অবকাশ ঘোরতর অল্প, অতএব কবে লিখি গল্প! সময়টা বিনা কাজে ন্যস্ত, তা নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত। তাই ছেড়ে দিতে হল শেষটা কলমের ব্যবহার-চেষ্টা। সারাবেলা চেয়ে থাকি শূন্যে, বুঝি গতজন্মের পুণ্যে পায় মোর উদাসীন চিত্ত রূপে রূপে অরূপের বিত্ত। নাই তার সঞ্চয়তৃষ্ণা, নষ্ট করাতে তার নিষ্ঠা। মৌমাছি-স্বভাবটা পায় নাই, ভবিষ্যতের কোনো দায় নাই। ভ্রমর যেমন মধু নিচ্ছে যখন যেমন তার ইচ্ছে। অকিঞ্চনের মতো কুঞ্জে নিত্য আলসরস ভুঞ্জে। মৌচাক রচে না কী জন্যে-- ব্যর্থ বলিয়া তারে অন্যে গাল দিক, খেদ নাই তা নিয়ে। জীবনটা চলেছে সে বানিয়ে আলোতে বাতাসে আর গন্ধে আপন পাখা-নাড়ার ছন্দে। জগতের উপকার করতে চায় না সে প্রাণপণে মরতে, কিম্বা সে নিজের শ্রীবৃদ্ধির টিকি দেখিল না আজও সিদ্ধির। কভু যার পায় নাই তত্ত্ব তারি গুণগান নিয়ে মত্ত। যাহা-কিছু হয় নাই পষ্ট, যা দিয়েছে না-পাওয়ার কষ্ট, যা রয়েছে অভ্যাসের বস্তু, তারেই সে বলিয়াছে "অস্তু' যাহা নহে গণনায় গণ্য তারি রসে হয়েছে সে ধন্য। তবে কেন চাও তারে আনতে পাব্লিশরের চক্রান্তে। যে রবি চলেছে আজ অস্তে দেবে সমালোচকের হস্তে? বসে আছি, প্রলয়ের পথ-কার কবে করিবেন তার সৎকার। নিশীথিনী নেবে তারে বাহুতে, তার আগে খাবে কেন রাহুতে? কলমটা তবে আজ তোলা থাক্, স্তুতিনিন্দার দোলে দোলা থাক্। আজি শুধু ধরণীর স্পর্শ এনে দিক অন্তিম হর্ষ। বোবা তরুলতিকার বাক্য দিক তারে অসীমের সাক্ষ্য।
তুমি বল তিনু প্রশ্রয় পায় আমার কাছে-- তাই রাগ কর তুমি। ওকে ভালোবাসি, তাই ওকে দুষ্টু ব'লে দেখি, দোষী ব'লে দেখি নে-- রাগও করি ওর 'পরে ভালোও লাগে ওকে এ কথাটা মিছে নয় হয়তো। এক-একজন মানুষ অমন থাকে সে লোক নেহাত মন্দ নয়, সেইজন্যেই সহজে তার মন্দটাই পড়ে ধরা। সে হতভাগা রঙে মন্দ, কিন্তু মন্দ নয় রসে; তার দোষ স্তূপে বেশি, ভারে বেশি নয়-- তাই দেখতে যতটা লাগে গায়ে লাগে না তত। মনটা ওর হালকা ছিপ্ছিপে নৌকো, হূহু করে চলে যায় ভেসে; ভালোই বল আর মন্দই বল জমতে দেয় না বেশিক্ষণ-- এ পারের বোঝা ও পারে চালান করে দেয় দেখতে দেখতে; ওকে কিছুই চাপ দেয় না, তেমনি ও দেয় না চাপ। স্বভাব ওর আসর-জমানো, কথা কয় বিস্তর, তাই বিস্তর মিছে বলতে হয়-- নইলে ফাঁক পড়ে কথার ঠাস-বুনোনিতে। মিছেটা নয় ওর মনে, সে ওর ভাষায়। ওর ব্যাকরণটা যার জানা তবু বুঝতে হয় না দেরি। ওকে তুমি বল নিন্দুক-- তা সত্য। সত্যকে বাড়িয়ে তুলে বাঁকিয়ে দিয়ে ও নিন্দে বানায়-- যার নিন্দে করে তার মন্দ হবে ব'লে নয়, যারা নিন্দে শোনে তাদের ভালো লাগবে ব'লে। তারা আছে সমস্ত সংসার জুড়ে। তারা নিন্দের নীহারিকা, ও হল নিন্দের তারা, ওর জ্যোতি তাদেরই কাছ থেকে পাওয়া। আসল কথা ওর বুদ্ধি আছে, নেই বিবেচনা। তাই ওর অপরাধ নিয়ে হাসি চলে। যারা ভালোমন্দ বিবেচনা করে সূক্ষ্ম তৌলের মাপে তাদের দেখে হাসি যায় বন্ধ হয়ে; তাদের সঙ্গটা ওজনে হয় ভারী, সয় না বেশিক্ষণ; দৈবে তাদের ত্রুটি যদি হয় অসাবধানে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে লোকে। বুঝিয়ে বলি কাকে বলে অবিবেচনা-- মাখন লক্ষ্মীছাড়াটা সংস্কৃতর ক্লাসে চৌকিতে লাগিয়ে রেখেছিল ভুসো; ছাপ লেগেছিল পণ্ডিতমশায়ের জামার পিঠে; সে হেসেছিল, সবাই হেসেছিল পণ্ডিতমশায় ছাড়া। হেডমাস্টার দিলেন ছেলেটাকে একেবারে তাড়িয়ে; তিনি অত্যন্ত গম্ভীর, তিনি অত্যন্ত বিবেচক। তাঁর ভাব-গতিক দেখে হাসি বন্ধ হয়ে যায়। তিনু অপকার করে কিছু না ভেবে, উপকার করে অনায়াসে, কোনোটাই মনে রাখে না। ও ধার নেয়, খেয়াল নেই শোধ করবার; যারা ধার নেয় ওর কাছে পাওনার তলব নেই তাদের দরজায়। মোটের উপর ওরই লোকসান হয় বেশি। তোমাকে আমি বলি, ওকে গাল দিয়ো যা খুশি, আবার হেসো মনে মনে-- নইলে ভুল হবে। আমি ওকে দেখি কাছের থেকে, মানুষ ব'লে, ভালো মন্দ পেরিয়ে। তুমি দেখ দূরে ব'সে, বিশেষণের কাঠগড়ায় ওকে খাড়া রেখে। আমি ওকে লাঞ্ছনা দিই তোমার চেয়ে বেশি-- ক্ষমা করি তোমার চেয়ে বড়ো ক'রে। সাজা দিই, নির্বাসন দিই নে। ও আমার কাছেই রয়ে গেল, রাগ কোরো না তাই নিয়ে।