সাগরতীরে পাথরপিণ্ড ঢুঁ মারতে চায় কাকে, বুঝি আকাশটাকে। শান্ত আকাশ দেয় না কোনো জবাব, পাথরটা রয় উঁচিয়ে মাথা, এমনি সে তার স্বভাব। হাতের কাছেই আছে সমুদ্রটা, অহংকারে তারই সঙ্গে লাগত যদি ওটা, এমনি চাপড় খেত, তাহার ফলে হুড়্মুড়িয়ে ভেঙেচুরে পড়ত অগাধ জলে। ঢুঁ-মারা এই ভঙ্গীখানা কোটি বছর থেকে ব্যঙ্গ ক'রে কপালে তার কে দিল ঐ এঁকে। পণ্ডিতেরা তার ইতিহাস বের করেছেন খুঁজি; শুনি তাহা, কতক বুঝি, নাইবা কতক বুঝি। অনেক যুগের আগে একটা সে কোন্ পাগলা বাষ্প আগুন-ভরা রাগে মা ধরণীর বক্ষ হতে ছিনিয়ে বাঁধন-পাশ জ্যোতিষ্কদের ঊর্ধ্বপাড়ায় করতে গেল বাস। বিদ্রোহী সেই দুরাশা তার প্রবল শাসন-টানে আছাড় খেয়ে পড়ল ধরার পানে। লাগল কাহার শাপ, হারালো তার ছুটোছুটি, হারালো তার তাপ। দিনে দিনে কঠিন হয়ে ক্রমে আড়ষ্ট এক পাথর হয়ে কখন গেল জমে। আজকে যে ওর অন্ধ নয়ন, কাতর হয়ে চায় সম্মুখে কোন্ নিঠুর শূন্যতায়। স্তম্ভিত চীৎকার সে যেন, যন্ত্রণা নির্বাক, যে যুগ গেছে তার উদ্দেশে কণ্ঠহারার ডাক। আগুন ছিল পাখায় যাহার আজ মাটি-পিঞ্জরে কান পেতে সে আছে ঢেউয়ের তরল কলস্বরে; শোনার লাগি ব্যগ্র তাহার ব্যর্থ বধিরতা হেরে-যাওয়া সে-যৌবনের ভুলে-যাওয়া কথা।
রাগ কর নাই কর, শেষ কথা এসেছি বলিতে-- তোমার প্রদীপ আছে, নাইকো সলিতে। শিল্প তার মূল্যবান, দেয় না সে আলো, চোখেতে জড়ায় লোভ, মনেতে ঘনায় ছায়া কালো অবসাদে। তবু তারে প্রাণপণে রাখি যতনেই, ছেড়ে যাব তার পথ নেই। অন্ধকারে অন্ধদৃষ্টি নানাবিধ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরে আচ্ছন্ন করিয়া বাস্তবেরে। অস্পষ্ট তোমারে যবে ব্যগ্রকণ্ঠে ডাক দিই অত্যুক্তির স্তবে তোমারে লঙ্ঘন করি সে-ডাক বাজিতে থাকে সুরে তাহারি উদ্দেশে আজো যে রয়েছে দূরে। হয়তো সে আসিবে না কভু, তিমিরে আচ্ছন্ন তুমি তারেই নির্দেশ কর তবু। তোমার এ দূত অন্ধকার গোপনে আমার ইচ্ছারে করিয়া পঙ্গু গতি তার করেছে হরণ, জীবনের উৎসজলে মিশায়েছে মাদক মরণ। রক্তে মোর যে-দুর্বল আছে শঙ্কিত বক্ষের কাছে তারেই সে করেছে সহায়, পশুবাহনের মতো মোহভার তাহারে বহায়। সে যে একান্তই দীন, মূল্যহীন, নিগড়ে বাঁধিয়া তারে আপনারে বিড়ম্বিত করিতেছ পূর্ণ দান হতে, এ প্রমাদ কখনো কি দেখিবে আলোতে। প্রেম নাহি দিয়ে যারে টানিয়াছ উচ্ছিষ্টের লোভে সে-দীন কি পার্শ্বে তব শোভে। কভু কি জানিতে পাবে অসম্মানে নত এই প্রাণ বহন করিছে নিত্য তোমারি আপন অসম্মান। আমারে যা পারিলে না দিতে সে-কার্পণ্য তোমারেই চিরদিন রহিল বঞ্চিতে।