সে পরম পরিপূর্ণ প্রভাতের লাগি, হে ভারত, সর্বদুঃখে রহো তুমি জাগি সরলনির্মলচিত্ত-- সকল বন্ধনে আত্মারে স্বাধীন রাখি, পুষ্প ও চন্দনে আপনার অন্তরের মাহাত্ম্যমন্দির সজ্জিত সুগন্ধি করি, দুঃখনম্রশির তাঁর পদতলে নিত্য রাখিয়া নীরবে। তাঁ' হতে বঞ্চিত করে তোমারে এ ভবে এমন কেহই নাই-- সেই গর্বভরে সর্বভয়ে থাকো তুমি নির্ভয় অন্তরে তাঁর হস্ত হতে লয়ে অক্ষয় সম্মান। ধরায় হোক-না তব যত নিম্ন স্থান তাঁর পাদপীঠ করো সে আসন তব যাঁর পাদরেণুকণা এ নিখিল ভব।
কে তুমি দিয়েছ স্নেহ মানবহৃদয়ে, কে তুমি দিয়েছ প্রিয়জন! বিরহের অন্ধকারে কে তুমি কাঁদাও তারে, তুমি কেন গো সাথে কর না ক্রন্দন! প্রাণ যাহা চায় তাহা দাও বা না দাও, তা বলে কি করুণা পাব না? দুর্লভ ধনের তরে শিশু কাঁদে সকাতরে, তা বলে কি জননীর বাজে না বেদনা? দুর্বল মানব-হিয়া বিদীর্ণ যেথায়, মর্মভেদী যন্ত্রণা বিষম, জীবন নির্ভরহারা ধুলায় লুটায়ে সারা, সেথাও কেন গো তব কঠিন নিয়ম। সেথাও জগৎ তব চিরমৌনী কেন, নাহি দেয় আশ্বাসের সুখ। ছিন্ন করি অন্তরাল অসীম রহস্যজাল কেন না প্রকাশ পায় গুপ্ত স্নেহমুখ! ধরণী জননী কেন বলিয়া উঠে না --করুণমর্মর কণ্ঠস্বর-- "আমি শুধু ধূলি নই, বৎস, আমি প্রাণময়ী জননী, তোদের লাগি অন্তর কাতর। "নহ তুমি পরিত্যক্ত অনাথ সন্তান চরাচর নিখিলের মাঝে; তোমার ব্যাকুল স্বর উঠিছে আকাশ-'পর, তারায় তারায় তার ব্যথা গিয়ে বাজে।" কাল ছিল প্রাণ জুড়ে, আজ কাছে নাই-- নিতান্ত সামান্য এ কি নাথ? তোমার বিচিত্র ভবে কত আছে কত হবে, কোথাও কি আছে প্রভু, হেন বজ্রপাত? আছে সেই সূর্যালোক, নাই সেই হাসি-- আছে চাঁদ, নাই চাঁদমুখ। শূন্য পড়ে আছে গেহ, নাই কেহ, নাই কেহ-- রয়েছে জীবন, নেই জীবনের সুখ। সেইটুকু মুখখানি, সেই দুটি হাত, সেই হাসি অধরের ধারে, সে নহিলে এ জগৎ শুষ্ক মরুভূমিবৎ-- নিতান্ত সামান্য এ কি এ বিশ্বব্যাপারে? এ আর্তস্বরের কাছে রহিবে অটুট চৌদিকের চিরনীরবতা? সমস্ত মানবপ্রাণ বেদনায় কম্পমান নিয়মের লৌহবক্ষে বাজিবে না ব্যথা!
তোমারে বলেছে যারা পুত্র হতে প্রিয়, বিত্ত হতে প্রিয়তর, যা-কিছু আত্মীয় সব হতে প্রিয়তম নিখিল ভুবনে, আত্মার অন্তরতর, তাদের চরণে পাতিয়া রাখিতে চাহি হৃদয় আমার। সে সরল শান্ত প্রেম গভীর উদার-- সে নিশ্চিত নিঃসংশয়,সেই সুনিবিড় সহজ মিলনাবেগ, সেই চিরস্থির আত্মার একাগ্র লক্ষ্য, সেই সর্ব কাজে সহজেই সঞ্চরণ সদা তোমা-মাঝে গম্ভীর প্রশান্ত চিত্তে, হে অন্তরযামী, কেমনে করিব লাভ? পদে পদে আমি প্রেমের প্রবাহ তব সহজ বিশ্বাসে অন্তরে টানিয়া লব নিশ্বাসে নিশ্বাসে।