের মুখে মুখে। তোমার বিজ্ঞাপন তোমার নাকের উপর। বিশ্বকর্মার হাতে এ নাক দুবার তৈরি হতে পারে না-- ছাঁচ তিনি মনের ক্ষোভে ভেঙে ফেলেছেন।

এই নাকের জোরে একবার বেঁচে গিয়েছি, দিদি। মট্রুগঞ্জে চুরি হল, সন্দেহ করে আমাকে ধরলে চৌকিদার। দারোগা বুদ্ধিমান; সে বললে, এ লোকটা চুরি করবে কোন্‌ সাহসে--নাক লুকোবে কোথায়। বুঝেছ, দিদি? আমার এ নাকটাতে ভাঁড়ামির ব্যাবসা চলে, চোরের ব্যাবসা একেবারে চলে না।

কিন্তু, তোমার হাতে যে কলার ছড়াটা দেখছি ওটা তো আমার চেনা, কোনো ফিকিরে তোমার জুড়ি-অন্নপূর্ণার ঘর থেকে সরিয়ে নিয়েছ।

অনেক দিনের পেটের জ্বালায় ওদের ভাঁড়ারে চুরি পূর্বে থেকেই অভ্যেস আছে।

এত বড়ো কাঁদি নিয়ে করবে কী। হনুমানের পালার তালিম দেবে?

সে তো ছেলেবেলা থেকেই দিচ্ছি। পথের মধ্যে দেখলুম এক ব্রহ্মচারী বসে আছেন পাকুড়তলায়। আমার বদ অভ্যাস, হাসাতে চেষ্টা করলুম-- ঠোঁটের এক কোণও নড়াতে পারলুম না, মন্তর আউড়েই চলল। ভয় হল, বুঝি ব্রহ্মদত্যি হবে। কিন্তু, মুখ দেখে বুঝলুম উপোষ করতে হতভাগা তিথিবিচার করছে না। ওর পাঁজিতে তিনটে চারটে একাদশী একসঙ্গে জমাট বেঁধে গেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, বাবাজি, খাবে কিছু? কপালে চোখতুলে বললে, গুরুর কৃপা যদি হয়। মাঝে মাঝে দেখি মাথার নীচে পুঁথি রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছেন, ডাকের শব্দে ও গাছের পাখি একটাও বাকি নেই। নাকের সামনে রেখে আসব কলার ছড়াটা।

লোকটার পরিচয় নিতে হবে তো।

নিশ্চয় নিশ্চয়। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে, আমার চেয়ে মজা।

ভালো হল। হনুমানের সঙ্গে অঙ্গদ চাই। ওকে তোমারই হাতে তৈরি করে নিতে হবে।? শেওড়াফুলির হাট উজাড় করে কলার কাঁদি আনিয়ে নেব।

শুধু কলার কাঁদির কর্ম নয়।

তা নয় বটে। যে কারখানায় তুমি নিজে তৈরি সেখানকার দুই-চাকা ওয়ালা যন্ত্রের তলায় ওকে ফেলা চাই।

দয়াময়ী, জীবের প্রতি এত হিংসা ভালো নয়।

ভয় নেই, আমি আছি, হঠাৎ অপঘাত ঘটতে দেব না। আপাতত কলার ছড়াটা ওকে দিয়ে এস।

আমাদের দেশে মেয়েরা থাকতে সন্ন্যাসী না খেয়ে মরে না। কিন্তু, ও লোকটা ভুল করেছে-- বৈরাগির ব্যাবসা ওর নয়, ওর চেহারায় জলুষ নেই। নিতান্ত নিজের স্ত্রী ছাড়া ওর খবরদারি করবার মানুষ মিলবে না।

তোমার অমন চেহারা নিয়ে তুমি ছ বছর চালালে কী করে।

ময়রার দোকানে মাছি তাড়িয়েছি, পেয়েছি বাসি লুচি তেলে-ভাজা, যার খদ্দের জোটে না। যাত্রার দলে ভিস্তি সেজেছি, জল খেতে দিয়েছেন অধিকারী মুড়কি আর পচা কলা। সুবিধে পেলেই মা মাসি পাতিয়ে মেয়েদের পাঁচালি শুনিয়ে দিয়েছি যখন পুরুষরা কাজে চলে গেছে--

মা-জননীদের দুই চক্ষু দিয়ে অশ্রুধারা ঝরেছে-- দু-চার দিনের সঞ্চয় নিয়ে এসেছি। আমাকে ভালোবাসে সবাই। জ্যাঠাইমা আমার যদি-দুটো বিয়ে না দিত তা হলে চাই কি আমার নিজের স্ত্রীও হয়তো আমাকে ভালোবাসতে পারত। বাইরে থেকে বুঝতে পারবে না,কিন্তু আমারও কেমন অল্পেতেই মন গলে যায়। এই দেখো না, এখন তোমাকে মা-অঞ্জনা বলতে ইচ্ছে করছে।

সেই ভালো, আমার নাতির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, দিদির পদটা বড্ড বেশি ভারি হয়ে উঠল। আচ্ছা, জিগেস করি, তোমার মনটা কী বলছে।

তবে মা, কথাটা খুলে বলি। অনেক দিন পরে এ পাড়ার কাছাকাছি আসতেই প্রথম দিনই আমার বিপদ বাধল ফোড়নের গন্ধে। সেদিন আমাদের রান্নাঘরে পাঁঠা চড়েছিল-- সত্যি বলি, বড়ো বোয়ের মুখ খারাপ, কিন্তু রান্নায় ওর হাত ভালো। সেদিন বাতাস শুঁকে শুঁকে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি সারাদিন। তার পর থেকে অর্ধভোজনের টানে এ পাড়া ছাড়া আমার অসাধ্য হল। বারবার মনে পড়ছে, কত দিনের কত গালমন্দ আর কত কাঁটাচচ্চড়ি। একদিন দিব্যি গেলেছিলুম, এ বাড়িতে কোনোদিন আর ঢুকব না। প্রতিজ্ঞা ভেঙেছি কাল।

কিসে ভাঙালো।

তালের বড়ার গন্ধে। দিনটা ছটফট করে কাটালুম। রাত্তিরে যখন সব নিশুতি, বাইরে থেকে ছিট্‌কিনি খুলে ঢুকলুম ঘরে। খুট করে শব্দ হতেই আমার ছোটোটি এক হাতে পিদিম এক হাতে লাঠি নিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। মুখে মেখে এসেছিলুম কালি, আমি হাঁ করে দাঁত খিঁচিয়ে হাঁউমাউখাঁউ করে উঠতেই পতন ও মূর্ছা। বড়ো বৌ একবার উঁকি মেরেই দিল দৌড়। আমি রয়ে বসে পেট ভরে আহার করে ধামাসুদ্ধ বড়া নিয়ে এলুম বেরিয়ে।

কিছু প্রসাদ রেখে এলে না পতিব্রতাদের জন্যে?

অনেকখানি পায়ের ধুলো রেখে এসেছি, আর বড়াগুলো নিয়ে এসেছি দলবলকে খাইয়ে দিতে।

আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্যি বলবে?

দেখো মা, বিপদে না পড়লে আমি কখনো মিথ্যে কথা কই নে।

লোকে বলে, তুমি কাশীতে গিয়ে আরও একটা বিয়ে করেছ।

তা করেছি।

পিঠ সুড়সুড় করছিল?

না মা, দুটো বিয়ে কাকে বলে হাড়ে হাড়ে জেনেছি। ভারি ইচ্ছা হল, একটা বিয়ে কি রকম মরার আগে জেনে নেব।

জেনে নিয়েছ সেটা?

বেশি দিন নয়। ভাগ্যবতী কিনা, পুণ্যফলে মারা গেল সকাল-সকাল, স্বামী বর্তমানেই। ঘোমটা সবে খুলেছে মাত্র। কিন্তু ভালো ক'রে মুখ ফোটবার তখনো সময় হয়নি। বেঁচে থাকলে কপালে কী ছিল বলা যায় না।

কার কপালে?

শক্ত কথা।

আহা, গুরুদেবের কৃপা। (ছড়াটা মাথায় ঠেকিয়ে চোখ বুজে) শিবোহং শিবোহং শিবোহং। (একটা একটা ক'রে গোটা দশেক খেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে) আঃ!

কী দাদা, ভালো তো! আমার নাম শ্রীমাখনানন্দ।

গুরুর চরণ ভরসা।

গুরুই খুঁজে মরছি সদ্‌গুরু মেলে না তো দয়া হবে কি। নেবে কি অভাবজনকে।

ভয় নেই, সময় হোক আগে।

(কান্নার সুরে) সময় আমার হবে না প্রভু, হবে না। দিন যে গেল! বড়ো পাপী আমি। আমার কী গতি হবে।

গুরুপদে মন স্থির করো-- শিবোহং।

এই পদেই ঠেকল আমার তরী; যম তা হলে ভয়ে কাছে ঘেঁষবে না।

তোমার নিষ্ঠা দেখে বড়ো সন্তুষ্ট হলুম।

শুধু নিষ্ঠা নয় গুরু, এনেছি কিছু তালের বড়া। তালগাছটা সুদ্ধ উদ্ধার পাক।

(ব্যগ্রভাবে আহার) আহা, সুস্বাদ বটে। ভক্তির দান কি না।

সার্থক হল আমার নিবেদন। বাড়ির এঁয়োরা খবর পেলে কী খুশিই হবেন! যাই, ওঁদের সংবাদ পাঠিয়ে দিইগে, ওঁরা আরও কিছু হাতে নিয়ে আসবেন।-- প্রভু, গৃহাশ্রমে আর কি ফিরবেন না।

আর কেন। গুরু বলেন, বৈরাগ্যং এবং ভয়ং।

গৃহী আমি, ডাইনে বাঁয়ে মায়া-মাকড়সানি জড়িয়েছে আপাদমস্তক। ধনদৌলতের সোনার কেল্লাটা কত বড়ো ফাঁকি সেটা খুব করেই বুঝে নিয়েছি। বুঝেছি সেটা নিছক স্বপ্ন। ভগবান আমাকে অকিঞ্চন করে পথে পথে ঘোরাবেন এই তো আমার দিনরাত্রির সাধনা, কিন্তু আর তোর পারি নে, একটা উপায় বাৎলিয়ে দাও।

আছে উপায়।

(পা জড়িয়ে) বলে দাও, বলে দাও, বঞ্চিত কোরো না।

দিন-ভোর উপোষ ক'রে থেকে--

উপোষ! সর্বনাশ! সেটা অভ্যেস নেই একেবারেই। আমার দুষ্ট গ্রহ দিনে চারবার করে আহার জুটিয়ে দিয়ে অন্তরটা একেবারে নিরেট করে দিয়েছেন। আর কোনো রাস্তা যদি--

আচ্ছা, দুখানা রুটি--

আরও একটু দয়া করেন যদি, দু'বাটি ক্ষীর!

ভালো, তাই হবে।

আহা, কী করুণা প্রভুর! তেমন করে পা যদি চেপে থাকতে পারি তা হলে পাঁঠাটাও--

না না, ওটা থাক্‌।

আচ্ছা, তবে থাক্‌, একটা দিন বই তো নয়। তা কী করতে হবে বলুন। দেখুন, আমি মুখ্‌খু মানুষ, অনুস্বার-বিসর্গওয়ালা মন্তর মুখ দিয়ে বেরবে না, কী বলতে কী বলব, শেষকালে অপরাধ হবে।

ভয় নেই, তোমার জন্যে সহজ করেই দিচ্ছি। গুরুর মূর্তি স্মরণ করে সারারাত জপ করবে, সোনা তোমাকেই দিলুম, তোমাকেই দিলুম, যতক্ষণ না ধ্যানের মধ্যে দেখবে, সোনা আর নেই--কোত্থাও নেই।

হবে হবে প্রভু, এই অধমেরও হবে। বলব, সোনা নেই, সোনা নেই; এ হাতে নেই, ও হাতে নেই; ট্যাঁকে নেই, থলিতে নেই; ব্যাঙ্কে নেই, বাক্সোয় নেই। ঠিক সুরে বাজবে মন্ত্র। আচ্ছা, গুরুজি, ওর সঙ্গে একটা অনুস্বার জুড়ে দিলে হয় না? নইলে নিতান্ত বাংলার মতো শোনাচ্ছে। অনুস্বার দিলে জোর পাওয়া যায়-- সোনাং নেই, সোনাং নেই, কিছুং নেই, কিছুং নেই।

মন্দ শোনাচ্ছে না।

আচ্ছা, তবে অনুমতি হোক, পোলাওটা ঠাণ্ডা হয়ে এল।

[সকলের হাস্য

তুমি খাও তালের বড়া, দেয় এনে আর-এক মহাত্মা, এও তো মজা কম নয়। তাকে চেন না?

আজ্ঞে না।

সে চেনে না তোমাকে?

আজ্ঞে না।

এ যে আরব্য উপন্যাস।

যা হবার তা তো হয়ে গেছে, এখন ঘরে চলো।

কার ঘরে যাব?

মরি মরি, ঘর চেন না পোড়ারমুখো! বলি, আমাদের দুটিকে চেন তো?

সত্যি কথা বলি, রাগ করবেন না, চিনি নে।

ঐ লোকটার ভণ্ডামি তো সইবে না। জোর করে নিয়ে যাও ওকে ধ'রে তালা বন্ধ করে রাখো।

গুরো।

(মিলে ঠেলাঠেলি) ওঠো, ওঠো বলছি।

বৌ দুটোকে এড়াতে চাও তার মানে বুঝি; কিন্তু তোমার ছেলেমেয়েগুলিকে? তোমার চারটি মেয়ে, তিনটি ছেলে, তাও ভুলেছ না কি।

ও সর্বাশ! আমাকে মেরে ফেললেও এখান থেকে নড়ব না। (গাছের গুঁড়ি আঁকড়িয়ে ধ'রে) কিছুতেই না।

জান আমি কে? পূর্ব-আশ্রমে জানতে। অনেক সাধুকে জেলে পাঠিয়েছি। আমি হরিশ উকিল। জান? তোমার দুই স্ত্রী!

এখানে এসে প্রথম জানলুম।

আর, তোমার চার মেয়ে তিন ছেলে।

আপনারা জানেন, আমি কিছুই জানি নে।

এদের ভরণ-পোষণের ভার তুমি যদি না নাও, তা হলে মকদ্দমা চলবে বলে রাখলুম।

বাপ রে! মকদ্দমা! পায়ে ধরি, একটু রাস্তা ছাড়ুন।

যাবে কোথায়, কোন্‌ চুলোয়, যমের কোন্‌ দুয়োরে।

গুরো! (হতবুদ্ধি হয়ে বসে পড়ল)

(লাফিয়ে উঠে) এ কী, এ যে হৈমবতী! বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।

ওলো, ওর সেই কাশীর বৌ, এখনো মরে নি বুঝি।

ধরা দিলেম-- বেওজর। লাগাও হাতকড়ি। প্রমাণের দরকার নেই। একেবারে সিধে নাকের দিকে তাকান। আমি মাখনচন্দ্র। এই আমার দড়ি আর এই আমার কল্‌সি। মা অঞ্জনা, কিষ্কিন্ধ্যায় তো ঢোকালে। মাঝে মাঝে খবর নিয়ো। নইলে বিপদে পড়লে আবার লাফ মারব।

ফকিরদা, তোমার মুক্তি কোথায় সে তো এখন বুঝেছ?

খুব বুঝেছি-- এ রাস্তা আর ছাড়ছি নে।

বাছা মাখন, তোমার মস্ত সুবিধে আছে-- তোমার ফুর্তি কেউ মারতে পারবে না। এ দুটিও নয়।

ছি ছি, আর একটু হলে তো সর্বনাশ হয়েছিল! (গড় হয়ে প্রণাম ক'রে) বাঁচালে এসে।