আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি। দিন চলে যায়, আমি আনমনে তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে, ওগো প্রাণে মনে আমি যে তাহার পরশ পাবার প্রয়াসী। আমি সুদূরের পিয়াসি। ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। মোর ডানা নাই, আছি এক ঠাঁই, সে কথা যে যাই পাসরি। আমি উৎসুক হে, হে সুদূর, আমি প্রবাসী। তুমি দুর্লভ দুরাশার মতো কী কথা আমায় শুনাও সতত। তব ভাষা শুনে তোমারে হৃদয় জেনেছে তাহার স্বভাষী। হে সুদূর,আমি প্রবাসী। ওগো সুদূর,বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। নাহি জানি পথ, নাহি মোর রথ সে কথা যে যাই পাসরি। ' আমি উন্মনা হে, হে সুদূর,আমি উদাসী। রৌদ্র-মাখানো অলস বেলায় তরুমর্মরে, ছায়ার খেলায়, কী মুরতি তব নীলাকাশশায়ী নয়নে উঠে গো আভাসি। হে সুদূর,আমি উদাসী। ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাসরি।
ছেড়ে গেলে হে চঞ্চলা, হে পুরাতন সহচরী! ইচ্ছা বটে বছর কতক তোমার জন্য বিলাপ করি, সোনার স্মৃতি গড়িয়ে তোমার বসিয়ে রাখি চিত্ততলে, একলা ঘরে সাজাই তোমায় মাল্য গেঁথে অশ্রুজলে-- নিদেন কাঁদি মাসেকখানেক তোমায় চির-আপন জেনেই-- হায় রে আমার হতভাগ্য! সময় যে নেই, সময় যে নেই। বর্ষে বর্ষে বয়স কাটে, বসন্ত যায় কথায় কথায়, বকুলগুলো দেখতে দেখতে ঝ'রে পড়ে যথায় তথায়, মাসের মধ্যে বারেক এসে অস্তে পালায় পূর্ণ-ইন্দু, শাস্ত্রে শাসায় জীবন শুধু পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু-- তাঁদের পানে তাকাব না তোমায় শুধু আপন জেনেই সেটা বড়োই বর্বরতা-- সময় যে নেই, সময় যে নেই । এসো আমার শ্রাবণ-নিশি, এসো আমার শরৎলক্ষ্ণী, এসো আমার বসন্তদিন লয়ে তোমার পুষ্পপক্ষী, তুমি এসো, তুমিও এসো, তুমি এসো, এবং তুমি, প্রিয়ে, তোমরা সবাই জান ধরণীর নাম মর্তভূমি-- যে যায় চলে বিরাগভরে তারেই শুধু আপন জেনেই বিলাপ করে কাটাই, এমন সময় যে নেই, সময় যে নেই। ইচ্ছে করে বসে বসে পদ্যে লিখি গৃহকোণায় "তুমিই আছ জগৎ জুড়ে'-- সেটা কিন্তু মিথ্যে শোনায়। ইচ্ছে করে কোনোমতেই সান্ত্বনা আর মান্ব না রে, এমন সময় নতুন আঁখি তাকায় আমার গৃহদ্বারে-- চক্ষু মুছে দুয়ার খুলি তারেই শুধু আপন জেনেই, কখন তবে বিলাপ করি? সময় যে নেই, সময় যে নেই।
১ প্রহরিষ্যন্ প্রিয়ং ব্রূয়াৎ প্রহৃত্যাপি প্রিয়োত্তরম্॥ অপি চাস্য শিরশ্ছিত্ত্বা রুদ্যাৎ শোচেৎ তথাপি চ॥ [১] --মহাভারত, আদিপর্ব ১৪০| ৫৬ ১ মারিতে মারিতে কহিবে মিষ্ট, মারিয়া কহিবে আরো। মাথাটা কাটিয়া কাঁদিয়া উঠিবে যতটা উচ্চে পারো॥ ২ সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি বাপ্রিয়ম্। প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতঃ॥ --মহাভারত, শান্তিপর্ব ১৭৪|৩৯ ২ সুখ বা হোক দুখ বা হোক, প্রিয় বা অপ্রিয়, অপরাজিত হৃদয়ে সব বরণ করিয়া নিয়ো॥ পাঠান্তর সুখ হোক দুঃখ হোক, প্রিয় হোক অথবা অপ্রিয়, যা পাও অপরাজিত হৃদয়ে বহন করি নিয়ো॥ পাঠান্তর আসুক সুখ বা দুঃখ, প্রিয় বা অপ্রিয়, বিনা পরাজয়ে তারে বরণ করিয়ো॥ ৩ নাধর্মশ্চরিতো লোকে সদ্যঃ ফলতি গৌরিব। শনৈরাবর্তমানস্তু কর্তুর্মুলানি কৃন্ততি॥ যদি নাত্মনি পুত্রেষু ন চেৎ পুত্রেষু নপ্তৃষু। ন ত্বেব তু কৃতোহধর্মঃ কর্তুর্ভবতি নিষ্ফলঃ॥ অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি। ততঃ সপত্নাঞ্জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি॥ --মনুসংহিতা, ৪|১৭২-৭৪ ৩ গাভী দুহিলেই দুগ্ধ পাই তো সদ্যই, কিন্তু অধর্মের ফল মেলে না অদ্যই। জানি তার আবর্তন অতি ধীরে ধীরে সমূলে ছেদন করে অধর্মকারীরে॥ আপনিও ফল তার নাহি পায় যদি, পুত্র বা পৌত্রেও তাহা ফলে নিরবধি। এ কথা নিশ্চিত জেনো অধর্ম যে করে নিষ্ফল হয় না কভু কালে কালান্তরে॥ আপাতত বাড়ে লোক অধর্মের দ্বারা, অধর্মেই আপনার ভালো দেখে তারা। এ পথেই শত্রুদের পরাজয়২করে, শেষে কিন্তু একদিন সমূলেই মরে॥ ৩ টীকা : ১ সুভাষিতরত্নভাণ্ডাগার-ধৃত পাঠ। মহাভারতের প্রচলিত পাঠ-- প্রহরিষ্যন্ প্রিয়ং ব্রূয়াৎ প্রহরন্নপি ভারত। প্রহৃত্য চ কৃপায়িত শোচেত চ রুদেত চ॥ ২ পাঠান্তর : পরাস্ত ৩ শেষ ছত্র-দুটির পাঠান্তর-- অধর্মেই শত্রুদের করে পরাজয় শেষে কিন্তু সমূলে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।