মধ্যাহ্নে বিজন বাতায়নে সুদূর গগনে কী দেখে সে ধানের খেতের পরপারে-- নিরালা নদীর পথে দিগন্তে সবুজ অন্ধকারে যেখানে কাঁঠাল জাম নারিকেল বেত প্রসারিয়া চলেছে সংকেত অজানা গ্রামের, সুখ দুঃখ জন্ম মৃত্যু অখ্যাত নামের। অপরাহ্নে ছাদে বসি এলোচুল বুকে পড়ে খসি, গ্রন্থ নিয়ে হাতে উদাস হয়েছে মন সে যে কোন্ কবিকল্পনাতে। সুদূরের বেদনায় অতীতের অশ্রুবাষ্প হৃদয়ে ঘনায়। বীরের কাহিনী না-দেখা জনের লাগি তারে যেন করে বিরহিণী। পূর্ণিমানিশীথে স্রোতে-ভাসা একা তরী যবে সকরুণ সারিগীতে ছায়াঘন তীরে তীরে সুপ্তিতে সুরের ছবি আঁকে উৎসুক আকাঙক্ষা জেগে থাকে নিষুপ্ত প্রহরে, অহৈতুক বারিবিন্দু ঝরে আঁখিকোণে; যুগান্তরপার হতে কোন্ পুরাণের কথা শোনে। ইচ্ছা করে সেই রাতে লিপিখানি লেখে ভূর্জপাতে লেখনীতে ভরি লয়ে দুঃখে-গলা কাজলের কালি-- নাম কি খেয়ালী।
মনকে, আমার কায়াকে, আমি একেবারে মিলিয়ে দিতে চাই এ কালো ছায়াকে। ওই আগুনে জ্বালিয়ে দিতে, ওই সাগরে তলিয়ে দিতে, ওই চরণে গলিয়ে দিতে, দলিয়ে দিতে মায়াকে-- মনকে, আমার কায়াকে। যেখানে যাই সেথায় একে আসন জুড়ে বসতে দেখে লাজে মরি, লও গো হরি এই সুনিবিড় ছায়াকে মনকে, আমার কায়াকে। তুমি আমার অনুভাবে কোথাও নাহি বাধা পাবে, পূর্ণ একা দেবে দেখা সরিয়ে দিয়ে মায়াকে। মনকে, আমার কায়াকে।
পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান, তার বেশি করে না সে দান। আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান, আমি গাই গান। বাতাসেরে করেছ স্বাধীন, সহজে সে ভৃত্য তব বন্ধনবিহীন। আমারে দিয়েছ যত বোঝা, তাই নিয়ে চলি পথে কভু বাঁকা কভু সোজা। একে একে ফেলে ভার মরণে মরণে নিয়ে যাই তোমার চরণে একদিন রিক্তহস্ত সেবায় স্বাধীন; বন্ধন যা দিলে মোরে করি তারে মুক্তিতে বিলীন। পূর্ণিমারে দিলে হাসি; সুখস্বপ্ন-রসরাশি ঢালে তাই, ধরণীর করপুট সুধায় উচ্ছ্বাসি। দুঃখখানি দিলে মোরে তপ্ত ভালে থুয়ে, অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে আনন্দ করিয়া তারে ফিরায়ে আনিয়া দিই হাতে দিনশেষে মিলনের রাতে। তুমি তো গড়েছ শুধু এ মাটির ধরণী তোমার মিলাইয়া আলোকে আঁধার। শূন্যহাতে সেথা মোরে রেখে হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে। দিয়েছ আমার 'পরে ভার তোমার স্বর্গটি রচিবার। আর সকলের তুমি দাও, শুধু মোর কাছে তুমি চাও। আমি যাহা দিতে পারি আপনার প্রেমে, সিংহাসন হতে নেমে হসিমুখে বক্ষে তুলে নাও। মোর হাতে যাহা দাও তোমার আপন হাতে তার বেশি ফিরে তুমি পাও।