এই ঘরে আগে পাছে বোবা কালা বস্তু যত আছে দলবাঁধা এখানে সেখানে, কিছু চোখে পড়ে, কিছু পড়ে না মনের অবধানে। পিতলের ফুলদানিটাকে বহে নিয়ে টিপাইটা এক কোণে মুখ ঢেকে থাকে। ক্যাবিনেটে কী যে আছে কত, না জানারি মতো। পর্দায় পড়েছে ঢাকা সাসির দুখানা কাঁচ ভাঙা; আজ চেয়ে অকস্মাৎ দেখা গেল পর্দাখানা রাঙা-- চোখে পড়ে পড়েও না; জাজিমেতে আঁকে আলপনা সাতটা বেলার আলো সকালে রোদ্দুরে। সবুজ একটি শাড়ি ডুরে ঢেকে আছে ডেস্কোখানা; কবে তারে নিয়েছিনু বেছে, রঙ চোখে উঠেছিল নেচে, আজ যেন সে রঙের আগুনেতে পড়ে গেছে ছাই, আছে তবু ষোলো-আনা নাই। থাকে থাকে দেরাজের এলোমেলো ভরা আছে ঢের কাগজপত্তর নানামতো, ফেলে দিতে ভুলে যাই কত, জানি নে কী জানি কোন্ আছে দরকার। টেবিলে হেলানো ক্যালেণ্ডার, হঠাৎ ঠাহর হল আটই তারিখ। ল্যাভেণ্ডার শিশিভরা রোদ্দুরের রঙে। দিনরাত টিক্টিক্ করে ঘড়ি, চেয়ে দেখি কখনো দৈবাৎ। দেয়ালের কাছে আলমারিভরা বই আছে; ওরা বারো-আনা পরিচয়-অপেক্ষায় রয়েছে অজানা। ওই যে দেয়ালে ছবিগুলো হেথা হোথা, রেখেছিনু কোনো-এক কালে; আজ তারা ভুলে-যাওয়া, যেন ভূতে-পাওয়া, কার্পেটের ডিজাইন স্পষ্টভাষা বলেছিল একদিন; আজ অন্যরূপ, প্রায় তারা চুপ। আগেকার দিন আর আজিকার দিন পড়ে আছে হেথা হোথা একসাথে সম্বন্ধবিহীন। এইটুকু ঘর। কিছু বা আপন তার, অনেক কিছুই তার পর। টেবিলের ধারে তাই চোখ-বোজা অভ্যাসের পথ দিয়ে যাই। দেখি যারা অনেকটা স্পষ্ট দেখি নাকো। জানা অজানার মাঝে সরু এক চৈতন্যের সাঁকো, ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনা তারি 'পরে চলে আনাগোনা। আয়না-ফ্রেমের তলে ছেলেবেলাকার ফোটোগ্রাফ কে রেখেছে, ফিকে হয়ে গেছে তার ছাপ। পাশাপাশি ছায়া আর ছবি। মনে ভাবি, আমি সেই রবি, স্পষ্ট আর অস্পষ্টের উপাদানে ঠাসা ঘরের মতন; ঝাপ্সা পুরানো ছেঁড়া ভাষা আসবাবগুলো যেন আছে অন্যমনে। সামনে রয়েছে কিছু, কিছু লুকিয়েছে কোণে কোণে। যাহা ফেলিবার ফেলে দিতে মনে নেই। ক্ষয় হয়ে আসে অর্থ তার যাহা আছে জমে। ক্রমে ক্রমে অতীতের দিনগুলি মুছে ফেলে অস্তিত্বের অধিকার। ছায়া তারা নূতনের মাঝে পথহারা; যে অক্ষরে লিপি তারা লিখিয়া পাঠায় বর্তমানে সে কেহ পড়িতে নাহি জানে।
দোতলার জানলা থেকে চোখে পড়ে পুকুরের একটি কোণা। ভাদ্রমাসে কানায় কানায় জল। জলে গাছের গভীর ছায়া টল্টল্ করছে সবুজ রেশমের আভায়। তীরে তীরে কলমি শাক আর হেলঞ্চ। ঢালু পাড়িতে সুপারি গাছ ক'টা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এ ধারের ডাঙায় করবী, সাদা রঙন, একটি শিউলি; দুটি অযত্নের রজনীগন্ধায় ফুল ধরেছে গরিবের মতো। বাঁখারি-বাঁধা মেহেদির বেড়া, তার ও পারে কলা পেয়ারা নারকেলের বাগান; আরো দূরে গাছপালার মধ্যে একটা কোঠাবাড়ির ছাদ, উপর থেকে শাড়ি ঝুলছে। মাথায় ভিজে চাদর জড়ানো গা-খোলা মোটা মানুষটি ছিপ ফেলে বসে আছে বাঁধা ঘাটের পৈঁঠাতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায় কেটে। বেলা পড়ে এল। বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশ, বিকেলের প্রৌঢ় আলোয় বৈরাগ্যের ম্লানতা। ধীরে ধীরে হাওয়া দিয়েছে, টলমল করছে পুকুরের জল, ঝিল্মিল্ করছে বাতাবি লেবুর পাতা। চেয়ে দেখি আর মনে হয় এ যেন আর কোনো-একটা দিনের আবছায়া; আধুনিকের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দূর কালের কার একটি ছবি নিয়ে এল মনে। স্পর্শ তার করুণ, স্নিগ্ধ তার কণ্ঠ, মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি। তার সাদা শাড়ির রাঙা চওড়া পাড় দুটি পা ঘিরে ঢেকে পড়েছে; সে আঙিনাতে আসন বিছিয়ে দেয়, সে আঁচল দিয়ে ধুলো দেয় মুছিয়ে; সে আম-কাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় জল তুলে আনে, তখন দোয়েল ডাকে শজনের ডালে, ফিঙে লেজ দুলিয়ে বেড়ায় খেজুরের ঝোপে। যখন তার কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি সে ভালো করে কিছুই বলতে পারে না; কপাট অল্প একটু ফাঁক করে পথের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।