মিথ্যে তুমি গাঁথলে মালা নবীন ফুলে, ভেবেছ কি কণ্ঠে আমার দেবে তুলে? দাও তো ভালোই, কিন্তু জেনো হে নির্মলে, আমার মালা দিয়েছি ভাই সবার গলে। যে-ক'টা ফুল ছিল জমা অর্ঘ্যে মম উদ্দেশেতে সবায় দিনু-- নমো নমঃ। কেউ বা তাঁরা আছেন কোথা কেউ জানে না, কারো বা মুখ ঘোমটা-আড়ে আধেক চেনা। কেউ বা ছিলেন অতীত কালে অবন্তীতে, এখন তাঁরা আছেন শুধু কবির গীতে। সবার তনু সাজিয়ে মাল্যে পরিচ্ছদে কহেন বিধি "তুভ্যমহং সম্প্রদদে'। হৃদয় নিয়ে আজ কি প্রিয়ে হৃদয় দেবে? হায় ললনা, সে প্রার্থনা ব্যর্থ এবে। কোথায় গেছে সেদিন আজি যেদিন মম তরুণ-কালে জীবন ছিল মুকুলসম, সকল শোভা সকল মধু গন্ধ যত বক্ষোমাঝে বন্ধ ছিল বন্দীমত। আজ যে তাহা ছড়িয়ে গেছে অনেক দূরে-- অনেক দেশে, অনেক বেশে, অনেক সুরে। কুড়িয়ে তারে বাঁধতে পারে একটিখানে এমনতরো মোহন-মন্ত্র কেই বা জানে! নিজের মন তো দেবার আশা চুকেই গেছে, পরের মনটি পাবার আশায় রইনু বেঁচে।
পিয়র্সন কয়েক জোড়া সবুজরঙের বিদেশী পাখি আশ্রমে ছেড়ে দিয়েছিলেন । অনেক দিন তারা এখানে বাসা বেঁধে ছিল । আজকাল আর দেখতে পাই নে । আশা করি কোনো নালিশ নিয়ে তারা চলে যায় নি, কিম্বা এখানকার অন্য আশ্রমিক পশু-পাখির সঙ্গে বর্ণভেদ বা সুরের পার্থক্য নিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ঘটে নি । এনেছে কবে বিদেশী সখা বিদেশী পাখি আমার বনে, সকাল-সাঁঝে কুঞ্জমাঝে উঠিছে ডাকি সহজ মনে । অজানা এই সাগরপারে হল না তার গানের ক্ষতি । সবুজ তার ডানার আভা, চপল তার নাচের গতি । আমার দেশে যে-মেঘ এসে নীপবনের মরমে মেশে বিদেশী পাখি গীতালি দিয়ে মিতালি করে তাহার সনে । বটের ফলে আরতি তার , রয়েছে লোভ নিমের তরে, বনজামেরে চঞ্চু তার অচেনা ব"লে দোষী না করে । শরতে যবে শিশির বায়ে উচ্ছ্বসিত শিউলিবীথি, বাণীরে তার করে না ম্লান কুহেলিঘন পুরানো স্মৃতি । শালের ফুল-ফোটার বেলা মধুকাঙালী লোভীর মেলা, চিরমধুর বঁধুর মতো সে ফুল তার হৃদয় হরে । বেণুবনের আগের ডালে চটুল ফিঙা যখন নাচে পরদেশী এ পাখির সাথে পরানে তার ভেদ কি আছে । উষার ছোঁওয়া জাগায় ওরে ছাতিমশাখে পাতার কোলে, চোখের আগে যে ছবি জাগে মানে না তারে প্রবাস ব"লে । আলোতে সোনা,আকাশে নীলা, সেথা যে চিরজানারই লীলা, মায়ের ভাষা শোনে সেখানে শ্যামল ভাষা যেখানে গাছে ।