আজ এ মনের কোন্ সীমানায় যুগান্তরের প্রিয়া। দূরে-উড়ে-যাওয়া মেঘের ছিদ্র দিয়া কখনো আসিছে রৌদ্র কখনো ছায়া, আমার জীবনে তুমি আজ শুধু মায়া; সহজে তোমায় তাই তো মিলাই সুরে, সহজেই ডাকি সহজেই রাখি দূরে। স্বপ্নরূপিণী তুমি আকুলিয়া আছ পথ-খোওয়া মোর প্রাণের স্বর্গভূমি। নাই কোনো ভার, নাই বেদনার তাপ, ধূলির ধরায় পড়ে না পায়ের ছাপ। তাই তো আমার ছন্দে সহসা তোমার চুলের ফুলের গন্ধে জাগে নির্জন রাতের দীর্ঘশ্বাস, জাগে প্রভাতের পেলব তারায় বিদায়ের স্মিত হাস। তাই পথে যেতে কাশের বনেতে মর্মর দেয় আনি পাশ-দিয়ে-চলা ধানী-রঙ-করা শাড়ির পরশখানি। যদি জীবনের বর্তমানের তীরে আস কভু তুমি ফিরে স্পষ্ট আলোয়, তবে জানি না তোমার মায়ার সঙ্গে কায়ার কি মিল হবে। বিরহস্বর্গলোকে সে-জাগরণের রূঢ় আলোয় চিনিব কি চোখে-চোখে। সন্ধ্যাবেলায় যে-দ্বারে দিয়েছ বিরহকরুণ নাড়া, মিলনের ঘায়ে সে-দ্বার খুলিলে কাহারো কি পাবে সাড়া।
এই গ্রন্থাবলীতে আমার কাব্যরচনার প্রথম পরিচয় নিয়ে দেখা দিয়েছে সন্ধ্যাসংগীত। তার পূর্বেও অনেক লেখা লিখেছি, সেগুলিকে লুপ্ত করবার চেষ্টা করেছি অনাদরে। হাতের অক্ষর পাকাবার যে খাতা ছিল বাল্যকালে সেগুলিকে যেমন অনাদরে রাখি নি, এও তেমনি। সেগুলিও ছিল যাকে বলে কপিবুক, বাইরে থেকে মডেল-লেখা নকল করবার সাধনায়। কাঁচা বয়সে পরের লেখা মক্শ করে আমরা অক্ষর ফেঁদে থাকি বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তার মধ্যেও নিজের স্বাভাবিক ছাঁদ একটা প্রকাশ হতে থাকে। অবশেষে পরিণতিক্রমে সেইটেই বাইরের নকল খোলসটাকে বিদীর্ণ করে স্বরূপকে প্রকাশ করে দেয়। প্রথম বয়সের কবিতাগুলি সেই রকম কপিবুকের কবিতা। সেই কপিবুক-যুগের চৌকাঠ পেরিয়েই প্রথম দেখা দিল সন্ধ্যাসংগীত। তাকে আমের বোলের সঙ্গে তুলনা করব না, করব কচি আমের গুটির সঙ্গে, অর্থাৎ তাতে তার আপন চেহারাটা সবে দেখা দিয়েছে শ্যামল রঙে। রস ধরে নি, তাই তার দাম কম। কিন্তু সেই কবিতাই প্রথম স্বকীয় রূপ দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। অতএব সন্ধ্যাসংগীতেই আমার কাব্যের প্রথম পরিচয়। সে উৎকৃষ্ট নয়, কিন্তু আমারই বটে। সে সময়কার অন্য সমস্ত কবিতা থেকে আপন ছন্দের বিশেষ সাজ পরে এসেছিল। সে সাজ বাজারে চলিত ছিল না।
সত্য মোর অবলিপ্ত সংসারের বিচিত্র প্রলেপে, বিবিধের বহু হস্তক্ষেপে, অযত্নে অনবধানে হারালো প্রথম রূপ,দেবতার আপন স্বাক্ষর লুপ্তপ্রায়-- ক্ষয়ক্ষীণ জ্যোতির্ময় আদিমূল্য তার। চতুষ্পথে দাঁড়াল সে ললাটে পণ্যের ছাপ নিয়ে আপনারে বিকাইতে-- অঙ্কিত হতেছে তার স্থান পথে-চলা সহস্রের পরীক্ষাচিহ্নিত তালিকায়। হেনকালে একদিন আলো-আঁধারের সন্ধিস্থলে আরতিশঙ্খের ধ্বনি যে লগ্নে বাজিল সিন্ধুপারে, মনে হল, মুহূর্তেই থেমে গেল সব বেচাকেনা, শান্ত হল আশাপ্রত্যাশার কোলাহল। মনে হল, পরের মুখের মূল্য হতে মুক্ত, সব চিহ্ন-মোছা অসজ্জিত আদিকৌলীন্যের শান্ত পরিচয় বহি যেতে হবে নীরবের ভাষাহীন সংগীতমন্দিরে একাকীর একতারা হাতে। আদিমসৃষ্টির যুগে প্রকাশের যে আনন্দ রূপ নিল আমার সত্তায় আজ ধূলিমগ্ন তাহা, নিদ্রাহারা রুগ্ণ বুভুক্ষার দীপধূমে কলঙ্কিত। তারে ফিরে নিয়ে চলিয়াছি মৃত্যু স্নানতীর্থতটে সেই আদি নির্ঝরতলায়। বুঝি এই যাত্রা মোর স্বপ্নের অরণ্যবীথিপারে পূর্ব ইতিহাস-ধৌত অকলঙ্ক প্রথমের পানে-- যে প্রথম বারে বারে ফিরে আসে বিশ্বের সৃষ্টিতে কখনো বা অগ্নিবর্ষী প্রচণ্ডের প্রলয়হুংকারে, কখনো বা অকস্মাৎ স্বপ্নভাঙা পরম বিস্ময়ে শুকতারানিমন্ত্রিত আলোকের উৎসবপ্রাঙ্গণে।