ছোটো কাঠের সিঙ্গি আমার ছিল ছেলেবেলায়, সেটা নিয়ে গর্ব ছিল বীরপুরুষি খেলায়। গলায় বাঁধা রাঙা ফিতের দড়ি, চিনেমাটির ব্যাঙ বেড়াত পিঠের উপর চড়ি। ব্যাঙটা যখন পড়ে যেত ধম্কে দিতেম কষে, কাঠের সিঙ্গি ভয়ে পড়ত বসে। গাঁ গাঁ করে উঠছে বুঝি, যেমনি হত মনে, "চুপ করো" যেই ধম্কানো আর চম্কাত সেইখনে। আমার রাজ্যে আর যা থাকুক সিংহভয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিল না কখ্খোনো। মাংস ব'লে মাটির ঢেলা দিতেম ভাঁড়ের 'পরে, আপত্তি ও করত না তার তরে। বুঝিয়ে দিতেম, গোপাল যেমন সুবোধ সবার চেয়ে তেমনি সুবোধ হওয়া তো চাই যা দেব তাই খেয়ে। ইতিহাসে এমন শাসন করে নি কেউ পাঠ, দিবানিশি কাঠের সিঙ্গি ভয়েই ছিল কাঠ। খুদি কইত মিছিমিছি, "ভয় করছে, দাদা।" আমি বলতেম, "আমি আছি, থামাও তোমার কাঁদা-- যদি তোমায় খেয়েই ফেলে এমনি দেব মার দু চক্ষে ও দেখবে অন্ধকার।" মেজ্দিদি আর ছোড়্দিদিদের খেলা পুতুল নিয়ে, কথায় কথায় দিচ্ছে তাদের বিয়ে নেমন্তন্ন করত যখন যেতুম বটে খেতে, কিন্তু তাদের খেলার পানে চাইনি কটাক্ষেতে। পুরুষ আমি, সিঙ্গিমামা নত পায়ের কাছে, এমন খেলার সাহস বলো ক'জন মেয়ের আছে।
ভালোবাসা-ঘেরা ঘরে কোমল শয়নে তুমি যে সুখেই থাকো, যে মাধুরী এ জীবনে আমি পাইয়াছি তাহা তুমি পেলে নাকো। এই-যে অলস বেলা, অলস মেঘের মেলা, জলেতে আলোতে খেলা সারা দিনমান, এরি মাঝে চারি পাশে কোথা হতে ভেসে আসে ওই মুখ, ওই হাসি, ওই দু'নয়ান। সদা শুনি কাছে দূরে মধুর কোমল সুরে তুমি মোরে ডাকো-- তাই ভাবি, এ জীবনে আমি যাহা পাইয়াছি তুমি পেলে নাকো। কোনোদিন একদিন আপনার মনে শুধু এক সন্ধ্যাবেলা আমারে এমনি করে ভাবিতে পারিতে যদি বসিয়া একেলা-- এমনি সুদূর বাঁশি শ্রবণে পশিত আসি, বিষাদকোমল হাসি ভাসিত অধরে, নয়নে জলের রেখা এক বিন্দু দিত দেখা, তারি 'পরে সন্ধ্যালোক কাঁপিত কাতরে-- ভেসে যেত মনখানি কনকতরণীসম গৃহহীন স্রোতে-- শুধু একদিন-তরে আমি ধন্য হইতাম তুমি ধন্য হতে। তুমি কি করেছ মনে দেখেছ, পেয়েছ তুমি সীমারেখা মম? ফেলিয়া দিয়াছ মোরে আদি অন্ত শেষ করে পড়া পুঁথি-সম? নাই সীমা আগে পাছে, যত চাও তত আছে, যতই আসিবে কাছে তত পাবে মোরে। আমারেও দিয়ে তুমি এ বিপুল বিশ্বভূমি এ আকাশে এ বাতাস দিতে পারো ভরে। আমাতেও স্থান পেত অবাধে সমস্ত তব জীবনের আশা। একবার ভেবে দেখো এ পরানে ধরিয়াছে কত ভালোবাসা। সহসা কী শুভক্ষণে অসীম হৃদয়রাশি দৈবে পড়ে চোখে। দেখিতে পাও নি যদি, দেখিতে পাবে না আর, মিছে মরি বকে। আমি যা পেয়েছি তাই সাথে নিয়ে ভেসে যাই, কোনোখানে সীমা নাই ও মধু মুখের-- শুধু স্বপ্ন, শুধু স্মৃতি, তাই নিয়ে থাকি নিতি, আর আশা নাহি রাখি সুখের দুখের। আমি যাহা দেখিয়াছি, আমি যাহা পাইয়াছি এ জনম-সই, জীবনের সব শূন্য আমি যাহে ভরিয়াছি তোমার তা কই।
সকলের শেষ ভাই সাত ভাই চম্পার পথ চেয়ে বসেছিল দৈবানুকম্পার। মনে মনে বিধি-সনে করেছিল মন্ত্রণ, যেন ভাইদ্বিতীয়ার পায় সে নিমন্ত্রণ। যদি জোটে দরদি ছোটো-দি বা বড়ো-দি অথবা মধুরা কেউ নাতনির র৻াঙ্কে, উঠিবে আনন্দিয়া, দেহ প্রাণ মন দিয়া ভাগ্যেরে বন্দিবে সাধুবাদে থ্যাঙ্কে। এল তিথি দ্বিতীয়া, ভাই গেল জিতিয়া ধরিল পারুল দিদি হাতা বেড়ি খুন্তি। নিরামিষে আমিষে রেঁধে গেল ঘামি সে, ঝুড়ি ভ'রে জমা হল ভোজ্য অগুন্তি। বড়ো থালা কাংসের মৎস্য ও মাংসের কানায় কানায় বোঝা হয়ে গেল পূর্ণ। সুঘ্রাণ পোলায়ে প্রাণ দিল দোলায়ে, লোভের প্রবল স্রোতে লেগে গেল ঘুর্ণো। জমে গেল জনতা, মহা তার ঘনতা ভাই-ভাগ্যের সবে হতে চায় অংশী। নিদারুণ সংশয় মনটারে দংশয়-- বহুভাগে দেয় পাছে মোর ভাগ ধ্বংসি। চোখ রেখে ঘণ্টে অতি মিঠে কণ্ঠে কেহ বলে, "দিদি মোর!" কেহ বলে, "বোন গো, দেশেতে না থাক্ যশ, কলমে না থাক্ রস, রসনা তো রস বোঝে, করিয়ো স্মরণ গো।" দিদিটির হাস্য করিল যা ভাষ্য পক্ষপাতের তাহে দেখা দিল লক্ষণ। ভয় হল মিথ্যে, আশা হল চিত্তে, নির্ভাবনায় ব'সে করিলাম ভক্ষণ। লিখেছিনু কবিতা সুরে তালে শোভিতা-- এই দেশ সেরা দেশ বাঁচতে ও মরতে। ভেবেছিনু তখুনি, একি মিছে বকুনি। আজ তার মর্মটা পেরেছি যে ধরতে। যদি জন্মান্তরে এ দেশেই টান ধরে ভাইরূপে আর বার আনে যেন দৈব-- হাঁড়ি হাঁড়ি রন্ধন, ঘষাঘষি চন্দন, ভগ্নী হবার দায় নৈবচ নৈব। আসি যদি ভাই হয়ে যা রয়েছি তাই হয়ে সোরগোল পড়ে যাবে হুলু আর শঙ্খে-- জুটে যাবে বুড়িরা পিসি মাসি খুড়িরা, ধুতি আর সন্দেশ দেবে লোকজনকে। বোনটার ধ'রে চুল টেনে তার দেব দুল, খেলার পুতুল তার পায়ে দেব দলিয়া। শোক তার কে থামায়, চুমো দেবে মা আমায়, রাক্ষুসি বলে তার কান দেবে মলিয়া। বড়ো হলে নেব তার পদখানি দেবতার, দাদা নাম বলতেই আঁখি হবে সিক্ত। ভাইটি অমূল্য, নাই তার তুল্য, সংসারে বোনটি নেহাত অতিরিক্ত।