সকাল-সাঁজে ধায় যে ওরা নানা কাজে। আমি কেবল বসে আছি, আপন মনে কাঁটা বাছি পথের মাঝে, সকাল-সাঁজে। এ পথ বেয়ে সে আসে তাই আছি চেয়ে। কতই কাঁটা বাজে পায়ে, কতই ধুলা লাগে গায়ে, মরি লাজে, সকাল-সাঁজে।
বয়স আমার বুঝি হয়তো তখন হবে বারো, অথবা কী জানি হবে দুয়েক বছর বেশি আরো। পুরাতন নীলকুঠি-দোতলার 'পর ছিল মোর ঘর। সামনে উধাও ছাত-- দিন আর রাত আলো আর অন্ধকারে সাথিহীন বালকের ভাবনারে এলোমেলো জাগাইয়া যেত, অর্থশূন্য প্রাণ তারা পেত, যেমন সমুখে নীচে আলো পেয়ে বাড়িয়া উঠিছে বেতগাছ ঝোপঝাড়ে পুকুরের পাড়ে সবুজের আলপনায় রঙ দিয়ে লেপে। সারি সারি ঝাউগাছ ঝরঝর কেঁপে নীলচাষ-আমলের প্রাচীন মর্মর তখনো চলিছে বহি বৎসর বৎসর। বৃদ্ধ সে গাছের মতো তেমনি আদিম পুরাতন বয়স-অতীত সেই বালকের মন নিখিল প্রাণের পেত নাড়া, আকাশের অনিমেষ দৃষ্টির ডাকে দিত সাড়া, তাকায়ে রহিত দূরে। রাখালের বাঁশির করুণ সুরে অস্তিত্বের যে বেদনা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, নাড়ীতে উঠিত নেচে। জাগ্রত ছিল না বুদ্ধি, বুদ্ধির বাহিরের যাহা তাই মনের দেউড়ি-পারে দ্বারী-কাছে বাধা পায় নাই। স্বপ্নজনতার বিশ্বে ছিল দ্রষ্টা কিংবা স্রষ্টা রূপে, পণ্যহীন দিনগুলি ভাসাইয়া দিত চুপে চুপে পাতার ভেলায়। নিরর্থ খেলায়। টাট্টু ঘোড়া চড়ি রথতলা মাঠে গিয়ে দুর্দাম ছুটাত তড়বড়ি, রক্তে তার মাতিয়ে তুলিতে গতি, নিজেরে ভাবিত সেনাপতি পড়ার কেতাবে যারে দেখে ছবি মনে নিয়েছিল এঁকে। যুদ্ধহীন রণক্ষেত্রে ইতিহাসহীন সেই মাঠে এমনি সকাল তার কাটে। জবা নিয়ে গাঁদা নিয়ে নিঙাড়িয়া রস মিশ্রিত ফুলের রঙে কী লিখিত, সে লেখার যশ আপন মর্মের মাঝে হয়েছে রঙিন-- বাহিরের করতালিহীন। সন্ধ্যাবেলা বিশ্বনাথ শিকারীকে ডেকে তার কাছ থেকে বাঘশিকারের গল্প নিস্তদ্ধ সে ছাতের উপর, মনে হ'ত, সংসারের সব চেয়ে আশ্চর্য খবর। দম্ ক'রে মনে মনে ছুটিত বন্দুক, কাঁপিয়া উঠিত বুক। চারি দিকে শাখায়িত সুনিবিড় প্রায়োজন যত তারি মাঝে এ বালক অর্কিড-তরুকার মতো ডোরাকাটা খেয়ালের অদ্ভুত বিকাশে দোলে শুধু খেলার বাতাসে। যেন সে রচয়িতার হাতে পুঁথির প্রথম শূন্য পাতে অলংকরণ আঁকা,মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কী লেখা, বাকি সব আঁকাবাঁকা রেখা। আজ যবে চলিতেছে সাংঘাতিক হিসাবনিকাশ, দিগ্দিগন্তে ক্ষমাহীন অদৃষ্টের দশনবিকাশ, বিধাতার ছেলেমানুষির খেলাঘর যত ছিল ভেঙে সব হল চৌচির। আজ মনে পড়ে সেই দিন আর রাত, প্রশস্ত সে ছাত, সেই আলো সেই অন্ধকারে কর্মসমুদ্রের মাঝে নৈষ্কর্ম্যদ্বীপের পারে বালকের মনখানা মধ্যাহ্নে ঘুঘুর ডাক যেন। এ সংসারে কী হতেছে কেন ভাগ্যের চক্রান্তে কোথা কী যে, প্রশ্নহীন বিশ্বে তার জিজ্ঞাসা করে নি কভু নিজে। এ নিখিলে যে জগৎ ছেলেমানুষির বয়স্কের দৃষ্টিকোণে সেটা ছিল কৌতুকহাসির, বালকের জানা ছিল না তা। সেইখানে অবাধ আসন তার পাতা। সেথা তার দেবলোক,স্বকল্পিত স্বর্গের কিনারা, বুদ্ধির ভর্ৎসনা নাই,নাই সেথা প্রশ্নের পাহারা, যুক্তির সংকেত নাই পথে, ইচ্ছা সঞ্চরণ করে বল্গামুক্ত রথে।
নামটা যেদিন ঘুচাবে, নাথ, বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে-- আপনগড়া স্বপন হতে তোমার মধ্যে জনম লয়ে। ঢেকে তোমার হাতের লেখা কাটি নিজের নামের রেখা, কতদিন আর কাটবে জীবন এমন ভীষণ আপদ বয়ে। সবার সজ্জা হরণ করে আপনাকে সে সাজাতে চায়। সকল সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে আপনাকে সে বাজাতে চায়। আমার এ নাম যাক না চুকে, তোমারি নাম নেব মুখে, সবার সঙ্গে মিলব সেদিন বিনা-নামের পরিচয়ে।