যে ভাবে রমণীরূপে আপন মাধুরী আপনি বিশ্বের নাথ করিছেন চুরি যে ভাবে সুন্দর তিনি সর্ব চরাচরে, যে ভাবে আনন্দ তাঁর প্রেমে খেলা করে, যে ভাবে লতার ফুল, নদীতে লহরী, যে ভাবে বিরাজে লক্ষ্মী বিশ্বের ঈশ্বরী, যে ভাবে নবীন মেঘ বৃষ্টি করে দান, তটিনী ধরারে স্তন্য করাইছে পান, যে ভাবে পরম-এক আনন্দে উৎসুক আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ, দুইয়ের মিলনাঘাতে বিচিত্র বেদনা নিত্য বর্ণ গন্ধ গীত করিছে রচনা, হে রমণী, ক্ষণকাল আসি মোর পাশে চিত্ত ভরি দিলে সেই রহস্য আভাসে।
খোকা থাকে জগৎ-মায়ের অন্তঃপুরে -- তাই সে শোনে কত যে গান কতই সুরে। নানান রঙে রাঙিয়ে দিয়ে আকাশ পাতাল মা রচেছেন খোকার খেলা- ঘরের চাতাল। তিনি হাসেন, যখন তরু - লতার দলে খোকার কাছে পাতা নেড়ে প্রলাপ বলে। সকল নিয়ম উড়িয়ে দিয়ে সূর্য শশী খোকার সাথে হাসে, যেন এক-বয়সী। সত্যবুড়ো নানা রঙের মুখোশ প'রে শিশুর সনে শিশুর মতো গল্প করে। চরাচরের সকল কর্ম ক'রে হেলা মা যে আসেন খোকার সঙ্গে করতে খেলা। খোকার জন্যে করেন সৃষ্টি যা ইচ্ছে তাই -- কোনো নিয়ম কোনো বাধা- বিপত্তি নাই। বোবাদেরও কথা বলান খোকার কানে, অসাড়কেও জাগিয়ে তোলেন চেতন প্রাণে। খোকার তরে গল্প রচে বর্ষা শরৎ , খেলার গৃহ হয়ে ওঠে বিশ্বজগৎ। খোকা তারি মাঝখানেতে বেড়ায় ঘুরে, খোকা থাকে জগৎ-মায়ের অন্তঃপুরে। আমরা থাকি জগৎ-পিতার বিদ্যালয়ে -- উঠেছে ঘর পাথর-গাঁথা দেয়াল লয়ে। জ্যোতিষশাস্ত্র-মতে চলে সূর্য শশী, নিয়ম থাকে বাগিয়ে ল'য়ে রশারশি। এম্নি ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে বৃক্ষ লতা, যেন তারা বোঝেই নাকো কোনোই কথা। চাঁপার ডালে চাঁপা ফোটে এম্নি ভানে যেন তারা সাত ভায়েরে কেউ না জানে। মেঘেরা চায় এম্নিতরো অবোধ ভাবে, যেন তারা জানেই নাকো কোথায় যাবে। ভাঙা পুতুল গড়ায় ভুঁয়ে সকল বেলা, যেন তারা কেবল শুধু মাটির ঢেলা। দিঘি থাকে নীরব হয়ে দিবারাত্র, নাগকন্যের কথা যেন গল্পমাত্র। সুখদুঃখ এম্নি বুকে চেপে রহে, যেন তারা কিছুমাত্র গল্প নহে। যেমন আছে তেম্নি থাকে যে যাহা তাই-- আর যে কিছু হবে এমন ক্ষমতা নাই। বিশ্বগুরু-মশায় থাকেন কঠিন হয়ে, আমরা থাকি জগৎ-পিতার বিদ্যালয়ে।
এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়! এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়। সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারি ধার। দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী, আকাশে জল ঝরে অনিবার। জগতে কেহ যেন নাহি আর। সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব। কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব। আঁধারে মিশে গেছে আর সব। বলিতে বাজিবে না নিজ কানে, চমক লাগিবে না নিজ প্রাণে। সে কথা আঁখিনীরে মিশিয়া যাবে ধীরে এ ভরা বাদলের মাঝখানে। সে কথা মিশে যাবে দুটি প্রাণে। তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার নামাতে পারি যদি মনোভার? শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে দু কথা বলি যদি কাছে তার তাহাতে আসে যাবে কিবা কার? আছে তো তার পরে বারো মাস, উঠিবে কত কথা কত হাস। আসিবে কত লোক কত-না দুখশোক, সে কথা কোন্খানে পাবে নাশ। জগৎ চলে যাবে বারো মাস। ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়, বিজুলি থেকে থেকে চমকায়। যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে সে কথা আজি যেন বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়।