ছেলেদের খেলার প্রাঙ্গণ। শুকনো ধুলো, একটি ঘাস উঠতে পায় না। এক ধারে আছে কাঞ্চন গাছ, আপন রঙের মিল পায় না সে কোথাও। দেখে মনে পড়ে আমাদের কালো রিট্রিভার কুকুরটা, সে বাঁধা থাকে কোঠাবাড়ির বারান্দায়। দূরে রান্নাঘরের চার ধারে উঞ্ছবৃত্তির উৎসাহে ঘুরে বেড়ায় দিশি কুকুরগুলো। ঝগড়া করে, মার খায়, আর্তনাদ করে, তবু আছে সুখে নিজেদের স্বভাবে। আমাদের টেডি থেকে থেকে দাঁড়িয়ে ওঠে চঞ্চল হয়ে, সমস্ত গা তার কাঁপতে থাকে, ব্যগ্র চোখে চেয়ে দেখে দক্ষিণের দিকে, ছুটে যেতে চায় ওদের মাঝখানে-- ঘেউ ঘেউ ডাকতে থাকে ব্যর্থ আগ্রহে। তেমনি কাঞ্চন গাছ আছে একা দাঁড়িয়ে, আপন শ্যামল পৃথিবীতে নয়, মানুষের-পায়ে-দলা গরিব ধুলোর 'পরে। চেয়ে থাকে দূরের দিকে ঘাসের পটের উপর যেখানে বনের ছবি আঁকা। সেবার বসন্ত এল। কে জানবে হাওয়ার থেকে ওর মজ্জায় কেমন করে কী বেদনা আসে। অদূরে শালবন আকাশে মাথা তুলে মঞ্জরী-ভরা সংকেত জানালে দক্ষিণসাগরতীরের নবীন আগন্তুককে। সেই উচ্ছ্বসিত সবুজ কোলাহলের মধ্যে কোন্ চরম দিনের অদৃশ্য দূত দিল ওর দ্বারে নাড়া, কানে কানে গেল খবর দিয়ে এই- একদিন নামে শেষ আলো, নেচে যায় কচি পাতার শেষ ছেলেখেলার আসরে। দেরি করলে না। তার হাসিমুখের বেদনা ফুটে উঠল ভারে ভারে ফিকে-বেগ্নি ফুলে। পাতা গেল না দেখা-- যতই ঝরে, ততই ফোটে, হাতে রাখল না কিছুই। তার সব দান এক বসন্তে দিল উজাড় ক'রে। তার পরে বিদায় নিল এই ধূসর ধূলির উদাসীনতার কাছে।
এল বেলা পাতা ঝরাবারে; শীর্ণ বলিত কায়া, আজ শুধু ভাঙা ছায়া মেলে দিতে পারে। একদিন ডাল ছিল ফুলে ফুলে ভরা নানা-রঙ-করা। কুঁড়ি ধরা ফলে কার যেন কী কৌতূহলে উঁকি মেরে আসা খুঁজে নিতে আপনার বাসা। ঋতুতে ঋতুতে আকাশের উৎসবদূতে এনে দিত পল্লবপল্লীতে তার কখনো পা টিপে চলা হালকা হাওয়ার, কখনো-বা ফাল্গুনের অস্থির এলোমেলো চাল জোগাইত নাচনের তাল। জীবনের রস আজ মজ্জায় বহে, বাহিরে প্রকাশ তার নহে। অন্তরবিধাতার সৃষ্টিনির্দেশে যে অতীত পরিচিত সে নূতন বেশে সাজবদলের কাজে ভিতরে লুকালো-- বাহিরে নিবিল দীপ, অন্তরে দেখা যায় আলো। গোধূলির ধূসরতা ক্রমে সন্ধ্যার প্রাঙ্গণে ঘনায় আঁধার। মাঝে-মাঝে জেগে ওঠে তারা, আজ চিনে নিতে হবে তাদের ইশারা। সমুখে অজানা পথ ইঙ্গিত মেলে দেয় দূরে, সেথা যাত্রার কালে যাত্রীর পাত্রটি পুরে সদয় অতীত কিছু সঞ্চয় দান করে তারে পিপাসার গ্লানি মিটাবারে। যত বেড়ে ওঠে রাতি। সত্য যা সেদিনের উজ্জ্বল হয় তার ভাতি। এই কথা ধ্রুব জেনে, নিভৃতে লুকায়ে সারা জীবনের ঋণ একে একে দিতেছি চুকায়ে।