সুরলোকে নৃত্যের উৎসবে যদি ক্ষণকালতরে ক্লান্ত উর্বশীর তালভঙ্গ হয় দেবরাজ করে না মার্জনা। পূর্বার্জিত কীর্তি তার অভিসম্পাতের তলে হয় নির্বাসিত। আকস্মিক ত্রুটি মাত্র স্বর্গ কভু করে না স্বীকার। মানবের সভাঙ্গনে সেখানেও আছে জেগে স্বর্গের বিচার। তাই মোর কাব্যকলা রয়েছে কুণ্ঠিত তাপতপ্ত দিনান্তের অবসাদে; কী জানি শৈথিল্য যদি ঘটে তার পদক্ষেপতালে। খ্যাতিমুক্ত বাণী মোর মহেন্দ্রের পদতলে করি সমর্পণ যেন চলে যেতে পারি নিরাসক্তমনে বৈরাগী সে সূর্যাস্তের গেরুয়া আলোয়; নির্মম ভবিষ্য, জানি, অতর্কিতে দস্যুবৃত্তি করে কীর্তির সঞ্চয়ে-- আজি তার হয় হোক প্রথম সূচনা।
অঙ্গের বাঁধনে বাঁধাপড়া আমার প্রাণ আকস্মিক চেতনার নিবিড়তায় চঞ্চল হয়ে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে, তখন কোন্ কথা জানাতে তার এত অধৈর্য। --যে কথা দেহের অতীত। খাঁচার পাখির কণ্ঠে যে বাণী সে তো কেবল খাঁচারি নয়, তার মধ্যে গোপনে আছে সুদূর অগোচরের অরণ্য-মর্মর, আছে করুণ বিস্মৃতি। সামনে তাকিয়ে চোখের দেখা দেখি-- এ তো কেবলি দেখার জাল-বোনা নয়।-- বসুন্ধরা তাকিয়ে থাকেন নির্নিমেষে দেশ-পারানো কোন্ দেশের দিকে, দিগ্বলয়ের ইঙ্গিতলীন কোন্ কল্পলোকের অদৃশ্য সংকেতে। দীর্ঘপথ ভালোমন্দয় বিকীর্ণ, রাত্রিদিনের যাত্রা দুঃখসুখের বন্ধুর পথে। শুধু কেবল পথ চলাতেই কি এ পথের লক্ষ্য? ভিড়ের কলরব পেরিয়ে আসছে গানের আহ্বান, তার সত্য মিলবে কোন্খানে? মাটির তলায় সুপ্ত আছে বীজ। তাকে স্পর্শ করে চৈত্রের তাপ, মাঘের হিম, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা। অন্ধকারে সে দেখছে অভাবিতের স্বপ্ন। স্বপ্নেই কি তার শেষ? উষার আলোয় তার ফুলের প্রকাশ; আজ নেই, তাই বলে কি নেই কোনোদিনই?
ওগো, ভালো করে বলে যাও। বাঁশরি বাজায়ে যে কথা জানাতে সে-কথা বুঝায়ে দাও। যদি না বলিবে কিছু, তবে কেন এসে মুখপানে শুধু চাও! আজি অন্ধতামসী নিশি। মেঘের আড়ালে গগনের তারা সবগুলি গেছে মিশি। শুধু বাদলের বায় করি হায়-হায় আকূলিছে দশ দিশি। আমি কুন্তল দিব খুলে। অঞ্চলমাঝে ঢাকিব তোমায় নিশীথনিবিড় চুলে। ছুটি বাহুপাশে বাঁধি নত মুখখানি বক্ষে লইব তুলে। সেথা নিভৃতনিলয়সুখে আপনার মনে বলে যেয়ো কথা মিলনমুদিত বুকে, আমি নয়ন মুদিয়া শুনিব কেবল চাহিব না মুখে মুখে। যবে ফুরাবে তোমার কথা যে যেমন আছি রহিব বসিয়া চিত্রপুতলি যথা। শুধু শিয়রে দাঁড়ায়ে করে কানাকানি মর্মর তরুলতা। শেষে রজনীর অবসানে অরুণ উদিলে, ক্ষণেকের তরে চাব দুঁহু দোঁহা-পানে। ধীরে ঘরে যাব ফিরে দোঁহে দুই পথে জলভরা দু'নুয়ানে। তবে ভালো করে বলে যাও। আঁখিতে বাঁশিতে যে কথা ভাষিতে সে কথা বুঝায়ে দাও। শুধু কম্পিত সুরে আধো ভাষা পূরে কেন এসে গান গাও!