মরণমাতা, এই যে কচি প্রাণ, বুকের এ যে দুলাল তব, তোমারই এ যে দান। ধুলায় যবে নয়ন আঁধা, জড়ের স্তূপে বিপুল বাধা, তখন দেখি তোমারই কোলে নবীন শোভমান। নবদিনের জাগরণের ধন, গোপনে তারে লালন করে তিমির-আবরণ। পরদাঢাকা তোমার রথে বহিয়া আনো প্রকাশপথে নূতন আশা, নূতন ভাষা, নূতন আয়োজন। চলে যে যায় চাহে না আর পিছু, তোমারই হাতে সঁপিয়া যায় যা ছিল তার কিছু। তাহাই লয়ে মন্ত্র পড়ি নূতন যুগ তোলো যে গড়ি-- নূতন ভালোমন্দ কত, নূতন উঁচুনিচু। রোধিয়া পথ আমি না রব থামি; প্রাণের স্রোত অবাধে চলে তোমারই অনুগামী। নিখিলধারা সে স্রোত বাহি ভাঙিয়া সীমা চলিতে চাহি, অচলরূপে রব না বাঁধা অবিচলিত আমি। সহজে আমি মানিব অবসান, ভাবী শিশুর জনমমাঝে নিজেরে দিব দান। আজি রাতের যে-ফুলগুলি জীবনে মম উঠিল দুলি ঝরুক তারা কালি প্রাতের ফুলেরে দিতে প্রাণ।
দাঁড়িয়ে আছ আড়ালে, ঘরে আসবে কিনা ভাবছ সেই কথা। একবার একটু শুনেছি চুড়ির শব্দ। তোমার ফিকে পাটকিলে রঙের আঁচলের একটুখানি দেখা যায় উড়ছে বাতাসে দরজার বাইরে। তোমাকে দেখতে পাচ্ছি নে, দেখছি পশ্চিম আকাশের রোদ্দুর চুরি করেছে তোমার ছায়া, ফেলে রেখেছে আমার ঘরের মেঝের 'পরে। দেখছি শাড়ির কালো পাড়ের নীচে থেকে তোমার কনক-গৌরবর্ণ পায়ের দ্বিধা ঘরের চৌকাঠের উপর। আজ ডাকব না তোমাকে। আজ ছড়িয়ে পড়েছে আমার হালকা চেতনা-- যেন কৃষ্ণপক্ষের গভীর আকাশে নীহারিকা, যেন বর্ষণশেষে মিলিয়ে-আসা সাদা মেঘ শরতের নীলিমায়। আমার ভালোবাসা যেন সেই আল-ভেঙে-যাওয়া খেতের মতো অনেক দিন হল চাষি যাকে ফেলে দিয়ে গেছে চলে; আনমনা আদিপ্রকৃতি তার উপরে বিছিয়েছে আপন স্বত্ব নিজের অজানিতে। তাকে ছেয়ে উঠেছে ঘাস, উঠেছে অনামা গাছের চারা সে মিলে গেছে চার দিকের বনের সঙ্গে সে যেন শেষরাত্রির শুকতারা, প্রভাত-আলোয় ডুবিয়ে দিল তার আপন আলোর ঘটখানি। আজ কোনো-সীমানা-দেওয়া নয় আমার মন, হয়তো তাই ভুল বুঝবে আমাকে। আগেকার চিহ্নগুলো সব গেছে মুছে, আমাকে এক করে নিতে পারবে না কোনোখানে কোনো বাঁধনে বেঁধে।