অধিক কিছু নেই গো কিছু নেই, কিছু নেই-- যা আছে তা এই গো শুধু এই, শুধু এই। যা ছিল তা শেষ করেছি একটি বসন্তেই। আজ যা কিছু বাকি আছে সামান্য এই দান-- তাই নিয়ে কি রচি দিব একটি ছোটো গান? একটি ছোটো মালা তোমার হাতের হবে বালা। একটি ছোটো ফুল তোমার কানের হবে দুল। একটি তরুলতায় ব'সে একটি ছোটো খেলায় হারিয়ে দিয়ে যাবে মোরে একটি সন্ধেবেলায়। অধিক কিছু নেই গো কিছু নেই, কিছু নেই। যা আছে তা এই গো শুধু এই, শুধু এই। ঘাটে আমি একলা বসে রই, ওগো আয়! বর্ষানদী পার হবি কি ওই-- হায় গো হায়! অকূল-মাঝে ভাসবি কে গো ভেলার ভরসায়। আমার তরীখান সইবে না তুফান; তবু যদি লীলাভরে চরণ কর দান, শান্ত তীরে তীরে তোমায় বাইব ধীরে ধীরে। একটি কুমুদ তুলে তোমার পরিয়ে দেব চুলে। ভেসে ভেসে শুনবে বসে কত কোকিল ডাকে কূলে কূলে কুঞ্জবনে নীপের শাখে শাখে। ক্ষুদ্র আমার তরীখানি-- সত্য করি কই, হায় গো পথিক, হায়, তোমায় নিয়ে একলা নায়ে পার হব না ওই আকুল যমুনায়।
সেদিনে আপদ আমার যাবে কেটে পুলকে হৃদয় যেদিন পড়বে ফেটে। তখন তোমার গন্ধ তোমার মধু আপনি বাহির হবে বঁধু হে, তারে আমার ব'লে ছলে বলে কে বলো আর রাখবে এঁটে। আমারে নিখিল ভুবন দেখছে চেয়ে রাত্রিদিবা। আমি কি জানি নে তার অর্থ কী বা? তারা যে জানে আমার চিত্তকোষে অমৃতরূপ আছে বসে গো, তারেই প্রকাশ করি, আপনি মরি, তবে আমার দুঃখ মেটে।
দিনের আলো নিবে এল, সুয্যি ডোবে-ডোবে। আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে। মেঘের উপর মেঘ করেছে-- রঙের উপর রঙ, মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা। বাজল ঠঙ ঠঙ। ও পারেতে বিষ্টি এল, ঝাপসা গাছপালা। এ পারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা। বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলেবেলার গান-- "বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।' আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা, কোথায় বা সীমানা! দেশে দেশে খেলে বেড়ায়, কেউ করে না মানা। কত নতুন ফুলের বনে বিষ্টি দিয়ে যায়, পলে পলে নতুন খেলা কোথায় ভেবে পায়। মেঘের খেলা দেখে কত খেলা পড়ে মনে, কত দিনের নুকোচুরি কত ঘরের কোণে। তারি সঙ্গে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান -- "বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।' মনে পড়ে ঘরটি আলো মায়ের হাসিমুখ, মনে পড়ে মেঘের ডাকে গুরুগুরু বুক। বিছানাটির একটি পাশে ঘুমিয়ে আছে খোকা, মায়ের 'পরে দৌরাত্মি সে না যায় লেখাজোখা। ঘরেতে দুরন্ত ছেলে করে দাপাদাপি, বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে -- সৃষ্টি ওঠে কাঁপি। মনে পড়ে মায়ের মুখে শুনেছিলেম গান -- "বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান। মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা, মনে পড়ে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যথা। মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটিমিটি আলো, একটা দিকের দেয়ালেতে ছায়া কালো কালো। বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝুপ্ ঝুপ্ ঝুপ্ -- দস্যি ছেলে গল্প শোনে একেবারে চুপ। তারি সঙ্গে মনে পড়ে মেঘলা দিনের গান -- "বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।' কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এল সে কোথা। শিবঠাকুরের বিয়ে হল, কবেকার সে কথা। সেদিনও কি এম্নিতরো মেঘের ঘটাখানা। থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা। তিন কন্যে বিয়ে ক'রে কী হল তার শেষে। না জানি কোন্ নদীর ধারে, না জানি কোন্ দেশে, কোন্ ছেলেরে ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান -- "বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।'