অনেক হাজার বছরের মরু-যবনিকার আচ্ছাদন যখন উৎক্ষিপ্ত হল, দেখা দিল তারিখ-হারানো লোকালয়ের বিরাট কঙ্কাল;-- ইতিহাসের অলক্ষ্য অন্তরালে ছিল তার জীবনক্ষেত্র। তার মুখরিত শতাব্দী আপনার সমস্ত কবিগান বাণীহীন অতলে দিয়েছে বিসর্জন। আর, যে-সব গান তখনো ছিল অঙ্কুরে, ছিল মুকুলে, যে বিপুল সম্ভাব্য সেদিন অনালোকে ছিল প্রচ্ছন্ন অপ্রকাশ থেকে অপ্রকাশেই গেল মগ্ন হয়ে-- যা ছিল অপ্রজ্বল ধোঁওয়ার গোপন আচ্ছাদনে তাও নিবল। যা বিকাল, আর যা বিকাল না,-- দুই-ই সংসারের হাট থেকে গেল চলে একই মূল্যের ছাপ নিয়ে। কোথাও রইল না তার ক্ষত, কোথাও বাজল না তার ক্ষতি। ঐ নির্মল নিঃশব্দ আকাশে অসংখ্য কল্প-কল্পান্তরের হয়েছে আবর্তন। নূতন নূতন বিশ্ব অন্ধকারের নাড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিয়েছে আলোকে, ভেসে চলেছে আলোড়িত নক্ষত্রের ফেনপুঞ্জে; অবশেষে যুগান্তে তারা তেমনি করেই গেছে যেমন গেছে বর্ষণশান্ত মেঘ, যেমন গেছে ক্ষণজীবী পতঙ্গ। মহাকাল, সন্ন্যাসী তুমি। তোমার অতলস্পর্শ ধ্যানের তরঙ্গ-শিখরে উচ্ছ্রিত হয়ে উঠছে সৃষ্টি আবার নেমে যাচ্ছে ধ্যানের তরঙ্গতলে। প্রচণ্ড বেগে চলেছে ব্যক্ত অব্যক্তের চক্রনৃত্য, তারি নিস্তব্ধ কেন্দ্রস্থলে তুমি আছ অবিচলিত আনন্দে। হে নির্মম, দাও আমাকে তোমার ঐ সন্ন্যাসের দীক্ষা। জীবন আর মৃত্যু, পাওয়া আর হারানোর মাঝখানে যেখানে আছে অক্ষুব্ধ শান্তি সেই সৃষ্টি-হোমাগ্নিশিখার অন্তরতম স্তিমিত নিভৃতে দাও আমাকে আশ্রয়।
হে প্রিয়, আজি এ প্রাতে নিজ হাতে কী তোমারে দিব দান। প্রভাতের গান? প্রভাত যে ক্লান্ত হয় তপ্ত রবিকরে আপনার বৃন্তটির 'পরে; অবসন্ন গান হয় অবসান। হে বন্ধু কী চাও তুমি দিবসের শেষে মোর দ্বারে এসে। কী তোমারে দিব আনি। সন্ধ্যাদীপখানি? এ-দীপের আলো এ যে নিরালা কোণের, স্তব্ধ ভবনের। তোমার চলার পথে এরে নিতে চাও জনতায়? এ যে হায় পথের বাতাসে নিবে যায়। কী মোর শকতি আছে তোমারে যে দিব উপহার। হোক ফুল, হোক-না গলার হার, তার ভার কেনই বা সবে, একদিন যবে নিশ্চিত শুকাবে তারা ম্লান ছিন্ন হবে। নিজ হতে তব হাতে যাহা দিব তুলি তারে তব শিথিল অঙ্গুলি যাবে ভুলি-- ধূলিতে খসিয়া শেষে হয়ে যাবে ধূলি। তার চেয়ে যবে ক্ষণকাল অবকাশ হবে, বসন্তে আমার পুষ্পবনে চলিতে চলিতে অন্যমনে অজানা গোপন গন্ধে পুলকে চমকি দাঁড়াবে থমকি, পথহারা সেই উপহার হবে সে তোমার। যেতে যেতে বীথিকায় মোর চোখেতে লাগিবে ঘোর, দেখিবে সহসা-- সন্ধ্যার কবরী হতে খসা একটি রঙিন আলো কাঁপি থরথরে ছোঁয়ায় পরশমণি স্বপনের 'পরে, সেই আলো, অজানা সে উপহার সেই তো তোমার। আমার যা শ্রেষ্ঠধন সে তো শুধু চমকে ঝলকে, দেখা দেয়, মিলায় পলকে। বলে না আপন নাম, পথেরে শিহরি দিয়া সুরে চলে যায় চকিতে নূপুরে। সেথা পথ নাহি জানি, সেথা নাহি যায় হাত, নাহি যায় বাণী। বন্ধু, তুমি সেথা হতে আপনি যা পাবে আপনার ভাবে, না-চাহিতে না-জানিতে সেই উপহার সেই তো তোমার। আমি যাহা দিতে পারি সামান্য সে দান-- হোক ফুল, হোক তাহা গান।
ম্যাট্রিকুলেশনে পড়ে ব্যঙ্গসুচতুর বটেকৃষ্ট, ভীরু ছেলেদের বিভীষিকা। একদিন কী কারণে সুনীতকে দিয়েছিল উপাধি "পরমহংস' ব'লে। ক্রমে সেটা হল "পাতিহাঁস'। শেষকালে হল "হাঁসখালি'-- কোনো তার অর্থ নেই, সেই তার খোঁচা। আঘাতকে ডেকে আনে যে নিরীহ আঘাতকে করে ভয়। নিষ্ঠুরের দল বাড়ে, ছোঁয়াচ লাগায় অট্টহাসে। ব্যঙ্গরসিকের যত অংশ-অবতার নিষ্কাম বিদ্রূপসূচি বিঁধে অহৈতুক বিদ্বেষেতে সুনীতকে করে জরজর। একদিন মুক্তি পেল সে বেচারা, বেরোল ইস্কুল থেকে। তার পরে গেল বহুদিন-- তবু যেন নাড়ীতে জড়িয়ে ছিল সেদিনের সশঙ্ক সংকোচ। জীবনে অন্যায় যত, হাস্যবক্র যত নির্দয়তা, তারি কেন্দ্রস্থলে বটেকৃষ্ট রেখে গেছে কালো স্থূল বিগ্রহ আপন। সে কথা জানত বটু, সুনীতের এই অন্ধ ভয়টাকে মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে পেত সুখ হিংস্র ক্ষমতার অহংকারে; ডেকে যেত সেই পুরাতন নামে, হেসে যেত খলখল হাসি। বি. এল. পরীক্ষা দিয়ে সুনীত ধরেছে ওকালতি, ওকালতি ধরল না তাকে। কাজের অভাব ছিল, সময়ের অভাব ছিল না-- গান গেয়ে সেতার বাজিয়ে ছুটি ভরে যেত। নিয়ামৎ ওস্তাদের কাছে হ'ত তার সুরের সাধনা। ছোটো বোন সুধা, ডায়োসিসনের বি. এ. গণিতে সে এম. এ. দিবে এই তার পণ। দেহ তার ছিপ্ছিপে, চলা তার চটুল চকিত, চশমার নীচে চোখে তার ঝলমল কৌতুকের ছটা-- দেহমন কূলে কূলে ভরা তার হাসিতে খুশিতে। তারি এক ভক্ত সখী নাম উমারানী-- শান্ত কণ্ঠস্বর, চোখে স্নিগ্ধ কালো ছায়া, দুটি দুটি সরু চুড়ি সুকুমার দুটি তার হাতে। পাঠ্য ছিল ফিলজফি, সে কথা জানাতে তার বিষম সংকোচ। দাদার গোপন কথাখানা সুধার ছিল না অগোচর। চেপে রেখেছিল হাসি, পাছে হাসি তীব্র হয়ে বাজে তার মনে। রবিবার চা খেতে বন্ধুকে ডেকেছিল। সেদিন বিষম বৃষ্টি, রাস্তা গলি ভেসে যায় জলে, একা জানালার পাশে সুনীত সেতারে আলাপ করেছে শুরু সুরট-মল্লার। মন জানে উমা আছে পাশের ঘরেই। সেই-যে নিবিড় জানাটুকু বুকের স্পন্দনে মিলে সেতারের তারে তারে কাঁপে। হঠাৎ দাদার ঘরে ঢুকে সেতারটা কেড়ে নিয়ে বলে সুধা, "উমার বিশেষ অনুরোধ গান শোনাতেই হবে, নইলে সে ছাড়ে না কিছুতে।' লজ্জায় সখীর মুখ রাঙা, এ মিথ্যা কথার কী করে যে প্রতিবাদ করা যায় ভেবে সে পেল না। সন্ধ্যার আগেই অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে; থেকে থেকে বাদল বাতাসে দরজাটা ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বৃষ্টির ঝাপ্টা লাগে কাঁচের সাশিতে; বারান্দার টব থেকে মৃদুগন্ধ দেয় জুঁইফুল; হাঁটুজল জমেছে রাস্তায়, তারি 'পর দিয়ে মাঝে মাঝে ছলো ছলো শব্দে চলে গাড়ি। দীপালোকহীন ঘরে সেতারের ঝংকারের সাথে সুনীত ধরেছে গান নটমল্লারের সুরে-- আওয়ে পিয়রওয়া, রিমিঝিমি বরখন লাগে! সুরের সুরেন্দ্রলোকে মন গেছে চলে, নিখিলের সব ভাষা মিলে গেছে অখণ্ড সংগীতে। অন্তহীন কালসরোবরে মাধুরীর শতদল-- তার 'পরে যে রয়েছে একা বসে চেনা যেন তবু সে অচেনা। সন্ধ্যা হল বৃষ্টি থেমে গেছে; জ্বলেছে পথের বাতি। পাশের বাড়িতে কোন্ ছেলে দুলে দুলে চেঁচিয়ে ধরেছে তার পরীক্ষার পড়া। এমন সময় সিঁড়ি থেকে অট্টহাস্যে এল হাঁক, "কোথা ওরে, কোথা গেল হাঁসখালি!' মাংসলপৃথুলদেহ বটেকৃষ্ট স্ফীতরক্তচোখ ঘরে এসে দেখে সুনীত দাঁড়িয়ে দ্বারে নিঃসংকোচ স্তব্ধ ঘৃণা নিয়ে স্থূল বিদ্রূপের ঊর্ধ্বে ইন্দ্রের উদ্যত বজ্র যেন। জোর করে হেসে উঠে কী কথা বলতে গেল বটু, সুনীত হাঁকল "চুপ'-- অকস্মাৎ বিদলিত ভেকের ডাকের মতো হাসি গেল থেমে।