এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী। তীরে বসে যায় যে বেলা, মরি গো মরি। ফুল-ফোটানো সারা ক'রে বসন্ত যে গেল স'রে, নিয়ে ঝরা ফুলের ডালা বলো কী করি। জল উঠেছে ছলছলিয়ে ঢেউ উঠেছে দুলে, মর্মরিয়ে ঝরে পাতা বিজন তরুমূলে। শূন্য মনে কোথায় তাকাস। সকল বাতাস সকল আকাশ ওই পারের ওই বাঁশির সুরে উঠে শিহরি।
কাঠবিড়ালির ছানাদুটি আঁচলতলায় ঢাকা, পায় সে কোমল করুণ হাতে পরশ সুধামাখা। এই দেখাটি দেখে এলেম ক্ষণকালের মাঝে, সেই থেকে আজ আমার মনে সুরের মতো বাজে। চাঁপাগাছের আড়াল থেকে একলা সাঁঝের তারা একটুখানি ক্ষীণ মাধুরী জাগায় যেমনধারা, তরল কলধ্বনি যেমন বাজে জলের পাকে গ্রামের ধারে বিজন ঘাটে ছোটো নদীর বাঁকে, লেবুর ডালে খুশি যেমন প্রথম জেগে ওঠে একটু যখন গন্ধ নিয়ে একটি কুঁড়ি ফোটে, দুপুর বেলায় পাখি যেমন-- দেখতে না পাই যাকে-- ঘন ছায়ায় সমস্ত দিন মৃদুল সুরে ডাকে, তেমনিতরো ওই ছবিটির মধুরসের কণা ক্ষণকালের তরে আমায় করেছে আনমনা। দুঃখসুখের বোঝা নিয়ে চলি আপন মনে, তখন জীবন-পথের ধারে গোপন কোণে কোণে হঠাৎ দেখি চিরাভ্যাসের অন্তরালের কাছে লক্ষ্মীদেবীর মালার থেকে ছিন্ন পড়ে আছে ধূলির সঙ্গে মিলিয়ে গিয়ে টুকরো রতন কত-- আজকে আমার এই দেখাটি দেখি তারির মতো।
এ কি তবে সবই সত্য হে আমার চিরভক্ত? আমার চোখের বিজুলি-উজল আলোকে হৃদয়ে তোমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে, এ কি সত্য? আমার মধুর অধর, বধূর নবলাজসম রক্ত, হে আমার চিরভক্ত, এ কি সত্য? চিরমন্দার ফুটেছে আমার মাঝে কি? চরণে আমার বীণাঝংকার বাজে কি? এ কি সত্য? নিশির শিশির ঝরে কি আমারে হেরিয়া? প্রভাত-আলোকে পুলক আমারে ঘেরিয়া, এ কি সত্য? তপ্তকপোলপরশে অধীর সমীর মদিরমত্ত, হে আমার চিরভক্ত, এ কি সত্য? কালো কেশপাশে দিবস লুকায়ে আঁধারে, মরণবাঁধন মোর দুই ভুজে বাঁধা রে, এ কি সত্য? ভুবন মিলায়ে মোর অঞ্চলখানিতে, বিশ্ব নীরব মোর কণ্ঠের বাণীতে, এ কি সত্য? ত্রিভুবন লয়ে শুধু আমি আছি, আছে মোর অনুরক্ত, হে আমার চিরভক্ত, এ কি সত্য? তোমার প্রণয় যুগে যুগে মোর লাগিয়া জগতে জগতে ফিরিতেছিল কি জাগিয়া? এ কি সত্য? আমার বচনে নয়নে অধরে অলকে চিরজনমের বিরাম লভিলে পলকে, এ কি সত্য? মোর সুকুমার ললাটফলকে লেখা অসীমের তত্ত্ব, হে আমার চিরভক্ত, এ কি সত্য?