পরিত্রাণ (paritran)

     

    প্রথম অঙ্ক

    প্রথম দৃশ্য

    ধনঞ্জয় ও প্রজাগণ
    প্রজা।
    থাকতে পারলুম না যে ঠাকুর। তাই তোমাকে ধরে নিয়ে চলেছি।
    ধনঞ্জয়।
    আমাকে নিয়ে তোদের কী হবে বল্‌ তো।
    প্রজা।
    মাঝে মাঝে তোমাকে না দেখতে পেলে যে-
    ধনঞ্জয়।
    তোরা ভাবছিস তোরাই আমাকে ধরে এনেছিস। তা নয় রে - আমিই তোদের খবর দিতে বেরিয়েছি-
    প্রজা।
    কিসের খবর ঠাকুর?
    ধনঞ্জয়।
    দুঃখের দিন আসছে।
    প্রজা।
    বল কী প্রভু?
    ধনঞ্জয়।
    হাঁ রে, আমি ধরণীর কান্না শুনতে পাই যে।
    প্রজা।
    কোথায় পালাব?
    ধনঞ্জয়।
    পালাব না রে, তাকে বুঝে নেব-ভিতরে এসে দুঃখটাকে দেখব বাইরে।

    গান

    তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া-
    তাই ভয়ে ঘোরায় দিক্‌-বিদিকে
    শেষে অন্তরে পাই সাড়া।
    আমি তোদের ডাকছি- সবাই আমার বুকের ভিতরে আয়, সেইখান থেকে নির্ভয়ে দেখবি তুফানের দাপট, মরণের চোখ-রাঙানি।
    প্রজা।
    তুমি যেখানে ডাক দাও ঠাকুর সেখানে যাবার পথ পাই নে যে।
    ধনঞ্জয়।
    যখন হারাই বন্ধ-ঘরের তালা,
    যখন অন্ধ নয়ন, শ্রবণ কালা,
    তখন অন্ধকারে লুকিয়ে দ্বারে
    শিকলে দাও নাড়া।
    ঘুম যখন ভাঙবে তখনই দরজা খোলবার সময় আসবে রে।
    প্রজা।
    ঘুম যে ভাঙে না।
    ধনঞ্জয়।
    সেইজন্যই তাড়া লাগছে, নইলে দুঃখ আসবে কেন।
    যত দুঃখ আমার দুঃস্বপনে,
    সে-যে ঘুমের ঘোরেই আসে মনে,
    ঠেলা দিয়ে মায়ার আবেশ
    করো গো দেশছাড়া।
    অজ্ঞান হয়ে থাকিস বলেই তো স্বপ্নের চোটে তোরা গুঙরে মরিস।
    প্রজা।
    রাজার পেয়াদা এসে যখন মার লাগায়? সেটা তুমি স্বপ্ন বল নাকি।
    ধনঞ্জয়।
    তা না তো কী? স্বপ্নের হাজার লক্ষ মুখোশ আছে; রাজার মুখোস প'রেও আসে-তোদের অচৈতন্য নিয়েই তোদের সে মারে,তার হাতে আর কোনো অস্ত্র নেই।
    আমি আপন মনের মারেই মরি
    শেষে দশ জনারে দোষী করি-
    আমি চোখ বুজে পথ পাই নে ব'লে
    কেঁদে ভাসাই পাড়া।

    দেখ্‌, আমি এই কথা তোদের বলতে এসেছি-সংসারে তোরাই দুঃখ এনেছিস।

    প্রজা।
    সে কী কথা ঠাকুর,আমরা দুঃখ পাই,আমরা তো দুঃখ দিই নে। আমাদের সেই শক্তিই নেই।
    ধনঞ্জয়।
    ওরে বোকা, মার খাবার জন্য যে তৈরি হয়ে আছে মারের ফসল ফলাবার মাটি সে যে চষে রেখেছে। তোদেরই সব চেয়ে বেশি-- তোরা তোদের অন্তর্যামী ঠাকুরকে লজ্জা দিয়েছিস, তাই এত দুঃখ।
    প্রজা।
    আমরা কী করব বলে দাও।
    ধনঞ্জয়।
    আর কত বলব? বার বার বলছি ভয় নেই, ভয় নেই,ভয় নেই।

    গান

    নাই ভয়, নাই ভয় নাই রে।
    থাক্‌ পড়ে থাক্‌ ভয় বাইরে!
    জাগো মৃত্যুঞ্জয় চিত্তে
    থৈ-থৈ-নর্তন-নৃত্যে,
    ওরে মন বন্ধনছিন্ন
    দাও তালি তাই তাই তাই রে।
    প্রজা।
    ঠাকুর, ঐ যেন কে আসছে?
    ধনঞ্জয়।
    আসতে দে।
    প্রজা।
    কী জানি, খুনে হবে কি ডাকাত হবে, এই অন্ধকার রাত্তিরে বেরিয়েছে।
    ধনঞ্জয়।
    খুনেকে তোরাই খুনে করিস, ডাকাতকে করে তুলিস ডাকাত। খাড়া দাঁড়িয়ে থাক্‌।
    প্রজা।
    প্রভু, বিপদ ঘটতে পারে। আমরা বরঞ্চ একটু সরে দাঁড়াই-- একেবারে সামনে এসে পড়বে-- তখন--
    ধনঞ্জয়।
    ওরে বোকারা, পিছন দিকে বিপদ যখন মারে তখন আর বাঁচোয়া নেই-- বুক পেতে দিতে পারিস, বিপদ তা হলে নিজেই পিছন ফিরবে।

    বসন্তরায় ও একজন পাঠানের প্রবেশ

    পাঠান।
    কোন্‌ হ্যায় রে!
    প্রজা।
    দোহাই বাবা, আমরা চাষি লোক-
    পাঠান।
    রাত্তিরে কী করতে বেরিয়েছিস?
    ধনঞ্জয়।
    রাত্তিরে যারা বেরোয় তাদের সঙ্গে মিলন হবে বলেই বেরিয়েছি। দিনে মিলি কাজের লোকের সঙ্গে, রাত্তিরে মিলি অকাজের লোকের সঙ্গে।
    পাঠান।
    ভয় ডর নেই?
    ধনঞ্জয়।
    দাদা, তোমারও তো ভয় ডর নেই দেখছি। দুই নির্ভয়ে সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ হল-এ তো পরম আনন্দ। (প্রজাদের প্রতি) যাস কোথায় তোরা!চেনাশোনা করে নে-না।
    বসন্ত।
    ভাবে বোধ হচ্ছে, তুমিই ধনঞ্জয় ঠাকুর, কেমন ঠিক ঠাউরেছি কি না?
    ধনঞ্জয়।
    ধরা পড়েছি। রাত-কানা নও তুমি।
    বসন্ত।
    তেমন মানুষ অন্ধকারেও চোখে পড়ে।
    ধনঞ্জয়।
    তুমিও তো অন্ধকারে ঢাকা পড়বার লোক নও, খুড়ো মহারাজ!
    পাঠান।
    যাঃ চলে! সব ফেঁসে গেল!
    ধনঞ্জয়।
    কী ফাঁসল দাদা!
    পাঠান।
    মহারাজের সঙ্গে ঠিক যে সময়টিতে একলা আলাপ জমিয়েছিলুম, তুমি এসে বাগড়া দিলে।
    ধনঞ্জয়।
    খাঁ-সাহেব,তুমি জান না, বাগড়া দিয়েই আলাপ জমান যিনি বড়ো আলাপী।

    গান

    আমার পথে পথেই পাথর ছড়ানো।
    তাই তো তোমার বাণী বাজে
    ঝর্‌না-ঝরানো।
    আমার বাঁশি তোমার হাতে
    ফুটোর পরে ফুটো তাতে,
    তাই শুনি সুর অমন মধুর
    পরান-ভরানো।
    তোমার হাওয়া যখন জাগে
    আমার পালে বাধা লাগে,
    এমন ক'রে গায়ে প'ড়ে
    সাগর-তরানো।
    ছাড়া পেলে একেবারে
    রথ কি তোমার চলতে পারে?
    তোমার হাতে আমার ঘোড়া
    লাগাম-পরানো।
    বসন্ত।
    খাঁ-সাহেব,এই তো জমে গেল। আজ পথে বাধা পেয়েছিলুম বলেই তো। যিনি বাগড়া দেন জয় হোক তাঁর।
    ধনঞ্জয়।
    আজ বেরিয়েছ কোন্‌ ডাকে মহারাজ?
    বসন্ত।
    যশোরে চলেছিলুম। ঠাকুর, গ্রামে ডাকাত পড়েছে খবর পেয়ে লোকজনদের সব পাঠিয়ে দিয়েছি। তাই খাঁ-সাহেবকে নিয়ে এই রাস্তার মধ্যেই মজলিশ জমে গেল।
    ধনঞ্জয়।
    রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ-মজলিশেই মজা মহারাজ। আমিও তোমার এ সভায় হঠাৎ-দরবারী।

    গান

    তুমি হঠাৎ-হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন-
    তাই হঠাৎ-পাওয়ায় চমকে ওঠে মন।
    বসন্ত।
    বেশ, বেশ ঠাকুর। যা নিত্যি জোটে তা থাক্‌ পড়ে-এই হঠাতের টানেই তো বাঁধন কাটে।
    ধনঞ্জয়।
    -- গোপন পথে আপন মনে
    বাহির হও যে কোন্‌ লগনে,
    হঠাৎ-গন্ধে মাতাও সমীরণ!
    বসন্ত।
    হায় হায় ঠাকুর-বড়ো শুভক্ষণেই বেরিয়েছিলুম-দেহমন শিউরে উঠছে।
    ধনঞ্জয়।
    -- নিত্য যেথায় আনাগোনা
    হয় না সেথায় চেনাশোনা,
    উড়িয়ে ধুলো আসছে কতই জন।
    বসন্ত।
    আহা, ভিড়ের মধ্যে হল না দেখা! দিন বৃথা গেল।
    ধনঞ্জয়।
    -- কখন পথের বাহির থেকে
    হঠাৎ বাঁশি যায় যে ডেকে
    পথহারাকে করে সচেতন।
    বসন্ত।
    এস ঠাকুর, একবার কোলাকুলি করে নিই।
    প্রজা।
    কোথায় চলেছ মহারাজ?
    বসন্ত।
    প্রতাপ আমাকে ডেকেছে, তাই যশোরে চলেছি।
    প্রজা।
    রায়গড়ে ফিরে যাও আজ রাত্তিরেই।
    বসন্ত।
    কেন বলো দেখি?
    প্রজা।
    নানারকম গুজব কানে আসে। ভালো লাগে না।
    ধনঞ্জয়।
    কোথাকার অযাত্রা এরা সব? নিজেরাও চলবি নে ভয়ে, অন্যকেও চলতে দিবি নে?
    প্রজা।
    দেখছ না ঠাকুর, পাঠানটা হঠাৎ কখন সরে গেল?
    ধনঞ্জয়।
    তোদের সঙ্গ ওর ভালো লাগল না, তাতে আর আশ্চর্য কী রে। সবাই কি তোদের সহ্য করতে পারে?
    প্রজা।
    তোমার সাদা মন, তুমি বুঝবে না-- ওর যে কী মতলব ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে।
    ধনঞ্জয়।
    সাদা মনে বোঝা যায় না, ময়লা মনে বোঝা সহজ হয়, এ কথা নতুন শোনা গেল। বিশ্বাস নেই, উপর থেকে দেখিস দিঘির পানা, বিশ্বাস করে নীচে ডুব মারিস, দেখবি ডুব-জল। তোরা ডাঙা থেকেই মুখ ফিরিয়ে যাস, আমি না তলিয়ে দেখে ছাড়ি নে।
    প্রজা।
    প্রভু, রাগ যে হয়।
    ধনঞ্জয়।
    সেই জন্যেই সংসারে কেবল রাগীকেই দেখিস- না রাগতিস, তা হলে যে রাগে না তাকেও দেখতে পেতিস।
    পাঠানের পুনঃপ্রবেশ
    বসন্ত।
    এই-যে খাঁ-সাহেব ফিরেছে। তুমি যে ফারসি বয়েদ্‌গুলি শুনিয়েছিলে, ওগুলি আমাকে লিখে দিতে হবে।
    পাঠান।
    দেব হুজুর, কিন্তু একটা কথা নিবেদন করি। (প্রজাদিগকে দেখাইয়া) এই এদের সরে যেতে বলো।
    প্রজা।
    না, সে হবে না। আমরা ওঁকে ফেলে যাব না।
    ধনঞ্জয়।
    কেন যাবি নে রে? ভারি অহংকার তোদের দেখি। তোরা হলি রক্ষাকর্তা, না?
    প্রজা।
    তুমি যদি হুকুম কর তো যাই।
    ধনঞ্জয়।
    রক্ষা করবার যদি দরকার হয়, খাঁ-সাহেব একলা রক্ষা করতে পারবেন।
    [ প্রজাদের প্রস্থান
    পাঠান।
    মহারাজ, আমাকেই রক্ষা করো।
    বসন্ত।
    সে কী কথা? কিছু বিপদ হয়েছে?
    পাঠান।
    হয়েছে। আমি যদি আজ যশোরে ফিরে যাই, আমার প্রাণ থাকবে না।
    বসন্ত।
    সর্বনাশ! কেন, কী অপরাধ করেছ?
    পাঠান।
    প্রতাপাদিত্য রাজা কাল যখন আমাদের দুই ভাইকে রওনা করে দিলেন, তখন পথের মধ্যে আপনাকে খুন করবার হুকুম ছিল।
    বসন্ত।
    কী বল খাঁ-সাহেব?
    পাঠান।
    হাঁ, কিন্তু গোপনে। গোপনও রইল না, তা ছাড়া আপনাকে মারা আমার দ্বারা হবে না, মনিবের হুকুমেও না। এখন আপনার মেহেরবানি চাই।
    বসন্ত।
    এখনই চলে যাও রায়গড়ে। তোমার কোনো ভয় নেই।

    [ সেলাম করিয়া পাঠানের প্রস্থান

    বুকে বড়ো বাজল ঠাকুর!
    ধনঞ্জয়।
    বাজবে বৈকি ভাই। ভালোবাস যে-- না বাজলে কি ভালো হত?

    গান

    কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারি ঘায়ে--
    নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে।
    বসন্ত।
    আহা, সার্থক হোক কান্না আমার।
    ধনঞ্জয়।
    - তোমার অভিসারে
    যাব অগম পারে
    চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে।
    বসন্ত।
    এই ব্যথার পথেই আমাকে চালাও প্রভু! আমি আর কিছুই চাই নে।
    ধনঞ্জয়।
    - পরানে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা--
    দুখের মাধুরীতে করিল দিশাহারা।
    সকলি নিবে কেড়ে
    দিবে না তবু ছেড়ে--
    মন সরে না যেতে ফেলিলে এ কী দায়ে।

    দ্বিতীয় দৃশ্য

    মন্ত্রগৃহে প্রতাপাদিত্য ও মন্ত্রী
    মন্ত্রী।
    মহারাজ, কাজটা কি ভালো হবে?
    প্রতাপ।
    কোন্‌ কাজটা?
    মন্ত্রী।
    যেটা আদেশ করেছেন--
    প্রতাপ।
    কী আদেশ করেছি?
    মন্ত্রী।
    আপনার পিতৃব্য সম্বন্ধে-
    প্রতাপ।
    আমার পিতৃব্য সম্বন্ধে কী?
    মন্ত্রী।
    মহারাজ আদেশ করেছিলেন, যখন রাজা বসন্তরায় যশোরে আসবার পথে শিমুলতলির চটিতে আশ্রয় নেবেন, তখন-
    প্রতাপ।
    তখন কী? কথাটা শেষ করেই ফেলো।
    মন্ত্রী।
    তখন দুজন পাঠান গিয়ে--
    প্রতাপ।
    হাঁ।
    মন্ত্রী।
    তাঁকে নিহত করবে।
    প্রতাপ।
    নিহত করবে! অমরকোষ খুঁজে বুঝি আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না? নিহত করবে! মেরে ফেলবে কথাটা মুখে আনতে বুঝি বাধছে?
    মন্ত্রী।
    মহারাজ আমার ভাবটি ভালো বুঝতে পারেন নি।
    প্রতাপ।
    বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি।
    মন্ত্রী।
    আজ্ঞে মহারাজ, আমি--
    প্রতাপ।
    তুমি শিশু! খুন করাটা যেখানে ধর্ম সেখানে না-করাটাই পাপ, এটা এখনো তোমার শিখতে বাকি আছে। পিতৃব্য বসন্তরায় নিজেকে ম্লেচ্ছের দাস বলে স্বীকার করেছেন। ক্ষত হ'লে নিজের বাহুকে কেটে ফেলা যায়, সে কথা মনে রেখো মন্ত্রী।
    মন্ত্রী।
    যে-আজ্ঞে।
    প্রতাপ।
    অমন তাড়াতাড়ি "যে-আজ্ঞে' বললে চলবে না। তুমি মনে করছ নিজের পিতৃব্যকে বধ করা সকল অবস্থাতেই পাপ। "না' বোলো না, ঠিক এই কথাটাই তোমার মনে জাগছে। কিন্তু মনে কোরো না এর উত্তর নেই। পিতার অনুরোধে ভৃগু তাঁর মাকে বধ করেছিলেন, আর ধর্মের অনুরোধে আমি আমার পিতৃব্যকে কেন বধ করব না?
    মন্ত্রী।
    কিন্তু দিল্লীশ্বর যদি শোনেন, তবে-
    প্রতাপ।
    আর যাই কর, দিল্লীশ্বরের ভয় আমাকে দেখিয়ো না!
    মন্ত্রী।
    প্রজারা জানতে পারলে কী বলবে?
    প্রতাপ।
    জানতে পারলে তো।
    মন্ত্রী।
    এ কথা কখনোই চাপা থাকবে না।
    প্রতাপ।
    দেখো মন্ত্রী, কেবল ভয় দেখিয়ে আমাকে দুর্বল করে তোলবার জন্যেই কি তোমাকে রেখেছি?
    মন্ত্রী।
    মহারাজ, যুবরাজ উদয়াদিত্য--
    প্রতাপ।
    দিল্লীশ্বর গেল, প্রজারা গেল, শেষকালে উদয়াদিত্য! সেই স্ত্রৈণ বালকটার কথা আমার কাছে তুলো না! দেখো দেখি মন্ত্রী, সে পাঠান দুটো এখনও এল না!
    মন্ত্রী।
    সেটা তো আমার দোষ নয় মহারাজ।
    প্রতাপ।
    দোষের কথা হচ্ছে না। দেরি কেন হচ্ছে তুমি কী অনুমান কর তাই জিজ্ঞাসা করছি।
    মন্ত্রী।
    শিমুলতলি তো কাছে নয়। কাজ সেরে আসতে দেরি তো হবেই।

    একজন পাঠানের প্রবেশ

    প্রতাপ।
    কী হল?
    পাঠান।
    মহারাজ, এতক্ষণ কাজ নিকেশ হয়ে গেছে।
    প্রতাপ।
    সে কী রকম কথা? তবে তুমি জান না?
    পাঠান।
    জানি বৈকি। কাজ শেষ হয়ে গেছে ভুল নেই, তবে আমি সে সময়ে উপস্থিত ছিলুম না। আমার ভাই হোসেন খাঁ'র উপর ভার আছে, সে খুব হুঁশিয়ার। মহারাজের পরামর্শমতে আমি খুড়া রাজাসাহেবের লোকজনদের তফাৎ করেই চলে আসছি।
    প্রতাপ।
    হোসেন যদি ফাঁকি দেয়।
    পাঠান।
    তোবা। সে তেমন বেইমান নয়। মহারাজ, আমি আমার শির জামিন রাখলুম।
    প্রতাপ।
    আচ্ছা, এইখানে হাজির থাকো, তোমার ভাই ফিরে এলে বক্‌শিশ মিলবে। (পাঠানের বাহিরে গমন) এটা যাতে প্রজারা টের না পায় সে চেষ্টা করতে হবে।
    মন্ত্রী।
    মহারাজ, এ কথা গোপন থাকবে না।
    প্রতাপ।
    কিসে তুমি জানলে?
    মন্ত্রী।
    আপনার পিতৃব্যের প্রতি বিদ্বেষ আপনি তো কোনোদিন লুকোতে পারেন নি। এমন-কি, আপনার কন্যার বিবাহেও আপনি তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন নি- তিনি বিনা নিমন্ত্রণেই এসেছিলেন। আর আজ আপনি অকারণে তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন, আর পথে এই কাণ্ডটি ঘটল, এমন অবস্থায় প্রজারা আপনাকেই মূল বলে জানবে।
    প্রতাপ।
    তা হলেই তুমি খুব খুশি হও! না?
    মন্ত্রী।
    মহারাজ, এমন কথা কেন বলছেন? আপনার ধর্ম-অধর্ম পাপ-পুণ্যের বিচার আমি করি নে, কিন্তু রাজ্যের ভালোমন্দর কথাও যদি আমাকে ভাবতে না দেবেন তবে আমি আছি কী করতে? কেবল প্রতিবাদ করে মহারাজের জেদ বাড়িয়ে তোলবার জন্যে?
    প্রতাপ।
    আচ্ছা, ভালোমন্দর কথাটা কী ঠাওরালে শুনি।
    মন্ত্রী।
    আমি এই কথাই বলছি, পদে পদে প্রজাদের মনে অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলবেন না। দেখুন, মাধবপুরের প্রজারা খুব প্রবল এবং আপনার বিশেষ বাধ্য নয়। তারা রাজ্যের সীমানার কাছে থাকে, পাছে আপনার প্রতিবেশী শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দেয়, এই ভয়ে তাদের গায়ে হাত তোলা যায় না। সেইজন্য মাধবপুর-শাসনের ভার যুবরাজের উপর দেবার কথা আমিই মহারাজকে বলেছিলেম।
    প্রতাপ।
    সে তো বলেছিলে। তার ফল কী হল দেখো-না। আজ দু বৎসরের খাজনা বাকি। সকল মহল থেকে টাকা এল, আর ওখান থেকে কী আদায় হল?
    মন্ত্রী।
    আজ্ঞে, আশীর্বাদ। তেমন সব বজ্জাত প্রজাও যুবরাজের পায়ের গোলাম হয়ে গেছে। টাকার চেয়ে কি তার কম দাম? সেই যুবরাজের কাছ থেকে আপনি মাধবপুরের ভার কেড়ে নিলেন। সমস্তই উল্টে গেল। এর চেয়ে তাঁকে না পাঠানোই ভালো ছিল। সেখানকার প্রজারা তো হন্যে কুকুরের মতো ক্ষেপে রয়েছে- তার পরে যদি এই কথাটা প্রকাশ হয়, তা হলে কী হয় বলা যায় না। রাজকার্যে ছোটোদের অবজ্ঞা করতে নেই মহারাজ! অসহ্য হলেই ছোটোরা জোট বাঁধে, জোট বাঁধলেই ছোটোরা বড়ো হয়ে ওঠে।
    প্রতাপ।
    সেই ধনঞ্জয় বৈরাগী তো মাধবপুরে থাকে?
    মন্ত্রী।
    আজ্ঞে হাঁ।
    প্রতাপ।
    সেই বেটাই যত নষ্টের গোড়া। ধর্মের ভেক ধরে সেই তো যত প্রজাকে নাচিয়ে তোলে। সেই তো প্রজাদের পরামর্শ দিয়ে খাজনা বন্ধ করিয়েছে। উদয়কে বলেছিলুম যেমন করে হোক তাকে আচ্ছা করে শাসন করে দিতে। কিন্তু উদয়কে জান তো? এ দিকে তার না আছে তেজ, না আছে পৌরুষ, কিন্তু একগুঁয়েমির অন্ত নেই। ধনঞ্জয়কে শাসন দূরে থাক্‌ তাকে আস্পর্ধা দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এবারে তার কণ্ঠিসুদ্ধ কণ্ঠ চেপে ধরতে হচ্ছে, তার পরে দেখা যাবে তোমার মাধবপুরের প্রজাদের কত বড়ো বুকের পাটা! আর দেখো, লোকজন আজই সব ঠিক করে রাখো-- খবরটা পাবামাত্রই রায়গড়ে গিয়ে বসতে হবে। সেইখানেই শ্রাদ্ধশান্তি করব- আমি ছাড়া উত্তরাধিকারী আর তো কাউকে দেখি নে।

    বসন্তরায়ের প্রবেশ। প্রতাপাদিত্য চমকিত হইয়া দণ্ডায়মান

    বসন্ত।
    আমাকে কিসের ভয় প্রতাপ? আমি তোমার পিতৃব্য, তাতেও যদি বিশ্বাস না হয় আমি বৃদ্ধ, তোমার কোনো অনিষ্ট করি এমন শক্তি নেই।

    [ প্রতাপ নীরব

    প্রতাপ, একবার রায়গড়ে চলো-- ছেলেবেলা কতদিন সেখানে কাটিয়েছ-- তার পরে বহুকাল সেখানে যাও নি।
    প্রতাপ।
    (নেপথ্যের দিকে চাহিয়া সগর্জনে) খবরদার! ওই পাঠানকে ছাড়িস নে!

    [ দ্রুত প্রস্থান


    [ বসন্তরায়ের প্রস্থান।


    প্রতাপ ও মন্ত্রীর পুনঃপ্রবেশ

    প্রতাপ।
    দেখো মন্ত্রী, রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ দেখা যাচ্ছে।
    মন্ত্রী।
    মহারাজ, এ বিষয়ে আমার কোনো অপরাধ নেই।
    প্রতাপ।
    এ বিষয়ের কথা তোমাকে কে বলছে? আমি বলছি, রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ দেখছি। সেদিন তোমাকে চিঠি রাখতে দিলেম, হারিয়ে ফেললে! আর-একদিন মনে আছে উমেশ রায়ের কাছে তোমাকে যেতে বলেছিলুম, তুমি লোক দিয়ে কাজ সেরেছিলে।
    মন্ত্রী।
    আজ্ঞে মহারাজ-
    প্রতাপ।
    চুপ করো! দোষ কাটাবার জন্যে মিথ্যে চেষ্টা কোরো না। যা হোক, তোমাকে জানিয়ে রাখছি, রাজকার্যে তুমি কিছুমাত্র মনোযোগ দিচ্ছ না। আর-একটা কথা তোমাকে বলে দিচ্ছি মন্ত্রী, সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে উদয় আছে। এমনি ক'রে সে নিজের চার দিকে জাল জড়াচ্ছে- এর পরে আমাকে দোষ দিতে পারবে না।

    তৃতীয় দৃশ্য

    উদয়াদিত্যের শয়নকক্ষ
    উদয়াদিত্য ও সুরমা
    উদয়।
    যাক্‌, চুকল।
    সুরমা।
    কী চুকল।
    উদয়।
    আমার উপর মাধবপুর শাসনের ভার মহারাজ রেখেছিলেন। টাকায় আট আনা বৃদ্ধি ধরে খাজনা আদায়ের হঠাৎ হুকুম এল। বৃষ্টি নেই, এবারে সেখানে অজন্মা-- তাই আমি--
    সুরমা।
    আমি তো তোমাকে আমার গহনাগুলো দিতে চেয়েছিলুম। তার থেকে-
    উদয়।
    তোমার গহনা কেনে এত বড়ো বুকের পাটা এ রাজ্যে আছে? আমি মহারাজকে বললুম, মাধবপুর থেকে বৃদ্ধি খাজনা আমি কোনোমতেই আদায় করতে পারব না। শুনে তিনি মাধবপুর আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। তিনি এখন কেবলই সৈন্য বাড়াচ্ছেন, অস্ত্র কিনছেন, টাকা তাঁর নিতান্ত চাই- তা প্রজা বাঁচুক আর মরুক।
    সুরমা।
    পরগনা তো কেড়ে নিলেন, কিন্তু তুমি চলে এলে প্রজারা যে মরবে!
    উদয়।
    আমি ঠিক করেছি, যে করে হোক তাদের পেটের ভাতটা জোগাব। শুনতে পেলে মহারাজ খুশি হবেন না- নিশ্চয় ভাববেন, আমি তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছি। উনি মনে করেন, আমি দয়া দিয়ে নাম কিনি। কিন্তু তোমার ঘরে আজ ফুলের মালার ঘটা কেন?
    সুরমা।
    রাজপুত্রকে রাজসভায় যখন চিনলে না, তখন যে তাকে চিনেছে সে তাকে মালা দিয়ে বরণ করবে।
    উদয়।
    সত্যি নাকি! তোমার ঘরে রাজপুত্র আসা যাওয়া করেন? তিনি কে শুনি? এ খবরটা জানতুম না!
    সুরমা।
    রামচন্দ্র যেমন ভুলেছিলেন তিনি অবতার, তোমারও সেই দশা। কিন্তু ভক্তকে ভোলাতে পারবে না!
    উদয়।
    রাজপুত্র! রাজার ঘরে কোনো জন্মে পুত্র জন্মাবে না, বিধাতার এই অভিশাপ।
    সুরমা।
    সে কী কথা?
    উদয়।
    রাজার ঘরে উত্তরাধিকারীই জন্মায়, পুত্র জন্মায় না।
    সুরমা।
    এ তুমি মনের ক্ষোভে বলছ।
    উদয়।
    কথাটা কি নূতন যে ক্ষোভ হবে? যখন এতটুকু ছিলুম তখন থেকে মহারাজ এইটেই দেখছেন যে, আমি তাঁর রাজ্যভার বইবার যোগ্য কি না? কেবলই পরীক্ষা, স্নেহ নেই।
    সুরমা।
    প্রিয়তম, দরকার কী স্নেহের। খুব কঠোর পরীক্ষাতেও তোমার জিত হবে। তোমার মতো রাজার ছেলে কোন্‌ রাজা পেয়েছে?
    উদয়।
    বল কী? পরীক্ষক তোমার পরামর্শ নিয়ে বিচার করবেন না, সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
    সুরমা।
    কারও পরামর্শ নিয়ে বিচার করতে হবে না- আগুনের পরীক্ষাতেও সীতার চুল পোড়ে নি! তুমি রাজ্যভার বহনের উপযুক্ত নও, এ কথা বললেই হল? এত বড়ো অবিচার কি জগতে কখনো টিকতে পারে?
    উদয়।
    রাজ্যভারটা নাই বা ঘাড়ের উপর পড়ল, তাতেই বা দুঃখ কিসের?
    সুরমা।
    না, না, ও কথা তোমার মুখে আমার সহ্য হয় না। ভগবান তোমাকে রাজার ছেলে করে পাঠিয়েছেন, সে কথা বুঝি অমন করে উড়িয়ে দিতে আছে! নাহয় দুঃখই পেতে হবে- তা বলে-
    উদয়।
    আমি দুঃখের পরোয়া রাখি নে। তুমি আমার ঘরে এসেছ, তোমাকে সুখী করতে পারি নে, আমার পৌরুষে সেই ধিক্‌কার!
    সুরমা।
    যে সুখ দিয়েছ তাই যেন জন্মজন্মান্তরে পাই।
    উদয়।
    সুখ যদি পেয়ে থাক তো নিজের গুণে, আমার শক্তিতে নয়। এ ঘরে আমার আদর নেই বলে তোমারও যে অপমান ঘটে; এমন-কি, মাও যে তোমাকে অবজ্ঞা করেন।
    সুরমা।
    আমার সব সম্মান যে তোমার প্রেমে, সে তো কেউ কাড়তে পারে নি।
    উদয়।
    তোমার পিতা শ্রীপুররাজ কিনা যশোরের অধীনতা স্বীকার করেন না- সেই হয়েছে তোমার অপরাধ- মহারাজ তোমার উপর রাগ দেখিয়ে তার শোধ তুলতে চান।
    নেপথ্যে।
    দাদা,দাদা!
    উদয়।
    কেও! বিভা বুঝি? (দ্বার খুলিয়া) কী বিভা? কী হয়েছে?
    বিভা।
    একটা কাণ্ড হয়ে গেছে। আমি আর বাঁচি নে!
    [ মুখ ঢাকিয়া কান্না
    সুরমা।
    (বিভার গলা জড়াইয়া ধরিয়া) কী হয়েছে ভাই, বল্‌!
    বিভা।
    আর-বার যখন উনি এখানে এসেছিলেন, ঠাট্টার সম্পর্ক ধরে ওঁকে কে ঠাট্টা করেছিল।
    সুরমা।
    সে তো জানি, ওই লক্ষ্মীছাড়া ছোঁড়া মাখনটা ওঁর কাপড়ের সঙ্গে একটা লেজ জুড়ে দিয়েছিল-বলেছিল-উনি রামচন্দ্র নন, রামদাস।
    বিভা।
    সে কথা তাঁরা ভুলতে পারেন নি। এবার এসে ঠাট্টায় জিততে পণ করে ওঁর রমাই ভাঁড়কে মেয়ে সাজিয়ে বাড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন-মাকে কী-একটা যা-তা বলেছে।
    উদয়।
    সর্বনাশ!
    বিভা।
    আমি তাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলুম-মোহন মালকে বলে তখনই তাকে বিদায় করে দিয়েছি। কিন্তু কী জানি যদি কেউ বুঝতে পেরে থাকে!
    উদয়।
    তোমার কি মনে হয় মা টের পেয়েছিলেন?
    বিভা।
    হতেও পারে মা হয়তো টের পেয়েছেন, কিন্তু অপমানটা পাছে ছড়িয়ে পড়ে, তাই চুপ করে গেলেন।
    উদয়।
    মা কখনো এত বড়ো সর্বনেশে কথাটা বাবাকে বলবেন না।
    বিভা।
    তা বলবেন না, কিন্তু কেমন করে বুঝব আর কেউ জেনেছে কি না।
    সুরমা।
    বিভা, ভয় পাস নে, নিশ্চয় কেউ টের পায় নি। পেলে এতক্ষণ আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত।
    উদয়।
    ব্যাপারটা তো কাল হয়ে গেছে?
    বিভা।
    হাঁ।
    উদয়।
    তা হলে আমি বলে দিচ্ছি ফাঁড়া কেটে গেছে। বিচার করতে মহারাজের এক মুহূর্ত বিলম্ব হয় না। খবর পেলে কালকের রাতটা কাটত না। তবু এক কাজ কর্‌, বিভা তুই এখনই যা। রামচন্দ্রকে বল্‌, এ বাড়ি থেকে চলে যেতে, যেন কিছুমাত্র বিলম্ব না করেন।
    বিভা।
    তুমি বলো-না দাদা, আমার কথা যদি না শোনেন।
    উদয়।
    না, আমি তাকে যেতে বললে সে অপমান বোধ করবে।
    [ বিভার প্রস্থান
    সুরমা।
    রাজা হলেই কি মানুষ নিজের খেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না?
    উদয়।
    সামান্য একটা মেয়েলি ঠাট্টার হার-জিতের কথা এই যশোরের রাজবাড়িতে স্বপ্নেও ভাবতে পারে, এত বড়ো নির্বোধ! এখানেও খেয়ালের রাজত্ব বটে, কিন্তু কত-বড়ো সব খেয়াল- বিধির লিখনকে মুছে ফেলে রক্তের অক্ষরে নতুন লিখন বসিয়ে দেওয়ার খেয়াল।

    বসন্তরায়ের প্রবেশ

    উদয়।
    একি, দাদামশায় যে! স্বপ্ন? না মতিভ্রম?
    বসন্ত।-।

    গান

    আজ তোমারে দেখতে এলেম
    অনেক দিনের পরে।
    ভয় কিছু নেই, সুখে থাকো,
    অধিক ক্ষণ থাকব নাকো-
    এসেছি এক নিমেষের তরে।
    দেখব শুধু মুখখানি,
    শুনব দুটি মধুর বাণী,
    আড়াল থেকে হাসি দেখে
    চলে যাব দেশান্তরে।
    সুরমা।
    দাদামশায়, কারো মুখে হাসি দেখবার জন্যে তোমাকে কোনোদিন আড়ালে থাকতে হয় নি।
    উদয়।
    তুমি যাই বল, হাসি দেখে দেশান্তরে যেতে ইচ্ছে হয় এমন হাসি আমরা কেউ হাসি নে।
    সুরমা।
    তুমি যে এলে আমরা কোনো খবর জানতুম না।
    বসন্ত।
    দিদি, এ সংসারে প্রত্যক্ষ এসে না পৌঁছলে, কে আসবে কে না আসবে তার ঠিক খবরটি তো পাওয়া যায় না।
    সুরমা।
    ওটা শঙ্করাচার্যের মতো কথা হল। তোমার ওই হাসিমুখে এমন কথা মানায় না।
    বসন্ত।
    সে কথা মিথ্যে বলিস নি ভাই। সংসার অনিত্য, জীবন অনিশ্চিত, এ-সব কথা ঘোর মিথ্যে। তোদের মুখ যখনই দেখি তখনই সংসার নিত্য, তখনই জীবন চিরদিনের, তা যেদিন মরি আর যেদিন বাঁচি।
    সুরমা।
    যে অমৃত-মুখের কথা বললে সেটিকে তোমার তৃষিত চক্ষু খুঁজে বেড়াচ্ছে, আমি কি বুঝতে পারছি নে?
    বসন্ত।
    ওটা, ভাই,মিথ্যে অভিমানের কথা বললি,মহাদেব বুকের মধ্যে রেখেছেন অন্নপূর্ণাকে, আর মাথায় উপরে রেখেছেন গঙ্গাকে-কাউকেই তাঁর ছাড়লে একদণ্ড চলে না। -তাঁর প্রাণের অন্নজল দুইই সমান চাই।
    সুরমা।
    আর আমার ঠাক্‌রুনদিদি! এখানে এসেই বুঝি ভুললে?
    বসন্ত।
    তিনি তো আমার চাঁদ। বিধাতা আমার কপালে লিখে দিয়েছেন। তাঁকে ভুলেও ভোলবার জো নেই।
    সুরমা।
    তিনি চাঁদের মতোই চুপ করে থাকেন বটে, আমি বোধ হয় গঙ্গার মতোই মুখরা।
    বসন্ত।
    সে কথা অস্বীকার করতে পারি নে। চক্ষু বুজে ওই স্নিগ্ধ কলকণ্ঠ নিয়তই মনে মনে শুনতে পাই।
    সুরমা।
    এত স্ততিবাক্যও চতুর্মুখ তোমার এক মুখে জোগান কী করে?
    বসন্ত।
    সে আমার এই বাগ্‌বাদিনীর গুণে-বিধিরও নয়, আমারও নয়।
    সুরমা।
    আর নয় দাদামশায়, মিষ্টির পরিমাণটা একলার পক্ষে কিছু বেশি হয়ে উঠেছে।

    বিভার দ্রুত প্রবেশ

    বসন্ত।
    বিভা! কী হয়েছে দিদি, তোমার মুখ অমন কেন?
    বিভা।
    মহারাজের কানে গিয়েছে।
    উদয়।
    কী সর্বনাশ! কেমন করে গেল? মা কিছু বলেছেন না কি?
    বিভা।
    না, মা বলেন নি। ওঁরা নিজেই থাকতে পারেন নি। এই নিয়ে আমাদের রাজবাড়ির লোকদের কাছে বড়াই করতে গিয়েছেন-তার থেকেই রাষ্ট্র হয়েছে।
    বসন্ত।
    কী হয়েছে ব্যাপারটা?
    উদয়।
    রামচন্দ্র ছেলেমানুষি করে অন্তঃপুরে তার ভাঁড়াকে পাঠিয়েছিল মেয়ে সাজিয়ে। সে কথা মহারাজের কানে উঠেছে, এখন কী হয় কিছুই বলা যায় না।
    বসন্ত।
    আমি একবাব প্রতাপের কাছে যাই।
    উদয়।
    এখন কিছু বোলো না- উলটো হবে। আগে দেখি মহারাজ কী হুকুম দেন।
    সুরমা।
    হুকুম যাই দিন, এখনই যশোর ছেড়ে ওঁদের পালানো চাই।

    রামমোহন মালের প্রবেশ

    রামমোহন।
    (বিভার প্রতি) তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি মা, ঘরে দেখতে পেলুম না, তাই এখানে এলুম।
    বিভা।
    (সভয়ে) কেন, কেন,কী হয়েছে!
    রামমোহন।
    কিছুই হয় নি। আজ কতকাল পরে মায়ের দেখা পেয়েছি। চারজোড়া শাঁখা এনেছি তুমি পরো, আমি দেখে যাই।
    উদয়।
    রামমোহন, তোমাদের নৌকো সব তৈরি আছে?
    রামমোহন।
    এখনই কিসের তৈরি যুবরাজ, কতদিন পরে আমাদের আসা, এখন তো শিগগির মাকে ছেড়ে যাচ্ছি নে।
    বিভা।
    মোহন, এখনই নৌকা তৈরি কর্‌ গে-একটুও দেরি করিস নে।
    রামমোহন।
    কেন মা?
    বিভা।
    বিপদ ঘটিয়েছে-তুই তো সব জানিস। ওই-যে ভাঁড় এসেছিল অন্তঃপুরে। সে কথা মহারাজের কানে গিয়েছে।
    রামমোহন।
    বেশ তো, এখনই তার মুণ্ডু নেন না- তার নোংরা মুখটা বন্ধ হলে আমরাও বাঁচি। আমি দরে এনে দেব তাকে-ভাবনা নেই।
    উদয়।
    রামমোহন,সে কীটটাকে কেউ ছোঁবেও না, তার চেয়ে বড়ো বিপদের ভয় আছে। তোমাদের সব চেয়ে বড়ো যে ছিপ নৌকো তার দাঁড়ি কত?
    রামমোহন।
    চৌষট্টি জন।
    উদয়।
    সেই নৌকোটা আমার এই জানলার সামনের ঘাটে এখনই তৈরি করে আনো। আজ রাত্তিরেই কোনোমতে রওনা করে দিতে হবে।
    রামমোহন।
    দেরি হবে না যুবরাজ, দণ্ড দুয়েকের মধ্যে সব তৈরি করে রেখে দেব। কী করতে হবে বলে দাও।
    উদয়।
    এই জানলা দিয়ে তাঁকে নাবিয়ে দিতে হবে, তার পরে রাতারাতি তোরা দাঁড় টেনে চলে যাবি।
    [ রামমোহনের প্রস্থান
    বিভা বসিয়া পড়িয়া মুখে অঞ্চল দিয়া রোদন
    বসন্ত।
    দিদি, ভয় করিস নে, ভগবানের কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বেঁচে থাকতে তোর ভয় নেই রে।
    বিভা।
    ভয় না, দাদামশায়, লজ্জা! ছি ছি, কী লজ্জা! রাজার ছেলে হয়ে এমন ব্যবহার তো আমি ভাবতে পারি নে। জন্মের মতো আমার যে মাথা হেঁট হয়ে গেল।
    বসন্ত।
    এখন ও-সব কথা ভাবিস নে, আপাতত--
    বিভা।
    অপরাধ করলে আমি নিজে মহারাজের কাছে মাপ চাইতে যেতুম।কিন্তু এ যে তারও বেশি। এ যে নীচতা। আমার মাপ চাইবার মুখ রইল না।
    সুরমা।
    বিভা, এখন মনটা বিচলিত করিস নে।
    বিভা।
    বউদিদি, যদি মহারাজ শাস্তি দেন, আমার তো কিছুই বলবার থাকবে না। তাঁর সম্মান তাঁর মেয়ে-জামাইয়ের সুখদুঃখের চেয়ে অনেক বড়ো, তাঁর মেয়ে হয়ে এ কথা কি আমি বুঝতে পারি নে।
    বসন্ত।
    এখন রামচন্দ্র আছেন কোথায়?
    বিভা।
    বাইরের বৈঠকখানায় নাচগান জমিয়েছেন--শহর থেকে তিনি সব নাচওআলী আনিয়েছেন,আজ দুদিন ধরে এই সব চলছে।
    বসন্ত।
    কলি যখন সর্বনাশ করে তখন আমোদ করতে করতেই করে। যেমন করে পার বিভা, তুমি এখনই তাকে ডাকিয়ে আনাও।
    [ বিভার প্রস্থান
    নেপথ্যে।
    উদয়,উদয়!
    উদয়।
    ওই-যে মহারাজ আসছেন!

    [ সুরমার পলায়ন


    প্রতাপাদিত্যের প্রবেশ

    প্রতাপ।
    শুনেছ সব কথা?
    উদয়।
    শুনেছি।
    প্রতাপ।
    লছমন সর্দারকে হুকুম করেছি,কাল সকালে রামচন্দ্র যখন শয়নঘর থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন তার মুণ্ডু কাটা যাবে। আজ রাত্রে অন্তঃপুরের পাহারার ভার তোমার উপরে।
    উদয়।
    আমার উপরে মহারাজ? এ যে আমাকে শাস্তি ।
    প্রতাপ।
    শাস্তি আমাকেও নয়? তা বলে রাজার কর্তব্য করতে হবে না?
    বসন্ত।
    বাবা প্রতাপ! (প্রতাপাদিত্য নিরুত্তর) বাবা প্রতাপ, এ ও কি সম্ভব?
    প্রতাপ।
    কেন সম্ভব নয়?
    বসন্ত।
    ছেলেমানুষ, সে তো অবজ্ঞার পাত্র, সে কি তোমার ক্রোধের যোগ্য?
    প্রতাপ।
    আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়, এ কথা যে বোকা না'ও বোঝে তারও হাত পোড়ে। দুর্‌বুদ্ধি যার মাথায় জোগাতে পারে সে বুদ্ধির ফলটা কী হবে সে কি তার মাথায় জোগায় না? দুঃখ এই, বুদ্ধিটা যখন মাথায় জোগাবে মাথাটা তখন দেহে থাকবে না।
    বসন্ত।
    অপরাধ যে করে সে দুর্বল, ক্ষমা যে করে শক্তি তারই, এ কথা ভুলো না।
    প্রতাপ।
    দেখো পিতৃব্য ঠাকুর, রায়বংশের কিসে মান-অপমান সে বোধ যদি তোমার থাকবে তা হলে পাকা মাথায় আজ মোগল-বাদশার শিরোপা জড়িয়ে বেড়াতে পারতে কি? তোমারও লাঞ্ছিত মাথার স্থান এই ধুলায়, আমারই দুর্ভাগ্য তোমাকে বাঁচিয়ে দিলে। এই তোমাকে স্পষ্ট বললুম। খুড়োমশায়, এখন আমার নিদ্রার সময়।
    বসন্ত।
    বুঝেছি প্রতাপ, একবার যে ছুরি তোমার খাপ থেকে বেরোয় রক্ত না নিয়ে সে ফিরবে না। তা নিক, যে তার প্রথম লক্ষ্য ছিল এখনও তো সামনেই আছে। প্রতাপ, একবার বিভার কথা ভেবে দেখো।
    প্রতাপ।
    আচ্ছা, তবে ডাকো বিভাকে।

    বিভার প্রবেশ

    ওই-যে এসেছে। বিভা!
    বিভা।
    মহারাজ!
    প্রতাপ।
    সকল কথা শুনেছ বিভা?
    বিভা।
    হাঁ।
    প্রতাপ।
    তোমার মাকে, আমাদের অন্তঃপুরকে কী রকম অপমান করেছে, তা তো জান?
    বিভা।
    জানি।
    প্রতাপ।
    আমি যদি তার প্রাণদণ্ড দিই তবে সেটা অন্যায় হবে কি?
    বিভা।
    না।
    বসন্ত।
    দিদি, কী বললি দিদি! মহারাজের পায়ে ধরে মাপ চেয়ে নে।

    [ বিভা নিরুত্তর

    প্রতাপ।
    খুড়ামহারাজ, মনে রেখো বিভা আমারই মেয়ে।
    উদয়।
    মহারাজ, আপনি দণ্ডদাতা, আপনিই শাস্তি দিন। কিন্তু এ শাস্তির দণ্ডভার আমাদের উপরে দেবেন না।
    প্রতাপ।
    কী বলতে চাও তুমি?
    উদয়।
    পাহারা দেবার লোক মহারাজের অনেক আছে, তাদের স্নেহ নেই, এই জন্যে তাদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়েই কর্তব্যপালন করবে। আমার উপরে পাহারা দেবার ভার দেবেন না।
    প্রতাপ।
    লোক থাকবে আমার, কিন্তু দায় থাকবে তোমার ।
    উদয়।
    আমি আমার স্নেহকে অতিক্রম করতে পারব না।
    প্রতাপ।
    না পার তো তারও জবাবদিহি আছে।
    [ প্রস্থান
    উদয়।
    কোথায় ফাঁক আছে, একবার দেখে আসি।
    বসন্ত।
    কিন্তু, দাদা, তুমি এতে হাত যদি দাও তা হলে--
    উদয়।
    তা হলে যা হবে সেটা তো এখনকার কথা নয়-এখনকার কথা হচ্ছে হাত দেওয়াই চাই।

    চতুর্থ দৃশ্য

    নৃত্যসভা
    রামচন্দ্র। নটনটীর দল
    রামমোহনের প্রবেশ
    রামমোহন।
    একবার উঠে আসুন।
    রামচন্দ্র।
    এখন না, যাঃ, বিরক্ত করিস নে। গান ছেড়ো না।
    রামমোহন।
    শুনতেই হবে।
    রামচন্দ্র।
    কাল সকালে শুনব। দেখ্‌, বিরক্ত করিস নে।
    রামমোহন।
    যুবরাজ ডাকছেন, জরুরি কাজ আছে।
    রামচন্দ্র।
    বুঝেছি, শালা বুঝি ঠাট্টার জবাব দিতে চায়! পারবে না আমার সঙ্গে।
    রামমোহন।
    ঠাট্টা শেষ হয়ে গেছে,এখন বিপদের পালা। শীঘ্র এসো।
    রামচন্দ্র।
    আর ভয় দেখাতে হবে না, এখন আর সময় নেই।
    রামমোহন।
    এ দিকেও সময় একটুও নেই। আচ্ছা, এই দিকে আসুন, বলছি। (রামচন্দ্রকে জনান্তিকে) প্রতাপাদিত্য মহারাজ সব কথা শুনেছেন।
    রামচন্দ্র।
    না শুনলে মজাটা কী।
    রামমোহন।
    কী বলেন মহারাজ, মজা! তিনি আপনার শ্বশুর, আপনার ঠাট্টার সম্পর্ক তো নন।
    রামচন্দ্র।
    আমার ঠাট্টা চলছে শালাদের নিয়ে। তিনি সেটা যদি গায়ে মাখেন সেটা কি আমার দোষ?
    রামমোহন।
    সে বিচার এখন নয়। আপাতত প্রাণদণ্ডের হুকুম হয়েছে, কাল সকালেই-
    রামচন্দ্র।
    তুমি শুনলে কোথা থেকে?
    রামমোহন।
    যুবরাজের নিজের মুখ থেকে।
    রামচন্দ্র।
    তোর মতো বোকা দুনিয়ায় নেই রে। যুবরাজ ঠাট্টা করেছে বুঝতে পারিস নে! প্রাণদণ্ড!
    রামমোহন।
    দোহাই তোমার, একটুও ঠাট্টা নয়।
    রামচন্দ্র।
    আমাকে ঠাট্টায় ওরা হারাতে পারবে না। তুই এখন যা।
    রামমোহন।
    আচ্ছা,আমি যুবরাজকে ডেকে আনছি।
    [ প্রস্থান
    রামচন্দ্র।
    (নটীদের প্রতি) ধরো গান।-

    নটীদের নাচ ও গান

    আমার নয়ন তোমার নয়নতলে
    মনের কথা খোঁজে।
    সেথায় কালো ছায়ার মায়ার ঘোরে
    পথ হারালো ও যে।
    নীরব দিঠে শুধায় যত
    পায় না সাড়া মনের মতো,
    অবুঝ হয়ে রয় সে চেয়ে
    অশ্রুধারায় মজে।
    তুমি আমার কথার আভাখানি
    পেয়েছ কি মনে।
    এই-যে আমি মালা আনি
    তার বাণী কেউ শোনে?
    পথ দিয়ে যাই, যেতে যেতে
    হাওয়ায় ব্যথা দিই যে পেতে;
    বাঁশি বিছায় বিষাদ-ছায়া
    তার ভাষা কেউ বোঝে?
    রামচন্দ্র।
    বেটা রামমোহন আমার মনটা মিছিমিছি খারাপ করে দিয়ে গেল। এ কেমন গোঁয়ার-গোছের ঠাট্টা এ বাড়ির? শ্যালাদের রসের জ্ঞান একটুও নেই। থেমো না, আর-একটা গান ধরো। একটু দ্রুততালে।

    নটীদের গান

    না ব'লে যেয়ো না চলে মিনতি করি
    গোপনে জীবন মন লইয়া হরি।
    সারা নিশি জেগে থাকি
    ঘুমে ঢ'লে পড়ে আঁখি,
    ঘুমালে হারাই পাছে সে ভয়ে মরি।
    চকিত চমকি বঁধু তোমারে খুঁজি,
    থেকে থেকে মনে হয় স্বপন বুঝি।
    নিশিদিন চাহে হিয়া
    পরান পসারি দিয়া
    অধীর চরণ তব বাঁধিয়া ধরি।

    (রামচন্দ্র মাঝে মাঝে বাহবা দিতেছেন, মাঝে মাঝে উৎকণ্ঠিতভাবে দ্বারের দিকে চাহিতেছেন।)


    উদয়াদিত্যের প্রবেশ

    উদয়।
    উঠে এস শীঘ্র।
    রামচন্দ্র।
    একেবারে জোর তলব যে।
    উদয়।
    দেরি কোরো না, এসো শিগগির।
    রামচন্দ্র।
    বোনের পেয়াদা হয়ে এসেছ বুঝি, তলব দিতে?
    উদয়।
    আমার কর্তব্য আমি করলুম। যদি না শোন তো থাকো। বিধাতা যাকে মারেন, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না।
    [ প্রস্থান
    রামচন্দ্র।
    আওয়াজটা ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে না। একবার দেখেই আসি গে। (নটীদের প্রতি) তোমরা গান থামিয়ো না- এখনও রাত আছে বাকি। আমি এখনই আসছি।
    [ প্রস্থান
    নটীদের গান
    ফুল তুলিতে ভুল করেছি
    প্রেমের সাধনে।
    বঁধু তোমায় বাঁধব কিসে
    মধুর বাঁধনে।
    ভোলাব না মায়ার ছলে,
    রইব তোমার চরণতলে,
    মোহের ছায়া ফেলব না মোর
    হাসি-কাঁদনে।
    রইল শুধু বেদন-ভরা আশা,
    রইল শুধু প্রাণের নীরব ভাষা।
    নিরাভরণ যদি থাকি
    চোখের কোণে চাইবে না কি,
    যদি আঁখি নাই বা ভোলাই
    রঙের ধাঁদনে।
    প্রথমা নটী।
    কই, এখনও তো ফিরলেন না।
    দ্বিতীয়া নটী।
    আর তো ভাই পারি নে। ঘুম পেয়ে আসছে।
    তৃতীয়া নটী।
    ফের কি সভা জমবে নাকি!
    প্রথমা নটী।
    কেউ যে জেগে আছে তা তো বোধ হচ্ছে না। এতবড়ো রাজবাড়ি সমস্ত যেন হাঁ হাঁ করছে।
    দ্বিতীয়া নটী।
    চাকররাও সব হঠাৎ কে কোথায় যেন চলে গেল।
    তৃতীয়া নটী।
    বাতিগুলো নিবে আসছে, কেউ জ্বালিয়ে দেবে না?
    প্রথমা নটী।
    আমার কেমন ভয় করছে ভাই।
    দ্বিতীয়া নটী।
    (বাদকদিগকে দেখাইয়া দিয়া) ওরাও যে সব ঘুমোতে লাগল-- কী মুশকিলেই পড়া গেল। ওদের তুলে দে-না। কেমন গা ছম্‌ ছম্‌ করছে।
    তৃতীয়া নটী।
    মিছে না ভাই। একটা গান ধরো। ওগো, তোমরা ওঠো, ওঠো।
    বাদকগণ।
    (ধড়্‌ফড়্‌ করিয়া উঠিয়া) অ্যাঁ অ্যাঁ, এসেছেন নাকি?
    প্রথমা নটী।
    তোমরা একবার বেরিয়ে গিয়ে দেখো না গো। কেউ কোথাও নেই। আমাদের আজকে বিদায় দেবে না নাকি?
    একজন বাদক।
    (বাহিরে গিয়া ফিরিয়া আসিয়া) ও দিকে যে সব বন্ধ।
    প্রথমা নটী।
    অ্যাঁ! বন্ধ! আমাদের কি কয়েদ করলে নাকি?
    দ্বিতীয়া নটী।
    দূর। কয়েদ করতে যাবে কেন?
    প্রথমা নটী।
    ভালো লাগছে না। কী হল বুঝতে পারছি নে। চলো ভাই, আর এখানে নয়। একটা কী কাণ্ড হচ্ছে।
    [প্রস্থান
    রাজমহিষীর প্রবেশ
    রাজমহিষী।
    কই এদের মহলেও তো মোহনকে দেখতে পাচ্ছি নে। কী হল বুঝতে পারছি নে। বামী!

    বামীর প্রবেশ

    এ দিক্‌কার খাওয়াদাওয়া তো সব শেষ হল, মোহনকে খুঁজে পাচ্ছি নে কেন।
    বামী।
    মা, তুমি অত ভাবছ কেন। তুমি শুতে যাও, রাত যে পুইয়ে এল, তোমার শরীরে সইবে কেন।
    রাজমহিষী।
    সে কি হয়। আমি যে তাকে নিজে বসিয়ে খাওয়াব বলে রেখেছি।
    বামী।
    নিশ্চয় রাজকুমারী তাকে খাইয়েছেন। তুমি চলো, শুতে চলো।
    রাজমহিষী।
    আমি ওই মহলে খোঁজ করতে যাচ্ছিলুম, দেখি সব দরজা বন্ধ- এর মানে কী, কিছুই বুঝতে পারছি নে।
    বামী।
    বাড়ীতে গোলমাল দেখে রাজকুমারী তাঁর মহলে দরজা বন্ধ করেছেন। অনেক দিন পরে জামাই এসেছেন, আজ লোকজনের ভিড় সইবে কেন। চলো, তুমি শুতে চলো।
    রাজমহিষী।
    কী জানি বামী, আজ ভালো লাগছে না। প্রহরীদের ডাক্‌তে বললুম, তাদের কারো কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না।
    বামী।
    যাত্রা হচ্ছে, তারা তাই আমোদ করতে গেছে।
    রাজমহিষী।
    মহারাজ জানতে পারলে যে তাদের আমোদ বেরিয়ে যাবে। উদয়ের মহলও যে বন্ধ, তারা ঘুমিয়েছে বুঝি!
    বামী।
    ঘুমোবেন না! বল কী। রাত কি কম হয়েছে।
    রাজমহিষী।
    গান-বাজনা ছিল, জামাইকে নিয়ে একটু আমোদ-আহ্লাদ করবে না? ওরা মনে কি ভাববে বলো তো। এ-সমস্তই ওই বউমার কাণ্ড। একটু বিবেচনা নেই। রোজই তো ঘুমোচ্ছে-একটা দিন কি আর-
    বামী।
    যাক্‌, সে-সব কথা কাল হবে-আজ চলো।
    রাজমহিষী।
    মঙ্গলার সঙ্গে তোর দেখা হয়েছে তো?
    বামী।
    হয়েছে বৈকি।
    রাজমহিষী।
    ওষুধের কথা বলেছিস?
    বামী।
    সে-সব ঠিক হয়ে গেছে।
    [ উভয়ের প্রস্থান
    প্রতাপাদিত্য প্রহরী পীতাম্বর ও অনুচরের প্রবেশ
    প্রতাপ।
    কত রাত আছে?
    পীতাম্বর।
    এখনও চার দণ্ড রাত আছে।
    প্রতাপ।
    কী যেন একটা গোলমাল শুনলুম।
    পীতাম্বর।
    আজ্ঞে হাঁ,তাই শুনেই আমি আসছি।
    প্রতাপ।
    কী হয়েছে?
    পীতাম্বর।
    আসবার সময় দেখলুম বাইরের প্রহরীরা দ্বারে নেই।
    প্রতাপ।
    অন্তঃপুরের প্রহরীরা?
    পীতাম্বর।
    হাত-পা-বাঁধা পড়ে আছে।
    প্রতাপ।
    তারা কী বললে?
    পীতাম্বর।
    আমার কথার কোনো জবাব দিলে না-হয়তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
    প্রতাপ।
    রামচন্দ্র রায় কোথায়? উদয়াদিত্য বসন্তরায় কোথায়?
    পীতাম্বর।
    বোধ করি তাঁরা অন্তঃপুরেই আছেন।
    প্রতাপ।
    বোধ করি! তোমার বোধ-করার কথা কে জিজ্ঞাসা করছে। মন্ত্রীকে ডাকো।
    [ পীতাম্বরের প্রস্থান
    মন্ত্রীর প্রবেশ
    মন্ত্রী।
    মহারাজ, রাজজামাতা-
    প্রতাপ।
    রামচন্দ্ররায়-
    মন্ত্রী।
    হাঁ, তিনি রাজপুরী পরিত্যাগ করে গেছেন।
    প্রতাপ।
    পরিত্যাগ করে গেছেন, প্রহরীরা গেল কোথা?
    মন্ত্রী।
    বহির্‌দ্বারের প্রহরীরা পালিয়ে গেছে।
    প্রতাপ।
    (মুষ্টি বদ্ধ করিয়া) পালিয়ে গেছে? পালাবে কোথায়? যেখানে থাকে তাদের খুঁজে আনতে হবে। অন্তঃপুরের পাহারায় কে কে ছিল?
    মন্ত্রী।
    সীতারাম আর ভাগবত।
    প্রতাপ।
    ভাগবত ছিল? সে তো হুঁশিয়ার; সেও কি উদয়ের সঙ্গে যোগ দিলে?
    মন্ত্রী।
    সে হাত-পা-বাঁধা পড়ে আছে।
    প্রতাপ।
    হাত-পা-বাঁধা আমি বিশ্বাস করি নে। হাত-পা ইচ্ছে করে বাঁধিয়েছে।
    আচ্ছা, সীতারামকে নিয়ে এস,সেই গর্দভের কাছ থেকে কথা বের করা শক্ত হবে না।
    মন্ত্রীর প্রস্থান
    ও সীতারামকে লইয়া পুনঃপ্রবেশ
    প্রতাপ।
    অন্তঃপুরের দ্বার খোলা হল কী করে।
    সীতারাম।
    (করজোড়ে) দোহাই মহারাজ,আমার কোনো দোষ নেই।
    প্রতাপ।
    সে কথা তোকে কে জিজ্ঞাসা করছে।
    সীতারাম।
    আজ্ঞা না, মহারাজ--যুবরাজ--যুবরাজ আমাকে বলপূর্বক বেঁধে--

    ব্যস্তভাবে বসন্তরায়ের প্রবেশ

    সীতারাম।
    যুবরাজকে নিষেধ করলুম, তিনি--
    বসন্ত।
    হাঁ হাঁ, সীতারাম কী বললি? অধর্ম করিস নে সীতারাম, উদয়াদিত্যের এতে কোনো দোষ নেই।
    সীতারাম।
    আজ্ঞা না, যুবরাজের কোনো দোষ নেই।
    প্রতাপ।
    তবে কার দোষ!
    সীতারাম।
    আজ্ঞে না।
    প্রতাপ।
    তবে কার দোষ?
    সীতারাম।
    আজ্ঞা যুবরাজ-
    প্রতাপ।
    তাঁর সঙ্গে আর কে ছিল?
    সীতারাম।
    আজ্ঞে,বউরানীমা-
    প্রতাপ।
    বউরানী? ওই সেই শ্রীপুরের- (বসন্তরায়ের দিকে চাহিয়া) উদয়াদিত্যের এ অপরাধের মার্জনা নেই।
    বসন্ত।
    বাবা প্রতাপ, এতে উদয়ের কোনো দোষ ছিল না।
    প্রতাপ।
    দোষ ছিল না! দেখো, তুমি তার পক্ষ নিয়ে যদি কথা কও তাতে তার ভালো হবে না--এই আমি বলে দিলুম।
    [বসন্তরায় কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধারে উঠিয়া প্রস্থান
    •  
    •  

    Rendition

    Please Login first to submit a rendition. Click here for help.